রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৮.১

0
406

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৮.১
___________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও কঠোর মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

অনিলের চোখদু’টোর দিকে স্থির চেয়ে রইল আশফিক৷ শেয়ালের মতো ধূর্ত মানবের চোখের ভাষাও খুব দুর্বোধ্য হয় না কি? তবুও আশফিকের মন আশি ভাগ নিশ্চয়তা দিচ্ছে অনিল সত্য মিথ্যা একত্রে একটা ফাঁদে ফেলা গল্প বাতলে দিচ্ছে কেবল৷ চোখের কোণ দিয়ে মাহিকে দেখে নিলো এর মাঝে। নজর গেল তখন, প্যান্টের পকেটে পুরে রাখা হাতটার অনামিকা আঙুল বাইরে বের করে রেখে খুব সতর্কতার সাথে আঙুলটা প্যান্টের ওপর নাচিয়ে যাচ্ছে সে। যার সুক্ষ্ম অর্থ — ‘বি কেয়ারফুল’ আশফিকের মস্তিষ্ক মুহূর্ত মধ্যে ধরে ফেলল।

একটা মিনিট নিরবতার মাঝে নিজের উত্তপ্ত হয়ে ওঠা মাথাটা শীতল করে ও এগিয়ে গেল অনিলের কাছাকাছি। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘আমিই এখন পর্যন্ত কাশনিরকে নিয়ে ঘুমাতে পারলাম না। তার আগেই আপনাকে দিয়ে দেবো? উহুঁ, সেটা নির্ভর করবে আপনার হটি ওয়াইফি আমাদে—র কতটা স্যাটিসফাইড করতে পারে। তারপর ভেবে দেখব আমার নতুন ডেটকে আপনার কাছে পাঠাব কি না? আমি ভাই বনে জঙ্গলে সারা বছর ঘুরে বেড়ানো মানুষ। জীব জন্তুর ওয়াইল্ড সে-ক্স দেখতে অভ্যস্ত, আবার কখনও গ্রুপ সে-ক্স। এদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া বউ আপনার। আমি একা নিলে আমার বাকি তিন বন্ধু ঝামেলা করবে খুব৷ দেখা গেল জোরপূর্বকই….. বুঝতেই তো পারছেন। তো মিসেস অনন্যার এক্সপেরিয়েন্স আছে তো? তার থেকে ইম্পর্ট্যান্ট কথা রাজি হবে তো? আমাদের জন্য অবশ্য মাত্র একটা রাতই যথেষ্ট।’

নিস্তব্ধতায় কাটল অনিলের দু থেকে তিন মিনিট। নিচের সিঁড়ি থেকে নেমে মাহি আর অনন্যা রিসোর্টের বাইরের দিকে যাচ্ছে। সেদিকে চেয়ে কতক্ষণ অনন্যাকে দেখতে থাকল সে৷ শুধু আশফিকের জন্য অনন্যাকে রাজি করাতে একটুও জোর জুলুম করতে হতো না। কিন্তু সঙ্গে অন্য তিনজন পুরুষ! খুবই অসম্ভব। আশফিককে কথা দিতে পারল না। শুধু বলল, ‘অল্প ক’দিনের ডেটকে সেইফ রাখতে এত ইনফ্যাচুয়েশন আর এত ট্যাক্টিস?’

আশফিক তাচ্ছিল্য প্রকাশে হাসল, মাছি তাড়াবার মতো হাত নেড়ে বলে উঠল, ‘ধুরঃ! কীসের মায়া? নিজে না পেয়ে আগেই অন্যকে দেবো? তো একটু কৌশল অবলম্বন তো করতেই হয়। আগে আমার কাছে পুরোনো হোক৷ তারপর ভেবে দেখব। আসি তাহলে? দেখা হবে।’

তবে সে বেলা ওদের দেখাটা আর হয়নি। মাহি অনন্যার সাথে কথাবার্তা বলে এসেই দেখে সবাই প্রস্তুত নিঝুম দ্বীপে যাবার জন্য। সৌরভই এ দলের অধিনায়ক বনেছে। সবাইকে নির্দেশাবলী দিচ্ছে৷ আশফিক অন্য বন্ধুদের সাথে কথায় ব্যস্ত। মাহিকে ফিরতে দেখেও গুরুত্ব দিলো না। নামা বাজার থেকে দশ মিনিট হেঁটে সমুদ্র সৈকত। ষোলো জন মানুষের দু’রকম মতামত। কেউ বলছে জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু গাড়বে, তো কেউ চায় সামনের সি বিচেই৷ এবার আশফিক নিরুদ্যম। ক্যামেরা হাতে, অথচ ছবি তোলার খবর নেই। সেটা দেখতে মাহির একটুও ভালো লাগল না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে ওর৷ প্রাপ্ত বয়সের ছেলেটা সুযোগ পেলেই কেমন বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়!

শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যেহেতু দু’টো দিনের ভ্রমণ তাই একদিন সৈকতে থাকবে আরেকদিন জঙ্গলে৷ সিদ্ধান্তটা সবারই পছন্দ হলো৷ মোটরসাইকেল করে চলে এলো সকলে কাঙ্ক্ষিত স্থানে। রিকশাতে করেও দ্বীপে যাতায়াত করা যায়। কিন্তু মোটরসাইকেলে দ্রুত আসা যাওয়ার সুবিধা আছে। এই নিঝুম দ্বীপের আশেপাশে আরও কিছু দ্বীপ, দর্শনীয় স্থান আছে৷ যা দেখার জন্য কমপক্ষে চার থেকে পাঁচদিন সময় নিয়ে ঘুরলে ভালো হয়৷ মাত্র দু’দিনে একাংশ দেখা হবে মাত্র। তাও যদি এই দলটার উদ্যোগ থাকে তবেই।

সবাই এক সঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে আটটা তাঁবু খাটাল। সন্ধ্যার সময় বসে বারবিকিউ করবে এখানে৷ এখন নিজেরা রান্না করে কিছু খাওয়ার পরিকল্পনা করছে। মোটামুটি সকল ব্যবস্থায় করে এসেছে ওরা। ঝটপট সবাই মিলে ভাত, ডাল, বেগুন আর ইলিশ মাছ ভাজা করে ফেলল। খাওয়ার পর্ব শেষে দশ মিনিট জিরিয়ে অবশেষে বেরিয়ে পড়ল অভয়ারণ্যে হরিণ দর্শনে। কিন্তু জঙ্গলে অভিযান কি আর সবাই-ই পারে? বনের গাছ গাছালিতে অনেকেরই হাত-পা কেটেছিঁড়ে গেল, মেয়েরা যারা থ্রি পিস পরনে তাদের জামা কাপড়ও বাদ পড়ল না। এমন এবড়োখেবড়ো জায়গাতে হেঁটে হেঁটে মেয়েদের দলটা আর এগোতেই চাইল না৷ তার ওপর সবার কথাবার্তার আওয়াজে হরিণ চোখের পলকেই ভেগে যায় দেখে আশফিক নিজের মতো তড়তড় করে হেঁটে এগিয়ে গেল বহুদূরে৷ এদিকে দলের প্রায় অর্ধেকই ফিরে এলো কষ্টের কারণে৷ মাহিও তাদের সাথে ফিরে এসেছে। তাবুর ভেতর বসে অনন্যা আর অনিলের খবরটা জানিয়ে দিলো জে.কে. স্যারের কাছে৷ পুরো সময়টাই সে কাটিয়ে দিলো কাজের মধ্যে৷ আশফিকের সাথে মাত্র সাতজন গিয়েছিল বনের ভেতর৷ এই সাতজনই দারুণ উপভোগ করেছে আশফিকের নির্দেশ মতো চলে অগণিত চিত্রা হরিণ দেখতে পেয়ে৷ একটা পর্যায়ে আশফিকের সাথে পরিচয় হবার পর তো ওরা যেন আনন্দ আর বিস্ময়ে আশফিকে কোলে তুলে নিয়ে নাচতে পারলে সন্তুষ্ট হতো৷ তাঁবুতে ফিরে ওদের মধ্যে থেকে একজন চিৎকার করে আশফিকের পরিচয় জানাল সবাইকে৷ এখন দ্বীপের সৌন্দর্য ছেড়ে ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷ আশফিকের ভালো লাগলেও খুব ক্লান্ত লাগছে এবার পরপর দু’রাত না ঘুমানোর ফলে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে মাহিকে নজরে পড়ল না৷ আর খোঁজও করল না৷ সন্ধ্যায় বারবিকিউ হবে সেই ব্যবস্থা করতে বলে একটু বিশ্রামের জন্য তাবুঁতে চলে এলো।
.
.
.
সমুদ্রের শীতের প্রকোপ বেশি বৈ কম নয়৷ গায়ে প্রত্যেকের উষ্ণ, মোটা মোটা বস্ত্র। মাহি সচারাচর প্যান্ট, জেগিন্স, শার্ট, টিশার্টই পরে। কিন্তু সবাইকে রঙবেরঙের সেলোয়ার কামিজ পরতে দেখে খুব আফসোস হলো একটা সেলোয়ার স্যুট সেও নিয়ে আসলেই পারত।

আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে ঘিরে গোল হয়ে বসে বারবিকিউ করছে ক’জন। আর ক’জন বসে দেখছে। আশফিককে চোখে পড়ল না আশেপাশে। বিকাল অবধি কাজ করে ওরও একটু চোখটা লেগে এসেছিল। ঘণ্টাখানিকের বিশ্রাম দিয়েছিল চোখজোড়াকে। আশফিকের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করছে খুব, মানটা ভাঙাতে মন চাইছে। আবার মনে হচ্ছে যেটা হচ্ছে সেটাই ভালো। তাতে দূরত্ব তৈরি হলেই আশফিক ফিরে যাবে লন্ডন৷ দোমনা মন নিয়ে চলেই এলো আশফিকের তাঁবুতে। দু হাঁটু উঁচু করে তার ওপর হাত ঝুলিয়ে চুপচাপ মাথা নুইয়ে বসে আছে আশফিক। খুব চিন্তামগ্ন সে। মাহি তাবুঁতে ঢোকার পরও মাথা তুলল না৷ টের পেলো না? না কি ইচ্ছা করেই তাকাল না? ঠিক বোঝা গেল না।

-‘এই হ্যালো?’

খুব ধীরে মুখটা তুলে চাইল আশফিক। খেয়াল করল মাহি, হাতে একটা লাইটার নিয়ে বসে আছে সে। জিজ্ঞেস করল, ‘স্মোক করো? কবে থেকে?’

-‘হাতে লাইটার থাকলেই সে স্মোকার হবে?’ শীতল গলায় উত্তর দিলো আশফিক।

-‘কেউ যা খুশি তাই বললেই বিশ্বাস করতে হবে?’

মৌন রয়ে চেয়ে রইল আশফিক নিষ্পলক। তারপর বলল, ‘আমি বলেছি আমি বিশ্বাস করেছি?’

-‘করোনি? তাহলে দূরে থাকছ কেন এত?’

-‘আমি দূরে বা কাছে থাকলে তোমার এক্সপ্রেশন একইরকম। আমি কথা বলছি না৷ সারাটা বেলার মধ্যে তুমি নিজে এসেছ কথা বলতে? আমাকে সকালের ঘটনাটা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা না-ই বা দিলে। আমার এখতিয়ার নেই তোমার সিক্রেট সম্পর্কে প্রশ্ন করবার। অলরেডি ক্ষণিকের পরিচিত আমরা। কিন্তু এটার কৈফিয়ত চাইতেই পারি যে, অনিল বা-স্টার্ডকে সেইফ করলে কেন তখন? তখন কেন আমাকে রিয়্যাক্ট করতে দাওনি?’

এই একটা প্রশ্নই তো সব কথা টেনে আনবে। আলাদা আলাদা করে তো আর জানবার প্রয়োজন নেই। তবে আশফিক কষ্ট পেয়েছে কোন ব্যাপারটাতে সেটা আগেই টের পেয়েছে মাহি। ও শুধু নিজের জটিল জীবন থেকে ওকে নিরাপদে আর দূরে রাখতেই কিছু জানায়নি। আশফিকের ভাবনামতে পর কেউ ভেবে আড়াল করেনি।

আশফিকের মুখোমুখি পাকাপোক্তভাবে পা ভাঁজ করে মুড়িয়ে বসল ও। বৈধ সম্পর্ক ভবিষ্যতে হোক বা না হোক। প্রিয়দের কাছে নিজের জন্য কখনো রাগ বা ঘৃণা দেখতে চায় না সে৷

-‘অর্ণব মুখার্জির সৎ বোনের ছেলে অনিল রায়। আর অনন্যা অনিলের আপন চাচাতো বোন। চেহারাতে মিল আছে খেয়াল করেছিলে?’

-‘না, অত খেয়াল করিনি। অর্ণব মুখার্জি প্রাইম মিনিস্টারে পিএস না? তার কথা বলছ?’

-‘হুঁ, কত বড়ো পরিচয় বুঝতে পেরেছ? যদিও অর্ণব মুখার্জির সঙ্গে ওদের সম্পর্কটা অত গভীর নয়৷ তবে বিপদে পড়লে সাহায্যে এগিয়ে তো আসেই। অনন্যা আর অনিলের বিয়ে সম্পর্কটা পরিবার থেকে কেউ গ্রহণ করেনি৷ চাচাতো ভাই বোন মানেই ওদের কাছে একই রক্ত৷ সেখানে বিয়ে সম্পর্ক কী করে হয়? মানে ওরা এমনটাই ভাবে৷ কিন্তু অনিল বা অনন্যা বহু আগে থেকেই এসব নোংরামিতে মেতে ছিল। নিজেদের ধর্মের প্রতিও ওদের কোনো শ্রদ্ধা নেই৷ আর না অন্যের৷ একটা সময় ওরা সামাজিক মাধ্যমে জানায় বিয়ে করেছে। এটা আদৌ সত্য কি না তা নিয়ে বেশ সন্দেহ থেকে গেছে সবার৷ তোমাকে তখন বারণ করলাম কারণ, ওরা আমাদেরকে আগে থেকেই স্টোক করছিল আমার বিশ্বাস। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাকে যাচাই করতে বা তোমার সঙ্গে আমার চেনাজানাটা কেমন তা বুঝতেই অত কথা বলছিল। কিন্তু অনিল তোমাকে কী বলেছিল?’

-‘চেইঞ্জ করে নিতে চাইছিল তোমাকে আর ওর বউকে, মালদ্বীপে যার সঙ্গে ছিলে তার মিস্ট্রেস তুমি, তোমরা খোলামেলা রোমান্স করতে।’ অবনত মুখটা গম্ভীর করে বলল আশফিক।

-‘কিন্তু এটা সম্পূর্ণই উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তোমাকে বাজিয়ে দেখতে চাইছিল। তবে পুরোটা মিথ্যেও বলেনি।’

সরু চোখে তাকাল তখন আশফিক। মাহি মিটিমিটি হাসছে, ‘আমরা যে সত্যিই হানিমুন কাপল এটা দেখানো জরুরি ছিল ওখানে৷ কারণ, ঘরের ভেতর কী হবে না হবে ওটা তো কেউ জানত না। দু’একবার চুমুটুমু খেতে হয়েছিল আমাদের। একটা বিশাল বড়ো জঙ্গি দলের ঘাঁটি ছিল মালদ্বীপে৷ এরা বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে চক্রান্ত সাজিয়ে যাচ্ছিল আর তা প্ল্যান মাফিক ধ্বংসও করে দিচ্ছিল। ওদের জন্য আমি আর আমার কো পার্টনার বিখ্যাত হীরে ব্যবসায়ী হিসেবে ডিসেমিনেইট করেছিলাম নিজেদের। সেখানেই অনন্যা আর অনিলের সঙ্গে পরিচয়। কিন্তু ওদের মধ্যেও বহুতল রহস্য উপলব্ধি করেছিলাম আমরা৷ কিন্তু আমাদের মিশন আর অভিষ্ট লক্ষ্য ছিল জঙ্গীরা। তাই কো পার্টনার বাধ্য হয়ে ওদের থেকে মনোযোগ ছিন্ন করে। আর সেটাই ভুল ছিল। গোপনসূত্রে জানা গেছে, ওই জঙ্গীদের বড়ো মাথায় না কি পলিটিকসে জড়িত বিশেষ বিশেষ কিছু ব্যক্তিবর্গ। আর অনিলও তাদেরই মধ্যে একজন।’

মুখটা কাঠিন্য করে আশফিক চোখদু’টো বুঁজে ফেলল, অভিমান আর তিরস্কারের সঙ্গে বলে উঠল, ‘কমার্শিয়াল পাইলটকে মিশনে যেতে হয়? জানতাম না।’

-‘না, এনএসআই সংস্থার একজন সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট, একজন ফাইটার পাইলটকে যেতে হয়।’

মুখটা নিচু করে শ্লেষাত্মক হাসল আশফিক, ‘মিথ্যে বলা হয়েছিল আমাকে। যদি লিকড্ করে দিই? কত অবিশ্বাস!’

-‘মিথ্যাটা এমন ভাবনা থেকে বলিনি, আশফি। আমার বিপজ্জনক জীবন থেকে তোমাকে শুধু দূরে রাখাই উদ্দেশ্য ছিল।’

কিন্তু নিজের পক্ষে এই সাফাইটা দেওয়ার সুযোগ পেলো না মাহি৷ কথাটা শেষ হবার আগেই আশফিক উঠে তাঁবুর বাইরে চলে গেছে। ঘাড় ফিড়িয়ে ওর যাত্রাপথে চেয়ে মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জেনে-বুঝে বিপদ ডেকে এনেছে সে। তা ঘাড়ে নিয়ে ঘুরেও বেড়াতে হচ্ছে৷ অনিল তখন কথার মাঝে ওকে ইচ্ছাপূর্বক মাহি বলে সম্বোধন করেছিল৷ যাতে স্পষ্ট ওর গোপন পরিচয় জেনেই মুখোমুখি হয়েছে৷ অনিল আর অনন্যা কী পরিকল্পনা করে মাঠে নেমেছে সেটাই ভাবনাচিন্তায় ছোটাছুটি করছে।

বারবিকিউ করার জায়গাতে গিয়ে বসেছে আশফিক। মৌমাছির মতো ওকে সবাই ঘিরে ধরে আছে৷ মাহি তাঁবুর মুখে বসেই দেখছে ওদেরকে৷ হঠাৎ করে নজর কাড়ল অন্যরকম কিছু। দিলিশা বাদেও তার আরও একজন প্রতিদ্বন্দী জুটে গেছে। অদ্ভুতভাবে ওর প্রতিটা প্রতিদ্বন্দীই ওর থেকে সুন্দর হয়। অন্তত ওর কাছে তা-ই মনে হয়। মেয়েটার সঙ্গে জঙ্গলের ভেতর যেতে যেতে কথা হয়েছিল৷ ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সে পরাগের কলেজে। বয়সটা আটাশ তা বোঝার একদমই উপায় নেই। দেখে মনে হবে ওর থেকেও বয়সে ছোটো। নামটা তিথি। নিবিড়ভাবে বসে আছে সে আশফিকের গা ঘেঁষে। কথা বলে যাচ্ছে অনর্গল হাত নেড়েচেড়ে, হেসে হেসে। আশফিকও স্বাচ্ছন্দ্যে তার কথা শুনছে, হাসির বদলে ফিরতি সৌজন্যের হাসি দিচ্ছে, নিজেও টুকটাক কথা বলছে।

সায়ং সন্ধ্যায় আকাশের বুকে ঘুমিয়ে থাকা তারকারাজি জেগে উঠছে। নীলচে পানির সিন্ধু ধারে আগুনের হলদে আলোয় ওদের দু’জনকে পাশাপাশি দেখে এক মিশ্র অনুভূতির আন্দোলন টের পাচ্ছে মাহি বুকের বাঁ পাশে৷ খুব শীঘ্রই বদলাতে যাচ্ছে আশফিকের জীবনটা। ছন্দ খুঁজে পেতে যাচ্ছে সেই জীবনের সুখেরা। মাহি অলীক চোখে তা দেখতে পাচ্ছে৷ চোখদু’টো অশ্রুতে আনমনে ভরে উঠলেও ওষ্ঠকোণে নিশ্চিন্তের ক্ষীণ হাসি৷ সময় এসেছে সকলকে যার যার আসল নীড়ে ফিরে যাবার। আশ্চর্য লাগছে ওর নিজের কাছেও যে, দিলিশাকে কখনোই সে আশফিকের পাশে কল্পনা করতে পারত না৷ অথচ তিথি মেয়েটাকে সেই আশফিকের জন্যই নিখুঁত লাগছে। ঈর্ষাও হচ্ছে, কষ্টও হচ্ছে। কিন্তু প্রিয়কে প্রকৃত সুখ দেবার চাবি পেয়ে বুকটা শান্তিতে শীতল লাগছে৷ ওর চোখ ভুল চেনেনি তিথিকে। মেয়েটার হাসিতে কী মধু, গোল মুখটাতে সরলতা আর মায়ার বাস। তা আশফিকের বিশুদ্ধ অন্তরের দৃষ্টিতে অবশ্যই পড়বে। জলে ঝাপসা চোখের পলকহীন চাউনি মেলে দীর্ঘ অনেকটা সময় মাহি ওদের দেখল আর সুদূরপ্রসারী ভাবনা ভাবতে থাকল৷ এরই মাঝে হঠাৎ ফোন কেঁপে উঠল প্যান্ট পকেটে। উঠে পড়ে ফোনটা বের করে নাম্বারটা দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল আপনা আপনি৷ দিব্য আজ আবারও কল করেছে? এত অহংকারী ছেলে প্রথম দিনে ফোন রিসিভ না করাতেই তো অহংবোধে আঘাত পাবার কথা ছিল! অথচ ভীষণ চমক দিলো সে আজ আবারও কল করে। কৌতুহল হলো মাহির৷ ফোনটা ধরলও।

গল্পটা সত্যিই আর বেশি পর্ব নেই৷ যেমন ভেবেছিলাম তেমনই সমাপ্তি টানব। তবে লেখাতে অনেক লুপহুল থেকে গেল৷ আগের মতো আমি সময় নিয়ে লেখাতে মনোনিবেশ করতে পারছি না বলেই প্লটগুলো আকর্ষণীয় করতে পারিনি। আমি নিজেই লিখে তৃপ্তি পাই না। তাই পরবর্তী পর্বটা লেখার জন্য আমারও এক্সাইটমেন্ট আসে না। তবুও যে সকল পাঠক আমার প্রতিটা লেখাকে যেভাবে সাপোর্ট দেন তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আচ্ছা এই ধারাবাহিকের বইয়ের কাজটা আমি আরও দেরিতে করব ভেবেছি। কাহিনিগুলো নতুন করে, আরও সুন্দর করে তারপর বই করার সিদ্ধান্ত নেবো৷ ততদিন এটা ফেসবুকেই থেকে যাবে। বইমেলার পরিকল্পনা আশফি মাহিকে নিয়েই আমাজনে নতুন কাহিনিতে ভাবছি৷ কোনো সিকুয়েল হবে না।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৮.২
____________________________

যাকে নিয়ে সময় কাটাতে এত কষ্ট করে নির্জন একটা দ্বীপে এলো। অথচ তাকে ছাড়াই অন্যদের মাঝে বসে ক্যাম্পিংয়ের মজা উপভোগ করতে হচ্ছে। সে এত দুর্ভাগ্যজনক একটা মানুষ কেন?

চারপাশে নজর ঘুরিয়ে মাহিকে খুঁজতে খুঁজতেই আশফিক নিজের ভাগ্যের প্রতি আফসোসের সুর গাইছে মনেমনে। নজরে পড়ল না মাহিকে কোথাও। আর বেশিক্ষণ দূরে থাকা সম্ভব নয়। সারাটাদিন অভিমানে অভিমানে কাটিয়ে কী লাভ হলো? যাকে ঘিরে অভিমান সে তো পাত্তাই দিলো না। সবার মাঝ থেকে উঠে এসে মাহিকে কল করতেই নাম্বার বিজি পেলো। অদূরে তাকিয়ে দেখল, হৃদয় আর দিলিশা বেশ সুন্দর একাকী মুহূর্ত পার করছে। ওদের দেখে যতটা ভালো লাগা অনুভব হচ্ছে ততখানিই নিজের জন্য দুঃখ হচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে গেল। বেশ দূরে কাউকে এক জায়গাতেই হাঁটাহাঁটি করতে দেখা যাচ্ছে। অমবস্যা তিথি। আকাশে তারার মেলা থাকলেও চাঁদের দেখা নেই। ওরা ক্যাম্পে সোলার প্যানেলের ব্যবস্থা করেছে। নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই। এখানের মানঁষ জেনারেটর বা সোলার প্যানেল ব্যবহার করে নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্য। রাত এগারোটার পর সেটাও চলে যায়৷ তখন মানুষজনকে মোমবাতি বা অন্য কিছুর ওপর নির্ভন করতে হয়৷ দূরে আবছা আলোতেই আরেকটু কাছে গিয়ে বুঝতে পারল ওটা মাহিই। পায়চারির মাঝে কথাতে ব্যস্ত কানে ফোন লাগিয়ে। ওকে দেখতে পায়নি পেছনে থাকার ফলে। ডাক দেবার পূর্বেই খুব স্পষ্ট কিছু কথা শ্রবণ হলো ওর — ‘নাহ দিব্য, আপনি আমার প্রপোজাল অ্যাক্সেপ্ট না করাতেই আমি খুশি হয়েছি। কারণ, আমি আমার নির্দিষ্ট গণ্ডিটা অতিক্রম করে ফেলেছিলাম৷ যেটা থেকে বের না হওয়া অবধি আপনিম কেন আমি কারও সাথেই কোনো সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারব না। তাছাড়া আমার মনে হয় আপনি আমি খুব ভালো বন্ধু হতে পারব। বাট নট আ কাপল। যদিও আপনার মতো ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ কিছু হলে আমাদের মধ্যে ভালোবাসা না থাকলেও আপনার সঙ্গে নিশ্চিন্তে এক জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়৷ আপনি আপন মানুষকে ভালো রাখতে জানো। আমাদের এই ছোট্ট জীবনে ভালো থাকাটাই তো গুরুত্বপূর্ণ।’

আড়ি পেতে কথা শুনবার মতো হীন মানসিকতা আশফিকের নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যতটুকু কথা কানে পৌঁছল ততটুকুই সামাল দেওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে যাবে। আর শুনতেও চায় না সে।

কিন্তু ভাগ্য তো অন্যদিকেই টানছে ওদের৷ পা বাড়াতে গিয়েও কানে পৌঁছল এবার — ‘আপনাকে তো আমার জীবনের লক্ষ্য জানিয়েছি, তাই না? আমি আপাতত সেটাকেই ফোকাস রাখছি। অন্য কিছু ভাববার সময়ও নেই এখন আর। তবে আপনার সিচুয়েশনগুলো শুনে খুব খারাপ লাগছে। দাদার জন্য কষ্ট পাবেন না। তাকে শেষবার দেখতে না পেলেও তার কবরটা এসে অন্তত দেখে যান।’

দিব্য ওপাশ থেকে হয়তো জিজ্ঞেস করেছে দেশে আসলে মাহি তার সঙ্গে দেখা করবে কি না? মাহি সে উত্তরে জানাল — ‘আমাদের পরিচয় তিন বছরের৷ দেখা তো নিশ্চয়ই করব সে যেখানে যেমন অবস্থাতেই থাকি, ওকে? তাহলে আমরা পরে কথা বলব আবার? একটু হ্যাঙআউট করতে এসেছি বন্ধুদের সঙ্গে। রাখছি।’

ফোনটা কান থেকে নামিয়ে পিছু ফিরতেই আশফিকের মুখোমুখি হলো৷ মুহূর্তেই আশফিক আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে বলল, ‘এক্সট্রিমলি স্যরি। মিনিট তিনেক হলো এসে দাঁড়িয়েছি৷ লুকিয়ে কথা শোনার ইনটেনশন একেবারেই ছিল না, সত্যি। চলেই যাচ্ছিলাম৷’

বলে আর দাঁড়াল না৷ মাহি একটু সময়ের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। চলে যাচ্ছে আশফিক সেদিকে চেয়েও বিমূঢ়তা কাটল না। হঠাৎ নারকেল গাছের পাতাগুলো বাতাসের তাণ্ডবে এলোমেলো শো শো শব্দে উড়তে আরম্ভ করলে সেদিকে চোখ আটকায় ওর৷ তারপরই দেখতে পায় একটা হেলিকপ্টার উড়ে আসছে। মাথার উপর দিয়ে শাঁ করে চলেও গেল সেটা। হঠাৎ কী খেয়ালে এলো এরপর মাহির কে জানে! চকিতে চঞ্চল দৃষ্টিজোড়া আশফিকের গমন পথে চাইল৷ চিৎকার করে ডেকে উঠল — ‘স্টপ আশফি! জঙ্গলের দিকে যাচ্ছ কেন?’

আশফিক শুনলও না ওর চিৎকার৷ লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেছে অনেকটা দূর কয়েক মিনিটের মাঝেই। এদিকে মাহির ইন্টেলিজেন্স অফিসারের সঙ্গে একটু কথা বলবার প্রয়োজন ছিল। আশফিকটা দিনে দিনে মেয়েদের মতো অভিমানী হয়ে যাচ্ছে! বিরক্তিকর! ধুরঃ! ছুটতে হলো ওকে আশফিকের পিছে। দৌঁড়ে এসে আশফিকের পাশে খাঁড়াল, বলিষ্ঠ হাতটা টেনে ধরল ওর — ‘কথা শুনেছ ভালো কথা। এত রিয়্যাক্ট করছ কেন?’

মাহির সেই কোমল হাতটাও কেমন পুরুষদের মতো কড়া হয়ে গেছে এখন। যেটা ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে বেশ খানিকটা জোর খাটাতে হলো আশফিককে৷ চলা থামাল না। বরং আরও দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে ওকে বলল, ‘তাঁবুতে ফিরে যাও, মাহি৷ ঘুরতে এসে আমার তোমাদের মতো বসে থাকতে ভালো লাগে না৷ আমি জঙ্গলের গভীরে ঢুকব।’

আঁতকে উঠল মাহি, ‘এই রাতের বেলা! জঙ্গলে মেছোবাঘ আছে কিন্তু!’

-‘জঙ্গলের বাদশার সঙ্গে দিনাতিপাত করেছি৷ আর কিছু বলতে চাও? না বললে বিদায় হও।’

-‘তুমি আমার সাথে বি-চ্ছিরি ব্যবহার করছ কেন?’ মাহি পিছু আসতে আসতে বলল।

-‘এর থেকেও বি-চ্ছিরি কিছু করে ফেলব হয়তো৷ তাই বলছি চলে যাও।’

-‘তুমি এমন হয়ে গেছ কেন আশফি? কিছু হতে না হতেই গাল ফুলাও!’

কথাটা শুনতেই দাঁড়িয়ে পড়ল আশফিক৷ ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের কাছাকাছি ওরা৷ হিম সুরে বলল মাহিকে, ‘এক্সাক্টলি। আমি আসলেই কেমন একটা হয়ে যাচ্ছি৷ বছর চার আগেও তুমি আমার হঠাৎ হঠাৎ গম্ভীরতাকে, রাগকে নিতে পারতে না৷ সেই স্বভাবের কারণেই তোমার গায়ে হাত তুলেছিলাম, বিবাদ করে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। সেই ভুলের শাস্তিই পেয়ে যাচ্ছি এখনও। ওই রাগ কি আর দেখানোর সাহস পাই তোমাকে? তাই মেয়েদের মতো গাল ফুলানো অবধিই সীমাবদ্ধ থাকি। তাতে তুমি এত বেশি ডেস্পারেট হচ্ছ কেন? য়্যু ডোন্ট থিঙ্ক অ্যাবাউট মি।’

-‘ইয়াহ্ আই ডোন্ট থিঙ্ক অ্যাবাউট য়্যু। বাট অ্যাট দ্য টাইম আই হ্যাভ টু থিঙ্ক৷ ফিরে চলো। যা বলার আছে সব বোলো।

-‘থ্যাঙ্ক য়্যু ফর বিয়িও সো কনসার্নড অ্যাবাউট মি। নাও য়্যু ক্যান গো।’

-‘তোমার রাগ একটুও কমেনি। বরং বেড়ে গেছে আশফি।’ চেঁচিয়ে বলতে থাকল৷

আশফিক ফিরেও তাকাল না। ওর বুকের গহীনে কতটা ধ্বং-সলীল হচ্ছে তা মাহিকে বোঝাতে পারবে না। বোঝালেও মাহি বুঝবে না৷ তখন কথাগুলো হৃদপিণ্ডটা যেন এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিয়েছে ওর৷ এই মুহূর্তে মাহির জীবনে প্রতিটা মানুষই খুব গুরুত্ব বহন করে না৷ আর ওর সেখানে কোনো অস্তিত্বই নেই।

আগে পিছে দু’জন হেঁটে হেঁটে সত্যিই ম্যানগ্রোভে প্রবেশ করল৷ রাত বাজে তখন আটটা। ক্যাওড়া গাছ আর লতাগুল্ম গাছের ফাঁকফোকর থেকে অজানা নানান প্রজাতির পাখি, অতিথি পাখি উদ্ভট উদ্ভট আওয়াজ করছে। ঘুঘুর ডাকও কানে আসছে মাঝেমধ্যে। হঠাৎ মাহির সামনে দিয়ে একটা খেকশেয়াল ভোঁ দৌড় দিলো৷ ও হঠাৎ চমকে একটু পিছিয়ে গেল৷ দৌঁড়ে যাবার শব্দে আশফিক হাঁটা থামিয়ে পিছু ফিরল। দেখল দাঁড়িয়ে পড়েছে মাহি, বাঁয়ে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। কোনো সমস্যা হলো কিনা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না। আবার চলতে শুরু করল হাতের ফোনটাতে টর্চ জ্বালিয়ে। মাহিও চলতে চলতে ওর পাশাপাশি এসে দাঁড়াল৷ হঠাৎ করেই ওর মনটা চনমনে হয়ে গেছে৷ জঙ্গলের মাঝে একা ওরা দু’জন পাশাপাশি। খুব রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে। তিথি আর আশফিককে নিয়ে তখনকার মন খারাপটাও উধাও হয়ে গেছে আর বসের নির্দেশনাও ভুলে গেছে সে। ওকে কতটা সাবধানে এখন প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলতে হবে তা খেয়ালই রইল না। এজন্যই বলে গানটা আবিষ্কার হয়েছে “সব কোরো প্রেম কোরো না।” তবে একটু আফসোস হচ্ছে ওর আকাশে ভরা পূর্ণিমার আলোটা নেই৷ তাহলে আজ কিছু না কিছু একটা জঙ্গল রোমান্স হয়েই যেত ওদের মধ্যে।

-‘ঘোড়ার মতো, বোবার মতো হাঁটছ কেন? একটু কথাটথা বলো। ভালোই লাগছে জঙ্গলে ঘুরতে।’

আশফিক একটুখানি ফাঁকা জায়গার মতো খুঁজছে। সেখানে শুকনো কাঠখড় পুড়িয়ে আ-গুন জ্বা-লিয়ে সারারাত কাটাবে৷ তবে মাহির সঙ্গ এই মুহূর্তে সত্যিই উপভোগ করতে পারছে না ও৷ বক্ষঃস্থলে আ-গ্নেআদ্রি সবকিছু ছারখার করে দিচ্ছে৷ মাথার চাঁদিটুকুও উ-ত্তপ্ত হয়ে আছে। এমনই এক পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিল সেদিন মাগুরা থেকে বহু কষ্টে। আজ হয়তো আর পারবে না। ও চায় না ওর রুদ্রমূর্তির সামনে মাহি দাঁড়াক, আবার ওদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হোক। তাই আদেশ করল ওকে — ‘আমি আমার সেফটি নিতে জানি, মাহি৷ তুমি চলে গেলে খুশি হবো।’

-‘আমি খুশি হতে পারব না তাহলে।’

অবশেষে সবুজ ঘাসে আবৃত বেশ ভালো একটা ফাঁকা জায়গা মিলে গেল। পাশে আবার ছোটোখাটো খাদ আছে মনে হচ্ছে। আশফিক আর কথা বাড়াল না৷ আশপাশ থেকে ফোনের আলোতেই শুকনো খড়কুটো, কাঠ চট করেই গুছিয়ে নিতে পারল। মাহি আ-গুন জ্বা-লাবার আয়োজনটা বুঝে নিজেও কিছু গুছিয়ে নিলো। যেখানটাতে আশফিক রাখল ওগুলো, ও-ও রাখল সেখানেই। লাইটার ছিল পকেটেই আশফিকের। আ-গুনটা জ্বা-লিয়ে দিলো। ও বসবার আগে মাহিই বসে পড়ল৷ কিন্তু মুহূর্তেই বেশ লজ্জাকর একটা ঘটনা ঘটে গেল ওর সঙ্গে। নিতম্বের নিচে প্যান্টের ওপর থেকেই কাঁটা জাতীয় কিছু একটু ফুটল বলে মনে হলো৷ তবে মুখে শব্দ করল না। একটু উঁচু হয়ে পেছনে হাত দিয়ে কাঁটার মতো চিকন কিছু একটা টেনে আনল প্যান্ট থেকে। ভাগ্যিস প্যান্ট ছিল পরনে৷ নয়তো কী হতো ইস! আশফিককে বলল, ‘আলোটা ধরো তো একটু এদিকে। দেখেশুনে বসি।’

অথচ ও খেয়াল করল না আলোটা ওর দিকেই আছে৷ সেই আলোতেই পেছন থেকে টেনে বের করা কাঁটাটা হাতে এনে দেখতে পেরেছে তখন। এত অস্থিরতা আর রাগের মধ্যেও আশফিকের হাসি পেয়ে গেল মুহূর্তটা দেখে। দু’ঠোঁট চেপে মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে সে হাসির বেগ সামলাল। গম্ভীর স্বরে বলে দিলো, ‘অন্যপাশে ঘুরে এসে বসো। ওদিকটাতে বসলে খাঁড়া থাকা ক্যাওড়া গাছে খোঁচা লাগবে।’

-‘ও তুমি দেখে নিয়েছ? মাহি নির্বিকার স্বরেই বলল। আশফিকের কথা মতো উঠে এসে অন্যপাশটাতে বসল।

আশফিক পাশে এসে বসলেই মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘এত চটে যাবার কারণ কী?’

জবাব দিলো না আশফিক। মাহি দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করল একই প্রশ্ন৷ তখন বলল ও, ‘কথা বলতে ভালো লাগছে না।’

-‘কেন ভালো লাগছে না? হঠাৎ এত কেন অসহ্য হয়ে গেলাম?’

-‘অসহ্য তুমি আমার কাছে না আমি তোমার কাছে হয়ে গিয়েছি! আকস্মিক চিৎকারে মাহি চমকে উঠল।

এবার আর থামল না আশফিক, ‘আমার মূল্য তোমার কাছে কতটুকু? আমি রেগে থাকি, অভিমানে থাকি এটার মূল্য সত্যিই নেই। নিজের বিরাট বড়ো একটা ফল্ট আছে৷ যার জন্য রাগ হলেও তা দেখাবার সাহসটা আর হয় না, আর না পারি অধিকারটাও দেখাতে। বোঝো কতটা অসহায় লাগে যখন আমার বৈধ স্ত্রীর প্রতি রাগ, অধিকার, প্রেম, কিছুই দেখাবার সাহসটা আসে না? আমি এই যে ফিরে এসেছি এটাও সেই বৈধ সম্পর্কের জোরেই। যতই রাগ, অভিমান থাকুক দশ বছর পর ফিরে এলেও আমার স্ত্রী একজনই থাকত। দ্বিতীয় নারীকে দ্বিতীয় স্ত্রীর মর্যাদা দিতাম না এবং দেবোও না। আমি কে? আমি আশফিক জাওয়াদ ; আমার পরিচয় দু’টো। প্রথম পরিচয় আমার আমি কারও সন্তান, দ্বিতীয় পরিচয় আমি কারও স্বামী। প্রথম পরিচয়ের মতোই দ্বিতীয় পরিচয়টাও আমি আজীবনেও ভুলিনি আর ভুলতে পারবও না৷ কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তুমি সেটা ভুলে গিয়েছিলে৷ তাই দিব্যকে নিয়ে ভাবতে পেরেছিলে। হঠাৎ করেই হয়তো গলায় কাঁটার মতো বেঁধে থাকা এই সম্পর্কটার কথা মনে পড়ে গেছে বলেই দিব্যকে আর নিজের জীবনে জড়ানোর সুযোগটা পেলে না। আমরা মানুষগুলো এত অদ্ভুত কেন বলো তো? আমার করা একদিনের অ-ন্যায়ের কাছে আমার তিনটা মাসের নিখাঁদ ভালোবাসা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? হ্যাঁ, আমি এখন বুঝতে পারি। আমি শুরু থেকেই তোমাকে ভালোবেসে এসেছি। ভালোবাসার আসল উপলব্ধিটা তখন বুঝিনি বলেই তোমাকে ফেলে চলে যেতে পেরেছিলাম৷ কিন্তু যাবার পর এমনটা কিন্তু ভাবিনি আমি তোমাকে আর জীবনে কখনোই গ্রহণ করব না৷ তোমার সাথে শেষবার দেখা হওয়ার দিনটাতে কি এমন কথা বলেছিলাম? বলিনি কিন্তু। আমার অভিমান ঝড়ে পড়তেই আমি ফিরে এসেছি৷ তুমি চাইলে সেই কবেই আমাদের সম্পর্কের পূর্ণতা পেতো! তুমি চাওনি বলেই আমিও কাউকে জানাতে পারিনি, নিজে আমাদের সম্পর্কটাকে এগোতে পারিনি৷ কখনো একজন বয়ফ্রেন্ড বা কখনো ফিয়ন্সের মতোই থেকেছি। তবুও ভালোবেসেছি স্ত্রীকে যেমন করে ভালোবাসে, যেমন করে মর্যাদা দেয় তেমন করেই৷ আর আজও সেই স্ত্রীরূপেই ভালোবাসি, আগের চেয়েও আরও বেশি। সেই পবিত্র সম্পর্ককে তুমি ভুলতে পারলে মাহি? অবশ্য ভুলতে পেরেছ বলেই না আমাকে পর ভাবতে পারছ। যদিও কোথায় আমার তিন মাসের ভালোবাসা আর কোথায় দিব্যর তিন বছরের সঙ্গ! তিন মাসে একজন মানুষ কখনো আপন হয় না কি? তাই তো আমাকে বিশ্বাস হয়নি নিজের পেশা, নিজের লক্ষ্য জানাতে। যেটা তিন বছরের সব থেকে বিশ্বস্ত বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষীকে জানানো যায়। সে যতই দূরে থাকুক তাতে কী? তোমার চিন্তায় তোমাকে আমি ডাম্প করেছিলাম। সেই সময়টাতে ওই ছেলেটা তোমাকে মেইন্টালি সাপোর্ট করেছে, এন্টারটেইনমেন্ট করেছে। ওর থেকে আপন আমি হতে পারি না নিশ্চয়ই? তুমি এখন কী চাও? আমার আর তোমার ওই গোপনে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সম্পর্ক থেকে খালাস পেতে? আমি জোরজবরদস্তি করার পক্ষপাতি নই৷ ভালোবেসেই যদি আঁকড়ে রাখতে না পারি তবে নিজের ভালোবাসাকে ধিক্কার জানাব যে আমার ভালোবাসার ক্ষমতা নেই নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে ধরে রাখার! তুমি চাইলেই আমি এই মুহূর্তে ওই একটা শব্দ তিনবার উচ্চারণ করে ফেলব। যেটা তোমার আমার সম্পর্ক চিরজীবনের জন্য সমাপ্ত করে দেবে।’

হাঁপিয়ে উঠল আশফিক৷ কথা আরও বলার ছিল। ওর মনে হয় সে কথাগুলোও মাহির কাছে পরোয়া না করার মতোই হবে। ও বুঝে গেছে ওর জায়গা সেই চার বছর আগেই মাহি অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়ার নিষ্ঠুরতম সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিয়েছে। দাউদাউ করা জ্বলন্ত শিখাতে নিবদ্ধ মাহির থইথই করা চোখদু’টোতে চেয়ে ভাবল ও, সেদিনের বিবাদে দোষটা কি শুধু ওর একারই ছিল? মাহির কি ছিল না একচুলও?
_________________________________

বেশ উ-ত্তপ্ত মেজাজ নিয়ে আশফিক বাসায় ফিরল হঠাৎ মায়ের জরুরি ফোন আসাতে। মেজাজ খিঁচিয়ে থাকার কারণ, মাহি দেখা করছে না ওর সঙ্গে শেষ এক সপ্তাহ ধরে৷ আজ বাসায় গিয়েছিল। অথচ মেয়েটা ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে ছিল। কতবার নাহিয়ান বের হতে বলল! কিন্তু সে একটা সাড়াও দিলো না। দিলিশার মতো বাইরের একটা মেয়ের জন্য হঠাৎ করে ওর প্রতি অতিরিক্ত অধিকারপ্রবণ হয়ে উঠেছে যে, ওর অর্ধেক জীবনের শখ আর লক্ষ্য ফটোগ্রাফি বাদ দিয়ে বাবার ব্যবসা সামলাতে বলছে৷ ও তো বলেছেই যদি কখনো বাইরে যাবার মতো চিন্তাভাবনা করেই ফেলে তাহলে বউকে ফেলে সে যাবে না অবশ্যই! মাহিকে ছাড়া থাকতে পারলে তো ফেলে যাবে? তারপরও কেন অবিশ্বাস ওর প্রতি?

মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বসার ঘরে আসতেই। তিনি ওকে ডেকে সোফায় বসালেন, খু্ব সাবধানী কণ্ঠে বললেন, ‘দিলিশা রোজ তোর ঘর গোছায়, আমাদের ঘর গোছায়, আমার থেকে রান্নাবান্না শেখে, তোর কী খেতে পছন্দ বিশেষ করে সেগুলো শিখতে চায়৷ আজ তো তোর ফেলে রাখা জামাকাপড়গুলো ওয়াশিং মেশিনে নিজেই ধুতে দিলো। শেষে ছাদে গিয়ে মেলেও দিলো। এখন কী করছে জানিস? তোর জামাকাপড় আয়রন করছে৷ ওর হাবভাবে সুবিধার না৷ তুই ওকে আজ নিজেই কিছু বলবি আমি বা তোর আব্বু বললে খারাপ দেখায়। তাও তো আমি আকারে ইঙ্গিতে অনেক কিছু বুঝিয়েছি। কিন্তু ও তেমন পাত্তায় দিলো না। আমি মাহিকে ফোন করেছি আমি কিছুক্ষণ আগেই। আসতে বলেছি। হ্যাঁ বা না কিছু বলল না। আমি একটু তোর খালামনির বাসায় যাব ওকে নিয়ে।’

-‘ও আসবে না। তুমি চলে যাও।’

-‘কেন আসবে না?’

কোনো জবাব দিলো না আশফিক । মাহিকে নিয়ে এত বেশি রেগে আছে আর বিরক্ত যে, ভালো লাগছে না এই মুহূর্তে ওর কোনো কিছুই । বেশ কিছুদিন ধরেই ও লক্ষ করছে মাহির আর দিলিশার মধ্যে কোনো কারণে দ্বন্দ চলছে। সেটা কী তা মাহিও কখনো জানাচ্ছে না। ঘরে গিয়ে দেখল মা যা বলেছে সেটা সত্যিই। দিলিশা যত্নের সাথে ওর শার্ট আর প্যান্ট ইস্ত্রি করছে।

-‘তুমি এগুলো করছ কেন দিলিশা? এগুলো আমার বউয়ের কাজ। মাহি তো চলে আসছে সামনের মাসেই পনেরো তারিখে।’

হাতের শার্টটা নিয়েই এগিয়ে এলো দিলিশা, ওকে স্মরণ করাল, ‘বাংলাদেশের জাতীয় যুব ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় মেধা তালিকাতে তুমি। ইউনেস্ক সিল্ক রেড প্রতিযোগিতায় তোমার তোলা ছবি তালিকাভুক্ত হয়েছে। সেই ছবিই জিওগ্রাফির ফেইজবুক, টুইটার ও ইন্সটাগ্রাম অফিসিয়াল পেজে প্রকাশ পেলো৷ ওরা তোমাকে ডাকছে আগামী মাসেই। বিয়েটা কি পরে করা যেত না? মাহিকে বলছ না কেন এ ব্যাপারটা? আমি বুঝতে পারছি না ও তোমাকে কেমন ভালোবাসে? কেন তোমাকে সাপোর্ট করছে না?’

শ্লেষের হাসি হাসল আশফিক, ‘ও আরও চায় আমি যেন এসব ছেড়ে আব্বুর বিজনেস সামলায়। কাকে বলব বলো তো!’

বলতে বলতে হতাশা নিয়ে দুর্বল পায়ে এগিয়ে বিছানাতে গিয়ে বসল। দিলিশাও এসে বসল ওর পাশেই৷ ওর কাঁধটা জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করল, ‘ও কিছুদিন ধরে আমার সঙ্গেও খু রু-ড হচ্ছে। তাও তোমার ফটোগ্রাফিকে আমি সাপোর্ট করছি এই কারণে৷ আমাকে বলছে, আমি যেন তোমার মাথা না খাই এগুলো নিয়ে।’

নীরবে শুনলই আশফিক। মনটা বি-তৃষ্ণাতে ভরে উঠছে ওর। ভালোবাসতে গিয়ে ওর স্বপ্নটাই জলাঞ্জলি দিতে হবে কে জানত?

-‘তুমি ব্যা-কবোনলেস হয়ে যাচ্ছ অ্যাশ! ও যদি তোমাকে ভালোবাসে তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছা সকল কিছুর মূল্য দেবে৷ কিন্তু আমার মনে হয় না ও তোমাকে ভালোবাসে৷ না হলে কেমন করে পারছে তোমার লক্ষ্য থেকে সরে আসতে বলতে? তুমি কষ্ট পাচ্ছ সেটা কি ও দেখছে না?’

দিলিশার কথাগুলো আরও বেশি হুল ফুটাচ্ছে ওর বুকের ভেতরটায়। মাথা দু’হাতে চেপে ধরে ঝুঁকে বসে রইল। কী করবে ও? ন্যাশনাল জিওগ্রাফি থেকে সুযোগটা না এলে এত বেশি বিভ্রান্ত হতে হতো না কোনো কিছু নিয়ে। মাহি হঠাৎ কেন ওকে ফটোগ্রাফি না করতে চাপ দিচ্ছে ও বুঝতে পারছে না। মাহির চাওয়া ছিল স্রেফ তাকে যেন কখনো না ছেড়ে হুটহাট কোথাও চলে না যায়। তাতে ফটোগ্রাফি নিয়ে কোনো আপত্তি নেই ওর। ও তো সিদ্ধান্ত নিয়েছেই যেতে হলে ওকে নিয়েই যাবে। প্রথমে লন্ডন গিয়ে ফটোগ্রাফি নিয়ে একটা কোর্স করতে হবেই ওর। আর এখানেই মাহির বাধা।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here