রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৪

0
479

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৪
__________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও কঠোর মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

সাবলীল, স্পষ্ট ভাষার কথাগুলো হৃদয়চূড়াতে তাণ্ডবলীলার শুরু হলো মাহির। অবরুদ্ধ গলার স্বর থেকে বহু কষ্টে দু’টো অস্পষ্ট শব্দ উচ্চারণ হলো, ‘শেষ দেখা!’ ঘোলা চোখে চাইল আশফিকের চোখে৷ নিবিড়, শীতল চোখজোড়ায় ওর মনোকষ্ট স্বচ্ছ দেখা যায় যেন। সেই সাধারণ দু’টো চোখে মাহিকে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নেবার ছটফটানি মাহি কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই বুঝে গেল। কর্মস্থলে নিজের সীমাবদ্ধতা, অপারগতার কঠোর সত্যতা জানাল না আর৷ সাবধান বা সতর্কতার নির্দেশ অমান্য করে আশফিককে নিশ্চয়তা দিলো, ‘কালকের মধ্যে সব কিছুর ব্যবস্থা কি সম্ভব? যদি হয় তবে পরশুই তোমার নির্ধারিত বা তোমাদের পছন্দসই জায়গাতে রওনা হবো। দু’দিনের জন্য।’

দু’দিন! সত্যিই কি এরপর মাহি আর আশফিকের কাছে ফিরবে না?

আশফিক মাহির হাতটা দু’হাতের মুঠিতে আবদ্ধ করে বিনা অনুমতিতেই হাতের পিঠে, তালুতে, প্রতিটা আঙুলের ডগাতে চুমু খেলো৷ আঙুলের ডগায় যেদিন আশফিক প্রথম চুমু খেয়েছিল সেদিন প্রেমে আনাড়ি কিন্তু স্পষ্টবক্তা মাহি ভালোবাসা অনুভবের বদলে জিজ্ঞেস করে বসেছিল, ‘আঙুলের মাথাতে চুমু খেয়ে ভালোবাসা বোঝায় এমনটা দেখিনি তো!’

ঘন প্রেম বিনিময় মুহূর্তে এমন অস্বাভাবিক, নির্বোধের মতো কথাতে আশফিকের বিরক্ত বা রাগ হওয়া যথাযোগ্য ছিল তখন৷ কিন্তু সে মাহির মধ্যমা আঙুলের ডগায় হালকা কামড় কেটে ফিচেল গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘দেখোনি? কোথায় দেখোনি?’
-‘ফোন, ল্যাপটপের অনস্ক্রিনে ছাড়া অন্য কোথাও দেখার সৌভাগ্য হয়নি।’
-‘ওহো, তো সেখানে কোথায় কোথায় চুমু খেয়ে ভালোবাসা দেখাত?’
স্বেচ্ছায় অসভ্য হবুবরের অসভ্যতামির সুযোগ করে দিয়ে বসল আজ! এখন তো ঘোর বিপদ! মাহি বিছানা ছেড়ে দ্রুত উঠে পড়লে আশফিক হাত ধরে টেনে ওকে সাদা রঙা আলমারিতে লাগোয়া লম্বা আয়নাটার সামনে এনে দাঁড় করায়। ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আয়নাতে দু’জন দু’জনের প্রতিবিম্বের দিকে চাইতেই আশফিক বলে, ‘অনস্ক্রিনে কেমনটা দেখেছ এবার বলো।’
বিপাকে পড়ে মাহি চোখ ছোটো-ছোটো করে তাকিয়ে থাকে আশফিকের দিকে। সুযোগ পেলে সেই পরিচয়ের শুরু থেকেই ওকে নাস্তানাবুদ করবার ধান্দা খোঁজে ফাজিল ছেলেটা! গরম চোখ করে তাকিয়ে থেকেও লাভ হয় না৷ আশফিক ওর দু’বাহু শক্ত করে ধরে আছে।
-‘বলছ না কেন?’
-‘কী বলব? জানো না যেন?’
-‘জানলে তো নিয়ম মেনেই চুমু খেতাম।’
চুমু খেতে হবে নিয়ম মেনে? অদ্ভুত কথা!
-‘নিয়ম মেনে মানে কী?’
-‘তুমিই জানো সেটা। সেজন্যই তো জিজ্ঞেস করছি।’
এই ছেলেটা কথার ফোড়ন কেটেই যাবে যতক্ষণ না মাহি তার কথার জবাব দেবে।
-‘ওকে কিসিং এক্সপার্ট বলছি, আদর করার কোনো নিয়মনীতি নেই৷ আমি তোমাকে একটু অপ্রস্তুত করতেই কথাটা বলেছিলাম। এই আর কী!’
-‘তুমি দেখতে যতটা ভোলা সুন্দরী তার থেকেও বেশি দুষ্টু। এখন জলদি বলো চুমু কোথায় কোথায় খেতে হয়। আমি অপ্রস্তুত হইনি। বরং আগ্রহী চুমু দেবার নিয়মনীতি শিখতে।’
মাহি বিরক্তির চূড়ান্তে পৌঁছে তড়বড় করে বলতে লাগল, ‘পায়ে, পায়ের পাতায়, পায়ের তালুতে, পায়ের আঙুলে, পায়ের নখে, হাতে, কানে, গলায়, মাথায়, চোখে, মুখে, ঠোঁটে, পিঠে, কোমরে, পেটে, বুকে …’ কথা শেষ করার পূর্বেই অতি সত্বর এক হাত ছড়িয়ে চেহারা ঢেকে ফেলল সে। আশফিকের সুন্দর পাতলা ঠোঁটে হাসির তরঙ্গ খেলে গেল তখন। মাহির মাথার পিছে কপাল ঠেকিয়ে হাসতে থাকল৷ চোখে পানি চলে এসেছে হাসির দমকে। দৃঢ় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে মাহি চুপিচুপি হাসছে। জোর করে ওকে মুখোমুখি ফেরাল আশফিক, ‘এখন বলো আমি শুরু করব কোথার থেকে?’
লজ্জায় আশফিকের চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা হলো না ওর।
-‘বলো বলো। আজ আর শশুরবাড়ি থেকে যেতে দিচ্ছি না চুমুর নিয়মনীতি না শিখে।’
ভীষণ লজ্জায় এলোমেলো হাল। বলে দিলো মাহি, ‘চুলের গোড়া থেকে।’
হাসির ফুলঝুরি ছুটে গেল আরও একবার। হাসতে হাসতেই ওর চাঁদির মাঝে ঠোঁট ছোঁয়াল আশফিক গাঢ় করে। জিজ্ঞেস করল, ‘এরপর?’
দুষ্টু মাহি নজর ঝুঁকিয়ে, ঠোঁট চেপে হেসে উত্তর দিলো, ‘কানের দুলে।’
ঠোঁট এগিয়ে আশফিক কানের লতি দু’ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরল, ছোট্ট করে কামড়ও দিলো। বলল, ‘সেয়ানা মেয়ে, কানে দুল নেই। ভেবেছ তাও ছেড়ে দেবো?’
বলেই নাকে ঠোঁট স্পর্শ করল, তখন বলল, ‘নোজপিন নেই। তাই নাকই বরাদ্দ চুমুর জন্য।’
তারপর হঠাৎই মাহির অঙ্গ কাঁপিয়ে তুলে ওর গ্রীবা আর কণ্ঠদেশে ঠোঁটের উষ্ণ আদরে ভেজাল, অনেকক্ষণ৷ ওর হাতদু’টো তখন কোনো আদেশবলে যেন আশফিকের পৃষ্ঠদেশ জাপটে রইল৷ উত্তপ্ত আদর শেষে আশফিক মাহিকে এনে বিছানাতে বসাল। ঘাড়ে চিবুক রেখে ওর স্নেহপূর্ণ লাজুক মুখটা দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি বারবার এত বাঁধা দিতে চাও কেন বলো তো? অস্বস্তি হয়? বিশ্রী লাগে? সরাসরি বলবে কিন্তু।’
মাহি দ্বিধাহীনভাবেই বলে দেয়, ‘আমার অনুভূতি সীমা ছাড়িয়ে সর্বশেষে পৌঁছতে চায়। নিয়ন্ত্রণে রাখা জটিল হয় খুব। তাই বাঁধা দিই।’
-‘সর্বশেষে যেতে দেবে না বলে বাঁধা দাও? তাহলে আমার আদর তুমি উপভোগ করো, তাই তো?’
-‘হুঁ, আরও একটা বিশেষ কারণ আছে। আমি সব আদরই নতুন অনুভূতির সঙ্গে পেতে চাই বিয়ের পর। সবটাই যদি বিয়ের আগে পেয়ে যাই তাহলে বিয়ের পর তোমার স্পর্শ আমাকে কম কম বা পুরোনো পুরোনো অনুভূতি দেবে না? নতুনত্ব না থাকলে এখনের মতো তখন এক্সাইটমেন্ট থাকবে না আর ইনজয়ফুলও লাগবে না। দেখো না এর জন্য রাতে তোমার সঙ্গে ফোনেও কম কথা বলি? এখন সব কথা বলে ফেললে যখন এক সাথে থাকব তখন কী বলব?
নির্বাক হয়ে শুনল আশফিক। কোনো স্বাদহীন খাবার চর্বন করছে এমন দুঃখী অভিব্যক্তির মতো মুখ করে চেয়ে রইল মাহির দিকে।
-‘কী বিজ্ঞ, যুক্তির সাগর বউ রে আমার! তোমার দুর্ভাগ্য এই যুক্তির ধারে আমার যুক্তি আগের মতোই বুক ফুলিয়ে চলবে।’
-‘তাহলে নিপাত যাক তোমার পচা যুক্তির বুক!’
-‘রেগো না। আসো তোমাকে বোঝাই, ভালোবাসা হলো পুকুরের মতো। পুকুর কাটলে যেমন বড়ো হতেই থাকে তেমন ভালোবাসাবাসি যত হবে তত বাড়বে। পরস্পরের প্রতি মায়াও বেড়ে যায়।’

এই যুক্তি যথার্থই ছিল। ভালোবাসা বেড়েছিল বৈকি, বাড়তে বাড়তে মাহি আশফিককে নিজেরই আত্মা ভেবে নিয়েছিল। তাই তো সেই আত্মা ওর মনোদেহ ত্যাগ করতেই ওর সমগ্র অনুভূতির সমাধি হয়।
___________________ ___________________

খুব সকালে মাহি ঐশীকে সঙ্গে করে ঢাকা ফিরে যায়। আশফিক রাতের বেলাতেই সাদিয়া আর সৌরভকে ক্যাম্পিংয়ের ব্যাপারে জানিয়েছিল। সৌরভ চাকরিজীবি মানুষ হয়েও ছুটি নিতে বাধ্য হয় আজ। এই বাধ্যবাধকতা শুধুই সাদিয়ার জন্য। সাদিয়া শোনা মাত্রই দু’পায়ে লাফিয়ে রাজি হয়ে গেছে যেতে। সৌরভের সঙ্গে এক প্রকার ঝগড়া আর দ্বন্দ চলছে ওর। এই সুযোগে ওকে মানানো যাবে ভেবেই সৌরভের রাজি হয়ে যাওয়া।

পরাগ আর অপির বেলাতে একটু কষ্ট করতে হয়েছে আশফিকের। কিন্তু তারপরই আরও চমৎকার কিছু ঘটে গেছে৷ পরাগের কিছু কলিগরা কয়েকদিন যাবৎ আলাপ আলোচনা করছিল সবাই মিলে কোথাও থেকে দু’তিন দিনের জন্য বেড়িয়ে আসবে। পরাগ আজ কলেজ কতৃপক্ষের কাছে ছুটির আবেদন নেবার সময় সবাই ক্যাম্পিংয়ের কথা জানতেই ওরাও প্রস্তাব রাখে পরাগের সঙ্গে যাবার জন্য। জাতীয় বিশ্বাবিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ছুটির কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই বলে রক্ষা। কলেজ ছুটি পড়ে যাবে ক’দিনের জন্য দু’দিন বাদেই। তাই এ ব্যাপারে সকলের এক সঙ্গে ছুটি নিতে তেমন ঝামেলা পোহাতে হয়নি। এটা আশফিকের কাছে বেশ সুবিধাজনক আর ভালো একটা ব্যাপার। ক্যাম্পিংয়ে সদস্য যত হবে ততই বিপদের ভয় কম থাকবে আর আনন্দও বাড়বে।

কিন্তু সম্ভব হলো না জারিনকে পাওয়া। তার যাবার মতো কোনো উপায় নেই। আশফিকও খুব একটা জোরাজোরি করতে পারল না হৃদয়ের কথা ভেবে। দিলিশার সঙ্গে খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়তে একান্ত সময় প্রয়োজন ওদের। সেখানে জারিন থাকলে হৃদয়ের পিছুটান বলে দিলিশার কাছাকাছি আসতে চাইবে না।

দিনভর শ্যুট শেষেই আশফিক আর বাকিরাও প্রত্যেকেই ঢাকা ফিরে আসে আজই। রাতের মধ্যে সকলে গোছগাছ করে নেয়। মেসেঞ্জারে একটা চ্যাট গ্রুপ ওপেন করে ক্যাম্পিংয়ে যাবার সমস্ত পরিকল্পনা জানানো হয় সেখানে। মাহিকে অবশ্য তেমন করে কিছুই জানানোর সুযোগ হয়নি। কারণ, অনলাইনে মাহির কোনো অস্তিত্বই নেই। এদিকে আশফিক তাকে ফোনেও পায়নি। নাহিয়ানকে কল করতেই সে জানায়, ঐশীকে সঙ্গে করে আজ সারাদিন বাইরেই সময় কাটাচ্ছে মাহি। দু’জন এক সঙ্গে কোথায় সময় কাটাতে পারে এটুকু বোঝার সাধ্যি বা ধারণা আশফিকের খুব আছে৷ যদি তা হয় আরও মাহি সম্পর্কিত৷ ঐশীকে নিয়ে কোনো সাইকোলজিস্টের শরণাপন্নই হয়েছে মাহি। তারপর নিশ্চয়ই সম্পর্কে ভাবি আর ননদের বন্ধুভাবাপন্নতা আনতেই একাকী সময় কাটাচ্ছে! ঘৃণা বা ক্রোধ দেখিয়ে হিংস্র মনোভাবের ব্যক্তিদের হিংস্রতা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ওদের পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন অসীম ভালোবাসা আর বন্ধুসুভল আচরণ। এ ব্যাপারটা আশফিক চেয়েছিল মাহিকে জানাতে। কিন্তু সেই আগেরকার সরল মনের মেয়েটি বাস্তবের কষাঘাতে এখন ধারণাতীত কঠিন। বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন একজন চমৎকার ধারাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী সেই মেয়েটি। তাই পুরোনো সময়ের মতো অ আ শিখিয়ে পড়িয়ে তারপর বানান বোঝানোর মতো বাস্তবতা বোঝাতে হয় না এখন।

আশফিক হাসে, ক্লেশিত হাসি। বাস্তবতার বুঝ যদি ভালোবাসাকে দাহ করে তবে সেই বুঝশক্তি হারিয়ে যাক তার আরাধ্য করে পাওয়া মানুষটির।
.
.
.
প্রভাতছটা ভূমণ্ডলকে স্পর্শ করবার পূর্বেই আশফিক গাড়ি নিয়ে হাজির হয়ে যায় মাহির বাসার মুখে। গন্তব্য ওদের ঢাকা থেকে বহুদূরের ছোট্ট নিঝুম দ্বীপে। দুইদিনের বসতি গাড়বে সেখানে৷ প্রত্যেকে একত্রিত হবে সদর ঘাটে পৌঁছে।

গাড়িতে বসে কল করল মাহিকে। গতকাল মাহিকে ফোনে না পেয়ে মেসেজ করে রেখেছিল আশফিক বিস্তারিত৷ জানিয়েও রেখেছিল সে নিতে আসবে খুব ভোরবেলা৷ কিন্তু বরাবরই মাহি ঘুমপ্রিয় মেয়ে৷ এত ভোরে কি তার ঘুম ভেঙেছে? না ভাঙলে উঠবে কখন আর গোছগাছই বা করবে কখন? পুরোনো সম্পর্কের অধিকার থাকলে এতক্ষণে ওই ঘুমন্ত নারীর ব্যক্তিগত ঘরে ঢুকে সে নিজেই সমস্ত কিছু গুছিয়ে দিতো৷ এমনকি অতীতের ব্যক্তিগত নারীটিকেও। কিন্তু এখন তা ভাবলেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আকাশসম দীর্ঘশ্বাস ফেললেও সেসব কিছুই আর ফিরে আসবে না। আশফিক লাগাতার কল করে গেল মাহিকে। রিসিভ না হলে বাসাতে তো ঢুকতেই হবে।

মাহি পিঠে ব্যাগপ্যাক চড়িয়ে গেট খুলে বেরিয়ে গাড়ির কাছে চলে এলো তার মধ্যেই। আশফিক ফোন কানে নিয়ে তখনো৷ ড্রাইভার গাড়ির বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল৷ জানালার বাইরে চোখ নেই আশফিকের৷ হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে পাশ ফিরতেই মাহিকে দেখে কিঞ্চিৎ মনঃক্ষুণ্ন করে জানাল, ‘আমি কল করছিলাম এতক্ষণ যাবৎ৷’

মাহি তড়িঘড়ি করে প্যান্টের পকেটে হাত পুরল। ফোনটা বের করে দেখল সাইলেন্ট মোডে আছে, পাঁচটা মিসড কল। গাড়িতে বসার পর জবাবদিহি করল, ‘আমি তো গতকাল সেই যে ফোন সাইলেন্ট করে বাসায় রেখে গিয়েছিলাম আর জেনারেল মোড করা হয়নি। বাসায় ফিরে শুধু ফোন চেক করে কাজে বসে পড়েছিলাম। তোমার মেসেজ দেখার পর ফোন আর ছোঁয়াও হয়নি। রাতেই সব গুছিয়ে রেখেছিলাম৷ ফোনটা পকেটে ঢুকিয়েছি তুমি কল করবার আরও দশ মিনিট আগে। স্যরি, আনইনটেনশনাল মিসটেক!’
আশফিক হাওয়াই হাত নাড়াল, ‘ড্রপ ইট। প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়েছ তো?’
-‘যেসব লিস্ট দিয়েছিলে মনে হয় সবই নিয়েছি। না নিলে তো তুমি আছই। আমরা যাচ্ছি তাহলে কে কে?’
-‘সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা তোমাকে খানিকটা অপ্রস্তুত করতে পারে। আমরা সহ পরাগ জুটি, সৌরভ জুটি, হৃদয় আর দিলিশা তো আছেই। পাশাপাশি আরও আটজন জয়েন করছে আমাদের সঙ্গে।’
-‘তবে তো ভালোই। তারা কারা? তোমার পরিচিত?’
-‘না, ওরা পরাগের কলিগ৷ আমাদের থেকে একটু সিনিয়র আর জুনিয়র।’
-‘টোটাল ষোলোজনের টিম আমাদের?’
-‘হ্যাঁ, যাচ্ছি কিন্তু লঞ্চ পাড়াপাড়ে। লঞ্চে কখনো ভ্রমণ করেছ?’
-‘হিসাব ছাড়া। তুমি কী ভাবো আমাকে?’
আশফিক জানালার ফাঁকে হাত রেখে বাইরে দৃষ্টি আবদ্ধ ছিল তার। প্রশ্নটা শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। মাহিকে দেখল বিভোর দু’চোখে। ঠোঁট এক পাশ করে একটু হাসলও। সফেদ জেগিন্সের সাথে সফেদ গেঞ্জি পরনে। তার ওপর গাঢ় নীল রঙা শ্রাগ আর গলায় সাদা কালো মাফলারটা পেচিয়ে রাখা। এত চটকদার, অভিজাত সাজপোশাকের আতিশয্য ওর চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে তো। ওর তো বেসামাল হওয়া গুনাহ। তাহলে একটু সতর্কতার সাথে সাজা উচিত ছিল না মাহির?

ফোন থেকে দৃষ্টি তুলে মাহি পূর্ণ চোখে তাকাল আশফিকের দিকে। নজর নিচে থাকলেও আড় দৃষ্টিতে আশফিকের বিহ্বল, উদ্দেশ্যপূর্ণ চাউনি দারুণ উপভোগ করছিল সে। ভাবছে লীলায়িত ধরনে ঠোঁটে মেরুন রঙা লিপস্টিকটা দিতে বসবে না কি? হাল আশফিকের বেহাল হয় কি না তা ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ। পরিকল্পনামাফিক ড্রাইভারকে হঠাৎ নির্দেশ দিলো, ‘আমার আর্জেন্ট ফেস টিস্যু প্রয়োজন। এত ভোরে ফার্মেসি দোকান নিশ্চয়ই খোলা পাওয়া যাবে। একটু দেখবে তুমি বাইরে গিয়ে?’
আশফিক জরুরি ভেবে বলল, ‘আশেপাশে তো দোকান দেখছি না। আপাতত পকেট টিস্যু হলে চলবে?’
-‘না, ওটাই লাগবে৷ সমস্যা নেই দোকান সামনেই।’

আর কিছুটা এগিয়েই সামনে ফার্মেসির একটা দোকান খোলা পাওয়া গেল। ড্রাইভারকে টাকাটা আশফিকই দিলো। সে নেমে পড়তেই মাহি হ্যান্ড ব্যাগ থেকে লিপস্টিকটা নিয়ে ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরাতে দেখে চোখের পলকেই পুরু ঠোঁটজোড়ায় মেরুন রঙে রাঙিয়ে ফেলল৷ আশফিকের কাছে খুব অদ্ভুত লাগল আজ মাহির কাণ্ডটা। ও বলেই ফেলল, ‘সাজগোজ নিয়ে এতটা কনসার্ন হতে আগে তো দেখিনি৷ এটাও কি তোমার পরিবর্তনের নতুন অভ্যাস?’

উত্তর দিলো না মাহি৷ আদৌ তার সাজসজ্জা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। জবাব দেওয়া মানে শুধু শুধু মিথ্যা বলা। লিপস্টিক মাখতে গিয়ে কিছুটা ছড়িয়ে পড়ল ঠোঁটের কোণে। আশফিকের অন্য রকম চাহনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি সোজা কথায় উত্তর দেবে। ভালো লাগছে না কি সেটা বলো।’
-‘ভালো তো লাগছে। কিন্তু একটু বেশি শোয়ি হয়ে যাচ্ছে না?’
-‘শোয়ি লাগছে বেশি? আশ্চর্য আমার মতো একজন কমার্শিয়াল ফার্স্ট অফিসার পাইলটের যদি এটুকু গ্লামারস না থাকে তাহলে কি মানায়?’
আশফিক ভ্রু জোড়া উঁচিয়ে মাথা নাড়াল শুধু৷ কিছু বললও না আর খুব বেশি দেখলও না। মাহি তোড়জোড় চালিয়ে গেল লাস্যময় ঠোঁটজোড়া আশফিকের চোখে লাগানোর জন্য। জিজ্ঞেস করল এবার, ‘না কি কালারটা চেইঞ্জ করব বলো তো? লাইট করব না কি আরও বোল্ড?’
বলে আশফিকের কিছুটা কাছে মুখটা এগিয়ে নিলো। আশফিক বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবার তাকাল, ‘ এই ঠোঁটের দিকে বারবার মনোযোগ দিলে শুধু কি চোখ দিয়েই দেখতে মন চাইবে? যদি ঠোঁট দিয়েও দেখতে মন চায় তখন আমার ঠোঁট পাপী হয়ে যাবে না?’
মাহি ফোন ক্যামেরাতে নিজেকে দেখতে দেখতে জবাব দিলো, ‘সে কথা পরে। আগে দেখতে বললাম দেখো।’
-‘দেখি আমার দিকে ফেরো।’
মাহি আরও কাছে এসে ঠোঁটটা দেখালে আশফিক সেদিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘রিপন তোমার ফেস টিস্যু নিয়ে আসছে না কি দেখো তো? লিপস্টিক ছড়িয়ে গেছে।’
মাহি সামনে নজর দিয়ে বলল, ‘আসছে। কিন্তু খালি হাতে ফিরে।’
-‘ওকে।’
বলা মাত্রই বাইরে থেকে মাহি দৃষ্টিজোড়া ফিরিয়ে আনবার মুহূর্ত মধ্যেই তার রাঙা অধরটা এক দিনের ব্যবধানে আরও একবার আশফিকের ওষ্ঠজোড়ায় ডুবল।

ইসরাত জাহান দ্যুতি
(আমার কাছে আশফি আর মাহি মানেই ভালোবাসার বাড়াবাড়ি। এই উপন্যাসে অন্যন্যা উপন্যাস থেকে সেই বাড়াবাড়িটাই থাকবে। তবে মার্জিত ভাষাতে, সীমার মধ্যে। এডিট ছাড়া লেখা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here