রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৮

0
426

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৮
_________________________

[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

মাত্র ক’টা দিনের জন্য ছুটি নিয়েছিল রায়ান। কিন্তু মাগুরা থানা থেকে কল আসতেই পুলিশের খাকি পোশাকটা গায়ে চড়িয়ে বিয়ে বাড়ির সব কাজ ছেড়েছুঁড়ে ছুটে আসতে হলো ওকে। উৎপীড়নকারী ছেলেটাকে আড়াইশো বেডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মাথার ডান পাশে চেয়ারের বা’ড়িটা লেগেছিল, ছ’টা সেলাই পড়েছে সেখানে৷ তাছাড়া বাম পাশের চোয়ালেও আংটি পরা মুষ্ট্যা’ঘাতে কে’টেকু’টে গেছে। সেখানেও দু’টো সেলাই পড়েছে। ছেলেটি মাগুরা সরকারি কলেজে অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিল। পুলিশ ওর ব্যাপারে আরও খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে সাবেক দলনেত্রীর দলীয় ছেলেদের সাথে ওঠাবসা ওর। নানা জায়গায় মা’রামা’রি, ক’লহ করার সাক্ষ্যপ্রমাণও মিলল। ব্যাপারটাকে এত খতিয়ে দেখার কারণ, রায়ান শিকদার মাগুরা থানার এসআই৷ এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শিকদার পরিবারের নাতনি মাহি। টাকা এবং ক্ষমতাই মুখ্য কিনা! তবে মাহির মুখের বয়ান শুনে আর সেই বাইক দু’র্ঘট’নার ছেলে-মেয়ের স্বাক্ষী নিয়ে আ’হত ছেলেটির বিরুদ্ধে ই’ভ’টি’জিং এবং দা’ঙ্গা’বাজ করার দায়ে কে’সও ঠুকে দিলো। ওর পরিবার থেকেও মাহির বিরুদ্ধে মা’র্ডা’র কে’স দিতে এসেছিল। রায়ানের ক্ষমতাবলে সেই কে’স নেওয়া হয়নি। এর বিনিময়ে ওসি রায়ানের কাছে সোজা ভাষায় ঘু’ষ আদায় করতে চায়। যদিও রায়ান এ বিষয়ে অবগত ছিল। সে প্রস্তুতিও নিয়ে এসেছিল। কেননা মাত্র এ মাসটা পরই জানুয়ারি থেকে গ্রাউন্ড কোর্স শুরু মাহির। বছর তিন বাদেই যে সামরিক বাহিনীতে নিযুক্ত হতে চলেছে তার নামে পুলিশের মা’ম’লা থাকা প্রচণ্ড ঝামেলার ব্যাপার।

রায়ান তাই টাকার বিষয়টা নিয়ে ওসির সঙ্গে আলোচনা করছিল। হঠকারী মাহিকে নিয়ে আশফিক তখন থানাতেই। রায়ান আসতেই ওকে ছেলেটির চিকিৎসা ব্যয় দিতে বলার পর থেকে মাহি নিশ্চুপ। আশফিক রায়ান আর ওসির আলোচনা শোনার জন্য ওদের দিকে এগোতেই টাকার সংখ্যা কানে আসলো ওর। চট করেই থানা থেকে বাইরে এসর তখন জাওয়াদ রায়হানের কাছে কল করল৷ বাবাকে ঘটনার বিবৃতি জানিয়ে ফিরতি কল আসবার অপেক্ষা করতে থাকল৷ মিনিট দশেক যেতেই জাওয়াদ সাহেব কল করে জানালেন মাহির বাবার সাথে কথা হয়েছে তার। যা ব্যবস্থা নেবার তা নাকি তিনিই নেবেন বলেছেন৷

চিন্তাভাবনা নিয়ে আশফিক থানার ভেতর ঢুকতেই ওসির কাছে কল এলো তখন। তটস্থ ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখা গেল ওসিকে। এক মিনিটের কথাবার্তা শেষে ঠোঁট কামড়ে ভাবনাশূন্য মাহির দিকে তাকাল ওসি। চেয়ারে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে চোখ বুঁজে আছে ও। ওর দিকে চোখা দৃষ্টিতে চেয়ে রায়ানকে বলল সে, ‘এ ব্যাপারটা ক্লোজ করি আমরা। প্রয়োজন নেই।’

আশফিক প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল তখন ওসির দিকে। রায়ান জিজ্ঞেস করল, ‘কার কাছ থেকে কল আসলো স্যার?’
-‘ডিআইজি স্যারের থেকে। ঝামেলাটা ছোটো করে ফেলতে বললেন। তোমার তো বিয়ে। বোনকে নিয়ে তাহলে বাড়ি ফিরে যাও। পুরো কাহিনিটা নিজের মতো করে তৈরি করে নেব আমি।’

রায়ানও মাহির দিকে একবার তাকাল। ডিআইজি থেকে কল এসেছে মানে অবশ্যই জারিফ সাহেবের কাছে খবর চলে গেছে। নিজের দাপটে উপরমহল থেকে কল করিয়েছেন তা বুঝতে বাকি নেই৷ কিন্তু খবরটা গেল কী করে? সে তো দাদাকেও জানায়নি৷ বাড়িতে কেউই জানে না। ভাবতেই আশফিকের দিকে নজর গেল। প্রশস্ত শক্তিশালী বুক ফুলিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে আশফিক, চোখের শাণিত দৃষ্টি তখন ওর মাহির দিকে। কথার মাঝে খেয়াল করেছিল ওকে একবার বাইরে যেতে। খবরটা তবে ওর মাধ্যমেই পৌঁছেছে। বি’পদে পড়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য সেও ভুলে গিয়েছিল বড়ো ফুপার ক্ষমতা সম্পর্কে। না হলে এখানে আসবার আগে সে-ই তাকে জানিয়ে আসত। ওসিকে জানাল, ‘এসেছি যখন ব্যাপারটা আমিই মিটমাট করে যাই৷’
আশফিকের কাছে এসে ওদের দু’জনকে বলল, ‘তোমরা বাড়ি যাও। আর আপাতত ঘটনাটা বাড়িতে কাউকে জানানোর প্রয়োজন নেই।’
মাথা নাড়িয়ে আশফিক সম্মত জানিয়ে মাহিকে নিয়ে বেরিয়ে এলো থানা থেকে। গাড়িতে ওঠার কথা মাহিকে বলতে হলো না। সে নিজেই গাড়িতে উঠে ওকে বলল, ‘ফাস্ট এইডের ব্যবস্থা করো। সরাসরি বড়ো নানুর বাড়িতে পৌঁছে দেবে আমাকে।’
ড্রাইভিং সিটে বসে আশফিক ফাস্ট এইডের কথা শুনতেই বুঝতে পারল আ’ঘা’ত মাহিও পেয়েছে। নিশ্চয়ই সে আসার আগে ওদের সাথে ধ’স্তাধ’স্তি হয়েছে। কতটুকু আ’ঘা’ত পেল ও? তা দেখতে মাহির কাছে এগিয়ে আসতেই মাহি হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো, ‘আমি তোমাকে দেখতে দেবো না। যেটুকু করতে বললাম সেটুকু করলেই খুশি হবো।’

ধৈর্য আর অপ্রকাশ্য রাগটুকু এই পর্যায়ে এসে দমিয়ে রাখা আর হলো না আশফিকের। কিন্তু রাস্তার মধ্যেও তা প্রকাশ করতে চায় না সে৷ ফার্মেসি থেকে ঝটপট ওষুধপত্র নিয়ে গাড়িতে ছুটল বড়ো শিকদারের বাড়ি। পথিমধ্যে একটা কথা হলো না দুজনের মধ্যে। মধ্য দুপুরে এসে গড়িয়েছে সময় তখন। বাড়ি পৌঁছতেই আশফিক আর মাহিকে একত্রে দেখে সে বাড়ির লোক ভেবেই নিলো, না হওয়া সম্পর্কটা জোড়া লেগে গিয়েছে নিশ্চয়ই। হঠাৎ করে আশফিকের আগমনে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়তেই মাহি তার নির্দিষ্ট ঘরটাতে এসে ধপ করে বিছানাতে শুয়ে পড়ল। নিমিষেই বন্ধ চোখের দুয়ারে জল ভিড়ল ওর, গড়িয়ে পড়ল চোখের কোণ বেঁয়ে। দম বন্ধ হয়ে আসছে কান্না দমাতে গিয়ে। কতক্ষণ পার হলো যেন এমনভাবে। তারপর হঠাৎ করে দরজা খোলার শব্দ হলো। ঘোর কাটেনি তখনো মাহির। মনের আচ্ছন্ন অবস্থা থেকে বের হতে সাহায্য করল ওকে আশফিক৷ বিছানা থেকে টেনে তুলল আচমকাই। চোখের চাহনিতে মা’রা’ত্মক রাগ আশফিকের৷ তা খেয়াল হতেই দরজার দিকে তাকাল মাহি৷ ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। রুঢ় হতে গিয়েও নিজেকে সামলাল।
-‘হাতটা ছাড়ো। বসার ঘরে না বসে আমার ঘরে এসেছ কেন?’
বিনা উত্তরে আশফিক মাহির গা থেকে চাদরটা টেনে ফেলল, সাদা শর্ট কামিজটার ওপর থেকে মাহির সারা শরীরটা মনোযোগ দিয়ে দেখল একবার। খুঁজে বেড়াল মাহির আ’ঘা’তের চিহ্নগুলো। ওর টলমল চোখের দিকে নিজের ক্রোধপূর্ণ চোখ মেলে শুধাল, ‘কোথায় কোথায় লেগেছে? কেমন লেগেছে সেই আ’ঘা’তগুলো? মা’রপি’ট জানলে আর র’ক্তগ’রম দেখালেই লায়েক হওয়া যায়?’
না চাইতেও ডান চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা পানি পড়ল মাহির, তবু অত্যুগ্র স্বরে আদেশ করল ওকে, ‘যাও তুমি। গোসল করব আমি এখন।’

মাহির হাতটা ছেড়ে দূরত্বে দাঁড়াল ও, ‘যাব তো অবশ্যই। আগের অধিকার তো আর দেখাতে পারব না৷ কিন্তু যা বলতে এলাম তা তো বলেই যাব। এই যে আজকে যে দুঃসাহসী, বেপরোয়া স্বভাবটা দেখালে তার বিনিময়ে কী নমুনা পেলে আর কেমন লাগল সেটা তো শোনাও! যার জন্য গায়ের জোর দেখালে জনসম্মুখে, সেই হ্যা’রা’স’মে’ন্ট থেকে কি রক্ষা পেলে? নোনাপানি তো ঝরলই। একটু বিবেচক হতে মাহি৷ ওই কু’কু’রটার শা’স্তি অন্যভাবে, অন্য সময়েও দেওয়া যেত এমন একটা রিস্ক না নিয়ে। অনার, পাওয়ার না থাকলে পারতে হাজত থেকে আজ বের হতে? আরেকটু বিবেচক হলে কয়েকটা জা’নো’য়া’র পুরুষের বিচ্ছিরি হাতগুলো স্পর্শ করত না তোমাকে, কাঁদতেও হতো না। মাথা গরম থেকেও রেডি উইট বেশি জরুরি মাহি।’

রাগ আর কষ্টটুকু গিলে আশফিক বেরিয়ে এলো ঘর থেকে৷ কিন্তু বাড়ি থেকে চলে আসতে পারল না৷ আজকের দিনটা এখানে কাটিয়ে তবেই যেতে পারবে ও। সবার অনুরোধটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

***
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আর্দ্রবসনের ফাঁক থেকে শরীরের আঁ’চ’ড়গুলোতে হাত বুলাল মাহি। এক সঙ্গে কতগুলো হাত পিষ্ট করছিল ওর কোমল দেহটা।
পিঠে, বুকে, পেটে, হাতে এই দা’গগুলো। এত নোংরা ছোঁয়া ও পায়নি কখনো। ছি’ন্নভি’ন্ন হয়ে আসছে অন্তরটা। কেমন যে অপবিত্র লাগছে নিজেকে, তা কাউকে বোঝানো অসম্ভব! কিন্তু আশফিক কি তা বুঝেছিল? বুঝেছিল হয়তোবা। তাই তো প্রজ্ঞান দিয়ে গেল কত! কিন্তু তাতে কী? সেই যাতনাময় স্পর্শগুলো তো ভুলতে পারছে না। এন্টিসেপটিক ক্রিমটা হাতের মুঠোয় শক্তভাবে চেপে ধরে রইল। মা মারা যাবার পর নিজের বাহ্যিক আচরণে কঠোরতা আনলেও কোমল চিত্তে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি সে৷

ঘণ্টা দুই হতে চলল আশফিক আর দেখা করেনি মাহির সঙ্গে। মাহিও ঘর থেকে বের হয়নি এর মাঝে৷ চাচি আর বোনেরা এসে ক’বার খেতে ডেকে গেছে মাহিকে। তবু আসেনি। আশফিক খেতে পারছে না ওকে ছাড়া। ওর মনের মধ্যে কী চলছে তাও কাউকে বোঝানোর উপায় নেই৷ নিজেই খাবার টেবিল থেকে উঠে মাহির ঘরে এলো। দরজাটা আলগোছে বন্ধ ছিল। মৃদু ধাক্কাতে খুলে গেলে ভেতরে ঢুকে দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে পড়ল।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে মাহি বুকে তোয়ালে জড়িয়ে চেপে ধরে উন্মুক্ত পিঠে বিক্ষিপ্ত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখজোড়া আশফিক ত্বরিতে মুদে নিতেই চকিতে আবার খুলল আর আবারও দেখল মাহিকে। শক্তভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে নিরবে অশ্রু ব্যয় করছে সে। এমন পরিণতিতেই যে দেখতে পাবে ওকে তা তো ও জানতই। তিন মাসে ব্যবধানে মাহিকে ভালোবাসতে না পারলেও ওর অন্তরের ভাষা ঠিক বুঝে নিতে পারত। আর আজও পেরেছে। কী লাভ তাতে? নিজে থেকে অধিকার ছেড়ে পুনরায় তা ফিরে পাওয়া দুষ্কর যে! কিন্তু এই মর্মবেদনাতে একান্ত আপন কাউকে খুব প্রয়োজন মাহির। ও তো আপনই। শুধু মাহি তা ভাবে না। না ভাবুক, তবুও আজ অধিকারটুকু দেখাবে ও।

নিঃশব্দে এগিয়ে মাহির পিছে দাঁড়াতেই ঝপাৎ করে আঁখি মেলল মাহি, আশফিকের সঙ্গে মুকুরের মাঝেই দৃষ্টি মিলিত হলো। স্পষ্ট ভালোবাসার ইশারা প্রাক্তন প্রেমিকের চোখে দেখে লাজ ভুলে ঠোঁট চেপে কেঁদে ফেলল ও। ওই যে কষ্টের সময় আদর, ভালোবাসা বেশি পেলে কেউ কেউ আরও আহ্লাদিত হয়ে পড়ে। মাহিও ঠিক তাই হলো আজ। খুব কাছের যে কেউ নেই, যাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গুপ্ত দুঃখের গল্পগুলো জানাবে। চার বছর পূর্বে শুধু এই পুরুষটিই ছিল।
অনায়াসে ও তোয়ালেটুকু পিঠে জড়িয়ে নিতেই ঘাড়ের নিচটাতে চেয়ে আশফিক অনুমতি চাইল, ‘একটু ছুঁই?’
-‘না।’ ভারী গলায় অত্যন্ত একগুয়ে জবাব মাহির।

শুক্রবার আর মঙ্গলবার ধারাবাহিক আসবে এখন থেকে।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here