রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৯

0
489

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৯
_________________________

[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

অন্তরতম অঁচলে শরীরের আঁচড়গুলোর কদর্য প্রভাব নিদারুণ ভুগাচ্ছে মাহিকে। চোখের ঝাঁপি নামলেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ওকে, পবিত্রতা ওর দেহকে ত্যাগ করেছে আরও বছর চার পূর্বে। বিশ্বাসের মর্যাদা না রাখার অপরাধ আশফিককে দিলেও, নিজেকে ওর কাছে সঁপে দেবার কলুষযুক্ত অপরাধতো ও-ই করেছিল। পুরুষ মানুষের নৈতিকতা কতক্ষণ চলে যদি নারী আপনাতেই ধরা দেয়?

জনসম্মুখে আপত্তিকর স্পর্শগুলো ছিল ওর বিনা অনুমতিতে আর আশফিকের ঘনিষ্ঠতা ছিল ওর পূর্ণ আশকারায়। পার্থক্য কেবল এটুকুই। আজ সেই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলো কল্প জগতে এসে হাজির হতেই মনে হচ্ছে অশুভ প্রতিকৃতির কোনো শয়তান ডান ঝাপটে এসে দাঁড়াল ওর অতি সংস্পর্শে। আজ সত্যিই আশফিকের সেই প্রকৃত প্রেম ছাড়া কামপরবশ স্পর্শগুলো এতখানিই ঘৃণ্য আর পাপ লাগছে। পথের মধ্যে অত্যন্ত নোংরা পরিস্থিতির শিকার হওয়া বুঝি তাহলে সেই পাপের ফল!

দৃষ্টি ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা ব্যাপক, হৃদয়ের সকল কথা প্রকাশের অন্যতম এক উপায়। তা মাহির ঈষৎ রক্তরাঙা স্পন্দিত চোখজোড়ায় দৃষ্টান্ত৷ সেখানে পূর্ণ উন্মেষ হচ্ছে ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধের! এ ক’টা দিনে আশফিক দেখেনি এ ক্রোধ মাহির চোখে।
-‘কার প্রতি এ ধিক্কার?’ অকপট স্বরে মৃদু সুর তুলে জিজ্ঞাসা আশফিকের।
দ্ব্যর্থক বাক্যে জানাল মাহি, ‘আমার এবং আমার আত্মার প্রতি।’
-‘আত্মা?’
-‘তুমি!’
-‘কী?’
-‘বেরিয়ে যাও তুমি।’
আষাঢ়ের মেঘমেদুর যেন ছেয়ে দিলো বক্ষঃস্থলের অলিগলি, গোলাপী আভার চারু মুখটা বিষাদভারাতুর করে তুলল আশফিকের। কিন্তু অতীতদিনের মাহির ওপর থাকা একচ্ছত্রাধিপত্যের করুণ অভ্যাস ছেড়ে দিতে অরাজি সে। দু’জনের মাঝের সামান্যতম ফাঁক মিলিয়ে দিয়ে কাটাকাটা শক্ত চোয়াল যেন আরও দৃঢ় করে অবাধ্যতা দেখাল, ‘ক্ষতিপূরণ অন্যভাবে চাও, সমস্ত পরিশ্রম দিয়ে হলেও তা পূরণ করব। ক্যারিয়ারকে মাঝপথে ছেড়ে এসে যা অর্জন করতে এসেছি তা জয় না করে ফিরব না।’
-‘যেমনটা চারটা বছর আগে জয় করেছিল, রাইট?’ আবারও শ্লেষোক্তি মাহির।
হতাশার নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের মধ্য থেকে, চলে যেতে গিয়েও দোরমুখে দাঁড়াল একবার, ‘বুঝেও অবুঝ তুমি, মাহি। মনকে লোহার শিকলে আটকেছ। যেটা তুমি ছাড়া আর কারও খোলার সাধ্যি নেই। তাতে তোমার মনটাই ভেঙেচুরে থাকবে বেশি।’

***
নিজনান্দুয়ালী এলাকার নতুন ব্রিজটা রাতের বেলা বেশ জমজমাট, তার কাছাকাছিই মূল শহর। আশেপাশে রেঁস্তোরা গড়ে উঠছে অগণিত। তবে ইদানিং সব থেকে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে একটা খোলামেলা কফিশপ। ব্রিজের নিচে নবগঙ্গা নদীর চড় পড়ে থাকা জায়গাটুকুতে কফিশপটা তৈরি হয়েছে। সামনে নদীর ছলছলানি পানি, সেই সঙ্গে তীব্র বয়ে চলা বাতাসের শনশন আওয়াজ। আর কফিশপটা ঝিলিক দেওয়া মরিচ বাতিতে হয়ে আছে ঝলমলে।

আশফিকের দলটা আজ বিকালে এসে বসেছিল ওখানে। মাগরিবের আজান দিলে সালাত আদায় করে এসে চার বন্ধু আবারও ওখানটাতেই বসল। ব্রিজের ওপর ফুচকা, চটপটিও দেখা যায়। জারিনদের নিয়ে এলেও মন্দ হতো না। তবে তারা বোধ হয় বাইরে ঘুরাঘুরি থেকে মাহি আর রুমকির সঙ্গে থাকতে পেরেই বেশি আনন্দিত।

কফির কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে হৃদয় জিজ্ঞেস করল আশফিককে, ‘দিলিশা কবে আসছে রে?’
ভাবলেশহীন উত্তর দিলো ও, ‘যেদিন ঢাকা ব্যাক করব সেদিন।’
-‘মানে বিয়েতে আসছে না?’
-‘বিয়েতে আসবে কেন? ও কি ইনভাইটেড?’
-‘আহা! রুমকি ইনভাইট করল না কেন? একটু বেশিই অপমানিত হলো মেয়েটা।’
সৌরভ ধূমপানে ব্যস্ত ছিল, ফিল্টার ফেলেই সেও কফির কাপটা ধরল, প্রশ্ন ছুঁড়ল হৃদয়কে, ‘দিলিশাকে নিয়ে এক্সাইটেড কেন তুই?’
হৃদয়ের মুখের উত্তর কেড়ে নিয়ে পরাগ জানাল, ‘মনে ধরেছে নাকি ওকে।’
আশফিক ভ্রু কুটি করে ফেলল, জহুরী চোখ করে দেখল ওকে একটুক্ষণ। তবে কিছু বলল না। বলল সৌরভ, ‘মেয়ে আশফিকের গলায় ঝোলার জন্য লাফাচ্ছে আর তুই ওর লেজ ধরে টানাটানি করছিস!’
-‘সারাজীবনের জন্য না তো। লন্ডনের সিটিজেনশিপটা ধরিয়ে দিলেই ওর লেজ ছেড়ে দেবো।’
-‘ইয়ার্কি মারিস না। তোর মধ্যে কী আছে যে তোকে বিয়ে করতে চাইবে?’ পরাগ জিজ্ঞেস করল।
প্রশ্নটা সাদা মনে করলেও হৃদয়ের মনটাতে বেশ আঘাত করল। লম্বাতে সে আশফিকের কাছাকাছিই, তামাটে গোত্রবর্ণ, মুখের আদল গোলগাল। কিন্তু ঘন চাপদাড়িতে ছেলেটাকে একটুও মানায় না। একদম ক্লিন শেইভই মানানসই ওর জন্য। মাথা ভর্তি ঢেউ খেলানো চুল আর ভাসা ভাসা দু’টো চোখ। ভবঘুরে হলেও তার মধ্যে কোনো কিছুর বদ অভ্যাস বলে কোনো ঝামেলা নেই। ধূমপান করে না বিধায় পাতলা ঠোঁটদু’টি ছোটো বাচ্চাদের মতোই লাল রঙা এখনো। এত সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে চেহারাখানা ফেলে দেবার মতো নয় নিশ্চয়ই! তীব্র ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠল তাই, ‘আমি কি দেখতে খারাপ? আমাকে ওর পছন্দ হবে না কেন? ওর দেশের বৃটিশ মালগুলোর থেকে অ্যাট্রাক্টিভ লুক দাঁড়াবে আমার, যদি পারফেক্ট কেয়ার নিই নিজের।’

আশফিক এই আলোচনার মাঝে শ্রোতা ছাড়া বক্তা হতে অনিচ্ছুক। সৌরভ হৃদয়ের রাগের কারণটুকু বুঝতে পেরে ওকে বোঝাতে চাইল, ‘ওরে ভাই তুই না বুঝেই চেতিস কেন? স্কুল থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত সুন্দর মেয়েদের কাছে তোর ডিমান্ড কত তা তো আমরা জানি। তবে ব্যাপারটা হচ্ছে তুই সুন্দর৷ কিন্তু এইরকম সুন্দর আমাদের দেশে অহরহ। যেটা দিলিশার মতো মেয়ের কাছে আমাদের দেশের ভাষায় ভাত-মাছ। কিন্তু জারিনের মতো মেয়ের কাছে বিরিয়ানি৷ যদিও বিরিয়ানি জারিনের পছন্দ না।’

এই কথার পর আশফিক চুপ থাকতে পারল না। শুরুতে একটু অদ্ভুত শব্দে হেসে ফেলল, তারপর হাঃ হাঃ করে হাসতে থাকল। আর পরাগের হাসি বহাল থাকল ঠোঁট টিপে রাখা পর্যন্ত। বাইরে মানুষের মধ্যে হৃদয় গালাগাল করতে চাইল না তাই ঠান্ডা সুরে হুমকি দিলো, ‘খ্যাপাবি না বলে দিলাম। আমি ইনটেক, বিয়েশাদি করলেও করব আমার মতোই ইনটেক মেয়েকে। আর তোদের আক্কেল হলো না। এত মেয়ে থাকতে ওকে নিয়ে খ্যাপাস কেন? ওর কি তালাক হয়েছে? আজ না হলেও কাল ওই স্বামীর ঘরেই যাওয়া লাগবে ওর।’
কথার মারপ্যাচে ফেলতে পরাগ বলে উঠল, ‘না গেলে তোর ঘরে পাঠাব, ঠিক আছে?’
বলেই ওরা তিনজন আবার আগের মতো হাসতে থাকল৷ ক্রুদ্ধ গলায় হৃদয় বলল, ‘শালা তোর ঘরে নে। তুই পাক্কা ঈমানদার পুরুষ। দুই বউ এক বিছানায় নিয়ে ঘুমাবি, দুইজনকেই এক সময়ে পোয়াতি বানাবি।’
-‘হেইত্! কথার লাগাম টান ফাতরা শালা। কোথার থেকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছিস?’ আশফিক জোরালো গলায় ধমকাল।
-‘আমার মেজাজের লাগাম তোরা ছুটিয়ে দিয়েছিস। ইয়ার্কি যা নিয়ে করা যায় না তা নিয়ে করবি কেন?’
-‘করা যাবে না কেন? জারিনও আমাদেরও কলিজার আর তুইও। মোটামুটি সবাই আমরা জীবনের লক্ষ্যের কাছাকাছি। কিন্তু তুই কী করছিস? লন্ডন যাবার জন্য তোর দিলিশার লেজ ধরতে হবে কেন? তোর কি সুযোগ ছিল না? তুই হাতছাড়া করলি কেন যখন ম্যানচেস্টার ইউভি থেকে তোকে সিলেক্ট করল? তুই কি মনে করেছিস আমরা বুঝিনি তখন তোর ছন্নছাড়া হয়ে যাবার কারণটা কী?’
কথা আরও বলতে চাইছিল আশফিক, কিন্তু হৃদয়ের তপ্ত মেজাজের তোপে পড়ে আর এগোতে চাইল না কেউ।
-‘আলতু ফালতু রিজন দেখাবি না খবরদার! আমি তোদের মতো লাইফের গোল নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম না, এখনো নাই। আমার লাইফে আমি ব্যতিত আর কারও বাহাদুরি মানতে পারব না বলেই পার্মানেন্ট রিলেশন, চাকরি, সব কিছু থেকে দূরে আছি আর থাকবও। আমার জীবন কীভাবে চলবে তার ডিসিশন আমার আর চিন্তাও আমার। কারও দখলদারি সহ্য করার মতো ধৈর্য আমার নাই।’
তর্ক বিতর্কে যখন যাবার প্রয়োজন ছিল তখনই কেউ যায়নি। আর এটাই আশফিকদের বড়ো ভুল। আশফিক চলে গেল বহুদূরে, পরাগ ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের বৈবাহিক জীবন নিয়ে৷ এদিকে সৌরভ আর সাদিয়া বাকি বন্ধুদের আগ্রহ না দেখে জীবনের লক্ষ্য থেকে হৃদয়ের ছিটকে পড়া এবং জারিনের হঠাৎ বিয়ের সিদ্ধান্ত, এ দুই ব্যাপারে নাক গলায়নি ওরা। কিন্তু ওদের ভুলটাই এই দুজন বন্ধুর জীবনকে হয়তো এলোমেলো করে দিলো। ভুল সিদ্ধান্তের সময় যদি পাশে দাঁড়ায় আপনজন আর শুভাকাঙ্ক্ষী, তাদের মানসিক সহায়তা পেলে একজন মানুষ সঠিক পথ আর সঠিক সিদ্ধান্তকে ঠিক বেছে নিতে পারে। আফসোস, জারিন আর হৃদয় এমন কাউকেই পায়নি জীবনের চূড়ান্ত মূল্যবান মুহূর্তে।

রাত বেজে গেছে এরই মাঝে সাড়ে আটটা। শিকদার বাড়ি থেকে কল আসছে আশফিকের কাছে। উঠে পড়ল ওরা। তবে আশফিক ভেবে রেখেছে ফিরে যাবার আগে হৃদয় আর জারিনের অগোছালো জীবনটার একটা না একটা সমাধান করেই যাবে। আজকে মাহির বলা একটা কথা মনে পড়ছে খুব। লন্ডন চলে যাবার আগে মাহির সঙ্গে যে রাতটাতে শেষ দেখা হয়েছিল, যে রাতটাতে ওদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল, সে রাতটাতে মাহি বলেছিল, ‘স্বার্থপর শ্রেণীর মানুষের যদি কোনো কাতার থেকে থাকে তাহলে তুমি প্রথম কাতারের স্বার্থপর, আশফি।’ কথাটাকে আজ ধ্রুব সত্য বলেই মনে হচ্ছে ওর।

***
আজ দুপুরের পর মাহি আর ফিরে যায়নি ছোটো শিকদার বাড়িতে। যার জন্য জারিনরাও এখানেই চলে আসতে বাধ্য হয় বিকেল বেলাতে। তারপর সারাটা সময় ওরা মাহিকে আগলে আগলে নেয়। কিন্তু সন্ধ্যা হতেই ওরা ফিরে যায় আবার রুমকির কাছে। তবে আশফিক ছোটো শিকদার বাড়ি থেকে নৈশভোজ সেড়ে শুধুই মাহির জন্য ফিরে আসে মেজো শিকদারের বাড়িতে। পাশাপাশি ঘরেই দুজনের রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা হয়। রাত বাড়ার সাথে আশফিক ধীরে ধীরে শুনতে পায় নিশি রাতের গল্প চলছে ওর পাশের ঘরটাতে। গল্পকার তারই হৃদয় আঙিনার প্রথম ও শেষমাত্র নারী। কিন্তু সে নারীর গল্পগুলো আজ শুধু একজনের জন্যই। যে গল্পতে কারও ভয়ে কোনো লুকোচুরি নেই, ফিসফিসানি নেই, লাজ নেই৷

একটা সময় ছিল মাহি যখন আশফিকের সঙ্গে রাতে গল্প করত, তখন মাহি খুব সহজে গল্প খুঁজে পেত না। আশফিক বলত আর ও শুনত। যদি জিজ্ঞেস করত আশফিক, ‘এত বকবক করা যায় না, যদি আরেকপাশের মানুষ প্রসঙ্গ খুঁজে না পায়। তুমি কোনো গল্প বলো না কেন মাহি?’ এর উত্তরে মাহি বলত, ‘আমি চেষ্টা করি। কিন্তু খুঁজে পাই না কী গল্প করব। তাই তুমি বলো আমি শুনি।’ তারপর হঠাৎ আশফিক দুষ্টুমির শীর্ষে গিয়ে বলত, ‘তাহলে চলো কল্পনা করি আমরা। কোনো গল্প করতে হবে না। তুমি চোখ বন্ধ করে ভাবো আমি তোমার ঘরে আর তোমার খুব কাছে, এক পর্যায়ে আমার ঠোঁটদু’টো আকস্মিক তোমার দুই ঠোঁটে মিশে গেল, একদম ভেজা চুমুর বর্ষণ চলছে। আরও ঘনিষ্ঠ লীলাময় মুহূর্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।’ তখন মাহির কণ্ঠ থেকে কোনো শব্দ আসতো না, শুধু ঘন নিঃশ্বাসের বাড়ি খেত ফোনের স্পিকারে। আর ওপাশে আশফিক বিছানাতে গড়িয়ে মিটিমিটি হাসত। কোনো কোনো সময় মাহির লজ্জা মাখা মুখখানি দেখবার জন্য ভিডিয়ো কলেও চলে আসত। আবার কিছু কিছু সময় ভিডিয়ো চ্যাটেও আশফিক কতভাবে যে মাহিকে লজ্জার মুখে ফেলে নাস্তানাবুদ করত!

অথচ আজকের মাহির কণ্ঠে আছে শত বুলি, গল্পের ফুলঝুরি। শুধু নেই সেদিনের লাজুকতা। ফোনের ওপাশের দিব্য ছেলেটিও কী অনায়াসে খোলামেলা গল্প শোনাচ্ছে আর মাহিও তাকে ফিরতি জবাব দিচ্ছে সেসব কথার। ওদের এই সম্পর্ক খুবই ভিন্ন৷ যা আশফিক আর মাহিয়ান নামের মানুষদু’টোর সম্পর্কের উলটো একদম। এই দুইজন মানুষের সম্পর্কে শুধু টুকরো টুকরো অনুভূতির ছোটাছুটি ছিল, ছিল হঠাৎ হঠাৎ দুজনের মধ্যে কাছাকাছি আসার অপ্রকাশ্য তৃষ্ণা, না বলেও মাহিয়ানের হাজার মনের কথা আশফিকের বুঝে নেওয়া আর সম্পর্কটাকে ধীরে ধীরে গাঢ় করা।

দিব্য আর মাহির নিঃশেষ গল্পগুলোর জন্য আর্তনাদের উচ্চ ধ্বনি আশফিকের অন্তর্দেশ কাঁপিয়ে তুলছে, শুধু তা মাহিয়ানই শুনতে পায় না, মেয়েটি শুনতে চায়ও না। এক দেওয়ালের ব্যবধানে আশফিকের হাহাকার মাহির শ্রুতিগোচর কি করা উচিত নয়? সুদূর বিদেশে থাকা পুরুষটির ফোনালাপ একটুখানির জন্য বিরতি দিয়ে হলেও মাহি শুনুক আশফিকের আত্মার কান্না। সে কান্না জাগিয়ে তুলুক বুকের অভ্যন্তরে ঘুমিয়ে থাকা আশফিকের প্রতি মাহির প্রেম। খুব করে চায় তা আশফিক।

রাতের গভীর তখন পৌঁছেছে দু’টোর ঘরে। দিব্য অহংবোধ তাড়িয়ে ফের ফিরে এসেছে মাহির কাছে। তাই আজ গল্প চলছে দুজনের মাঝে সীমাহীন। এমনিতেও মাহি দিব্যর সঙ্গে কথা বলার সময় চাপা স্বরে কথা বলে না। কিন্তু আশফিক আজ পাশের ঘরে বলেই সমস্ত কথা স্বাভাবিকের থেকেও উচ্চ স্বরেই বলছিল। একটা সময় গল্পের তালে আশফিককে ভুলে গিয়ে গভীর আলাপনও করে চলেছে সে।

ঘর থেকে বেরিয়ে আশফিক বেশ ক’বার মাহির ঘরের সামনে থেকে ঘুরে গেছে, কিন্তু দরজাতে কড়া নাড়বার সাহসটা হয়নি৷ ধৈর্য বলেও তো একখানা শব্দ আছে! পুরুষ মানুষ সেই ধৈর্যের খেলাতে একান্ত আপন নারীর ক্ষেত্রে কখনোই প্রশংসা পায় না৷ এ কথার প্রমাণ বহু আছে।

রাত ঢের বলে একটু আস্তেই মাহির দরজাতে ঠকঠক করল সে। হদিস নেই দরজা খুলবার৷ অপরিহার্যভাবে আওয়াজ তুলে অবশেষে কড়া নাড়ল ফের। গল্পে মশগুল মাহি হঠাৎ দরজাতে জোর আওয়াজ পেয়ে আঁতকেই উঠল৷ তবে ধারাল মস্তিষ্ক বলে কয়েক পলেই বুঝে নিলো ও, দরজার ওপাশের ব্যক্তি কে হতে পারে। রুক্ষ হচ্ছে ধীরে ধীরে কড়া দেবার আওয়াজ৷ এভাবে চলতে থাকলে পাশের ঘরের মানুষগুলো জেগে যাবে চকিতেই। দিব্যকে বিদায় দেবার ফুরসতও পেল না যখন দরজার ওপাশ থেকে কিড়মিড়িয়ে ডেকে উঠল আশফিক, ‘মাহি! ওপেন দ্য ডোর।’ বিনা নোটিশে কলটা কেটেই মাহি ঝটপট দরজা খুলে দিলো। আর তার থেকেও ঝটপট গতিতে আশফিক ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here