রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৯.১

0
490

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৯.১
____________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও কঠোর মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

মন মস্তিষ্ক সব ঠান্ডা রেখে ভাবতে হবে আশফিককে। মাহিকেও খুব ভালোবেসে বোঝাতে হবে লন্ডন যাওয়াটা ওর জন্য খুব জরুরি। এমন সুযোগ তো আর বারবার আসবে না জীবনে। তাছাড়া ও মাহিকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার ব্যবস্থাও করবে অতি জরুরিভাবে। এর মাঝেই ভিসার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন নিশ্চয়ই জাওয়াদ সাহেব!

দিলিশার হাতটা কাঁধ থেকে নামিয়ে আশফিক বাথরুমে ঢুকল চোখেমুখে পানি দিতে। মাথাটাও ভেজাল একটু ভালো লাগার জন্য। তখন ঘরে এসে দিলিশাকে যা বলতে চাইছিল তা ভুলে বসে রইল৷ বাথরুম থেকে বেরিয়ে হঠাৎ ফোনের মেসেজের শব্দ বেজে উঠতেই ও প্রত্যাশা করল মাহি নিশ্চয়ই মেসেজ করেছে আর সেখানে একগাদা অভিযোগ লেখা তাকে নিয়ে। রাগ করলে সচারাচর মাহি মেসেজেই কথা বলে। অভিযোগ করুক আর রাগ করুক, আশফিক এ ভেবেই উৎফুল্ল মাহি মেসেজ করেছে। হাতে তোয়ালেটা নিয়ে শুধু মুখটাই মোছা হলো। উত্তেজনায় মাথা মোছা হলো না ঠিকঠাক। বিছানাতে বসে মোবাইলটা হাতে নিতেই দিলিশা ইস্ত্রি করা বন্ধ রেখে এগিয়ে এলো ওর কাছে। দুম করেই ওর হাত থেকে তোলায়েলটা নিয়ে চুলগুলো মুছে দিতে শুরু করল৷ প্রচণ্ড বিব্রত হয়ে আশফিক মাথা তুলে বলতে চাইল, ‘এসব কী করছ তুমি দিলিশা? তোয়ালেটা আমাকে দাও।’ তবে বলা হলো না অপ্রত্যাশিতভাবে মাহিকে দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে। আশফিক ওর বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার বিশ মিনিট পরই বেরিয়েছিল আসমান আরার কল পেয়ে। রাগ, অভিমান ভুলে গিয়ে হবু শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করতে আসলো মাহি, আর আশফিকের সাথেও ঠান্ডা মাথায় দিলিশার চালবাজি আচরণ আলোচনা করতে চাইল। দিলিশা বেশ কিছুদিন ধরেই আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চায় ওকে– ও আশফিকের যোগ্য না, আশফিককে ও ভালোবাসে না, স্বার্থপর মেয়ে ও৷ আশফিককে নিয়ে লন্ডন যাবার পর আশফিকের অগ্রগতি শুরু হতেই ওকে আর দেশে ফিরতে দেবে না ওর কাছে। এসব গায়ে জ্বালা ধরানো কথাগুলোর রাগটাই আশফিকের ওপর দেখাতে শুরু করেছে ও৷ মোদ্দা কথা আশফিককে লন্ডনই যেতে দেবে না ও।

বয়সটা সবে বিশ পেরিয়ে একুশে পড়েছে মাহির৷ তুচ্ছতম বিষয়েও রক্ত গরম হয়ে যায় দ্রুত, পরিণত বুঝজ্ঞান দ্বারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, ধৈর্যশক্তি কম। সেই মেয়েটার মন আশফিককে নিয়ে নিরপত্তাহীনতায় ভুগছে শেষ কিছুদিন ধরে৷ একবার, দুবার আশফিককে খোলাখুলিভাবে বলতে গিয়েও ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারেনি দিলিশার ব্যাপারটা৷ উলটে দিলিশাকে লন্ডন পাঠিয়ে দিতে বলেছে ওদের বিয়ের আগেই আর আশফিককে লন্ডন যেতে বারণ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

মাহির শীতল চাউনি, রাশভারী মুখের দিকে কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আশফিক দ্রুত দিলিশার হাত সরিয়ে দিলো মাথা থেকে। তা দেখে মাহি চকিতেই বলে উঠল, ‘দরজা খোলা রাখলে প্রাইভেসি মেইনটেইন হয় না। আন্টির কাছে এসেছিলাম৷ ইনডোরে, আউটডোর কোথাও পেলাম না তাকে৷ তাই এ রুমে আসা।’

-‘কীসের প্রাইভেসি মেইনটেইন? আর এলেই যখন আমার সঙ্গে বাসায় তখন দেখা করলে না কেন?’ আশফিক এগিয়ে এলো ওর কাছে। দিলিশা নিজ জায়গাতেই নির্বাক দাঁড়িয়ে।

ঘরের ভেতর আসতে আসতে মাহি দিলিশার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো, ‘সেটাই বলতে এসেছি।’ বলেই দিলিশাকে রুক্ষ স্বরে আদেশ করল, ‘বের হও এখান থেকে।’

-‘কী?’ মাহির অমন কর্কশ গলায় আদেশটা হজম হলো না দিলিশার।

একই বাক্য পুনরাবৃত্তি করল মাহি, ‘বললাম, এ ঘর থেকে বের হও।’

আশফিক নিজেও একটু অবাক হলো মাহির হঠাৎ অমার্জিত আচরণে, বলল, ‘এরকম রুডলি বলছ কেন ওকে? অপমানিত হচ্ছে ও।’

দিলিশার জন্য আশফিকের পক্ষপাত মাহির নিয়ন্ত্রিত ধৈর্য আর ক্রোধ এবার ঘোড়ার বেগে ছুটল, ‘তোমার এত লাগছে কেন?’

-‘লাগার কথা আসছে কেন? তুমি ইদানিং এমন অদ্ভুত আচরণ করছ কেন সবার সঙ্গে? কী হয়েছে তোমার?’

-‘সবার সঙ্গে করছি মানে?’

-‘তুমি আমার সঙ্গে যেমনটা করছ দিলিশার সাথেও তেমনটাই করছ? এর কারণ কী?’

-‘হ্যাঁ, সেটাই তো বলতে চাইছি। কিন্তু তুমি দিলিশার হয়ে আমার কাছে জবাবদিহি চাইছ কী জন্য? ও আমার থেকে যেটা ডিজার্ভ করে সেটাই দিচ্ছি ওকে।’

-‘জবাবদিহি চাইছি কোথায়? শুধু কারণটাই জানতে চাইছি। তাছাড়া দিলিশার আমার বাসার গেস্ট। ওর ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব তো আমার ওপরেই পড়ে৷ সে খাতিরেই জিজ্ঞেস করছি৷ কী এমন করেছে ও যে তোমার থেকে এত নীচু ব্যবহার ডিজার্ভ করে?’

চটে গেল মাহি খুব, ‘নীচু ব্যবহার! হ্যাঁ, আমি তো নীচ মানুষ তাই নীচু ব্যবহারই করছি। ও যদি তোমাকে আমার থেকে ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য তোমার ব্রেইন ওয়াশ করে আমি কি ছেড়ে কথা বলব? ও তোমাকে লন্ডন নিয়ে যাবার জন্য পলিটিকিস নেতাদের মতো কূটনীতি শুরু করেছে।’

-‘কথা সংযত করো, মাহি! ছিঃ তুমি খুব সংকীর্ণ মনের মেয়ে আর অবশ্যই স্বার্থপর৷ নয়তো যাকে কিনা ভালোবাসো তার শখ, ইচ্ছা, স্বপ্নকে গ-লা টি-পে হ-ত্যা করতে চাইছ?’ দিলিশা প্রতিবাদী গলায় বলে উঠল৷

মাহি একবার শুধু তাকাল নীরব মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা আশফিকের দিকে। পূর্ণ সমর্থন করছে সে তবে দিলিশাকে! ও তো আশফিককে শুধু লন্ডন যেতে বারণ করেছে। বলেনি একবারও ফটোগ্রাফি ছেড়ে দিতে। দিলিশাকে সে একদমই বিশ্বাস করতে পারছে না৷ কোনো চক্রান্তের শিকার বানিয়ে যদি আশফিককে বিয়ে করে নেয়? ওর সাফ সাফ ধারণা এটাই আর এ কারণেই এত ভয় আশফিকের লন্ডন যাওয়া নিয়ে। কিন্তু আশফিকও এটাই বিশ্বাস করে দিলিশা যা বলল? নিদারুণ কষ্টে চোখে আপনা আপনিই কান্নারা ভীড় করল মাহির৷ ঠিক আছে, স্বার্থপর না হয়েও যদি স্বার্থপরের তকমা গায়ে লেগে যায় তবে এবার স্বার্থপর হয়েই না হয় নিজের স্বামীকে বেঁধে রাখবে? কিন্তু যে বাঁধা পড়তে চায় না তাকে জোর করেই হোক আর ভালোবেসে হোক, সে কি বাঁধা পড়তে চায়? দিলিশার কথাকেই কেন্দ্রবিন্দু করে বলল ও, ‘কারণ, আমার কাছে ওই ফটোগ্রাফির থেকেও ও কোনো সোনার দোকানের স্যাকরা হলে বেশি মূল্যবান লাগবে সেই পেশা।’

জবাবে দিলিশা সাজানো উত্তর বলতে গিয়েও থেমে গেলে আশফিকের অভিব্যক্তি দেখে৷ বজ্রাহত প্রগাঢ় চাহনিতে আশফিক তাকাল মাহির দিকে, ‘কী বলছ তুমি? আমার স্বপ্ন পূরণের সাথী না-ই বা হলে অন্তত ছোটো কোরো না সেই স্বপ্নকে! আমি তোমার চাওয়াকে প্রাধান্য দিতেই আমার ক্যামেরাটা অবধি বাক্সবন্দি করে ফেলেছিলাম৷ কিন্তু হঠাৎ করেই আমার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ হাতের মুঠোয় চলে এলো। তোমার কি একটুও খারাপ লাগছে না আমার থেকে আমার ভালো থাকা ছিনিয়ে নিতে? তুমি কি সত্যিই এতটা স্বার্থপর, মাহি?’

একইভাবে মাহির হৃদয়টাও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে আশফিকের কথায়। এই তিনটা মাসে ওকে কি একটুও চিনল না আশফিক? ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষটাকে বুঝতে হয় আগে৷ আচ্ছা আশফিক কি তাকে ভালোবাসে? কই কখনও তো বলেনি! সে ভালোবাসি বললেও আশফিক তার ফিরতি জবাব দেয়নি। তাহলে এত দিন ধরে ও একাই ভালোবেসে গেল আশফিককে? খুব কঠিন হয়ে গেল মাহি মুহূর্তেই।

-‘হয়তো তাই। আমি সত্যিই চাই না তুমি লন্ডন যাও৷ আর দিলিশাকে অতি শিঘ্রই ওর মাদারল্যান্ড ফিরে যেতে বলবে৷ এটাই আমার শেষ কথা। তাতে তুমি আমাকে যা খুশি তাই ভাবতে পারো৷ তবু আমি তোমাকে লন্ডন যেতে দেবো না।’

ধৈর্য শক্তির বিনাশ ঘটল এবার আশফিকের, ‘কিন্তু কেন? কেন করছ তুমি এমন নিষ্ঠুরতা? আমি তোমাকে সত্যিই আমার দেখা থেকে সব থেকে সরল, শুদ্ধ মনের মানুষ ভেবেছি। এ কারণেই তোমাকে প্রথম দেখাতেই বিয়ে করবার সিদ্ধান্তটাও নিয়ে নিয়েছিলাম। আমি কি তবে ভুল চিনেছিলাম তোমায়?’

-‘তুমি দিলিশাকে এই ঘর থেকে যেতে বলো তারপর আমি তোমার সাথে কথা বলব।’

-‘কী কথা বলবে? তুমি এটাই তো ইমোশনালি বলার চেষ্টা করবে যেন আমি না যাই লন্ডন? অথচ দিলিশা, সেও আমার জীবনে একজন ভালো বন্ধু৷ সে ঠিক তার বন্ধুত্বের পরিচয়ই দিয়ে চলেছে প্রতিটাদিন আমাকে প্রেরণা যুগিয়ে। কিন্তু আমি এটা তোমার থেকে আশা করেছিলাম, মাহি।’

মাহি আর পারছে না ক্রোধ সংবরণ করে রাখতে। শেষ অবধি দিলিশার সঙ্গে আশফিক ওর তুলনা করে এভাবে ছোটো করল! উচ্চস্বরে বলে উঠল ও, ‘তাহলে তুমি দিলিশাকেই তোমার জীবনে জড়াতে! আমাকে আগেই বলতে তুমি দিলিশার সঙ্গে অ্যাটাচড্, ওর প্রতি তোমার দুর্বলতা আছে? আমিই বোকা, ভীষণ বোকা! তোমার দিলিশার প্রতি এত ভরসা, ওর জন্য এত প্রশংসা, ওকে এত সাপোর্ট! আর আজ তো নিজে চোখেই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত দেখতে পেলাম তোমাদের৷ কী বললে তখন? ভালো বন্ধু তোমরা? এতটাই ভালো বন্ধু যে কাজগুলো আমাকে করা মানায় সেগুলো দিলিশা করছে? একটু আগের ওই মুহূর্তটা আমার জায়গায় তুমি অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে দেখলে কী রিয়্যাক্ট করতে? কিন্তু আমি কি কোনো রিয়্যাক্ট করেছি? কারণ, আমি তোমাকে বিশ্বাস করতাম পুরোটাই৷’

ইস্ত্রি আর এলোমেলো শার্টগুলো দেখিয়ে বলল এবার, ‘এই যে কী সুন্দর ঘরের বউয়ের মতো তোমার জামা কাপড় ইস্ত্রি করছে, গোসল শেষে তোমার চুল মুছে দিচ্ছে, তুমি বা আন্টি তো কখনো ফ্লাওয়ারপটে তাজা ফুল সাজাও না। এটাও নিশ্চয়ই দিলিশা করেছে? তার মানে তোমার ঘর পরিপাটি রাখে এই মেয়েটাই? কী কারণে করে? এসবের পরেও আমি ওকে পছন্দ করব? যাকে পছন্দ করি না আমি সেই মেয়ের সঙ্গে তোমাকে লন্ডন যেতে বারণ করছি সেটার জন্য আমি স্বার্থপর হয়ে গেলাম? আমি বোধ হয় এতক্ষণ একপাক্ষিক দোষ দিচ্ছিলাম শুধু৷ এক হাতে তো কখনও তালি বাজে না, রাইট? তুমি আশকারা না দিলে কি আর দিলিশা ঘরের বউয়ের দায়িত্ব পালন করে? তাহলে আমি কেন এলাম তোমাদের মাঝে? আমাকে কেন টেনে আনলে?’ কান্না গলায় মাহি চেঁচিয়ে উঠল।

আশফিকের পাগল পাগল লাগছে সব কিছু৷ মাহির বিধ্বস্ত, অগ্নিমূর্তির সামনে ও নিজেই এই মুহূর্তে লাগামছাড়া মেজাজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ দিলিশাকে নিয়ে মাহির এত এত ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শুনে ও সেই লাগামছাড়া মেজাজের সঙ্গে বলল, ‘প্রসঙ্গ কোথার থেকে তুমি কোথায় টানছ? দিলিশাকে নিয়ে তুমি সেই শুরু থেকেই আমাকে নানাভাবে সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখো৷ আর এখনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুমি তো ডাবল মিনিং বের করবেই। আমার যদি ওকে নিয়ে এমন কোনো ফিলিংস থাকতই তাহলে তোমাকে বিয়ে করতে যাব কেন? কী ফায়দা আমার?’

-‘তাই তো! ঠিক আছে। তাহলে তুমি আজই, এক্ষুনি আমাকে বিয়ে করবে। আমার আব্বু আর ভাইও আজ বাসায়৷ আঙ্কেল, আন্টিকে ডাকো তুমি৷ রাতের মধ্যেই বিয়ে করে সামাজিক মর্যাদা নিয়ে আমি এ বাড়িতে থাকতে শুরু করব। তাহলেই বিশ্বাস করব তুমি দিলিশার প্রতি তুমি দুর্বল নও।’

মাহির প্রতিটা কথায় আজ কেন যেন আশফিকের মাথায় খু-ন চেপে যাচ্ছে৷ ওর প্রতি তো কখনোই এতটা ক্ষোভ আসেনি! আজ ওর কী হয়েছে ও জানে না। শুধু মন এটাই মানছে, মাহি ওকে ভালোবাসেনি বলেই ওকে ওর সাফাল্যের দ্বারপ্রান্ত থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে চাইছে৷ আর ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল তো এই মুহূর্তে বিয়ে করে নিজের ওপর থেকে সন্দেহ দূর করবার কথাটা শুনেই। মাহিকে সত্যিই হীন মানসিকতার লাগল। প্রবল রাগ, জেদ, অভিমান আর অহংবোধে আশফিক আগে-পিছে না ভেবে বলে দিলো, ‘ইয়েস, আই অ্যাম অ্যাট্রাকটেড টু দিলিশা, আই অ্যাম অ্যাটাচড্ টু হার, আই অ্যাম ভলনারেবল টু হার। কী করবে তুমি এখন? বিয়েটা করবে না? ওকে ফাইন। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো কিছুই নেই। না ভালোবাসা, না বিশ্বাস, না ভরসা, না নিঃস্বার্থ মনোভাব। সেখানে বিয়ের প্রশ্নই আসে না।’

যা-ই কিছু হয়ে যাক, এমন কোনো কথা শোনার মতো প্রস্তুতি মাহির ছিল না। কান্না থেমে গেছে ওর স্তব্ধতায়। দৃঢ় গলায় বলে ফেলল, ‘সততাও নেই। যে ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি তার মাঝে বিন্দু পরিমাণ সততা নেই! সে তো একজন দুশ্চরিত্র পুরুষ। তাই তো আমি সুযোগ পুরোপুরি না দেওয়া অবধি ঘরের অতিথির সঙ্গেও বেডরুমে একান্ত সময় কাটায়৷ আবার বাড়ির বাইরে আমার কাছে গেলেও৷ অনেকটা সেই সব পুরুষের কাতারেই আমার সামনের মানুষটাও– যারা গাছেরও খায় তলারও কুড়ায়। আচ্ছা এক মিনিট! আমি আসার আগ মুহূর্তেও কি তোমরা ইন্টিমেট ছিলে? দু’জনেই কি এক সঙ্গে গোসলও করেছ?’ দু’জনের দিকে রুষ্ট চাউনি ছুড়তেই মাহির নজর আটকাল দিলিশাতে, ‘ওহো, তাই তো! আমি তো তোমার দিকে লক্ষই করিনি৷ তুমিও তো আফটার শাওয়ার লুকিংয়েই আছ দেখছি! আর আমি তা না লক্ষ করে এতক্ষণ খালি খালি ভ্যাজর ভ্যাজর করে গেলাম! তো আশফি, আমার সঙ্গে তুমি শুতে না পেরেই কি দিলিশার দিকে ঝুঁকেছ না কি আগে থেকেই?’

শেষ বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে পারেনি মাহি৷ তার পূর্বেই আশফিক আচম্বিতেই ওকে থা-প্পড় মেরে বসে, চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘বেরিয়ে যাও তুমি! আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও৷ আর জীবনে কোনোদিন তোমার মুখ আমায় দেখাবে না! মনে থাকে যেন। আমার এখন ঘেন্না করছে তোমার মতো নোংরা মনের মেয়েকে আমি আমার যোগ্য ভেবেছিলাম!’

জড়ীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে মাহি আশফিকের প্রতিটি কথার আঘাত আর মারের আঘাতটাও হৃদয়পুরীতে জিইয়ে রাখল৷ যাতে মৃত্যুর আগ অবধিও এই ব্যথা তাজা থাকে। পাথরের মতো দাঁড়িয়েই বিড়বিড় করে স্বগোতক্তি করল, ‘আমি মনে রাখব, আশফি।’

ক্ষীণ পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যেতে গিয়ে সামনের সব কিছু ঝাপসা লাগছিল ওর। চোখদু’টো বারবার মুছলেও সেখানে উপচে পড়া কান্নার ভীড়!

আমি আজকের দিনটা অন্তত সময় নিয়ে পর্বটা লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই অসুস্থ মস্তিষ্কের সাইকোপ্যাথ মানুষগুলোর পরবর্তী স্টেপ দেখতে চাই এই পর্বটাতেও তারা রিপোর্ট করে কি না! তাই বুঝে আমিও তাদের মুখোশ উন্মোচন করব। এলোমেলো চিন্তাভাবনা নিয়ে পর্বটা লিখেছি। যেমন করে সাজাতে চেয়েছিলাম তেমন করে পারিনি। তার জন্য দুঃখিত।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৯.২
___________________________

ক্লান্ত, বিবর্ণ মুখ, ভঙ্গুর পরিণতিতে মাহিকে অমন করে বিদায় নেবার দৃশ্যটুকু দেখে অজান্তেই এক চোখ থেকে বাঁধাহীন এক বিন্দু নোনাজল পড়ল ওর, কলিজায় ছুরিকাঘাত করল মুহূর্তটা। ওর পরিণতিটাও করুণ! মানসিক অবস্থা অপ্রকৃতিস্থ আর মনটা ক্ষত-বিক্ষত! কী করে ফেলল সে? পারলই বা কী করে এত নির্দয় হতে? অসম্ভব ক্রোধের তাড়নায় মানসিক, শারীরিক, সবভাবেই আঘাত করে বসল সে মাহিকে! সে কি মানুষ? অমানুষ বুঝি তাকেই বলে!

দিলিশা কে? সম্পূর্ণই ওদের মাঝে একজন তৃতীয় ব্যক্তি৷ তার জন্য, তার ভয়ে মাহি ওর লক্ষ্য থেকে সরে আসতে বলবেই বা কেন? ও যদি নিজে থেকে দিলিশাকে কোনো সুযোগ না দেয় দিলিশার তো ক্ষমতা নেই ওকে মাহির থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার! এই সাধারণ বুঝটা মাহির হলো না কেন? তবে মাহি নিশ্চয়ই ওর ওপরও আস্থা রাখে না? অবিশ্বাস ওর প্রতিও! সেই সাথে ব্যক্তিগতভাবে ওর ছবি তোলার পেশা, ছবি তোলার প্রতি আসক্তি খুবই অপছন্দ করে। উভয় কারণ মিলিয়েই মাহি চায়ই না ছবি তোলার পেশাটা ও গ্রহণ করুক আর তাতে অগ্রগতি হোক! ঠিক আছে তবে। না-ই হোক! তাও মাহিকে সে কখনোই ছেড়ে থাকতে পারবে না৷ আগেও একবার বেছে নিয়েছিল সে মাহিকেই। শেষবারও তাকেই বেছে নেবে। শেষ পরিণতি সন্ধি ছাড়া বিচ্ছেদ কোনোভাবেই হতে দেবে না সে।

দিলিশা এত কিছু কল্পনাও করেনি। এভাবে পুরো পরিস্থিতিটা বিগড়ে যাবে কে জানত! আশফিক যতটা৷ না ভেঙে পড়েছে তার থেকে বেশি শোচনীয় অবস্থাটা মাহির তা ও টের পাচ্ছে৷ কিন্তু মাহি যে সত্যিই ভীষণ স্বার্থপর৷ আশফিককে ভালোবাসলে ওর লক্ষ্যটাকেও তো নিজের লক্ষ্যই ভাবা উচিত ছিল। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো আশফিকের কাছে। পুরুষ মানুষের চোখের জল ও জীবনে কখনও দেখেনি৷ সেই জল আশফিকের মতো কঠিন সত্তার পুরুষের চোখে দেখতে পেলো আজ! ও কি সত্যিই কেঁদেছে? ওর ব্যথাহত দৃষ্টিজোড়া এখরও ঘরের দরজাটার পানেই। কাঁধটাতে হাত রাখতে গেলেই অকস্মাৎ আশফিক ছুটে বের হলো। ভীষণ চমকাল দিলিশা! মাহিকে আটকাতেই গেল নিশ্চয়ই। এবার রক্তাক্ত হলো ওর হৃদয়টাও৷ ও এই দু’জনের মাঝে একজন বহিরাগত, এটা ও মানতেই পারে না।

পার্কিং লটেই গাড়িতে বসে মাহি মুখে হাত চেপে উচ্চরবে কাঁদছে। গাড়িটা নিজে চালিয়ে যাবার মনোবল, শক্তি কোনোটাই মিলছে না। শিরায় শিরায় কষ্ট, রাগ, জেদ, অভিমান, এক সঙ্গে বিরাজ করছে৷ এরূপ এলোমেলো মাথায় যা ভাবনা এলো সেটাই করে বসল। চোখ, মুখ মুছে নাহিয়ানকে কল করল। নাহিয়ান দু’বার রিং বাজতেই কল ধরল, ‘হ্যাঁ রে আপু বল!’

কাতর গলায় কেঁদে উঠল মাহি আবারও ভাইয়ের ডাকে আহ্লাদিত হয়ে। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘আব্বুকে এক্ষুনি বলো আমি বেঁচে থাকতে আশফির মতো বেঈমান, পাষণ্ড, দুশ্চরিত্র ছেলেকে বিয়ে করব না। দিলিশার সাথে ঘর, সংসার শুরু করেছে ও। ফটোগ্রাফি ফটোগ্রাফি করে লন্ডনেও এক সঙ্গে যাবার জন্য পাগল হয়ে গেছে ওরা! এখানেই দু’জন যখন তখন নোংরামিতে মত্ত থাকে আর লন্ডন গেলে… ছিঃ! আমি এই ছেলেটার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছি আর সে আমার আড়ালে দিলিশার সাথে! আমাকে আজ স্পষ্ট বলেছে দিয়েছে ও দিলিশার প্রতি দুর্বল, আসক্ত। তুমি আব্বুকে বলে দাও বিয়ের কার্ড যেন কাউকে না দেয়। মরে গেলেও ওকে আমি বিয়ে করব না আমি৷’

এই সম্পর্কের স্থায়ীত্ব বিধাতা তিন মাসের জন্যই ভেবে রেখেছিলেন। বিয়ে হবার পরও দু’জন সেই পবিত্র সম্পর্কে হেলাফেলা করার জন্যই হয়তো আজকের এই পরিস্থিতিটা এলো ওদের মাঝে, দু’জনের ভালোবাসাতেও নিশ্চয়ই বিস্তর ফাঁক থেকে গেছে। নয়তো দু’জন দু’জনের প্রতি এত অবিশ্বাস, ভালোবাসার থেকেও এক অপরের রাগ, জিদ আর অহংকারটাই বড়ো হলো কেন? কেউ কারও কাছে দ্বিতীয়বারের জায়গায় তৃতীয়বার নত হতে রাজি নয়। ওদের বন্ধনটা একেবারেই নড়বড়ে ছিল।

কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আশফিক। হৃদপিণ্ড ছিদ্র করে দেওয়া মাহির কথাগুলোতে আশফিকের কষ্টের থেকেও বেশি আত্মসম্মান আর অহংবোধে আঘাত করল, রাগে, অভিমানে ঝড় তুলল বুকের বাঁ পাশটায়। মাহিকে ছুটে এসে জাপটে ধরবার জন্য আসলেও ওর কান্নারত মুখটা আর একবারও না দেখে চলে গেল আবার। মাহিও দেখতে পেলো না উদ্বিগ্ন আশফিকের ছুটে আসা আর বিক্ষিপ্ত অনুভূতি নিয়ে একেবারের জন্য চলে যাওয়া।

কথায় আছে না সময় গেলে সাধন হবে না? এই বাক্যের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছিল অতীতে মাহির বেলাতে। সেদিন ফিরে আসার পর রাত-দিন ঘর আটকে পড়ে থাকতে থাকতে মনটা আপনা আপনিই কোমল হয়ে আসে আশফিকের জন্য। রাগের মাথায় সেও তো কম কিছু বলেনি! সোজা কথা জিদ করে উলটো বলে এসেছে৷ তেমনই আশফিকও তাই! ভুল তো আশফিকের ছিল বটে। কিন্তু তা ধরে রেখে সম্পর্কটা ভেঙে দেওয়ার মতো নয় নিশ্চয়ই? তিনটা দিন যোগাযোগ নেই ওদের মাঝে। নাহিয়ান বা জারিফ সাহেব জোর করেও কথা বলতে পারেনি এ ব্যাপারে মাহির সাথে৷ ওদিকে জাওয়াদ সাহেব হুট করে ছেলের লন্ডন চলে যাওয়া কাউকে না জানিয়ে, এ বিষয়টা কোনোভাবেই জারিফ সাহেবকে জানাতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তিনদিনের মাথায় মাহি নিজের বন্ধ করে রাখা ফোনটা খুলে আশফিককে কল করতেই নাম্বার বন্ধ পায় তারও৷ আসমান আরার কাছে কল করলে তিনি আমতা আমতা করে গোপন রাখা সত্যিটা জানিয়ে দেন মাহিকে। জরুরিভাবে টিকেট কেটেই গত পরশু আশফিক দিলিশাকে নিয়ে লন্ডন চলে গেছে৷ এই কথাটা আসমান আরা যতটা সহজ করে বলতে পেরেছিলেন মাহি কি সহজভাবে নিতে পেরেছিল? ওর মনের অবস্থা বুঝিয়ে বলতে গেলে ভাষার অভাব পড়বে৷ পাগলের মতো ঘরের মধ্যে দাপিয়ে পড়ে আর্তনাদ করেছিল মাহি। বারবার মনে হচ্ছিল আশফিক ওর আর নেই! আত্মহত্যা করার প্রবণতাও মনের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। বর্ণনাতীত মুহূর্তটা ছিল সেদিন৷

চলে যাবার পর আশফিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি মাহি। জাওয়াদ সাহেবের থেকে ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে কতবার কল করেছিল তা হিসাবহীন! পরাগ, অপি, হৃদয়, সৌরভ, জারিন, কাউকে বাদ রাখেনি অনুরোধ করতে– শুধু একটাবার আশফিকের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ওরাও ব্যর্থ হয়৷ আশফিক মাহি নামটা শুনলেই ফোন কেটে দিতো আর মাহির নাম্বার ব্ল্যাকলিস্ট না করতে পারলেও রিসিভ করত না। একটা সময় মাহির সয়ে যায় সবটাই৷ আশফিক ওর স্বামী– এই সত্যিটাই ও নিশ্চিহ্ন করে দেয় আত্মা থেকে।
_______________________________

দু’জনের বেখেয়ালে, অন্যমনস্কের সুযোগে আগুনটা নিভু নিভু করছে। কিন্তু দু’জনের অনিমেষ দৃষ্টিই ওই একই শিখাতেই নিবদ্ধ৷ প্রায় অনেকটা সময় দু’জন পাশাপাশি বসে নীরব। বলতে চায় ওরা একে অপরকে অনেক কিছুই। বিশেষতঃ আশফিক আজ মাহির থেকে পরিষ্কারভাবে শুনতে চায়– সকলের না জানা তাদের এই সম্পর্কের শেষ পরিণতি মাহি কী চায়?

-‘তুমি চুপ থেকো না আজ আর। আমার কথার পিঠে তোমার যদি কোনো উত্তর থাকে তা আমি শুনতে চাই৷ তা যত তিক্তই হোক।’

-‘আচ্ছা! বলছি তবে। তুমি তো বললে তুমি দশ বছর পর ফিরে এলেও আমি প্রথম এবং আমিই শেষ মানবী থাকতাম তোমার জীবনে৷ এই যে তোমার মনের সুপ্ত ভালোবাসাটা, এটা কি তুমি আমাকে কখনও ব্যাখ্য করেছ? যখন চলে গেলে তখনই বা কি আমাকে কথায় ইঙ্গিত দিয়েছিলে তুমি আজ হোক বা কাল হোক আমার কাছেই ফিরবে? আমার আর তোমার শেষ দেখা হওয়ার পরিস্থিতি কী বোঝায়? অনিশ্চিত আমাদের দু’জনের সম্পর্কের ভবিষ্যত৷ তুমি একদিন অবশ্যই ফিরবে এই আশা বুকে নিয়ে আমি বছরের পর বছর দিব্যি পার করতাম। যদি আমাকে আশা দিয়ে যেতে। দিয়েছিলে না কি কোনো আশা? চলে যাবার পর তুমি দীর্ঘ চার বছরের মতো আমার সাথে যোগাযোগ করলে না। অথচ এ বিশ্বাস রাখলে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব? কীভাবে করলে? কারণ, আমার ভালোবাসার গভীরতা তুমি উপলব্ধি করে গিয়েছিলে। আমি তো করতে পারিনি সেই উপলব্ধি। জানি, মুখে ভালোবাসি না বললেও অনুভব করা যায়৷ আমিও করেছিলাম তা৷ বিশ্বাস করেছিলাম তুমি আমায় ভালোবাসো৷ কিন্তু পাশাপাশি আমাকে দ্বিধান্বিতও করেছ দিলিশাকে নিয়ে সব সময় মাতামাতি করে। পরিশেষে তো সেই তাকে নিয়েই আমাকে ফেলে তোমার লক্ষ্যে পৌঁছতে চলে গেলে৷ তাহলে তোমার ভালোবাসার প্রতি আমার মন প্রশ্নবিদ্ধ হবে না? একটা নয় দুইটা নয়। চার চারটা বছর! কীভাবে বুঝব আমার স্বামী ফিরে তো আসবেই আমার কাছে? যেখানে কোনো যোগাযোগই নেই। দিনের পর দিন সিনেমা, উপন্যাসের মহান চরিত্রের নায়িকাদের মতো এক জনের জন্য আমার পুরো জীবনটাকে থামিয়ে রাখব একটা জায়গাতেই? এটাই আশা করো না কি? কিন্তু আমি তো বিশ্বপ্রেমিকা নই। তুমি চলে গেছ, তোমার জন্য আমি আমার জীবন এগিয়ে না নিয়ে অতীতেই পড়ে থাকব না। অবশ্যই আমি আমার বর্তমানকে সুন্দর করার জন্য যোগ্য কাউকে খুঁজব। বিয়ের কথাটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম তোমার কারণেই। তবে এ কথা সত্য৷ হয়তো এই পবিত্র সম্পর্কটার জোরেই দিব্যর প্রতি আমি ভালো লাগার থেকে বেশি কিছু অনুভব করতে পারিনি তিনটা বছরেও। যদি করতাম সেদিনই তোমার থেকে তালাক নিতাম।’

ইসরাত জাহান দ্যুতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here