রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৩১

0
472

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৩১
_________________________

-‘হ্যালো!’

-‘হ্যাঁ ভাবি আমি মাহি। ভাইয়াকে, আব্বুকে কল করলাম একবার৷ ফোন তো ধরল না। সবাই কি অফিসে? কোনো মিটিংয়ে আছে না কি?

-‘হ্যাঁ অফিসে আছে মিটিংয়ে। আমিও যাচ্ছি। তুমি কোথায়? তোমাকে নিয়ে আমরা টেনশনে অস্থির। তুমি সেই যে বললে তোমরা ঠিক আছ। কিন্তু তোমাদের দলটাই তো দুর্ঘটনার শিকার হলো। কোনো খবরই পেলাম না এ বিষয়ে। আশফিকের খোঁজ চলছে ওর বাসা থেকে।’

-‘ডিউটিতে ছিলাম। এসব ব্যাপারে পরে কথা বলব৷ আমিও অফিসেই আসছি৷ দেখা হচ্ছে সবার সঙ্গে।’

-‘আচ্ছা আসো তাহলে।’

নিঝুম দ্বীপে মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে তা সরকার থেকেই টিভি চ্যানেলে প্রচারে নিষেধ জারি করেছেন। আরও যখন জানতে পেরেছেন সেখানে ছুরিকাহত হয়েছে আশফিক জাওয়াদ– আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত বন্য জীবনের ফটোগ্রাফার যে, সে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল থেকেই ঘাতক দ্বারা আহত হয়েছে সেটা বিবিসির মতো চ্যানেলগুলোতেও খবর হয়ে যাবে। এতে সরকারের দায়িত্ববোধ আর তার ভাবমূর্তিতে খারাপ প্রভাব পড়বে৷ কিন্তু আশফিকের চিকিৎসাধীন থাকার খবরটা এখনও কেন ওর বাসা অবধি পৌঁছেনি সে ব্যাপারে মাহিও অনবগত। তবে মনে হচ্ছে আশফিকই বারণ করেছে। তাহলে কি আশফিক সুস্থ হয়েছে? নিশ্চয়ই তাই! মাহির মুমূর্ষু হৃদয়টা এটুকু সান্ত্বনা পেয়ে প্রশান্তি পেলো খুব।

ব্যক্তিগত ফোন আর কাজের স্বার্থে প্রাইভেট ফোন উভয় থেকেই মাহির জন্য বারণ আশফিকের কাছে বা নিজের পরিবার ছাড়া অন্য কারও কাছে ফোনকল করা। বাইরে থেকে করবারও কোনো উপায় নেই৷ ওর পিছে এই মুহূর্তে দু’জন স্পাই আছে তা বোঝার জন্য স্বচক্ষে দেখার প্রয়োজন নেই। এক সময় সেও তো এই স্পাই ছিল। সেখান থেকে এখন একজন ইনটেলিজেন্স এজেন্ট।

গাড়ি উত্তরা থেকে ঘুরিয়ে গুলশানের দিকে ছুটল মাহির। যদি জাওয়াদ সাহেবের মুখোমুখি হয় তাহলে তো ওর কাছে জিজ্ঞেস করবেই আশফিকের কথা। কী জবাব দেবে ও? সত্যটা লুকানো তো ঠিক হচ্ছে না। ছ’জন মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অপরাধবোধের যন্ত্রণা আর অভিমান উৎসর্গ করার সেই প্রিয় মানুষটির অসুস্থতার জন্য মনের অবস্থাটার বেহাল ওর। তবুও সব কিছু একপাশে রেখে দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে সেই মনটাকেই আবার দৃঢ় করবার চেষ্টায় আছে সে।

অফিসে ঢুকবার পথে রিসিপশনে বসে থাকা মেয়েটা হঠাৎ ওকে দেখে কেমন কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকল। মাহি তা লক্ষ করলেও দাঁড়িয়ে তার সাথে কথা বলে কারণটা বুঝবার প্রয়োজনবোধ করল না। তবে জিজ্ঞেস করল, ‘মিটিং শেষ হয়েছে?’
মেয়েটি বলল, ‘হ্যাঁ শেষ হয়েছে মাত্রই।’

ব্যথা নিরাময়ের ওষুধ খেয়েছিল ও সকালবেলা। এখন বেলা বাজে দু’টোরও বেশি। আবারও খাওয়ার সময় হয়েছে৷ ব্যথাটাও বাড়ছে আবার ধীরেধীরে। শরীরের ভার নিয়ে চলতে অসু্বিধা হচ্ছে কিছুটা৷ মাহি এগোলো বাবার অফিস কক্ষে। ভেতরে এসে কাউকে পেলো না। তখন সহকারী এক ছেলে কর্মী এসে জানাল, ‘কিছুক্ষণ আগেই সবাই রুফটপে গিয়েছে। আপনার জন্য কি কিছু পাঠাব, ম্যাম?’

মাহি ঘাড়ের পেছনটা হাত দ্বারা হালকা চাপতে চাপতে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবল, তারপর বলল, ‘একদম লাঞ্চটাই পাঠান।’

-‘কী খাবেন ম্যাম?’

-‘যা ইচ্ছা৷ সাথে ট্যাপেনাক্স ১০০ এম জি ট্যাবলেটটাও পাঠিয়ো।’
বলেই লিফটে চড়ল। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে কেমন৷ জ্বরটর আসবে বলে মনে হচ্ছে। পেছনে দাঁড়িয়ে ছেলেটা তখন হতবুদ্ধিভাব নিয়ে। এমন ওষুধ তো চেতনানাশক হিসেবে পরিচিত৷ অবশ্য তীব্র ব্যথা বা মাঝারি ব্যথার জন্যও নির্ধারিত৷ কিন্তু মাহিকে দেখে তার মনে হলো না এই ওষুধ ওর জন্য৷

বড়ো ছাতার নিচে এক সঙ্গে চারজন বসার মতো ব্যবস্থা করা রয়েছে ছাদের উপরিভাগে। আপাতত সেখানে নাহিয়ান, ঐশী আর জারিফ সাহেব মধ্যাহ্নভোজ সাড়ছেন। তবে খাওয়াতে মনোযোগী নন জারিফ সাহেব। তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে৷ নাহিয়ানকেও কিছুটা অমনই লাগছে৷ ঐশী বেশ প্রাণবন্ত আজ৷ ওদের দু’জনকে অন্ধকার মুখ করে বসে থাকতে দেখে ও হঠাৎ বলে উঠল, ‘আব্বু, আপনাদের বোধ হয় মাহিকে সবটা জানিয়ে দেওয়া উচিত এখন। তেরো -চৌদ্দ বছর যাবৎ এমন একটা সত্য তো লুকিয়ে রাখলেই।’

নাহিয়ান প্লেটে চামচ নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, ‘আব্বু তো তাও আমাকে ক’বছর আগে বলেছে৷ কিন্তু মাহিয়ানকে জানানোর সুযোগ বা সাহস কোনোটাই হয়নি আমাদের। এখন জানতে পারলে ওর মনের অবস্থাটা কেমন হবে বুঝতে পারছ? ও আদৌ মেনে নিতে পারবে কি না সেটাও তো ভাবনার বিষয়।’

-‘তাই বলে কি তোমরা জানাবে না? আর আমার ফুপি দীর্ঘ তেরো বছর স্বামীর পরিচয় লুকিয়ে চলছে। আর কতদিন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে? মাহি মেনে নিতে পারবে কি পারবে না এটা তো তাহলে আমার ফুপির সঙ্গে আব্বুর অ্যাটাচড্ হওয়ার আগে ভাবা উচিত ছিল। আমি জানি আমি ছোটো মুখে বড়ো কথা বলছি। তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আব্বু ছোটো একটা ভুল করে ফেলেছেন। আম্মু মারা যাবার পরপরই আব্বুর উচিত ছিল আমার ফুপিকে এই সংসারে নিয়ে আসা৷ আব্বুর সঙ্গে ফুপির তেরো বছরের বিয়ে আর দু’বছরের অ্যাফেয়ার। এখন অবধি আব্বু সর্বসম্মুখে ফুপিকে স্বীকৃতি দিলেন না। এটা আমার ফুপি বলেই সহ্য করে যাচ্ছে৷ অন্য কেউ হলে কি এতদিনে নিজে থেকেই বাড়িতে এসে উঠত না?’

ছেলে বউয়ের মুখে জারিফ সাহেব নিজের বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ক আর লুকিয়ে বিয়ের প্রসঙ্গটুকু শুনতেই কেমন অস্বস্তি আর লজ্জায় মুখ তুলে চাইতে পারছেন না। মেয়েটা যখন জানবে তখন কি ওর সামনে দাঁড়ানোর অবস্থা থাকবে? বছর চার আগে নাহিয়ানকে যখন ঐশীর ফুপু রেশমার সঙ্গে দেখা করিয়েছিলেন তখন বুদ্ধিমান ছেলেটা নিজে থেকেই কিছুটা তাদের সম্পর্কে আন্দাজ করেছিল৷ তারপর তিনি যখন নিজে থেকে জানান, প্রথম ক’টা দিন নাহিয়ান ভার ভার হয়ে চলেছে তার সঙ্গে৷ তবে কিছুদিন যেতেই সে মেনেও নিয়েছে৷ এদিক থেকে জারিফ সাহেব ভয়ে ছিলেন যে নাহিয়ানই বেশি ক্ষিপ্ত হবে হয়তো৷ কিন্তু ছেলেটা বোধ হয় বাবার একাকীত্বের সঙ্গী থাকা জরুরি এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তাই বলে নাহিয়ান আর মাহিয়ানের মা বেঁচে থাকাকালীনই যে তিনি বাইরে কারও সাথে জড়িয়ে পড়লেন এ ব্যাপারেও নাহিয়ান নির্বিকার থাকবে সেটা আশা করেছিলেন না। কিন্তু মাহি মাতৃভক্ত মেয়ে। ওর কাছে বিয়ের ব্যাপারটা উল্লেখ করা গেলেও ওদের মা বেঁচে থাকতেই সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি, এ কথা কোনোভাবেই বলা যাবে না ওকে। মুখে কখনও না বললেও তিনি দু’ছেলে মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসেন। কম বেশি পার্থক্য করা যাবে না সেই ভালোবাসাতে। সেই মেয়ের মনে তার জন্য ক্ষোভ, অভিমান সহ্য করতে পারলেও ঘৃণাটা নিতে পারবেন না। তাই গম্ভীর গলায় নাহিয়ান আর ঐশীকে আদেশ করলেন, ‘আমার আর রেশমার পরিচয় তোমাদের মা বেঁচে থাকতেই যে ছিল এটা জানানোর প্রয়োজন নেই মাহিকে।’

ঐশী তখন বলল, ‘ঠিক আছে৷ সেটা না জানল৷ কিন্তু ফুপি আসছে খুব শীঘ্রই। তাই ফুপিকে যাতে মায়ের মর্যাদাটা দেয় মাহি তেমন করে ওকে আপনাদের বোঝাতে হবে। আমার ফুপি আর কত স্যাক্রিফাইজ করবে? মাহি আর নাহিকেই সে নিজের সন্তান ভেবে আসছে। আপনার কথা মতো যার জন্য সে নিঃসন্তান থেকে গেল। তাকে আর কষ্ট পেতে দেবেন না প্লিজ৷ নাহি, তুমি তো জানো ফুপি তোমাকে কী পরিমাণ ভালোবাসে!’

-‘হুঁ।’

-‘অবশ্যই মাহিকে বোঝাব৷ আমার মাহি আমার জন্য হলেও রেশমাকে কখনও অমর্যাদা করবে না। ও বাসায় ফিরলেই ওকে জানাব আমি সবটা।’

অথচ মাহি ছাদের প্রবেশদ্বারে খাড়িয়ে ইতোমধ্যে ওদের কথোপকথন শুনে নিয়েছে। বলা যায় ঐশী শুনিয়েছে৷ ওদের চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কৈফিয়ত চাইবার ইচ্ছা, শক্তি কোনোটাই হলো না৷ মুমূর্ষু মনটা এবার ওর পুরোপুরিই মেরে দিলো বাবা আর ভাই মানুষটা৷ কাছের মানুষের থেকে একের পর এক আঘাত আর তাদের বেঈমানী রূপ! বারবার সইতে হবে এমন অভ্যাসটা করে রাখলে হয়তো খুব উপকার হতো ওর জন্য।

দুর্বল পায়ে হেঁটে মাহি নেমে গেল ছাদ থেকে। ঐশী বক্রচোখে তাকিয়ে সেটাও দেখতে পেলো৷ মাহি ফোন করবার পরই এই পরিকল্পনাটা করে রেখেছিল ও৷ ভুলতে পারেনি মাহি আর আশফিকের করা সেদিনের অপমান। মাহির প্রতি সীমাহীন ক্রোধটা দমিয়ে রাখতে পারলেও নিবারণ হয়নি সেই ক্রোধ৷ যা এতদিন পুষে পুষে রেখে পরিকল্পনা আর সুযোগের অপেক্ষা করে গেছে ওকে জ্যান্ত রেখেও নিষ্প্রাণ করে দেওয়ার। অফিসে ঢুকেই রিসিপশন ডেস্কে বসে থাকা মেয়েটাকে তাই আগেভাগেই বলে এসেছিল যেন মাহি আসার সঙ্গে সঙ্গেই ওকে ফোন করে জানায়৷

লিফটটা বন্ধ হতেই মাহি ক্ষীণ পল স্থানু থেকে আচমকা মাঃ বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। আজ মনে হচ্ছে আল্লাহ পাক ওর মা’কে ভীষণ ভালোবাসেন৷ স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতা যাতে সহ্য করতে না হয় তাই নিজের বান্দাকে জলদিই তিনি নিজের কাছে নিয়ে গেছেন। মা বেঁচে থাকলে বাবার এই হীন চরিত্রের কথা জানলে কতটা কষ্টটা পেত সেই উপলব্ধিটা করতে পেরেই মাহির বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে আসছে। মাথা দু’হাতে চেপে ধরে নিচে জাপটে বসে আর্তনাদ করতে থাকল ও৷ বাবা বিয়ে করে নিয়েছে এমন ইঙ্গিত জিহাদ কবির আগেই দিয়েছিলেন৷ কিন্তু এই সত্যিটা নাহিয়ানও চার বছর ধরে জেনে আসছে আর সেই মহিলার ভাতিজিকেই সে বিয়ে করে এনে ঘরে তুলেছে! ভাইয়ের এই বেঈমানীটাও ও মানতে পারছে না। মা’কে কি তবে ও-ই শুধু ভালোবাসে? ভাইয়ের কি একটুও বাবার অপরাধটাকে অপরাধ মনে হয়নি? নাহ, হয়নি বলেই তো কত অনায়াসে দ্বিতীয় মা’কে মেনে নিয়েছে আর তার ভাতিজিকেও বউ করে আনতে পেরেছে৷ আপনজনদের বদলে যাওয়া, বিশ্বাসঘাতকতা আর মর্মবেদনা সহ্য করা কতটা মুশকিল তা বোধ হয় শুধু ও-ই অনুভব করল।

সেই সহকর্মী লিফট ব্যস্ত পেয়ে সিঁড়ি বেঁয়ে ছাদে উঠে গেল আর অন্যপাশ থেকে মাহি লিফট থেকে বের হলো। শরীর টলছে ওর, বুকের বাঁ পাশটাই চিনচিন করে একটা ব্যথার উদ্রেক হচ্ছে৷ তবুও আর মন্থর পায়ে না হেঁটে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে।

সবুজ নামের সহকর্মীটা ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে ছাদে পৌঁছলে মাহিকে সেখানে দেখতে পেলো না। নাহিয়ানদের কাছে এগিয়ে ট্রেটা টেবিলের ওপর রাখতেই ঐশী জিজ্ঞেস করল, ‘এটা অর্ডার করা হলো কখন?’

-‘মাহিয়ান ম্যাম এসেছেন তো। উনিই বললেন। সাথে এই যে ব্যথার ট্যাবলেটটাও নিয়ে আসতে বললেন।’

জারিফ সাহেব আঁতকে ওঠা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কই? এখানে তো আসেনি!’

-‘কিন্তু আমার সামনেই তো লিফটে উঠল। আমি জানিয়েছিলাম আপনারা রুফটপে আছেন।’

নাহিয়ান মাথায় হাত দিয়ে বসল। জারিফ সাহেবও বুঝতে পেরেছেন মাহি তাদের কথা সবই শুনেছে। এভাবে তো তিনি কখনওই মেয়েকে এই সত্যিগুলোর মুখোমুখি করতে চাননি! কেমন অবস্থায় আছে এখন তার মেয়েটা? সবুজের হাতে ব্যথার ওষুধটা দেখে এও খেয়ালে এলো, নিশ্চয়ই ভীষণ অসুস্থও ছিল মাহি। কোনোভাবে কি নিঝুম দ্বীপে গিয়ে আহত হয়েছিল?
____________________ ____________________

গাড়িটা নিয়ে মাহি কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে, এমন কোনো আত্মার কাছের মানুষের অভাববোধ করে গুলশান লেকে এসে বসে আছে সেই দুপুরবেলা থেকে। সাঁঝ ঘনিয়ে এসেছে প্রায়৷ লাগাতার ফোন বেজে চলেছে ওর। জিহাদ সাহেবের বাসায় যেতে হবে ঠিক সন্ধ্যা ছ’টায়৷ সেই হুঁশও নেই৷ বুকের সেই ব্যথাটা কখনও কমছে, কখনও বাড়ছে৷ তবুও ওই একই জায়গাতেই অনড় ও৷ এমনিতেও ওর মনে হচ্ছে ওর মৃত্যুর ক্ষণ খুব কাছে আর যেখানে সেখানে পড়ে থেকে মরবে ও, তা নিশ্চিত৷

ফোনটার কম্পন বন্ধ করার জরুরিবোধ করল এবার৷ দুপুর থেকে ঘণ্টা দুই অনর্গল বেজে তারপর থেমে গিয়েছিল৷ আবার বাজতে আরম্ভ করেছে। পকেট থেকে বের করে ফোনের স্ক্রিনে দিব্যর মেসেজ পেলো। খুব দরকারি কথা বলতে চায় সে৷ এতক্ষণ ও-ই কল করছিল। কতক্ষণ মনোবিকারশূন্য দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দিব্যর কল এলো আবার। ইচ্ছেও করল দিব্য কী বলতে চায় তা শুনতে৷ আসল কথা হলো, দিব্য যত সময় কথা বলবে তত সময় ওর মনোযোগটা ওই কথাতেই থাকবে৷ ক্ষণিকের জন্য হলেও মনটা ওই বেঈমানদের কথা ভুলে থাকতে পারবে।

-‘বলো দিব্য। কী খবর?’

-‘তুমি কি খুব ব্যস্ত ছিলে? রিসিভ করছিলে না যে!’

-‘তেমনই। কী হয়েছে বলো? তোমার কণ্ঠ কেমন যেন শোনাচ্ছে৷ কাঁপছে কেন? জ্বরটর লেগেছে না কি?’

দিব্য ওপাশে হঠাৎ নীরব হয়ে গেল৷ মাহিও একটু সময় দিলো ওকে। হয়তো কথা গুছিয়ে নেওয়ার জন্য সময় নিচ্ছে ভেবে। প্রায় মিনিট দুই গড়াল দু’জন মৌন হয়ে আছে৷ অবশেষে দিব্য কান্নাজড়িত নিস্তেজ গলায় বলতে শুরু করল, ‘আমি আমার জন্মদাত্রীকে হারিয়েছি যখন পাঁচ বছর বয়স। বাবা দাদার কথাতে দ্বিতীয় বিয়ে করল আমাকে দেখাশোনা করার জন্য। মা’কে বিয়ে করে আনার পর থেকে আমি নিজেই তাকে মা বলে ডাকতাম। মাও আমাকে আপনই করে নিয়েছিল। কিন্তু বছর তিন পর যখন আমার ছোটো ভাই জন্ম নিলো তখন থেকে মায়ের ব্যস্ততা বেড়ে গেল খুব৷ আমাকে চাইলেও সময় দিতে পারত না। এতে আমার মধ্যে রাগ আর হিংসা কাজ করত দীপ্তর জন্য। দীপ্তর যখন দুই বছর বয়স হলো ও অনিভজ্ঞ পায়ে হেঁটে বেড়াত আর সবাই ওকে নিয়ে মেতে থাকত। দিনে দিনে তা আমার সহ্য সীমার বাইরে চলে যাচ্ছিল৷ তাই একদিন সবার অগোচরে ওকে খুব মেরেছিলাম৷ বাঁচা মরার অবস্থায় চলে গিয়েছিল প্রায়৷ সেইদিনের পর থেকে আমার জন্য মায়ের সমস্ত ভালোবাসা নিঃশেষ হয়ে গেল। আমার অবুঝ সময়ের ভুলটাকে মা আজও মাফ করেনি৷ বাবা মারা যাবার মুহূর্তে মা আর ভাইয়ের দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিয়ে যান। দাদাও একজন দায়িত্ববান মানুষ হিসেবেই বড়ো করেন আমাকে৷ সেই সাথে আমি মা’কে কীভাবে খুশি করা যায়, আগের মতো ভালোবাসা পাওয়া যায় মায়ের শুধু সেই সব ভাবনায় বিভোর থাকতাম, চেষ্টাও করতাম। আজও করে যাই সেই চেষ্টা৷ কানাডাতে পড়াশোনা করার জন্য অনেক অর্থ ব্যয়ের দরকার পড়ে আমার৷ যেটা মা প্রথমে দিতে রাজি ছিল না। দাদার অনুরোধেই মা শেষমেশ রাজি হয় আমাকে এখানে পাঠাতে৷ তবে শর্তও থাকে৷ এখানে আসার পর আমাকে আমার ভাইয়ের ভবিষ্যতটা নিয়েও ভাবতে হবে। মানে ভাইকেও কানাডা সেটেল করার ব্যবস্থা করতে হবে। ভাইয়ের জীবন সুনিশ্চিত না করা অবধি আমি যেন স্বার্থপরের মতো নিজের জীবনটা না গুছিয়ে নিই৷ যার অর্থ বিয়েসাদী, বাচ্চাকাচ্চা, এসব আর কী! মা নিজের পছন্দ এবং ইচ্ছানুসারে আমার জীবন গঠন করবে৷ আমি তা শুনে এক পায়ে রাজি হয়ে যাই। কারণ, এতে নিশ্চয়ই মা আমাকে আবার আগের মতো ভালোবাসবে খুশি হয়ে! তোমাকে আমি তোমারও আগে থেকে ভালোবাসি মাহি। না, তুমি কখনও আমাকে ভালোবাসোনি। আমি বেসেছি, আমি বাসি। আমি তোমার জাস্ট পছন্দের তালিকাভুক্ত। কিন্তু আমাকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে যোগ্য ভেবেছিলে, এজন্য আমি কতটা আনন্দ পেয়েছিলাম তা তুমি জানো না। কিন্তু আমি যদি নিজের পছন্দমতো কাউকে নিজের জীবনে জড়াই তাহলে মা মোটেও খুশি হবে না। মা ভাববে আমি সত্যিই স্বার্থপর৷ আমি মায়ের ভালোবাসাটাই চাই শুধু। তাই ভালোবাসা সত্ত্বেও তোমাকে গ্রহণ করতে পারলাম না। আজ এত স্বীকারোক্তি কেন জানো? মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে সে ডিভোর্সি। দু’বছরের একটা ছেলেবাবু আছে তার। মেয়েটা মায়ের বোনের মেয়ে। আমার কাছে মতামত চেয়েছিল। আমি শুধু বলেছি, যদি তোমার মনে হয় আমি তার সঙ্গে ভালো থাকব তাহলে আমি তাকেই বিয়ে করব৷ কিন্তু তোমাকে তো আমার ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দেওয়া বাকি ছিল। যা না জানালে সারাজীবন আমার মনের ভেতর এই চেপে রাখা ব্যর্থ প্রেমটা ব্যথা দিতো। আমার প্রতি তুমি কোনো অভিযোগ রাখবে না তো, মাহি?’

-‘বন্ধু আর একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে অভিযোগ থাকবে, আপনি এতটা বোকা আর এতটা মেরুদণ্ডহীন পুরুষ না হলেও পারতেন।’

-‘হাঃ হাঃ! আমি এই অভিযোগ বিনা আপত্তিতে মেনে নিলাম। ভালো থেকো, আমাদের বন্ধুত্বের যাত্রা এখানেই শেষ হলো।’

-‘ঠিক আছে।’

দিব্য ফোন রাখবার আগেই মাহি ফোনটা রেখে দিলো। আশফিকের কথা খুব মনে পড়ছে। আজকে এই মানুষটার কাছে না যেতে পারলে ও হয়তো মরেই যাবে। মান অভিমান, রাগ, জিদ, অহংবোধ, সমস্ত কিছুর দ্বিধাদ্বন্দ কাটিয়ে হলেও ও নিজের ভালোবাসাকে অন্তত নিজের করেই পেয়েছে। দিব্যর তো এই ভাগ্যটুকু নেই। দিব্যর মনের অবস্থা কী তা ও বেশ বুঝতে পারছে। ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার নির্মম বেদনা সে একবার অনুভব করেছে কি না!

বুকের বাঁ পাশটাই ডলতে ডলতে জিহাদ সাহেবকে কল করল ও। তিনি হয়তো ওর ফোনকলের অপেক্ষায় করছিলেন৷ তাই অবিলম্বেই কল ধরে ফেললেন। ওকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আদেশ করলেন, ‘আমার আরও অনেক দায়িত্ব আছে মাহি। তোমার ওপর নজরদারি করাই আমার একমাত্র কাজ না। লেক থেকে বেরিয়ে এক্ষুনি বাসায় আসো।’

-‘মনিকাকু, আপনি বলেছিলেন পরিবারের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করে আসতে৷ আমার স্বামীও আমার পরিবারেরই একজন। বরং সে-ই আমার একমাত্র পরিবার। আমি আমার স্বামীর ঠিকানা চাই৷ নয়তো আমি ফিরব না।’

-‘তুমি কিন্তু আবারও আমার কথা অমান্য করছ! ভাইয়া অস্থির হয়ে এসেছেন বাসায়৷ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

-‘আমার ফোনে ঠিকানাটা টেক্সট করুন। আমি গাড়িতে উঠছি। আজ রাতটা আমি তার কাছেই থাকব।’

বলেই মাহি ফোনটা কাটল৷ জিহাদ সাহেবের কথা পাত্তায় দিলো না৷ একমাত্র চাচার সঙ্গে জেদাজেদি করাটা নতুন নয় ওর৷ এ কারণে ওর শাস্তিটাও হয় ভয়াবহ পর্যায়ের। কারণ, ভাতিজির এই জিদের কাছে চাচাকে সব সময়ই হার মানতে হয়।

মিনিট তিনের মাঝে মাহির ফোনে লম্বা একটা মেসেজ এলো জিহাদ সাহেবের কাছ থেকে। তিনি যে আশফিককে নিজের দায়িত্বে রেখেছেন তা মাহি আগেই বুঝতে পেরেছিল৷ আশফিকের ঠিকানার সাথে লেখা আছে মেসেজে, ‘তোমার চাচি আর তোমার দু’ভাইও তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা আশা করে আছে কিন্তু আজ রাতে তুমি ফিরবে এখানেই। আমার কথার যেন নড়চড় না হয়।’

কিন্তু মাহি আদেশ বাণীগুলো দেখলই না৷ গাড়ির ড্রাইভারকে নিয়ে ছুটল গাজীপুর। হাওরিয়াচালা, মৌচাকের এক বাংলো বাড়িতে অবস্থান করছে আশফিক।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

লেখা শেষে এডিট না করেই পোস্ট করে দেওয়া, পোস্ট করার পর নিজে পড়ে তারপর এডিট করা আমার অভ্যাস। ধারাবাহিক একদমই শেষ পর্যায়ে। দুই থেকে তিনটা পর্বে শেষ হতে চলেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here