রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ১৯.১
____________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]
সাঁঝের বেলা ঘনিয়ে এসেছে, ঘরটাতে অস্পষ্ট আলোক।
সায়ংকালে বিছানাতে শুতে নেই, তাতে বড়ো বড়ো রোগ বালাই হয় মা বলতেন। মা আরও অনেক কিছুই শেখাতেন। মাত্র এগারোটা বছর মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমোনোর সুভাগ্য হয়েছিল মাহির। জীবনের সব থেকে বড়ো শূন্যতা তো এখানেই। মা’কে হারানোর পর থেকে মায়ের কথা মনে পড়ে ওর যখন তখন, শরীরের ভেতর থাকা আত্মাটি মায়ের জন্য আহাজারি করে আজও…. চোখের শীতলতা নোনা পানিতে উষ্ণ হয়ে আসে ক্ষণিকেই। এত বেশি মনে পড়ে কেন মা’কে? ভাইয়ের মুখে শেষ কবে মায়ের কথা শুনেছে তা মনে করাই দায়। আর বাবার কথা কী বলা যায়? বাবা মানুষটির কি মনে পড়ে মায়ের কথা? অন্তত আজকের কথাটি শোনার পর এ বিশ্বাসের জায়গায় থাকে না যে, বাবা মানুষটিও মা’কে স্মরণ করেন।
দুপুরের পর সন্ধ্যা অবধি ঘুমে মাতাল ছিল সে। কয়েক ঘণ্টার ঘুমে অতীত, বর্তমান নিয়ে হাজারটা স্বপ্ন দেখা হয়ে গেছে। যেখানে আশফিকের রাজত্বই বেশি ছিল৷ ছেলেটি নির্ঘাত চুম্বক। সে জন্যই তার মতো লৌহমনার মানুষকে বিরতিহীনভাবে আকর্ষণ করে যাচ্ছে।
সেই ঘুমের ঘোর কাটে কিছুক্ষণ আগে ফোনের কম্পনে। চোখদু’টো মেলতেও জ্বালাপোড়া করছিল। কিন্তু যে কলটি এসেছে সেটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রিংটোনই তা বুঝিয়ে দিয়েছে। J.K লেখা অক্ষরদু’টি ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠতেই ছোঁ মেরে ফোন হাতে তুলে কল রিসিভ করে ও। খুব বেশি সময় কথা হয়নি ফোনের বিপরীত পাশের মানুষটির সাথে। জরুরি কথাখানা জানাবার জন্য তার জরুরি সময় থেকে আটচল্লিশ সেকেণ্ড সময়টুকু ওকে দিলেন ব্যক্তিটি। কিন্তু তাকে কিছু বলবার বা জিজ্ঞেস করবার সুযোগ দেননি।
আজকের তথ্যটি ঠান্ডা মস্তিষ্কের নাহিয়ান জানলে অতি উত্তেজনায় কী থেকে কী করত, জারিফ সাহেবকে কী বলত তা অনুমানও করা যায় না। কিন্তু ধৈর্যহারা মাহি আজ এত বড়ো একটি সত্য জানার পরও মনোবিকারশূন্য। উদাসীন এক কাঠ পুতুল হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে শুধু। পলকহীন চোখদু’টোর উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি দেওয়ালের গায়ে। কপালের ওপর হাত ফেলে স্থির মূর্তি সে।
এই ছোটো জীবনটি মুখে ‘ছোটো’ শব্দটি উচ্চারণ করার মতো অতটা ছোটোও নয়। একটি দীর্ঘ সময় সৃষ্টিকর্তা তাকে বাঁচিয়ে রাখলে বেঁচে থাকতেই হবে। ঐহিক এই বৃহৎ সময়গুলো নিরাপদে পার করবার জন্য প্রয়োজন অর্থ। কোনো অবলম্বন বা পিছুটানের প্রয়োজন আছে কি?
সহজ প্রশ্নের উত্তরটি খুব কঠিন লাগছে মাহির। অবলম্বন বলতে কিছু ছিল না তার৷ কিন্তু পিছুটান তো ছিল। বাবা! আজ তা থেকেও মুক্ত। তার বিপদসংকুল জীবনটিতে কিছু না থাকাই বরং সহস্রভাগ শ্রেয়। আরও একবার চরম বাস্তবদর্শী হলো সে আজ। জারিফ সাহেবের এই মূখ্য কারণটিই ছিল বুঝি তাকে এত দ্রুত বিয়ে দিতে চাইবার? নয়তো তার মতো একজন সম্মানীয়, বিত্তবান ব্যক্তির আত্মসম্মান লাঠে উঠবে কেন? মেয়ের জন্য আশফিক ছাড়া জামাইয়ের অভাবই বা পড়বে কেন?
যাকগে, যেটা হয় সেটা ভালোর জন্যই হয়। অনেক অল্প বয়সে জারিফ সাহেব বিপত্নীক হয়েছিলেন যে বয়সে এখনকার পুরুষেরা বিয়ের পিঁড়িতে বসে। সেই তরুণ বয়সটিতে তিনি পার্থিব সুখগুলো ত্যাগ করেছেন।
তার মতো এমন একজন মানুষ তাও যে ছেলে-মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে বৈবাহিক জীবনের সুখ, আকাঙ্খা কতগুলো বছর বিসর্জন দিলেন, সেটা নিশ্চয়ই কম বড়ো স্বার্থত্যাগ নয়? বরঞ্চ ওদের দু’ভাই-বোনেরই উচিত ছিল বাবার একাকিত্ব ঘুচাবার জন্য যোগ্য কাউকে তার পাশে এনে দেওয়া। উলটে এ নিয়ে কষ্ট পাওয়া, বিরোধ করা হবে খুব স্বার্থপরের মতো কাজ।
মাহি স্বার্থপর নয়, মাহি বাবার সুখ কুড়িয়ে নেবার বিরোধেও নয়। মাহির ব্যথা মায়ের জন্য। মা মারা যাবার শোকটা সে পঁচিশ বছরে এসেও নিরাময় করতে পারেনি। কিন্তু বাবা লোকটি? বছরখানেক সময়ও নেননি৷ মাত্র এক বছর! এক বছরে তিনি মায়ের সঙ্গে কাটানো সতের বছরের সংসারের মায়া ভুলে নতুনকে খুঁজে নিলেন! যা কিনা সন্তানদের থেকে লুকিয়েও রাখলেন! তবে কি সত্যিই চোখের আড়াল হলে মনেরও আড়াল হয়ে যায়?
বিশ্বসংসারের মারপ্যাচ বোঝা বেজায় জটিল। এ সংসার থেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্তি মিলবে ততই আত্মার গ্লানি মোচন হবে।
“মাহি! শুনতে পাচ্ছ? ঘুম থেকে জেগেছ? মাহি?”
খোলা চোখের নিষ্প্রভ, উদ্দেশ্যপূর্ণ নজর দরজাতে গিয়ে বিঁধল মাহির। আশফিকের আগমন সুখকর। কিন্তু মন সায় দেয় না ছেলেটির কাছে পুনরায় নিজেকে সঁপে দিতে।
বিছানা ছেড়ে দরজা হালকা খুলে উঁকি দেবার মতো মুখটা কিঞ্চিৎ বের করে এক দিনের জ্বরে কাহিল আশফিকের শুকনো মুখটি নিষ্পলক কয়েক পল দেখে শুধাল মাহি, ‘কী চায়?’
-‘আবার জিজ্ঞেস করো।’ মুক্ত হাসি আশফিকের।
আদেশ পালনের মতো মাহি সত্যিই পুনরায় শুধাল, একটু টেনে কঠোর স্বরে, ‘কী চায়?’
-‘তোমাকে, তোমাকে।’ মধুর ঝঙ্কার তোলা হাসিতে ওকে ভড়কে দেয় আশফিক। তারপর বলে, ‘মাত্র দু’বারই তোমাকে চাই। জীবনের দু’টো পরিণতি শুরু আর শেষ। শুরুতেও তোমাকে আর শেষেও তোমাকে।’
-‘ওভার ওভার সিনেম্যাটিক্স!’ বিড়বিড় করে বলল মাহি।
-‘আজ সিনেমার হিরো না বলে ভর্ৎসনা পেতে হচ্ছে? আচ্ছা, সে হোক। তুমি ফ্রেশ হয়ে বের হও জলদি। রিসোর্ট তো ঘুরেই দেখলে না।’
এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে মাহি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আমার ঘরে এসেছিলে?’
-‘কখন?’
-‘দুপুরে।’
কপট চিন্তামগ্ন হলো আশফিক। চঞ্চল দৃষ্টি দূরে কোথাও রেখে তারপর জবাব দিলো, ‘মনে হয়।’
-‘কী?’ রাগান্বিত গলায় মৃদু চিৎকার ধ্বনি মাহির।
অবিচলিত, নির্ভীক আশফিক উত্তর দিলো এবার, ‘মনে হয় তুমি স্বপ্ন দেখেছ। কুইক ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি।’
হেঁটে কটেজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল আশফিক। কিন্তু তখন ঘুম জাগরণে আচ্ছন্ন মাহির সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদা সতর্ক ইন্দ্রিয় যে তাকে আশফিকের উপস্থিতির ভুল সংকেত দেয়নি তা সে জানানোর সুযোগ পেলো না।
.
.
.
জমিদার বাড়ি থেকে দিলিশা, ঐশীদের দলটি রিসোর্টে এসে পৌঁছতে আরও ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। আশফিক দুপুর থেকে ছটফট করতে করতে সবে সুযোগ পেলো মাহিকে হাতের নাগালে পাওয়ার। সারাটা দিনে কেউ ছিল না বিরক্ত করবার মতো। শুধু ছিল মাহি আর সে। তবুও মাহিকে এখন আর মন চাইলেই পাওয়া যায় না। দুপুর বেলা ওকে ডাকতে গিয়ে আশফিক ওর ঘরের দোর খোলা পেয়ে ঘরে প্রবেশ করেছিল ঠিকই। কিন্তু ঘুমে মগ্ন মাহিকে ক’ঝলক দেখে দ্বারমুখ থেকেই ফিরে এসেছিল। অপেক্ষায় আর আকুলতায় ছিল শুধু মাহির জাগ্রত হবার।
লোকলস্করের ভীড় থেকে খানিকটা আড়ালে এলো ওরা। চলতে চলতে আশফিক দুম করে বলে উঠল, ‘তুমি ভেবেছিলে ওখানে গেলেই মডেল ব্রাইড দিলিশা আমার পাশে দাঁড়িয়ে যাবে ফটোশ্যুটের জন্য। তাই স্কিপ করলে যাওয়াটা।’
-‘নিজেকে অফ গ্রেট ইম্পর্টেন্স মনে করো তুমি।’ খামোখা রাগ না দেখিয়ে মাহি পালটা জবাব রাখল।
স্তিমিত সুরে আশফিক আফসোস করল, ‘ছিলাম তো।’
-‘ইয়েস। ইট’স পাস্ট।’
প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে প্রস্তাব দিলো আশফিক, ‘চলো ঘাসের ওপরই বসি।’
-‘ঠান্ডাতে?’
-‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই! মাটির স্বাদও নিতে হয়। শীত হোক তাতে কী?’
-‘তো চামচ নিয়ে এসো, খাই।’
-‘হাঃ হাঃ! স্বাদ তোমার শরীর নেবে। মুখ না। তবে চাইলে অন্য কিছু…. তুমি চাইলে আর কী খাওয়াব।’
-‘লাইসেন্সকৃত। সব সময় সাথেই রাখি। দিস টাইম বি এলার্ট, ওকে?’
নিঃশব্দে হাসতে হাসতে আশফিক ঘাসের ওপর গিয়ে বসল। মাটির কোমল দেহ খুব শীতল। কিন্তু আশফিকের অভিজ্ঞতার ঝুঁলিতে সব পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেবার যোগ্যতা ব্যাপক। পাশাপাশি মাহিরও। তবে তা অজানা কিনা!
চারপাশটা দেখতে দেখতে আশফিক বলে উঠল, ‘ভাগ্যিস হিম হাওয়া নেই। নয়তো কী করতে? এত মনোরম দর্শন রেখে নিশ্চয়ই আবার রুমে ছুটতে?’
মাহি মুখোমুখি বসল, ‘কেন? এই লেদার জ্যাকেটটা দিতে না?’
-‘কেন না? চাইলে এই প্যান্টটাও।’ ফিচেল হেসে জবাব দিলো আশফিক।
কড়া চোখে সামনের মিচকে মিনসেটার ওই হাসি দেখে গোত্র জ্বালায় ঠোঁট কামড়ে ধরে চিন্তা করতে থাকল মাহি। ঠিক কী বললে এই বদমাশ লোকটির পাজি কথা বন্ধ থাকবে?
ইসরাত জাহান দ্যুতি
রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ১৯.২
____________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]
চারপাশের সৌম্যদর্শন আর সম্মুখের সুপুরুষটি, কেউই মাহির মনের ঘাঁটিতে প্রবেশ করতে পারছে না। সমস্ত ভাবনার ঘূর্ণায়ন কাঠি জারিফ সাহেবে গিয়েই ঠেকছে। আমেরিকাতে তের বছর ধরে যে সম্পর্কটি গড়ে উঠেছে বাবার, সেই সম্পর্কের সঠিক পরিচয় জানতে মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠছে ওর। আজকের রাতটি শেষ হবার তীব্র অপেক্ষাতে সে। গতকাল সারা বিকাল, সারা সন্ধ্যা কাটিয়ে এলো ঘরোয়া পার্টিতে। অথচ তখন তাকে জানানো হলো না । এখন এত দূরে আসবার পর জানিয়ে ছটফটানি বাড়িয়ে দেবার কী প্রয়োজন ছিল? ঢাকা ফিরলেই জানাতেন! অদ্ভুত! মধ্যবয়স্ক, বৃদ্ধবয়স্ক মানুষগুলোর চিন্তাভাবনা, যুক্তিগুলো বাস্তববাদী হলেও মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড অদ্ভুতও হয়।
আশফিকেরও খুব অদ্ভুত লাগছে চিন্তাকুলিত মাহিকে। মাথা ঝুঁকিয়ে চোখদু’টোর নিমেষহীন দৃষ্টি জ্বলজ্বল করা ফোনের স্ক্রিনে। কিন্তু মুখে ওর রাজ্যের উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পাচ্ছে। এভাবে চুপচাপ বসে থাকবার জন্য তো আশফিক নিয়ে আসেনি ওকে। একটু মনোযোগ তাকেও দিক পাথর চিত্তের মেয়েটা!
-‘তুমি আজকাল এক্সাক্টলি কী করছ মাহি?’
আশফিকের মনোইচ্ছা পূর্ণ হলো। আগ্রহ চোখে চাইল মাহি ওর দিকে।
-‘তোমার বাড়ির বউ যাতে না হতে হয় তেমন কিছুই করছি।’
বলার পর আবারও ফোনেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। একটু হেসে উঠল আশফিক। মেয়েদের বাঁকা কথার জবাব সে দিতে পারে না। বিষয়টি বাদ দিয়ে হঠাৎ হাতটা বাড়াল ওর দিকে। চকিতে তির্যক দৃষ্টি ছুঁড়ল মাহি, ‘কী?’
-‘আমার জ্যাকেটটা নাও আর তোমার চাদরটা দাও।’
-‘আমি কি শীতে মরে যাচ্ছি?’
-‘যাচ্ছ না?’ বিস্ময়ের ভান আশফিকের।
-‘না, যাচ্ছি না। সোয়েটারও পরে আছি। চাদর স্রেফ একটা ক্র্যাঙ্ক কভার।’
-‘ওয়েল আই ওয়ানা ইয়োর অনলি ক্র্যাঙ্ক কভার। আমি এখানে বিছিয়ে একটু শুবো।’
চাদরটা মাহি গায়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হেলাফেলায় বলল, ‘আমরা আস টাইমে আসিনি বা পিকনিকে আসিনি।’
-‘তুমি দেবে?’
-‘না দিয়ে আর উপায় কী? ধ্যাত!’ বিরক্তি ঝেড়ে চাদরটা ছুঁড়ে মারল আশফিকের কোলে।
চট করেই চাদরটা ঘাসের ওপর বিছিয়ে শুয়ে পড়ল আশফিক৷ মাহির কাছ ঘেঁষেই। বুকের ওপর হাতজোড়া রেখে স্বপ্নালু চোখে আকাশ পানে চেয়ে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলো। ওর কাছে মনে হলো, দেশের মাটিতে এসে দীর্ঘ একটি মাসে প্রশান্তির শ্বাস নিতে পারল কেবল আজ। এর একান্তই কৃতিত্ব পাশে প্রিয় মানুষ আর তার সঙ্গে কাটানো এই ক্ষণ।
বিহ্বল আশফিক শূন্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই আবেগময় সুরে শুধাল মাহিকে, ‘লাস্ট ক্যাম্পিংয়ের গল্প শুনবে মাহি?’
-‘নাহ।’ মাহির কণ্ঠে ঔদাসিন্যতা।
তবুও আশফিক বলে চলল, ‘দেশে আসার তিন মাস আগে আমার সহকর্মী, সাথীদের নিয়ে স্পেনে সিয়েরা নেভাডা ন্যাশনাল পার্কে তাঁবু ক্যাম্পিং করেছিলাম। পূর্ণ চন্দ্রিমা ছিল তখন। সে সপ্তাহে জানুয়ারির হাড় কাঁপানো শীত৷ ক্যাম্পফায়ারের পাশে বসে সবাই যেখানে আড্ডাতে মশগুল আমি তখন চার বছর যাবৎ করা আমার ভুলগুলো নিয়ে মগ্ন। ক্যাম্পিংয়ের প্রত্যেকটা রাতে তাঁবুতে ঘুমাতে গেলেই আমি স্বপ্নে শুধু তোমার সঙ্গে কাটানো সময়গুলোর ছিন্নছিন্ন অংশ দেখতে পেতাম। ঘুম ভেঙে যেত আর তখন ভাবতে বসতাম, গোটা চার বছর কীভাবে আমি আছি? কীভাবে কাটিয়েছি তোমার খোঁজটা অবধি না নিয়ে? তোমার ফোন নাম্বার, তোমার সোশ্যাল সাইটগুলোর অ্যাকাউন্ট, কিচ্ছু কারও থেকে পাইনি। বর্তমানে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একজন গুরুত্বপূর্ণ ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এই নতুন বছরে আমার ফটোগ্রাফি ক্যারিয়ারের সব থেকে চ্যালেঞ্জিং ট্রাভেল হতে চলেছে আমাজন৷ এখন সেসব প্রিপারেশনে বিজি থাকার কথা ছিল আমার। এটা আমার কাছে ড্রিম প্রজেক্ট ছিল সেই শুরু থেকে। তোমাকে তে অনেক আগে বলেছিলাম, তাই না? ক্যারিয়ারের তুঙ্গে পৌঁছে আমি সেসব ছেড়ে এসেছি যা ফেলে গিয়েছিলাম তা সযত্নে ফের বুকে আগলে নিতে।’
-‘এটা তোমার ক্যাম্পিংয়ের গল্প? এত বোরিং?’
বলতে বলতে আশফিকের মাথার কাছেই মাথা রেখে শুলো মাহি, ‘আমি ভেবেছিলাম অনেক ইন্ট্রেস্টিং হবে, অ্যাডভেঞ্চার থাকবে।’
ব্যথাহত সুরে আশফিক জিজ্ঞেস করল, ‘একদমই নিরাসক্ত তুমি আমার প্রতি, তাই না?’
এ কথার জবাব দিতে হলে মনের ভেতর জিইয়ে রাখা সমস্ত অভিযোগ, অভিমানের বই খুলে বসতে হবে মাহিকে। চোখের সামনে সর্বক্ষণ থাকলে বারবার এড়িয়ে যাওয়াও যায় না ছেলেটিকে। আবার চাইলে খোলাখুলি, বিস্তারিত উত্তরও দিতে পারে না। কী বলবে, কোন কারণটা বলবে, বুঝে পায় না ও। ওর চারপাশের পরিস্থিতিগুলো ওকে সাধারণ সংসার জীবনের প্রতি আসলেই নিরাসক্ত করে তুলছে। আশফিকের প্রতি আসক্তি থাকলেও তার থেকে বেশিই অনিচ্ছা, অনাসক্তি বৈবাহিক সম্পর্কের প্রতি। এই তো, আর তো মাত্র পনেরোটা দিন ছুটি আছে হাতে। কিন্তু সে ক’টা দিনও বোধ হয় কাটাতে পারবে না। যখন তখন ডাক পড়ে যাবে। গত পরশু পার্টিতে আন্ডারকভার এজেন্টদের সিক্রেট কনফারেন্সে বসে অবগত হয় সামনের ভয়াবহ মিশনের প্রস্তুতি এবার অনেক কঠোরভাবে নিতে হবে৷ তার মতো সামরিক অথবা মিলিটারি আন্ডারকভার এজেন্টদের সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখার অনুমতি পরে। আগে নিজের দেশ, দেশের সুরক্ষা।
সুদূর আকাশে দুজন দায়িত্বশীল, স্বপ্নাবিষ্ট মানুষের চিন্তা আর অনুভূতির বিষয়বস্তু আজ একই। মাহির মনটা ভীষণ রকম কাঁদে আজ কাল। মা’কে ইদানিং ঘনঘন স্বপ্নে দেখে। মায়ের মৃত্যুর দিনটা আর আশফিকের ছেড়ে চলে যাবার কাল্পনিক একটা মুহূর্ত স্বপ্নে আনাগোনা করে শুধু। অন্তঃস্থলে কেমন একটা ত্রাস ত্রাস অনুভূত হয় খালি৷ মনে হয় আরও কী যেন হারাতে চলেছে ও।আশফিকের আগামী পরিকল্পনা আমাজন ভ্রমণের তথ্যটি মাগুরা থাকতেই শুনেছিল ও হৃদয়দের কাছ থেকে। শোনার পর থেকেই অসীম দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কে বক্ষঃস্পন্দনের গতি সেই থেকেই বেড়ে গেছে ওর। বুঝতে পারছে, অতি সচেষ্ট ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় কোনো বিপদের লাল সঙ্কেত দিতে চাইছে। কিন্তু বিপদটা কোনদিন থেকে ঘনাবে তা নিয়ে সন্ধিগ্ধ হতে হচ্ছে এবার৷ বাবা বর্তমান যে সম্পর্কটিতে আছেন, সেই ভদ্রমহিলার অতীত রেকর্ড যতটুকু জানতে পেরেছেন জে. কে, তা নাকি মোটেও সু্বিধাজনক না৷ সেটা কী তা বিস্তারিত সামনে দেখা হলে বলবেন বলেছেন৷ তার জন্য মাহিকে কালই রওনা করতে হবে ঢাকায়৷ যদিও এটা ওরই ব্যক্তিগত সিন্ধান্ত৷ নিজেকে নিয়ে ভয় তো আর নেই৷ ভয়টা তাড়া করছেই এই দু’জন পুরুষকে নিয়ে।
আশফিকের চিন্তার বিষয়বস্তু মাহির দোলাচল মনকে নিয়ে। ও বুঝতে পারে মাহি এখন সব থেকে কঠিন পরিস্থিতিতে আছে ওকে নিয়ে৷ ভালোবেসেও যেখানে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয় ভালোবাসা গ্রহণ করবে কি না তা নিয়ে, সেই মনস্তাপ আর মানসিক চাপটা সামলে ওঠা খুবই জটিল৷ মাহির শেষ সিদ্ধান্ত কী হবে তা জানা নেই ওর। কিন্তু যা-ই হোক, তা ও মেনে নিতে পারবে কি না সেটাই বড়ো দুশ্চিন্তার কারণ।
ঝকঝকে হীরের মতো নক্ষত্রগুলোর ভীড় ঠেলে লাল নীল আলো জ্বালিয়ে যাওয়া আকাশযানের দিকে দু’জোড়া চোখ অনিমেষ চেয়ে। মাহির এক মাত্র গন্তব্য ওখানেই। আর আশফিকের খেয়ালে আসে, মাত্র চারটা মাস বাদে ওই যানে চড়েই তাকে আবারও ফিরতে হবে তার গন্তব্যে। এই চার মাসে মাহির চার বছরের ব্যথায় প্রলেপ দিতে পারবে কিনা কে জানে? হঠাৎ মনে পড়ে, একটা সময় মাহির স্বপ্ন ছিল ওই আকাশে উড়বার। ও চলে যাবার পর কি মাহি সেই স্বপ্ন ছোঁয়নি? আসার পর মাহির ব্যাপারে যতটুকু খোঁজ খবর নিয়েছে সেখান থেকে বিশেষ কোনো তথ্যের উদ্ঘাটন হয়নি। ঘুরে ফিরেই দিন কাটায় নাকি মাহি! কখনো দেশের ভেতর, কখনো দেশের বাইরে। কিন্তু ওর তা বিশ্বাস হয় না৷ মাহি ভ্রমণপিয়াসী হলে ওদের সম্পর্কের ঠিকানা একটাই হতো, আজ ওরা এক সঙ্গেই থাকত।
-‘কথাটা জিজ্ঞেস করব করব করে করা হয়নি এখনো। তুমি তো ফ্লাইং ক্লাবে ভর্তি হতে চেয়েছিলে। কিন্তু আমাদের বিয়ের জন্য সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কনফিউজড ছিলে আর আঙ্কেলও রাজি ছিলেন না। আমি যাবার পর কি তুমি আর ওই বিষয়ে এগোওনি?’
-‘কেন এগোবো না? আব্বু তো পাইলট হতে দেবেন না বলে আর তোমাদের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কটা আরও গাঢ় করতে বিয়েটা দিতে চেয়েছিলেন৷ সেই তুমিই যখন ফেলে চলে গেলে তখন কি আর আব্বুর লজিক থাকে আমাকে আটকানোর? তুমি চলে যাবার সপ্তাহখানেক পরই আমি আমার লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছি ধীরে ধীরে। স্টুডেন্ট পাইলট লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছি, পাইলট এন্ট্রান্স এক্সাম দিয়েছি, দেশের বাইরে গিয়ে ট্রেনিং নিয়েছি। এক বছরের মাথাতেই দক্ষ পাইলট হিসেবে এয়ারফোর্সে যোগদান করেছি। পাশাপাশি স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের জন্যও পড়েছি।’
এই মুহূর্তে আশফিক সত্যিই একজন পাইলটের পাশে! এ ক’দিনে ও শুধু আন্দাজই করেছিল৷ সেটা নির্ভুল হওয়াতে ও যে কতটা খুশি তা হয়তো কেউ জানলে বিশ্বাসও করবে না। আজ যদি ওর জন্য মাহির পাইলট হওয়ার সুযোগটি যদি হাতছাড়া হয়ে যেত, তাহলে আর কক্ষনো নিজেকে নিজেই ও সম্মান করতে পারত না। নিজের ক্যারিয়ারকেও আর এগোতে দিতো না।
-‘তাহলে আমি কি এখন সামরিক পাইলটের পাশে আছি না কি বেসামরিক?’
খুব সহজেই মাহি মিথ্যা বলে দিলো, ‘কমার্শিয়াল পাইলট।’
আশফিক অতি উত্তেজনায় উঠে বসল৷ মাহির মাথার দু’পাশে হাতে ভর দিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘বাহ কমার্শিয়াল পাইলট! জুনিয়র ফার্স অফিসার না কি ফার্স্ট অফিসার?’
ল্যাম্পশেডের সাদা আলোয় আশফিকের হাস্যোজ্জ্বল মুখের মায়াময় চোখে চেয়ে মাহি মোহাবিষ্ট গলায় বলল, ‘একটা অপ্রিয় সত্যি বলছি৷ দিলিশা আর তোমাকে পাশাপাশি কেন যেন ভীষণ মানায়৷’
আশফিক বিরক্ত হলো, ‘এখন কেন এসব কথা?’
-‘কথাটা বলতে মন চাইল এখন, তাই। কিন্তু আমি মিথ্যা বলছি না। এতদিন তোমরা এক সঙ্গে ছিলে। কেউ কোনোদিন বলেনি?’
রাশভারী গলায় আশফিক জবাব দিলো, ‘বলেছে কেউ কেউ। তারা তোমাকে দেখেনি আমার পাশে তাই বলেছে। এই আলোচনা বাদ দিই প্লিজ!’
বলে ঘাড় ফিরিয়ে অন্য দিকে চেয়ে রইল।
-‘বাদ কেন দিতে চাইছ? তোমাদের সব কিছুই ম্যাচ করে। ওকে কেন বিয়ে করে নিচ্ছ না?’
-‘আমি ওর জন্য বেস্ট নই তাই।’
-‘তাহলে কি আমার জন্য বেস্ট?’
আবেগঘন চাউনিতে তাকাল আশফিক, ‘হুঁ, কেন তা তুমিও জানো আমিও জানি।’
না! আশফিক জানে না তারা দুজন দুজনের জন্য একেবারেই ঠিক নয়। আশফিকের চলে যাবার ধাক্কাটা সামলে উঠতেই বাবার থেকে পাওয়া ধাক্কাটা মাহিকে আবারও জগৎ-সংসারের প্রতি অনীহা করে তুলেছে। আশফিকের থেকে পাওয়া অবর্ণনীয় দুঃখ, অভিমান জমতে জমতে আকাশ ছোঁয়া হয়ে গেছে। নিজের কর্মজগতটাও একান্ত ভালোবাসাকে দূরে রাখতে সতর্কতা দিচ্ছে বারবার। শেষ কান্না মায়ের মৃত্যুতে হলেও ইদানিং হঠাৎ হঠাৎ ওর কান্না পায়৷ মা হারানোর শোকটা ওকে ভালো করে অবগত করে দিয়ে গেছে, আপন হারানোর মানসিক কষ্ট শারীরিক কষ্ট থেকেও যাতনাদায়ক৷ এই অসহনীয় পীড়া আর পেতে চায় না ও। আশফিককে যদি কোনোভাবে ওই বিপদগ্রস্ত জীবন থেকে টেনে আনতে পারত! ইস্ যদি পারত!
নিজের কথাও ভাবনাতে আসছে মাহির। আগামীর যুদ্ধটা দেশ বিদেশের রাঘববোয়ালদের সাথে। কতটুকু জয়ী হয়ে ফিরতে পারবে বা আদৌ পারবে কিনা, সেই আত্মবিশ্বাসটাই আসছে না এবার। তাই মনটা আজ আশফিকের সাথে ক্ষণিকের জন্য সন্ধিতে যেতে চাইছে। যদি এই দেখায় শেষ দেখা হয় দুজন দুজনের?
আশফিকের গভীর বিষণ্ন চোখে চেয়ে মাহি অকল্পনীয় এক প্রস্তাব দিলো, ‘তোমার সঙ্গে কোথাও গিয়ে ক্যাম্পিং করতে চাই, আশফি।’
ইসরাত জাহান দ্যুতি
তাড়াহুড়ো নিয়ে লেখা এলোমেলো খুব। এডিট করা হয়নি।