রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৩৩

0
498

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৩৩
__________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও কঠোর মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত। এবং কপি নিষেধ।]

সকালটা খুব সুন্দর আজ। বাগানে নজর পড়লেই শিশিরে ভেজা পাতাবাহার গাছগুলো ঝলমলে সোনালী রোদে চিকচিক করাটা দেখতে আশফিকের কাছে এই সাধারণ দৃশ্যই অসাধারণ লাগছে। রোদের লম্বা রশ্মি ওর বিছানার একাংশ জুড়ে রেখেছে। যে পাশটাতে মাহি ছিল সে পাশটাতে। মাহি এখন নেই৷ ও ঘুম ভেঙে পাশে পায়নি ওকে।

সকাল ন’টা বাজে প্রায়। কম্বলটা কোমর অবধি ধরে রেখে কাউকে না ডেকে আশফিক নিজ প্রচেষ্টায় উঠে বসল হাডবোর্ডের সঙ্গে হেলে। পরনের প্যান্টটা বিছানাতে নেই। নিচে পড়ে আছে। একটু ঝুঁকে সেটা তুলতে গেলেই দরজাটা খুলে গেল। সম্মুখে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ওর। মাহি গতকালকের পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে দরজার মুখে। কালো জেগিন্স আর বাসন্তী, কালো রঙা মিশেলে পশমীর ক্রপ টপস। পিঠের মাঝ অবধি রেশমী, কালো ভেজা চুলগুলো এক পাশে সিঁথি করে ছড়িয়ে রাখা। বুকের এক পাশেও এসে জায়গা নিয়েছে খোলা চুলগুলো। সবে ঘুম ভাঙা ফোলা ফোলা চোখদু’টোই হেসে কী যেন বোঝাতে চাইছে সে আশফিককে। ফিচেল হাসিও তরঙ্গ খেলে গেল ওর ঠোঁঠের কিনারায়। এগিয়ে এসে নিজেই প্যান্টটা তুলে নিলো। আশফিক কেমন তীক্ষ্ণ আর জহুরি দৃষ্টিতে ওকে দেখে যাচ্ছে। মুখটা খুব ভার আশফিকের। মাহি প্যান্টটা ওর দিকে এগিয়ে ধরলে ও দরজাটা বন্ধ করে আসার কথা বলল। ভ্রু উঁচিয়ে মাহি তখন শুধাল, ‘আবার কেন দরজা বন্ধ করতে হবে?’

-‘প্রয়োজন আছে। বন্ধ করে দিয়ে এসো।’

মাহি যথাযথ আদেশ মান্য করে ফিরে এলো ওর কাছে, ‘প্যান্টটা কি পরবে না? না কি ধান্দা অন্য কিছু?’

আশফিক কথা না বলে হাতটা বাড়াল ওর দিকে। কাছে এসে বসার আহ্বান আর কী! মাহি গিয়ে বসতেই আশফিক ওর কাঁধের ওপর থেকে টপসটা বিনাবাক্যেই টেনে অনেকটা নামিয়ে নিলো।

-‘কী করছ? আবার চাইছ না কি? সেটা একেবারেই না কিন্তু।’

এসব কোনো কথা কর্ণপাত করছে না আশফিক। মাহির কাঁধের মাঝে কিছু খুঁজে চলার মতো চেয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ ওর ভাবনাচিন্তার বাইরে গিয়ে এক টানে পুরো টপসটাই নিচ থেকে উলটিয়ে মাহির গলার ওপর দিয়ে খুলে ফেলল। সাংঘাতিক লজ্জায় নাস্তানাবুদ মাহি। জানালাটাও খোলা ওদিকে৷ যদিও জানালার পাশে বা এদিকে ধারেকাছেও কেউ আসবে না। কিন্তু কখনও দিনের স্বচ্ছ আলোয় এমন খোলামেলাভাবে আশফিকের সামনে নিজেকে প্রকাশ করেইনি ও। করছেটা কী আশফিক? কিছুটা হলেও তো মাহিকে বিজড়িত করে এমন কাজ করবার আগে দু’বার ভাববে!

জড়সড় হয়ে মাহি আশফিকের কোমর অবধি রাখা কম্বলটা নিয়ে দু’জনের বুক অবধি টেনে ঢেকে নিলো। আশফিক তাতে মহা বিরক্ত হলো, একটু বকুনির সাথে বলল, ‘আহ্ দেখতে দাও মাহি! এসব কী তোমার সারা গায়ে? গতকাল রাতে আবছা আলোতেই কিছুটা বুঝেছিলাম৷ এত মারের দাগ কেন বলো? সব নতুন চিহ্ন। তাই নিশ্চয়ই এ কথা বোলো না কোনো অপারেশনে গিয়ে মারধোর খেয়েছিলে!’

-‘আচ্ছা বলছি, আগে টপসটা দাও। আমার লজ্জা করছে।’

-‘আমার করছে না। তুমি বলো তাড়াতাড়ি।’

-‘কী আশ্চর্য! তোমার করবে কেন? আমার তো করছে। প্লিজ টপসটা দাও।’

-‘দিলেই তুমি ওটা নিয়ে পালাবে। আগে বলো।’

-‘এটা পানিশমেন্ট ছিল জিহাদ স্যারের আদেশ অমান্য করার। আগে থেকেই বলে আসছিলেন সতর্ক হতে, ট্যুরে না যেতে। আমার জন্যই তো নিঝুম দ্বীপে অ্যাটাকটা হলো। এটা আমি ডিজার্ভ করি৷ কাকু সব সময় আমার ক্ষেত্রে একটু বেশিই স্ট্রিক্ট৷ আমি ছাড়া তার কথা বা আদেশ অমান্য করার সাহস তো কেউ দেখায় না।’

-‘উনি আমাকে অপছন্দ করেন, আমাদের বিয়ের ব্যাপারটাও জানেন, তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম বলে সেই কারণেও রেগেও আছেন, উনি চান না তুমি আমার কাছে ব্যাক করো, তাই না?’

-‘হুঁ, সবই সত্যি। একমাত্র কাকুই জানেন আমাদের বিয়ের কথা।’

মাহির ভেজা চুলগুলো পিঠের মাঝ থেকে সরিয়ে দিতে দিতে আশফিক নির্বিকার সুরে বলল, ‘যাকগে, নানু হওয়ার পর না চাইলেও এমনিতেই আমার কাছেই ভাতিজিকে দিয়ে দেবেন। খামোখা মন জয় করার কষ্টটা করতে হবে না।’

সরাসরি এবার আশফিকের দিকে তাকাল ও, ‘বাপ হওয়া এতই সহজ?’

-‘কঠিনও তো না। কাল রাতেই তো তা দেখলে। নিঝুম দ্বীপে থাকতে তোমার পিরিয়ড টাইম চলছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম সেটা।’

-‘তাতে কী? যেমন চাইছ তেমন কিছুই হবে না। ছাড়ো, তুমি উঠে ফ্রেশ হও। নাশতা আনছি আমি।’ কথাগুলো বলার মাঝে মাহির মুখটাই কেমন আঁধার নেমে এসেছে।

আশফিক তা লক্ষ করে ওকে একদম নিজের কাছে টেনে আনল, ‘এমন কেন বলছ? কেন হবে না? তুমি কি এনিহাও কনসিভ করতে চাও না?’

স্থির চোখে চাইল মাহি ওর দিকে, ‘হয়ে গেলে আমি কখনওই ওর ক্ষতি হতে দেবো না। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি সত্যিই চাইছি না৷ এখনের পরিস্থিতি আমার প্রেগন্যান্সির জন্য প্রতিকূল হবে। রিস্ক থেকেই যাবে ক্ষতি হয়ে যাওয়ার।’

-‘কিন্তু গত রাতের পর সম্ভাবনা তো থেকেই যায়। জানি দেশের স্বার্থ সবার আগে। তাই বলে তুমি এ ক্ষেত্রে জেনে-বুঝে ঝুঁকিতে ফেলতে পারো না নিজেকে।’ অসন্তোষ প্রকাশ করেই বলল আশফিক।

-‘না, আমাকে অবশ্যই কেয়ারফুল হতে হতো। কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি এমার্জেন্সি পিল নিয়ে নিয়েছি। রুমার থেকেই হেল্প নিয়েছি। ফার্মেসি থেকে এনে দিয়েছে ও সকালেই।’

কথাটা বা বিষয়টা অনেকটা সাধারণ। চাইলেই আশফিক বিষয়টাকে ‘ব্যাপার না’ অভিব্যক্তিতে ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু স্বভাবজাতভাবে তা ও পারল না৷ আসলে এই সুযোগে মাহিকে বিপজ্জনক কাজ থেকে রোধ করার যেমন উপায়টা ছিল, তেমনই খুব আশা ছিল ওদের সম্পর্কের একটা পরিপূর্ণতা পাবে, মাহির ফের দূরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেও পরিত্রাণও মিলবে।

তা আর হওয়ার নয়। ওদের সম্পর্কের বাঁধনটাই কেমন যেন ঢিলে। সব সময় একটা শঙ্কা থেকেই যায় কখন না যেন সেই বাঁধনটা ছিঁড়ে যায়। বড্ড অস্থির লাগছে আশফিকের৷ নিজের প্রতি, এই সময়, এই সম্পর্ক, পাশের মানুষটার প্রতিও বিতৃষ্ণা বোধ হচ্ছে এখন। মাহিকে ছেড়ে নীরবেই একলা একলা বিছানা থেকে নেমে যেতে চাইল ও। বাইরে কিছুটা সময় একাই থাকতে চায় একটু।

মাহি ওর নত রাখা মুখটার দিকে এতক্ষণ চেয়েই ছিল। অন্তরের ভাবনাটা যে ওর তমসাচ্ছন্ন মুখেই ফুটে উঠেছে তা মাহি বুঝে নিয়েছে। ঝট করে ওর বাহু জাপটে ধরল, ‘আশফি প্লিজ! একটু রিল্যাক্স হও। আমার তোমার একান্ত সময় পার করার সুযোগ তুমি আর পাবে না চার বছর আগের মতো৷ আমি এখন আগের সেই সাধারণ একটা মেয়ে নেই৷ আমার প্রথম মটো “বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত।” আর দ্বিতীয় মটো “Watch & Listen For The Nation, To protect National Security.” আমাকে আমার নীতিবাক্যে অটল থাকতেই হবে৷ সেই জায়গায় সবার আগে থাকতে হবে আমার দেশপ্রেম৷ তার পরের দায়িত্ব আমার পরিবার পরিজন।’

আশফিক ওর দিকে ফিরল না, শুধু মৃদু আওয়াজে সম্মতি দিলো, ‘ঠিক আছে। বুঝতে পেরেছি। তুমি যাও, নাশতা রেডি করো৷ বাইরে বসে নাশতাটা করি আজ। তুমি তো বোধ হয় আজই চলে যাবে, না?’

দু’হাতের মাঝে আশফিকের মুখটা ধরে মাহি নিজের দিকে ফেরাল। ওই কালো মনির চোখদু’টোই অব্যক্ত কষ্ট, অভিযোগ, অভিমান৷ মাহি সে চোখে চেয়ে যেন সব পড়ে নিলো অনায়াসেই। ওর গালে গাঢ় চুমু খেয়ে বলল, ‘তুমি যেটা চাইছ আমিও সেটাই চাই, আশফি। বিশ্বাস করো আমাকে?’

গালে রাখা হাতটা ধরে আশফিক বলল, ‘তোমায় বিশ্বাস করি আমি। আমি আমার ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারি না শুধু। তুমি বারবার বলেছিলে এটা হতে পারে আমাদের এক সঙ্গে কাটানো শেষ দিনগুলো। তুমি আজ চলে যাবার পর কীভাবে আমি কাটাব? কীভাবে বিশ্বাস করব তুমি ফিরে আসবেই আমার কাছে? কালকের রাতটা আমাকে উৎসর্গ করলেও তুমি মৌন ছিলে যখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সো উই আর অলওয়েজ টুগেদার?’

-‘আমি জানি না সামনের পরিস্থিতি কতটুকু শিথিল হবে আর কতটুকু কঠিন। এক দিকে মাফিয়া সংগঠন অন্যদিকে জঙ্গি। যারা বাঙালিই৷ কিন্তু আইএস এর হয়ে লড়ছে ওরা৷ এ ব্যাপারে তোমাকে বিস্তারিত বলিনি কারণ আমি আমাদের এই সময়টুকুর মাঝে আর কিছু চাইছিলাম না। আমাকে যুদ্ধে নামতে হবে অতিশিঘ্রই। যেখানে সবাই এখন সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ আমি সেখানে সবাইকে অমান্য করে তোমার কাছে ছুটে এসেছি৷ এরপরও বলছ আমি তোমার কাছে ফিরব না?’

এরপরও আশফিক আগের মতোই বিষণ্নতায় নিশ্চুপ থাকে। মাহি তখন বলে ওঠে, ‘আমি যদি মরে যাই এটাই ভাবছ, তাই না?’

কথাটা শোনা মাত্রই আশফিক চোখদুটো বুঁজে মুখটা কাঠিন্য করে ফেলল৷ এ কথা মুখে উচ্চারণ করাও সম্ভব নয়। তবে সত্যি, এমনটাই ভাবনাতে আসছে ওর। কিছুদিন ধরেই সামাজিক মাধ্যমে দেখছে ও, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বহু নাগরিক আইএস এর হয়ে যুদ্ধে নেমেছে। নানা পরিকল্পনায় বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে ওরা৷ বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর নজরদারিতে আছে। যদিও গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও যথেষ্ট সজাগ। তবুও বর্তমান দুশ্চিন্তার বড়ো কারণ হয়ে আছে এরাই। কেননা আশঙ্কা করা হচ্ছে, এরা প্রচলিত বা অপ্রচলিত যে-কোনো পথে দেশে ফেরার চেষ্টা করবে আর ফিরতে পারলেই দেশে আপাতত নিয়ন্ত্রণে থাকা জঙ্গি তৎপরতাকে বিপজ্জনক মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে। বছর খানেক আগেই ভারতীয় বায়ুসেনারা এদের একটা ঘাঁটি ধ্বংস করেছে পাকিস্তানের সীমানা থেকে৷ এবার গোয়েন্দা বিভাগ তথ্য পেয়েছে এরা বাংলাদেশের পাশ্ববর্তী দেশ আসাম মেঘালয়ে ঘাঁটি গেড়েছে৷ তবে এ তথ্যের পুরোপুরি সত্যতা নিয়ে এখনও কিছুটা সন্দিহান সবাই।

আশফিকের নীরাবতা মাহিকে শান্তি দিচ্ছে না এক দণ্ডও। আর কতটুকু সময়ই বা আছে এক সঙ্গে ওরা! যদি সত্যিই এবার আর ফিরে আসতে না পারে? এ আশঙ্কা তো থেকেই যায়। মৃত্যুর আগে তো আশফিকের এই মলিন মুখটাই চোখের তারায় ভেসে উঠবে। ধূসর স্মৃতি নিয়ে ও ফিরতে চায় না। ও এবার ভালোবাসায় মোড়ানো রঙিন স্মৃতি মুঠো করে ফিরবে।

-‘তুমি কী চাও আশফি?’

নিঃশব্দে তাকাল আশফিক ওর পানে, ‘থেকে যাও। এ চাওয়া তো চাইতে পারব না। তোমাকে ফিরে পাবো, ভালোবাসার সুযোগ পাবো, এ কথা কি দেওয়া যায়?’

মাহি ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল, ‘ভালো তো এখনও বাসতে পারো।’

আশফিক মাহিকে আবার কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এখনও চাই, আগামীতেও চাই।’

মাহিও চায়। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো আশফিককে। আশফিক তখন ওর স্কন্ধ, গ্রীবাদেশ, বক্ষদেশ জুড়ে তপ্ত, আর্দ্র চুমুই আবিষ্ট করে হঠাৎ নিচুস্বরে আবদার জানাল, ‘আমার অস্তিত্বকে তোমার গর্ভে ঠাঁই দাও, মাহি৷ ভীষণভাবে চাই।’

-‘তাই হোক।’ উন্মাদনায় মাহিও অভিন্ন মত জানিয়ে দিলো।

আগামী পর্ব এমনিতেই বেশ বড়ো হবে৷ দেখা গেল আপলোড নাও হতে পারে৷ তাই কিছুটা দিয়ে দিলাম। এডিট করা হয়নি।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here