রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৬.১

0
437

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৬.১
____________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও কঠোর মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

-‘এই এই দাঁড়াও দাঁড়াও!’ টেনে ধরল মাহি আশফিকের বলিষ্ঠ হাতটা। স্বচ্ছ আকাশের মতো চোখদু’টোই ছেয়ে যাওয়া বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী বললে? বিয়ে করছি মানে?’
হাতটা আবারও ধরে আশফিক হাঁটতে শুরু করল, ‘মসজিদে বিয়ে করে নেবো আজকেই আমরা। তিন মাস পরিবারের ব্যস্ততার কারণে আমাদের বিয়ে আটকে থাকবে তা মানব না। আমরা আজকেই বিয়ে করে নিজেদের মতো থাকব, মাঝেমধ্যে সংসার সংসার ফিলও নেবো এক সঙ্গে থেকে। বাড়িতে কেউ আমাদের এই বিয়ের ঘটনা জানবে না৷’

বলতে বলতে চলে এলো ওরা মসজিদের সামনে। ভেতরে প্রবেশ করবার সময় মাহি আশফিকের হাতটা জাপটে ধরল। সে এখনো একমত হতে পারেনি এ সিদ্ধান্তে।
-‘এভাবে বললেই হয় না কি? আর এত দ্রুত বিয়ে করে নেবার ঝোঁকইবা কেন উঠল তোমার?’
সরল চোখে চেয়ে জবাব দিলো আশফিক, ‘শুভ কাজ জলদিই সাড়তে হয় আর যে সম্পদ আমার নামেই লিখিত হবে তা বিলম্ব করে অলিখিতভাবে ফেলে রাখব কেন? মূল্যবান সম্পদ যত দ্রুত সম্ভব নিজের কাছে নিরাপদে এনে রাখব।’

এই কণ্ঠে একটুও কপটতা নেই। কথাগুলো খুব গোছালো হলেও মাহির মনে হলো এ কথা কোনো আতিশয্যপূর্ণ নয়। শক্ত করে ধরে রাখা নিজের হাতটার দিকে চেয়ে বিশ্বাস করে নিলো, চিরকালের জন্য এভাবেই ভালোবেসে বেঁধে রাখবে তাকে আশফিক।
-‘কিন্তু এভাবে মসজিদে বিয়ে হয় না কি?’
-‘কেন? ওই যে হচ্ছে তো মসজিদের ভেতরে। না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতাম না।’
-‘সত্যি!’
এসব ব্যাপারে ওদের জ্ঞান পরিসীমাও শূন্য প্রায়। তাই ভীষণ অদ্ভুতই মনে হচ্ছে ওদের কাছে। কিন্তু মাহির মনটা বিশ্বাস করতে পারছে না এভাবে আদতে ওদের বিয়েটা শুদ্ধ হবে কি না?

মসজিদের সিঁড়িতে পা রাখার পূর্বে আবারও পিছটান আশফিকের। মাহি হাতটা টেনে ধরে রেখেছে ওর। প্রশ্নবিদ্ধ নজর ছুঁড়লে বলে মাহি, ‘আমি পবিত্র অবস্থাতে নেই।’
চিন্তিত মুখে ও মাহিকে একবার দেখে মসজিদের ভেতরে আরেকবার তাকাল৷ ওদের দুজনের দিকেও ভেতরে থাকা মানুষগুলো কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টি। সেই সুযোগে আশফিক ডাকল একজন ভদ্রলোককে। তিনি মধ্যবয়স্ক। জিজ্ঞেস করলেন এসে, ‘কী হইছে আপনাগের?’
সরলভাবে বলেও দিলে আশফিক, ‘আমরাও বিয়ে করতে চাইছি।’
লোকটার অনুসন্ধিৎসা দৃষ্টিতে পড়ে ওরা দু’জন একটু অপ্রতিভ হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আবার, ‘ভাইগে আইছেন আপনেরা?’
-‘আরে না, পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়ে ঠিক। আরও তিন মাস পর। কিন্তু আমরা অত দেরি করতে চাইছি না এখন।’ তীব্র প্রতিবাদে জানাল আশফিক।
বিশ্বাসযোগ্য হলো না তা লোকটার কাছে। তিনি কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলেন। সেখানে থাকা প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষগুলোকে ওদের কথা জানালে একে একে সবাই হাজির হলো সেখানে৷ মাহি তখন একটু হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেও আশফিক বেশ অটল। কথা বললেন মসজিদের ইমাম সাহেবই, ‘তুমরা বিয়ে করবার চাও?’
-‘জি চাচা।’ আশফিক নির্দ্বিধায় জবাব দিলো।
তিনি ওদের পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেন। নতুন বর কনেও বেশ আগ্রহান্বিত চোখে তাকিয়ে দেখছে ওদের৷ মাহির খেয়ালও তাদের দিকেই। ইমাম ওদের কথাবার্তা শুনে আর কিছু যাচাই-বাছাই করার ভেজাল ঘাড়ে নিলেন না৷ পালিয়ে আসা ছেলে-মেয়েরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে৷ এরা মসজিদে কেন এলো সেটা জানতে মন চাইলেও জিজ্ঞাসা করলেন না। শরিয়ত বিধান মেনে পবিত্র সম্পর্কে যেহেতু জড়াতে চাইছে সেখানে অত গোয়েন্দাগিরি করে কী হবে? যদিও ওঁরও জানার আগ্রহ ছিল অনেক কিছু। এমন অভিবাবক ছাড়া বিয়ে এই প্রথমবার দিচ্ছেন বলে৷ আশেপাশের লোকগুলো ওদের নিয়ে কানাঘুঁষা করছে এটাই, নির্ঘাত পালিয়ে বিয়ে করতে এসেছে এরা৷ সেসব কানে এসে লজ্জায় মাথাকাটা যাচ্ছে মাহির। আশফিকের এসব হঠকারিতায় ওর অপছন্দ বেশি। যেটা গাড়িতে বসে জানানোর পরও এমন গর্দভের মতো কাজ করবার জন্য রাগে চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। এখন যদি ও বিয়ে করবে না বলে রেগেমেগে চলে যায় তবে ঝামেলাতে পড়ে যেতে পারে আশফিক৷ এখানকার অপরিচিত মানুষগুলো যদি ভেবে বসে ওকে জোর করে বিয়ে করতে চাইছে আশফিক! তাই তো চুপ থাকা।

ইমাম সাহেবের কথা মতো ওরা বাইরে থেকে ওযু করে আসলো। ওদের জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন কার্ড চাইলেন, বাবা-মায়ের সম্মতি আছে কি না সেটা আবারও জিজ্ঞেস করলেন। আশফিকের একই উত্তর, ‘অবশ্যই সম্মতি আছে।’ কিন্তু এনআইডি কার্ড আশফিক দেখাতে পারলেও মাহি শূন্য। ওদের বিয়েটা যে পরিবারের অনুমতিতেই হচ্ছে, এটা বিশ্বাস করার মতো কোনো যুক্তিসই কথা পেলো না ওদের থেকে। ইমাম ক্ষুব্ধ, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললেন, ‘অভিভাবকের অজান্তে বা বিনা অনুমতিতে বিয়েশাদি করা একেবারেই ঠিক না। অভিবাবক ছাড়া বিয়ে সংঘটিতও হয় না, বুঝছ? সেই বিয়েতে সমতা রক্ষা হয় না। কবুল পড়বার চাচ্ছ পড়ো। বাপ মারেও বাড়ি যাইয়ে জানাইয়ো।’

এর বিপরীতে কোনো জবাব দিলো না ওরা৷ মনের মধ্যে সংশয় নিয়ে কবুল পড়ে নিলো মাহি৷ আশফিক নিজেও বিভ্রান্তি নিয়েই বিয়েটা করল।

সাঁঝের আলো ক্ষীণ নিভে এসেছে। আবছা আলোছায়ার রাস্তায় গাড়ি চলতে শুরু করেছে ওদের। জানালার কাচ এবার নামিয়ে দিয়েছে মাহি। দখিনা হাওয়া খোলা জানালায় হুড়মুড়িয়ে এসে ওদের শরীরে লুটোপুটি খাচ্ছে। ফিরে তাকাল মাহি আশফিকের দিকে। আশফিকও ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল একবার, জিজ্ঞেস করল তখন, ‘রেগে আছ?’
-‘এমন ছেলেমানুষি কাণ্ড করে বিশ্বাস করবার নমুনা দিলে?’
হো হো করে হেসে উঠল আশফিক, ‘নমুনা দেবার কি প্রয়োজন ছিল আমার? তুমি আমাকে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করো আমি জানি। নয়তো নিশ্চিন্তে তোমার ওই সিক্রেটগুলো বলতে পারতে না।’
গম্ভীরমুখো মাহি কথা কাটল না।
-‘আর বিয়েটাকে কি তুমি ছেলেমানুষি বলছ কেন?’
-‘বলব না কেন? শুধু শুধু লোকগুলোর চোখে কতটা নিচু হলাম আমরা।’
-‘কোথায় শুধু শুধু? খারাপটার থেকে ভালো কাজটার কথা ভাবছ না কেন?’
-‘ভালো কাজটা কীভাবে হলো? এভাবে বিয়ে হয় না শুনলে না? আমাদের পরিবারের সম্মতি থাকলেও তারা তো আর উপস্থিত ছিলেন না৷ আমরা কাজ না অকাজ করলাম।’
বিয়েটার সঠিকতা নিয়ে আশফিকের দ্বিধান্বিত মন এবার আরও চিন্তাতে পড়ল, মন খারাপের গলায় শুধাল, ‘বিয়েটা সত্যিই হয়নি, মাহি?’
-‘একটা বিয়ে কি এতই সহজ? শুধু কবুল বললাম আর হয়ে গেল? হলেও পরিপূর্ণ হয়নি বলেই মনে হয় আমার।’
-‘আমার অনেক কিছুই অজানা, মাহি। এমনকি আল্লাহর ইবাদত করার জন্য জ্ঞানটাও ঠিকঠাক আহরণ করতে পারিনি। যে সময়তে এসব শেখানোর জন্য বাবা-মায়ের তৎপরতা থাকে সেই সময়টা আমার খেয়াল আমার নিজেকে রাখতে হয়েছে। তোমাকে অনেক কিছুই জানানো হয়নি বোধ হয়। ভালো হলো প্রসঙ্গটা উঠে। আমার নয় বছর বয়সে আম্মুর মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটে যায়, জানতে এটা? সোজা ভাষায় পাগল।’
থমকাল মাহি, ‘না, সত্যিই?’
-‘হ্যাঁ সত্যিই। তোমার বাবা জানেন। আম্মুর অসুস্থতাটা আসলে জিনেটিক ডিজঅর্ডার। যেটা আব্বু জানত না। সমস্যাটা শুরু হয়েছিল আরও আগে থেকেই একটু একটু করে। সঠিক সময়ে ট্রিটমেন্ট না নেবার ফলে আম্মু একটা সময় পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমার নানাভাইয়ের বংশতে এই সমস্যাটা আছে৷ তিনিও বয়স একটু ভারী হতে না হতেই পাগল হয়ে যান৷ আম্মুর ছোটো বোন তো জন্ম থেকেই। আরেকজন খালামনিও সুস্থ তবে খেয়াল করলে ওনার মাঝেও এখন কিছুটা অসামঞ্জস্যতা বোঝা যায়। মামা দু’জন পুরোপুরি সুস্থ৷ ওরা লন্ডনে থাকে। তাই আগেভাগেই প্রোপার ট্রিটমেন্টের মধ্যে আছে। কিন্তু আমার খালাতো, মামাতো ভাইবোনের মধ্যে এমন কোনো সমস্যা নেই। সামনে কী হবে বলতে পারছি না। আম্মু অসুস্থ ছিল প্রায় সাতটা বছর৷ সাড়িয়ে তুলতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে আব্বুর। তো ওই সময়গুলো আমি নানিবু, দাদীবু বা খালামনিদের সান্নিধ্যও পাইনি তেমন। পড়াশোনা করার জন্য যতটুকু শাসন প্রয়োজন সেদিকেই কেবল লক্ষ রেখেছিল আব্বু। যদিও তার প্রভাব কিছুটা পড়ে গিয়েছিলই আমার মধ্যে। অত বড়ো বাসায় আমি একা জড়বস্তুর মতো পড়ে থাকতে থাকতে যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছিলাম। যার কারণে আব্বু সিকিউরিটির মাধ্যমে আমাকে বাইরে ঘুরতে ফিরতে পাঠিয়ে দিতো। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার দিকে খেয়াল রাখত খুব। বাইরে ঘুরে ফিরে বেড়ানোর পুরো স্বাধীনতায় আমাকে দিয়ে দেয়। সেখান থেকেই ঝোঁক চলে আসে ছবি তোলার। তারপর সেই ঝোঁক আমার মধ্যে মারাত্মক রূপ নেয়।’
-‘তার মানে তোমার মাঝে ইসলামিক শিক্ষা-দীক্ষা তেমন একটা নেই?’
শ্রুতিকটু লাগল খুব কথাটা৷ আশফিকের খারাপ লাগল তা, ‘এভাবে বলছ কেন? জিনিয়াস খেতাব থাকলেও পড়াশোনাতে আমি ফাঁকিবাজই ছিলাম।’
-‘তো বলব না? বড়ো হওয়ার পর নিজের গরজে তো এ শিক্ষা নিতেই পারতে।’
-‘তুমি এসে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ো।’ মুচকি হেসে বলল।
-‘তার আগেই শিখতে শুরু করবে তুমি৷ তোমার বাসার কাছের মসজিদে যাবে নিয়মিত। ইমামের থেকে কুরআন শিক্ষাসহ সব কিছু আয়ত্ত করে নেবে।’
-‘নিজের গরজ ছিল না এ কথা ঠিক। সেই সাথে এমন করে জোর দিয়ে বলার মতোও কেউ ছিল না। এখন তো বড়ো হয়ে গেছি। তাই আম্মুও আর কিছু বলে না।’

সেদিনের বিয়েটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দের মাঝেই ওদের তিন মাসের সম্পর্কটা কেটে যায়। মাহি অবশ্য সহজ উপায় গুগলে এমন করে বিয়ে হওয়ার ব্যাপারে অনুসন্ধান চালায়। একেক জায়গায় একেক রকম শরিয়াতি বিধানগুলো দেখে সঠিক ধারণা না পেলেও ওর মন কখনো মানত সে আশফিকের সঙ্গে সুন্দর, পবিত্র সম্পর্কতে আবদ্ধ আছে। আবার কখনো তা সন্ধিগ্ধও থাকত। কিন্তু আশফিক এই বিয়েটা যতখানি আগ্রহ নিয়ে সম্পন্ন করেছিল, সেটার শুদ্ধতা নিয়ে ব্যগ্রতা তার এক বিন্দুও দেখায় যায়নি ওর মাঝে। কারণ, ওর মস্তিষ্কে মাহির অস্বীকৃতি আর ইমাম সাহেবের একটা বাক্যই বিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল “অভিবাবক ছাড়া বিয়ে সংঘটিতও হয় না।” তাই ওর মনের কোণে ঠায় হয়নি এ বিয়ের স্মৃতি আর ভাবনা। মাহির ধারণাগুলো অবশ্য ওর কাছে ব্যক্ত করেনি এই ভেবে যে, তাহলে আশফিক একটা মুহূর্তও আর দেরি করবে না দূরে থাকতে৷ ওদের আদরঘন মুহূর্তকে চূড়ান্তরূপে প্রশ্রয় দিতে চাইবেই। যা সামাজিকভাবে বিয়ের পূর্বে মাহি চায়নি৷ আশফিক চলে যাবার পর এই অনিশ্চয়তা কাটানোর বা সমাধানেরও চেষ্টা করেনি মাহি। দিব্যকে যখন নিজের জীবনে জড়াবার চিন্তা করল তখন আশফিক ওর ভাবনচোখের অগোচরে৷ কিন্তু যেদিন সে ফিরে এলো আবার, ধীরে ধীরে পুনরায় ওর মনরাজ্যে বিচরণ শুরু করল তখন মনে পড়ল এই বিয়েটার কথাও। রিসোর্ট থেকে ফিরে এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করবার পর এখন ওর জ্ঞানগম্য হয়, দীর্ঘ চার বছর ধরে সে আশফিকের লিখে নেওয়া সম্পদই হয়ে আছে।

কিন্তু আশফিক, সে তো মাহির আগেই ভুলে গিয়েছিল তা গুরুত্বহীন ভেবে। এখনো কি তাই ভাবে সে?
_____________________ ____________________

ইসরাত জাহান দ্যুতি
(কী মনে হয়? মনে আছে আশফিকের? আর আপনারা নেক্সট না বললেও আমি নেক্সট দেবো। তাই নেক্সট মন্তব্য করবেন না প্লিজ)

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৬.২
____________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও কঠোর মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

লং ড্রাইভে যাবার পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে মাহির জন্য। গাড়িতে বসে টুকটাক কথা বলতে বলতে ঝিমুনি চলে আসছিল ওর। আশফিক বাসায় ফিরে যাবার কথা বললে সে উত্তরা ৭ নং সেক্টর লেক সাইড মাইক্রো পার্ক থেকে একটু ঘুরে যাবার আবদার ধরে।

শান্ত, শীতল লেকে সুক্ষ্ম জলের পুঞ্জ ধোঁয়া আর সবুজায়ন চারপাশের শুনশান নীরবতায় আজ শুধু ওদের নস্টালজিক হওয়ার দিন। লেকের সামনে বসে আছে ওরা। আশফিকের কালো মনির মোনোলিড আকৃতির চোখ দু’টোর অচঞ্চল দৃষ্টিজোড়া লেকের নির্মল পানিতে আর মাহি মাথা নুইয়ে বসে ভাবে এলোমেলো ভাবনাগুলো। সময় কাটল এমন মৌনতায় অল্প কিছুক্ষণ। হঠাৎ আশফিক ডাকল ওকে, ‘মাহি? বসে থাকবে?’
-‘বসতেই তো এলাম।’ নৈঃশব্দ্য ভেঙে স্বভাবসুলভ মৃদুস্বরে, ধীরস্থিরভাবে বলল।
-‘কিন্তু তোমাকে খুব টায়ার্ড লাগছে। বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে নিলে ভালো করতে।’
-‘তা ভালো হতো। আসলে….’ দ্বিধাগ্রস্ত লাগল ওকে। থেমে আবার বলল, ‘আমার ফিরতে মন চাইছে না। কিন্তু থাকতেও মন চাইছে না।’
আবেগতাড়িত সুরে জিজ্ঞেস করল আশফিক, ‘তুমি চিন্তিত কিছু নিয়ে?’

যথার্থই বুঝে নিয়েছে আশফিক। মাহি চিন্তিত ওর জীবনের সঙ্গে জড়ানো সবকিছু নিয়ে। বাবাকে নিয়ে সঠিক তথ্য এখনও অজানা, ভাই-ভাবির অনিশ্চিত সম্পর্ক, আশফিকের সঙ্গে থাকা গোপন বিয়েটা গোপন থাকলেও হঠাৎ করেই না চাইতেও ওর সঙ্গে পুনরায় জড়িয়ে পড়া আর সব কিছুর ঊর্ধ্বে নিজের পেশা। এই সবটা এক সঙ্গে কেমন করে যেন একটা গোলকচক্রে আটকে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে ওর৷ কোথাও একটা ভীষণ গড়বড়ে লাগছে৷ ধরতে না পারাটাই চিন্তার বিষয়। কেন যেন মনে হচ্ছে, নিঝুম দ্বীপের ক্যাম্পিংটা ওর জন্য সুবিধার হবে না৷ স্যার জে.কে. খুব খেপে আছেন এই সিদ্ধান্তে। যে জন্য ওর কাছে বাবার বিষয়টা পরিষ্কারও করেননি। এই প্রথম রীতিমতো হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন ওকে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার বিনিময়ে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। সাথে আশফিকের ক্ষতির সম্ভাবনাও জানিয়েছেন ইঙ্গিতে। গতকাল রাতে অনলাইন কনফারেন্সে ওকে পুরোটা সময়ই খুব রাগের শিকার হতে হয়েছে জে.কে. স্যারের কাছে। অন্যরা চুপচাপ তা দেখে যাচ্ছিল কেবল। কিন্তু এই একটা মুহূর্তই তো ওদের শেষ কাছাকাছি থাকা। যার জন্য মাহি শ্রদ্ধেয় মানুষটির সকাল আদেশ, নিষেধ অবজ্ঞা করে যাচ্ছে। এর ফল ওর জন্য খুব ভয়াবহ হবে তা জেনেও। মিশনে যাবার পূর্বে কাছের মানুষের কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে তবেই যেতে হবে ওকে৷ আশফিক লন্ডন চলে গেলে একটা চিন্তা থেকে নিষ্পত্তি পাওয়া যাবে৷ যদিও ওর ওপর বিপদের আশঙ্কা কমই। ভাগ্যিস আইনী কোনো প্রমাণপত্র নেই ওই বিয়ের!

মুখটা খুব পাংশুটে হয়ে আছে মাহির। এমনটা কেন লাগছে আজ ওকে কে জানে? আশফিক জিজ্ঞেস করল কিন্তু তার তো কোনো উত্তর দিলো না৷ এতে জোরও করল না ওকে৷ অনেক কিছুই এখন লুকোছাপা করে মাহি তা বোঝে আশফিক৷ জোর জবরদস্তি করে তা জানার মতো অধিকারবোধ দেখাতে পারে না সে। সেই অধিকার দেখাবার জায়গাটাই রাখেনি যে!

-‘চলো, ওঠো তো। বাসায় পৌঁছে দিই৷ গিয়ে রেস্ট করো বিকাল অবধিই। আমার মনে হচ্ছে তুমি রাতটা ঠিকঠাক ঘুমাও না। চোখদু’টোতে আকাশের মতো সেই স্বচ্ছতা আর নেই তোমার।’
মাহি হাসতে চাইল খুব। কিন্তু শরীরটা চিন্তাভাবনায় একটু বেশিই নুইয়ে পড়তে চাইছে, মনোবল নষ্ট হচ্ছে। হাসিটা তাই ক্ষীণ রইল ওর, ‘তোমার চোখজোড়াও তো লালচে লাগছে।’
-‘সে তো গতকালে রাতে ঘুম হয়নি প্ল্যান প্রোগ্রাম করতে গিয়ে।’
-‘তুমি আমার কাজ ভুলে গেছ বোধ হয়৷ কর্মজীবনে আমাকে ঘুম বাদ দিয়েই দায়িত্ব পালন করতে হয়।’
-‘হুঁ, আসলেই ভুলে গিয়েছিলাম। তোমার সর্বোচ্চ রেকর্ড কত, মাহি?’
-‘গত বছর প্রায় ৩৭ ঘণ্টা একটানা।’

গুণমুগ্ধ হলো আশফিক, একটু বিস্মিতও। শুধু তার জন্য সেই প্রিয়দর্শিনীর কাদামাটির মতো নরম ব্যক্তিরূপ কিন্তু হিং-স্র সমাজের জন্য কঠোর, নিষ্ঠুর চরিত্রের মেয়েটা আজ পুরোদস্তুরই কঠোর হয়ে গেছে।
.
.
.
ফেব্রুয়ারির প্রায় মাঝামাঝি। সামান্য কুয়াশায় মোড়ানো হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা এখন। সকাল আটটার মধ্যে মাহিকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল আশফিক৷ আবার দুপুর ৩ টায় এসে নিয়ে যায় ওকে। তারপরও জ্যামে আটকে সদরঘাট পৌঁছতে পৌঁছতে সব থেকে বেশি দেরি হয় ওদেরই৷ লঞ্চ ছাড়ার কিঞ্চিৎ পূর্ব মুহূর্তে ওর দৌঁড়ে গিয়ে উঠতে পেরেছিল। সন্ধ্যা নেমে গেলে তখন লঞ্চটা ছাড়ে। ডাবল কেবিন ভাড়া করে ওদের ষোলোজনের দলটা আশ্রয় নেয়৷ দিনের বেলা নেহাৎ আশফিক আর মাহি ঘুমিয়ে নিয়েছিল বলে বেশ ফুরফুরে লাগছিল ওদের। অর্ধেক রাত অবধি আড্ডা দিয়ে ভোর হবার ঘণ্টা দুই আগে সকলে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে৷ নদীর বুকে দাঁড়িয়ে সূর্যদয় দেখার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে আশফিক শত বাঁধা দিয়েও জাগিয়ে রাখতে পারল না কাউকে। এমনকি দিলিশাকেও। যে কিনা ভ্রমণে বের হলে সব কিছুতে বেশি কৌতূহল থাকত সে-ই। একটু অবাকই হয়েছিল আশফিক।

পাশাপাশিই বসেছিল আজ মাহি আর দিলিশা। মাহির ইচ্ছাতেই অবশ্য বসতে হয়েছিল দিলিশাকে। আশফিক যতক্ষণ চেষ্টা করছিল দিলিশাকে জাগিয়ে রাখবার, ততক্ষণই মাহি ঠোঁট চেপে ধরে হেসে যাচ্ছিল ওর দিকে ঠাট্টার দৃষ্টিতে চেয়ে। তা লক্ষ করে আশফিক ইশারাতে জিজ্ঞেস করে এত হাসবার কারণ। রাত বাজে তখন ৩ টা বেজে সাতচল্লিশ। মাহিও ওকে ইশারাতে জানাল বাইরে যেতে।

দু’জন কেবিন থেকে বেরিয়ে লঞ্চের ছাদে আসলো। দীর্ঘ সাড়ে চারটা বছর পর আশফিক জলরাশির মাঝে দাঁড়িয়ে তারকা ঝলমলিত বাংলার রাতের আকাশটা দেখল। এই বড়ো পাওয়ার সাথে আরও একটি অমূল্য পাওয়া ওর প্রিয়, একান্ত নারীটিও পাশে এই মুহূর্তে। এত আনন্দ! বুকের মধ্য জুড়ে শত শত অনুভূতির উড়াউড়ি! আকাশ মুখে চেয়ে কতবার প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নিলো! আবেগে বিহ্বল হয়ে মৃদু চিৎকারে ডেকে উঠল মাহিকে, জিজ্ঞেস করল, ‘মাহি? ডু য়্যু ফিল সামথিং ডিফ্রেন্ট?’

লোহার রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো মাহি। অনিমেষ চেয়ে ছিল সেও মুগ্ধতায় দৃষ্টি থমকে দেওয়া আকাশ পানে। হঠাৎ চিৎকারের ধ্বনিতে ঘোর কাটলে আনন্দে আত্মহারা আশফিককে দেখে মুচকি হেসে উঠল৷ ওকে জিজ্ঞাসা করতেই বুঝতে পারে আশফিক মূলত কী শুনতে চায়! মজা করে সে কপট গম্ভীরস্বরে জবাব দিলো, ‘নাহ, কী ফিল করব?’

খানিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। মাহির অবুঝের মতো উত্তরটা শুনে নিমেষে ওর কাছে ফিরে আসে আশফিক। হিমহিম পাগল হাওয়াই সারা দেহে শীতের শাণিত কামড় বসে যাচ্ছে যেন। আশফিক দেখতে পেলো না মাহির গালে দু’পাশে কাটাও দাঁড়িয়ে গেছে শীতে। কিন্তু হাত গুটিয়ে বুকের ওপর গুঁজে রাখা দেখে বুঝতে পারল শীতে ভীষণ কাবু হয়ে পড়ছে ও। আনন্দে টইটম্বুর আশফিকের সারা হৃদয়। সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশে আর মাহিকে সেই অন্যরকম কিছু অনুভব করাতে এবং একটু ভালোবাসার উষ্ণতা দিতেও ভাবনাতীত সহসা জড়িয়ে ধরল। ছাদে আরও কিছু যাত্রীও দাঁড়িয়ে আছে অন্যপাশটাতে। আশফিক লোকসমাগম আগেও পরোয়া করেছে না কি? ওর নিয়ন্ত্রণবহির্ভুত আদুরে ভালোবাসাও তো নতুন কিছু নয়! তবুও মাহি বিস্ময়ে আঁতকে উঠল। কারণ, অনেকগুলো দিন আশফিকের এই উদ্দাম ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিল বলেই অনভ্যাসেও পরিণত হয়ে গেছে তা।
-‘কী করছ তুমি? ওই দেখো সবাই দেখছে।’
একটুও হাতের বাঁধন ঢিলে করল না আশফিক, উলটে জিদ্দি কণ্ঠে বলল, ‘দেখুক। জরুরি হলো এখন তুমি ওই অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করছ কি না সেটা বলো।’
-‘এজন্য তুমি জড়িয়ে ধরলে এভাবে?’
-‘জানি না। শুধু বলো কিছু বুঝতে পারছ কি না?’

মাহি কিন্তু আজও এবং এখনও অতীতের জখমি সাড়িয়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু তাও ওর বিবেক বলল, এই উশৃঙ্খল প্রেমিককে এখন কষ্ট দেওয়া যাবে না, তার আনন্দমাখা হাসিমুখকে সামান্যতমও ম্লান হতে দেওয়া যাবে না। নয়তো ভীষণরকম অন্যায়কারী হয়ে যাবে সে।
দু’হাতে তাই নিজেও ওর পৃষ্ঠদেশ আঁকড়ে ধরল। বহুকাল পর এই আলিঙ্গন ওদের। আশফিক খুশিতে খুশিতে দিশাহারা, মতিচ্ছন্ন। মাহির স্কন্ধে মুখ গুঁজল, ফিসফিস করে প্রথমবার আজ মুখেও স্বীকারোক্তি দিলো, ‘আমার হৃৎস্পন্দন তোমার বুকে আঘাত করছে মাহি। টের পাও? সেখানে একটাই স্লোগান, ভালোবাসি! বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসি! একটু শোনো?’
-‘শুনছি। আরও বলো।’ যেন কানেকানে বলল মাহি।
-‘আমি বলে যে বোঝাতে পারি না। ভালোবেসে ভালোবাসাকে বোঝাই?’
-‘উহুঁ, সবাই দেখবে।’

পরবর্তী যতগুলো পর্ব আসবে সব পর্ব হবে ভীষণ থ্রিলিং। মাহির নৃশংসতার, নিষ্ঠুরতার একেকটা গোপন অধ্যায়। সেই পর্বগুলোতে প্রতিটা পাঠকের গঠনমূলক মন্তব্য না পেলে বেশি খাটাখাটনি করে পর্বগুলো লিখব না। একদম সাদামাটাভাবে লিখে শেষ করে দেবো।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here