রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২

0
714

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২
_________________________

[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

আমার কাছে মনে হয় যে-কোনো বাড়ির প্রাণ হলো বয়োজেষ্ঠ্য আর বাচ্চা শিশু। এদের অস্তিত্ব বাড়িটাকে অবিরত প্রাণবন্ত রাখে। বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষগুলো সময়ের সাথে সাথে খিটখিটে হয়ে যায় তো, তাই সব সময়ই সকলের ওপর চলতে থাকে ওঁদের আদেশ উপদেশ আর বকাঝকা। বাড়ি ঘর তাঁর হাঁক ডাকেই সব সময় রমরমা থাকে। ছেলে, ছেলেবউ, নাতিপুতি সকলকে নাকের ডগায় রেখে চলতে চায় ওঁরা। ওঁদেরকে সঙ্গ দেবার মতো মানুষ থাকে না বলেই হয়তো কারণে অকারণে সবাইকে নাচাতে থাকেন।

তিন শিকদারদের মাঝে বেঁচে আছেন শুধু ছোটো শিকদার৷ বড়ো দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর মুমূর্ষু অবস্থাতে টিকে আছেন তিনি। শিকদার গোষ্ঠীতে এই একটি মাত্র মুরুব্বি সকলের মাথার ওপরের ছায়াতল যেন। সকলেই কামনা করে এই মানুষটি যেন সর্বদা প্রফুল্লচিত্তে থাকেন, কখনো যেন এক ফোঁটা কষ্ট উপলব্ধি না হয় ওঁর, সৃষ্টিকর্তা যেন আরও দীর্ঘায়ু করেন ওঁকে। এই শিকদারের দুই পুত্র চার কন্যা। দুই পুত্রের আবার ছেলে-মেয়ে চারজন। আর চার কন্যার মাঝে বড়ো কন্যাকে আল্লাহ পাক খুব অল্প বয়সেই নিয়ে গেছেন। সেই কন্যার মৃত্যু শোক এখনো মাঝেমধ্যে সালাম শিকদারের অন্তর কাঁদায়, যখন ফুটফুটে দুটো নাতি-নাতনির মুখপানে চান।

আশফিক ঘরের মুখে দাঁড়িয়ে আরাম কেদারায় শয্যারত অবস্থায় থাকা নানাজানের দিকে ভীতিচোখে চেয়ে আছে। চার বছর আগে এই মানুষটি তাকে বুকে জড়িয়ে কতবার যে সারা মুখে চুমু খেয়েছিলেন, শুধু তাঁর আদরের নাতনির হবু জামাই বলে। ওকে দেখতে এই বয়সেই সাত ঘণ্টার গাড়ি জার্নি করে ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকাতে। সেই সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যাবার সময় আশফিক শুধু নিজের ইচ্ছা, নিজের স্বপ্নকে প্রাধান্য দিয়ে বাকিসব সম্পর্ক ধূলো ভেবে ঝেড়ে ফেলে গিয়েছিল। মনে পড়েনি সে শুধু মাহির নয়, সাথে আরও কতগুলো মানুষের হৃদয় ভঙ্গ করে যাচ্ছে। এত বড়ো অন্যায়ের পরেও এই পরিবারের প্রতিটা সদস্য তাকে মাথায় করে রেখেছে। কিন্তু সামনের এই শ্রদ্ধেয় মানুষটি কি সেই আগের মতো ওকে স্নেহের সঙ্গে বুকে জড়িয়ে নেবেন?

ভারী নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে নানাজানের পায়ের কাছে বসল ও। তাঁর হাঁটুর ওপর হাতটা রেখে সম্পন্দিত গলায় ডাকল, ‘নানুভাই!’
চোখ মেললেন না তিনি। পুনর্বার ডাকল আশফিক, ‘ও নানুভাই। একটু দেখো না আমাকে!’

নানাজান ডান কাত করা ঘাড়টা ঘুরিয়ে ঝাপসা চোখে পিটপিট করে চেয়ে আশফিকের মুখটা দেখল। এই মুখটা চিনতে প্রথমবারে বেশ খানিকটা কষ্টই হলো তাঁর। আশফিক আন্দোলিত গলায় জানাল, ‘আমি জাওয়াদ রায়হানের ছেলে আশফিক, নানুভাই। চিনতে পেরেছ আমাকে?’

চিনতে পারলেন কি সালাম শিকদার? হ্যাঁ, এই তো সেই হীরার টুকরো মুখখানা। যে মুখখানা দেখে শুধু আদর পেয়েছিল তাঁর। নাতনিখানা যেমন তাঁর সোনার টুকরো, তেমনই মিলেছিল নাতজামাইটাও। ভারি খুশি হয়েছিলেন তিনি মাহি আর আশফিকের না হওয়া সম্পর্কটার খবর শুনে। কিন্তু সেই আশফিক চার বছর আগে কত বড়ো একটা ধাক্কা দিয়ে তাঁর মা হারা নাতনিকে ফেলে চলে গেল না? মনে পড়তেই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না তিনি। বিনা অভিব্যক্তিতে চোখদু’টো আবার বুঁজে ফেললেন। কী-বা বলবেন? আশফিকের দাদু আবদুল রায়হানও ছিলেন সোনা ব্যবসায়ী। সেই সূত্রেই পরিচয় ছিল দু’জনের। আর আজ আবদুলের ছেলে জাওয়াদের সঙ্গে তাঁর বড়ো জামাই জারিফের পার্টনারশিপ। আবদুল যেমন নির্ভেজাল মনের ছিলেন তেমনই ওঁর ছেলে জাওয়াদও ভীষণ ভালো মনের মানুষ। কিন্তু আশফিক ওঁদের কারও মতো হলো না। আবদুল আর জাওয়াদের জন্যই আশফিকের সঙ্গে জোড় আওয়াজে কিছু বললেন না তিনি। না হলে এই ছেলেটিকে তাঁর বাড়ির দোরগোড়ায় পা রাখার জন্য জুতোপেটা করে ছাড়তেন।

বুঝতে পারল বোধ হয় আশফিক, নানাজান কথা বলতে চায় না ওর সঙ্গে। পা দু’টো জড়িয়ে ধরল নানাজানের, নরম মৃদুস্বরে বলল, ‘আমার অন্যায়ের মাফ হয় না তাই না নানুভাই? আমাকে চড় থাপ্পড় দাও, যা খুশি গালমন্দ করো, তবুও আমায় ক্ষমা করো না নানুভাই! তোমার জন্য আমি এতদূর এসেছি, মাফ চাইতে এসেছি। আমাকে অভিশাপ দিয়ো না নানুভাই।’

কথাগুলো শুনেও নানাজান দেখল না আশফিকের মুখটা, অশ্রুনিরে ভেজা চোখ দুইটা। বন্ধ চোখেই হাতের ইশারায় চলে যেতে বললেন ওকে। তা দেখে আশফিক আরও একবার প্রলম্বিত শ্বাস ত্যাগ করল। চোখদু’টো মুছে দাঁড়িয়ে পড়ল। এই বৃদ্ধ মানুষটির অভিশাপ কুড়িয়ে মনের শান্তি কি কখনো মিলবে?

আশফিক আর দিলিশার নাশতা পানির আধিক্য চোখে পড়বার মতো। দিলিশাকে খাবার টেবিলে বসানোর পর তার দু’পাশে চারজন কাজের লোক দাঁড় করিয়ে দিলেন মঞ্জুয়ারা। কিন্তু সালাম শিকদারের ছোটো পুত্রবধূ আর বাকি তিন কন্যা যখন থেকে শুনেছে আশফিক বউ সাথে করে এনেছে, তারপর থেকে দিলিশার আশেপাশে তাদের ছেলে-মেয়েদেরও ভিড়তে দেননি, তারাও মুখদর্শন করেননি। আর আপ্যায়ন তো দূরে পড়েই থাক। মঞ্জুয়ারার হয়েছে যত জ্বালা। না পারছে আশফিক আর দিলিশা নামক আপদদু’টোকে খাতির করতে, আবার না পারছে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে। তাই জন্য বাড়ির কাজের লোকগুলোকে ভেজিয়ে দিয়ে আপাতত দূরে সরে আছেন। তবে বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্যগুলো তাদের মায়েদের নিষেধ বারণ অমান্য করে লুকিয়ে-চুরিয়ে খাবার ঘরের দরজায় উঁকিঝুঁকি মারছে বিদেশি মেয়েটাকে দেখার জন্য। তা দেখে দিলিশার বিরক্তি, অস্বস্তি যেন আকাশ ছুঁই। সারা বাড়িতে ক্যাচক্যাচ ফ্যাচফ্যাচ লেগেই আছে। দশ মিনিটেই শান্তির অবসান ঘটে গেছে তার৷ না জানে সারাদিন থাকলে নিশ্চিতভাবে তাকে পাগল হয়ে ছুটতে হয় কিনা। আশফিক কি এ বাড়িতেই থাকবে না কি? অসম্ভব, যে করেই হোক আশফিকের দাদু বাড়ি চলে যাবে সে ওকে নিয়ে। আশফিক চাইলেও থাকতে দেবে না ওকে।

নানাজানের ছোটোপুত্র রামিম ফজরের ওয়াক্তে মসজিদে গিয়ে নামাজ শেষে সেখানেই ঘুমিয়েছিলেন। রামিমের স্ত্রী মোমেনা তার ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন ডাকতে। ছেলের সঙ্গে বাড়িতে আসবার পরই আশফিকের কথা শুনে ভীষণ আনন্দিত হলেন তিনি। ভেবে নিয়েছিলেন আশফিক নিশ্চয়ই ক্ষমা চাইতে এসেছে তাদের কাছে, তাদের মেয়েটাকে ফিরে পাবার জন্য। কিন্তু মুখ কালো করে রাখা বউয়ের কাছ থেকে যখন জানতে পারলেন, লন্ডন থেকে বৃটিশ সুন্দরী নিয়ে দেশে ফিরেছে সে তারপর থেকে তিনি চড়া হয়ে যাওয়া মেজাজটাকে খুবই ধৈর্যের সাথে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। যে বড়ো ভাই নিজেই বদরাগী মানুষ, তাকেও আশফিককে আদর আপ্যায়ন করতে দেখে ভীষণভাবে কুণ্ঠিত আর রাগান্বিত হলো। কেন যে হাবিব ভাই ওই বেঈমানকে জামাই আদর সোহাগ করছে আল্লাহ জানেন?

নানাজানের ঘর থেকে বেরিয়েই রায়ান তাকে খাবারের ঘরে নিয়ে গেল। টেবিলে দেখতে পেল খাবারের সমারোহ। যেখানে পিঠার পদই অগণিত। যার নামও অজানা আশফিকের৷ দিলিশার পাশে খেতে বসতেই বাড়ির দুই পুত্রবধূ এসে হাজির হলেন সেখানে৷ মঞ্জুয়ারা খাবারগুলো ওদের পাতে পরিবেশন করতে চাইলেও মোমেনা তাকে করতে দিলেন না। এতক্ষণ গজগজ করতে থাকা মানুষটিকে হঠাৎ করে যত্নআত্তি করে খাবার বেড়ে দিতে দেখে মঞ্জুয়ারা বিরক্ত হলেন।

মোমেনা যখন ওদের খাবার পরিবেশন শুরু করলেন তখন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো একটা কথায় ভাবতে থাকল, মানুষকে না খায়িয়েই কেবল মারা যায় না। আচ্ছামতো খায়িয়ে খায়িয়েও খুন করা যায়। এভাবে অতিথি আপ্যায়ন করা যে রীতিমতো তাকে লাঞ্ছনা করা তা দিলিশা সুন্দরী বুঝতে না পারলেও ছবিয়াল আশফিক জাওয়াদ মামি মোমেনার হাসিমুখর মুখটার আড়ালে তার জন্য সীমাহীন ঘৃণা থাকা খুব ভালোভাবেই টের পেল। খাবার প্লেটটাতে একের পর এক পিঠা, গোশ, রুটি, সবজি, ভাত, ক্ষীর, সবকিছু দিয়ে জ্যাম বেঁধে গেছে যেন। দিলিশা ক্রন্দনোন্মুখ করে স্যরি বলে উঠে পড়তে চাইলেও মোমেনা কোনো ক্রমেই তাকে উঠতে দিলো না। আশফিক নিজের জন্য চিন্তিত না হয়ে দিলিশার জন্য উত্তেজিত হয়ে পড়ল কিছুটা। মামিকে ক’বার বারণও করল ওকে এত খাবার না দিতে। মেয়েটি এমন বাঙালি খাবারে অভ্যস্ত নয় তো। কিন্তু তা কি আর মোমেনা শুনতে চান? বরং বারণ করার দোষে তিনি আশফিকের প্লেটে আস্ত একটা দেশী মুরগীর ঝাল ঝাল রোস্ট তুলে দিলেন। ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে ওকে বললেন, ‘তুমার পাশে যেই থাক আব্বাজান, একবার যহন জামাই কয়ে ডাকছি সেই আদর তো তুমারে দিবোই। সে তুমি না নিবার চাইলিও দিবো।’

সে মুহূর্তে আশফিকের অভিব্যক্তি কেউ দেখলে নিশ্চিত তার মনে আপনাআপনি বেজে উঠবে,
ছলছল নয়নে…হাসিমাখা বদনে!

ভোগ যুদ্ধ শেষে হতেই আশফিক বিদায় নিয়েছিল, অতিরিক্ত এক মুহূর্তও আর ব্যয় করেনি। তারপর থেকে মোমেনার হাসির দমকে যেন শ্বাস আটকে আসে অবস্থা। বদমেজাজি মঞ্জুয়ারাও জায়ের ছেলেমানুষীতে পেটে ফাটা হাসি দিয়েছেন। অন্তত আজকের এই আতিথেয়তা মনে থাকলে আশফিক বেঈমানটা তার ইংলিশ ব্রাইডকে নিয়ে আর এই শিকদার বাড়িমুখো হবে না বলে বিশ্বাস তাদের।

***
ল্যাম্পোস্টের নিচে অপেক্ষারত এই লাস্যময়ী আমাকে দেখে অবাক হই।
বিষময় প্রতিটি ক্ষণ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়
দাঁড়িয়ে আছি আদিমতা, বন্যতার হিংস্র অপেক্ষায়।
ল্যাম্পোস্টের এই টিমটিমে আলোয়
চোখ ধাঁধায় আমার
এত আলো, এত আলো!
না জোনাকি হতে চাই না আমি
নিষিদ্ধ পল্লীর এই তেলাপোকার মতো স্যাঁতস্যাঁতে জীবন নিয়ে বেশ আমি।

-‘সংগৃহীত।’ কবির নামটা নাই।’
-‘ইশ! কী বিষাদময় কবিতা! কী মর্মান্তিক ব্যাপার! কতটা বেদনা ওদের? কী জঘন্য আবৃত্তি!

দিব্বর আফসোসের বাক্যগুলো শুনতে শুনতে শেষে আচমকা নিন্দাটুকু টুপ করে মস্তিষ্ক ধরতে পারল না মাহির। তাই সেও একই সুর ধরে বলতে থাকল, ‘ল্যাম্পপোস্টের নিচে মেয়েটা ভ্যানিটি ব্যাগ কাঁধে করে সেজেগুজে দাঁড়ায় আছে। চোখে তার নিদারুণ যন্ত্রণা। কিন্তু ঠোঁটে কাউকে আকৃষ্ট করবার জন্য লীলায়িত হাসি। ছবিটা যে আঁকছে তার আঁকার হাতও দারুণ।’

ওদিকে ফোনের ওপারের ব্যক্তি যে ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে সেদিক ঠাওর করতে পারল না মাহি। এরপর কোনো মন্তব্য না পেয়ে ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি তুলে ভ্রু কুঁচকাল ও, ‘কী ব্যাপার চুপ করে গেলেন যে?’
-‘তোমার মনোযোগ নষ্ট করতে চাচ্ছি না তাই।’
-‘মনোযোগ নষ্ট হবে কেন? আমার দু’দিকেই মনোযোগ আছে। আপনি বলতে থাকেন।’
-‘তাই নাকি? দু’দিকেই মনোযোগ তোমার? বলো তো কবিতা শোনার পর কী কমেন্টস করছিলাম?’
-‘ইশ! কী বিষাদময় কবিতা! কী মর্মান্তিক ব্যাপার! কতটা বেদনা ওদের? কী জঘন্য আব…! আপনি জঘন্য আবৃত্তি বললেন?’ রীতিমতো রাগ ঝড়ে পড়ল মাহির শেষ প্রশ্নে।

হা হা, হি হি, ওহ হো হো, নানাভাবে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিলো দিব্ব। মাহি চুপচাপ সেই হাসি হজম করছে। হাসি কমতেই মাহি মুচকি হেসে বলল, ‘আমার ঘুম ভাঙা কণ্ঠ শুনে যে আপনার হিংসে হচ্ছে তা তো আর বলতে পারতেছেন না। আহারে!’
-‘আইছে, ভয়েজ রেকোর্ডারে তোমার ভয়েজ রেকর্ড করে শোনো একবার।’
-‘শোনা আছে। হোয়াটসঅ্যাপে ভয়েজ আরও সুন্দর শোনা যায়। আর আমার স্লিপি ভয়েজ তো…’
-‘হট! এইটা বলতে গেছিলা? এই শোনো, মাইনষের ঘুমানো ভয়েজ শোনা যায় গরুর হাম্বা ডাকের মতো। টিভি নাটকে, গল্প কবিতার মতো কইতে পারলাম না মারাত্মক। হট, মারাত্মক ওসব কবি লেখকদের লেখালেখিতেই থাকে। বুঝছ না?’
-‘বুঝছি। যার মনে যা, ফাল দিয়া ওঠে তা। আমি বলতে চাইছিলাম মাশা আল্লাহ। কিন্তু আপনার কাছে যে হট লাগছে তা সরাসরি প্রকাশ করতে কি নিষেধ করছি আমি?’
-‘হ, কইছি তোমারে! তোমার চেহারাখানই খালি ভালো। তাছাড়া আর কিছু আমার মতো আলট্রা কিউট না।’
-‘সেইটাই৷ আপনার চরিত্রের মতো আমার চরিত্রও আলট্রা কিউট না।’
-‘ক্যান? আমার চরিত্রে কী খারাপ দেখলা তুমি?’
-‘দুই দুইটা মেয়ের সাথে…’
কথা শেষ হতে না হতেই দিব্ব হাঁক দিয়ে উঠল, ‘ওই থামো। কী করছি হ্যাঁ? আমি কি ওগোরে আমার ফ্ল্যাটে ডাকছি? ব্রেকআপ হবার পর তো খোঁজও ছিল না। যেই শুনছে কানাডা যাচ্ছি সেই দৌঁড় মাইরে চলে আসছে। খাইয়ে তো কাম পালাম না ওই সকিনার মা’গের কোলে চড়ায় আনবানে।’
-‘অত কষ্ট করে কোলে চড়ায় নিয়ে যাবেন ক্যান? প্লেনের ছাদে বসায়ে নিয়ে যাইতেন।’
-‘তাইলে তো তোমারেই আনা যাইত।’
-‘আমারও তো খেয়েদেয়ে কাম নাই কুদ্দুসের সাথে নাচতে নাচতে যাব!’
-‘কুদ্দুস কীরা? আমার নাম কুদ্দুস না। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার দিব্ব ফারহান আমি। আমার পাছে পাছে আসা হ্যাপ্পা আছে হুঁ?’
-‘আপনার পিছে পিছে যাবার শখ নাই মাহিয়ানের। আচ্ছা রাখতেছি এখন। নানুভাইয়ের কাছে যাব। সেই সকালে আসছি এইখানে।’
-‘যাও ফ্রেশ হয়ে নেও। থাকবা কি বিয়ে বাড়িতেই?’
-‘নাহ্। আজকে থেকে এই বাড়িই থাকব রাতে।’
-‘ভালো। যাওয়ার আগে একটু ভিডিয়ো কলে আসতা, দেখতাম কালা না ধলা হইছো।’
-‘যেরকম ছিলাম সেরকমই আছি।’
-‘কই দেখাও দেখি।’
-‘কনফেস করতে কী সমস্যা?’
-‘পরের বউয়ের কাছে কনফেস করতে নাই।’
-‘পরের স্বামীর সামনে মুখ দেখাইতে নাই।’
-‘উফ্! এত টাইম কিল করো ক্যান? কল দিচ্ছি পিক করো।’

দুপুরের খাওয়া শেষেই মাহি জানালা দরজা আটকে আবারও ঘুমিয়েছিল। গোধূলি বেলায় দিব্বর ফোনকল পেয়ে সেই ঘুমের সমাপ্তি হয়। তাই আর জানালা না খুলে ঘরের নীলাভ ডিম লাইটটা জ্বেলে দিয়েছিল। দিব্বর কল রিসিভ করতেই ফোনের ব্রাইটনেস বাড়িয়ে দিলো মাহি। শুধু মুখটাই উজ্জ্বল দেখতে পাচ্ছে দিব্ব৷
-‘ঘুমায়ে তো চোখরে ব্যাঙ বানাইছো। কম্বলের তল থেকে ওঠো নাই?’
-‘শীত!’ চোখ ডলতে ডলতে জবাব দিলো।
-‘কবরের ভিতর ঘুমায় আছ না কি? আন্দারকুটা ক্যা ঘর?’
হেসে ফেলল মাহি। বলতে বলতে দিব্ব নিজেও হাসছিল। এদের দু’জনের ভাষা এদের নিজেদেরই কাছে একরকম বিনোদন। ব্যাক ক্যামেরায় মাহি আলো-আঁধারির ঘরটা দেখাল তার। দেখতে দেখতে হঠাৎ দিব্বর মনে হলো এই মুহূর্তে যদি মাহির গা ঘেঁষে একই কম্বলের নিচে আষ্টেপৃষ্টে থাকতে পারত! সারাদিনের সব অবসাদ এক চুটকিতেই ভুলে যেত যেন। নীলাভ সাদায় ডুবে থাকা ঘরটা কেমন যেন মায়াপুরী লাগছে ওর কাছে। মস্তিষ্কে মাহিকে নিয়ে ওলট-পালট চিন্তাভাবনা আসছে সেই সাথে। বিনা নোটিশেই তাই কলটা কাটতে বাধ্য হলো। মাহি নিজেও আর ফিরতি কল দিলো না।

***
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।

কনকনে শীত, সাথে উত্তর পাশ থেকে এলোমেলো হাওয়া এসে ঝাপটে পড়ছে ধরার বুকে। মাহির মনে হলো পাকা রাস্তার দুই ধারে সরিষার ক্ষেত সেই হাওয়ার তোরে হেলে দুলে যেন নাচন করছে রবীন্দ্র গুরুর গানে। এমনটা ভাবতেই হঠাৎ ওর খেয়াল হলো ব্যাটা জোকার দিব্বর সঙ্গে অনেকটা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়ছে সে। সেই সাথে আজকাল নিজেকে একটু আধটু কাব্যিকও মনে হচ্ছে। ব্যাটা ইগোইস্টিক জাদু-বশ করল না কি ওকে? ছেলেটার সঙ্গে কথা শুরু হলে সহজে শেষ করতে ইচ্ছে হয় না। এমনি সময়েও আবার বড্ড মিস করে তাকে। এই যে এই মুহূর্তেই তো ওর মন মস্তিষ্কে সরিষার ক্ষেতের মতো ব্যাটা নাচনকোঁদন করছে। হঠাৎ তখন ফোনটা কেটে দিলো কেন? টানা ছ’মাস পর ভিডিয়ো কলেই বা দেখতে চাইল কেন? কত কত চিন্তাভাবনা যে হয়, নিজেকে নিয়ে অতিরিক্ত গর্ব করা ওই ছেলেটাকে নিয়ে!

হাঁটতে হাঁটতে নানুবাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেল সকালের সেই লাল গাড়িটা বাড়ির গেটের ভেতর প্রবেশ করছে। খুব একটা আগ্রহ বা ভাবান্তর হলো না তা নিয়ে। ওরে মনে চলছে দিব্বর সঙ্গে হওয়া না হওয়া ব্যাখ্যাহীন এই অদ্ভুত সম্পর্কের বিশ্লেষণ। ওদের দুজনের মাঝে এই সম্পর্কটা কীসের যার ব্যাখ্যাই নেই, তার বিশ্লেষণটাই বা কী ফলাফল দেবে? মানব মন যেমন জটিল তেমন সরল। আর নারীদের ক্ষেত্রে সে মন একটু বেশিই নমনীয়। দিব্বর প্রতি মাহির এই মনটাও নমনীয় হতে চাইছে। তা সামাল দেবে নাকি লাগাম ছেড়ে দেবে তা নিয়েই তো দোলাচল কাটছে না।

বাড়ির উঠানে পা রাখতেই বিচ্ছিরিভাবে মেজাজটা ঘেঁটে গেল মাহির। আরেকটু অসাবধনা হলেই পা স্লিপ কেটে পড়তে যাচ্ছিল৷ এই সন্ধ্যাবেলায় আলী মদনটা পাকা উঠান সাবান পাওডার গুলিয়ে ঝাড়ু নিয়ে ধৌত করছে। বিশের কাছাকাছি ছেলেটার বয়স। জোর করে ধরে তাকে পড়াশোনা করানো হয়। যার দরুন আজও সে ক্লাস সেভেনে আটকে। কাজের থেকে অকাজই বেশি হয় তার দ্বারা। এই কারণেই তার নামের পাশে বড়ো মামি মদন নামটা জুড়ে দিয়েছেন। তারপর থেকে আলী নিজেও তার নাম কেউ জিজ্ঞেস করলে সগৌরবে জানায় ‘আব্বায় রাকছে মোস্তফা আলী। আর বড়ো মায় রাকছে আলী মদন। তয় আপনে আলী মদন কইয়েন।’

চারপাশ আঁধার হয়ে আসছে। এত মানুষ কাজকর্মে ঘনঘন যাওয়া আসা করছে, কখন কেউ খেয়াল না করলেই আছাড় খেয়ে কোমর ভাঙবে পিচ্ছিল উঠানে, সে বুঝ তো আলীটার নেই। মাহি গিয়েই ওর কানটা টেনে ধরল, ‘মদনের বাচ্চা সন্ধ্যাবেলায় তোরে এই অকাজ করতে বলছে কে? আমি চোখে ফকফকা দেখতে পাওয়া মানুষই আছাড় খাইতে যাচ্ছিলাম। আর বয়স্ক মানুষদের কী হবে বল?’
আলী মদন ব্যথায় মাহির হাত থেকে কান ছাড়ানোর চেষ্টা চালাতে চালাতে বলল, ‘ইইহ্! ইইহ্! আফু ব্যতা লাগে! রিমি আফু কইছিল বিকেলবেলা। মনে ছিল না তাই এহন ধুইতেছি। আফু নাকি ইটু ফর আল্ফুনা দিবো।’
-‘ওর ঘাড়ের ওপর দেবো আমি। তুই যেমন মদন, তোর রিমি আফুও তেমন মদনা।’

আলীর কানটা ছেড়ে রিমিকে বকতে বকতে ঘরের বারান্দাতে পা দেবে মাহি, সে মুহূর্তেই কে যেন বালিভর্তি পাঞ্চব্যাগ ওর ওপর ছুঁড়ে ফেলল। আর ন্যানো সেকেন্ডেই দড়াম করে সেই ব্যাগটা নিয়েই উঠানের মধ্যে পড়ল বেচারি। কোমর আর মেরুদণ্ডের ওপর দিয়ে ওর মনে হলো আল্লাহ গজব ফেলল বোধ হয়! তবে আল্লাহর রহমতে মাথাটা বেঁচে গেল। সেই মুহূর্তেই গায়ের ওপর পড়ে থাকা বস্তুটা পাঞ্চব্যাগের জায়গায় হলো আশি কেজির মানবী অপি। ব্যথা ভুলে চোখজোড়া তুলে মাহি যখন বড়ো আপু কম বান্ধবী বেশি মানুষটাকে দেখতে ব্যস্ত, ততক্ষণে দো’তলার বারান্দাতে থাকা সকলে ছুটে এসেছে ওদের কাছে।

অপি বেচারি আনন্দে উত্তেজনায় দৌঁড়ে আসতে গিয়ে নিজের শরীরটার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেনি বলেই এমন একটা অঘটন ঘটে গেল৷ দ্রুত উঠে পড়ে মাহিকেও টেনে তুলে জড়িয়ে ধরল, ‘আ’ম স্যরি! আ’ম স্যরি কিউট বাচ্চাটা! আমি বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম তোমাকে এতদিন পর দেখে৷ ব্যথা পেয়েছ খুব?’
-‘ইট’স নর্মাল আপু৷ আমি ব্যথা পাইনি৷ আমি নিজেও বেসামাল হয়ে পড়তাম৷ কেমন আছ তুমি? বিশ্বাসই করতে পারছি না তোমাকে দেখছি আমি।’

চারপাশে দুই মামিসহ, তিন খালা আর মামাতো খালাতো বোনগুলোর ভিড় পড়ে গেছে। তারা তো প্রায় প্রস্তুতি নিয়েই নিয়েছিল অপি মেয়েটিকে তুলোধুনো করে ছাড়বে এমন বেআক্কেল ধরনের কাজের জন্য। কিন্তু তাদের মেয়ের মুখে ইট’স নর্মাল শুনে উগ্রে আসা রাগ গিলে ফেলতে বাধ্য হলো সবাই। মাহিও ব্যথাটুকু আপাতত হজম করে মামি আর খালাদের ইশারায় চলে যেতে বলল। পাশে দাঁড়ানো আরও মানুষগুলোর দিকে নজর পড়তেই ওর এবার সত্যিই বেসামাল হবার যোগাড়। চার বছর আগে আশফিকের সাথে সম্পর্কে জুড়ে যাবার খাতিরে যে ছয়টি অসাধারণ মানুষের সাথেও ছোটোবোনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল ওর, এতদিন পর সেই মানুষগুলোকে এক সঙ্গে দেখে খুশিতে একদম ডগমগ হয়ে গেল৷ ওকে মাঝে রেখে সাদিয়া, জারিন আর অপি জড়িয়ে ধরল আবারও৷ সৌরভ, হৃদয় আর পরাগ জড়িয়ে ধরতে না পারলেও হাসতে হাসতে ওদের চারজনের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। এরা ছ’জন মূলত আশফিকের খুব কাছের বন্ধু ছিল। সেই সুবাদে মাহির সঙ্গেও ওদের সম্পর্কটা ছিল ভীষণ ভালো৷ বন্ধুর বউ নয়, বরং বন্ধুর মতোই ওরা মাহির সঙ্গে মিশত। এমনকি রুমকি ওদের পাঁচ বছরের ছোটো হলেও রুমকিকেও ওরা বন্ধুর মতো ট্রিট করত। ওরা যে রুমকির নিমন্ত্রণে সত্যি আসবে তা ভাবতে পারেনি মাহি৷ তবে সে ধারণাটা হয়তো ভুল হলো ওর, নিচতলায় আশফিককে নানাজানের ঘরের মুখে দাঁড়িয়ে হাসতে দেখে৷ এগিয়ে আসছে সেও ওদের কাছে৷

উপন্যাসের চরিত্র অনেক। তাই খেয়াল করে সবাই বোঝার চেষ্টা করবেন। সাথে ধৈর্য রাখবেন উপন্যাসের গভীরে না যাওয়া অবধি। এবং উপন্যাস যেখানে শেষ করতে চাইব সেখানে শেষ করা মাত্রই ডিলিট দেবো। তাই কেউ পরে পড়বার আশায় ফেলে রাখবেন না। ভবিষ্যতে এটাও বই হবে ইন শা আল্লাহ।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here