দিন কেটে যায় আশায় আশায়
প্রথম পর্ব
সুমাইয়ার সাথে আমার প্রথম দেখাটা একটু অদ্ভুত ভাবে হয়েছিল I আমি যে মেসে থাকি তার সামনেই একটা চায়ের দোকান I সামনে বললে ভুল হবে I গলি থেকে বের হয়ে একটু হাঁটলেই I মেসটা গলির একেবারে শেষমাথায় I ঠিক মেস বলা যায় না I কানা গলির ভেতর বাসা বলে ব্যাচেলারদের ভাড়া দিয়ে রেখেছেন বাড়িওয়ালা I ফ্যামিলি ভাড়া পাওয়া যায় না এখানে I একটু বৃষ্টি হলেই হাঁটু জল জমে যায় I অল্প ভাড়ায় থাকা যায় বলে আমার মত অনেকেই এখানে ভাড়া থাকে Iআমি ছাড়া আরো তিনটা ছেলে থাকে এখানে I দুই বেডের ফ্ল্যাট বাসা I এটাচ বাথ সহ বড় ঘরটাতে আমি থাকি I এজন্য অবশ্য ভাড়া গুনতে হয় আমাকে সবচেয়ে বেশি I ছোট ঘরটায় আরেকটা ছেলে থাকে I সম্ভবত স্টার কাবাবের ক্যাশিয়ার I চুপচাপ নিরিবিলি টাইপের ছেলে I প্রথমে আমরা দুজনই ভাড়া নিয়েছিলাম I ভালোই চলছিল I ঝামেলা বাধলো যখন বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়িয়ে দিলেন I আরো দুটো ছেলে কে জোগাড় করতে হলো I দুজনই কলেজের ছাত্র Iড্রইং ডাইনিং শেয়ার করে থাকে দুটো চৌকি পেতে I এই ছেলে দুটো কে মাসুদ জোগাড় করেছে I মাসুদ আমার পাশের ঘরে থাকে I খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা যার যার I প্রথমদিকে আমরা কাজের বুয়া রেখে রান্না করাতাম I কিছুদিনের মধ্যেই সেই ঘোর কেটে গেল I একবার খালা বাজারের সমস্ত টাকা নিয়ে পালিয়ে গেলেন I অবশ্য ফিরে এসেছিলেন এক মাস পর I আসার পর কান্নাকাটি অবস্থা I তার শ্বশুর মারা গেছে I তাই সে রাতেই চলে যেতে হয়েছিলI টাকা ফেরত দিতে পারেনি ইত্যাদি ইত্যাদি I আমরা কিছু বলিনি I এরপর নতুন কাজের লোককে বাজার করে দিতাম I বেশিরভাগ মাসুদই করত Iসে আরেক ফ্যাকড়া I কাঁচা বাজার অর্ধেক উধাও হয়ে যেত I মাছ-মাংসের বিভিন্ন অংশ দেখা যেত না I মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতাম লেজবিহীন মাছ আর এক পা ওয়ালা মুরগি কি করে হয় I এমনিতেই তখন খরচের ঝামেলায় নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় I সবে পড়াশোনা শেষ করেছি I টিউশনি করে দিন কাটাতে হচ্ছে I টিউশনির টাকায় এসব বিলাসিতা মানায় না I মাসুদের ও একি অবস্থা I সময় মতো বেতন দেয় না I অন্য চাকরির ধান্দা করছে I মাসুদের পড়াশোনা খুব একটা নেই I কোনমতে বিএ পাস করেছে I হিসেবটা ভালো বোঝে এই যা I যাই হোক একদিন মাসুদ বলল
এভাবে না চলে না রাশেদ ভাই I চলেন পার ডে মিল অর্ডার করি
সেটা কি জিনিস ?
হোটেলের মতো আরকি I পার মিল হিসেবে টাকা দিবেন
আমি রাজি হয়ে গেলাম I ভালো ব্যবস্থা I শুধু দুপুরের খাবারটা নিলাম I সকালের নাস্তা আমি কলিম ভাইয়ের দোকানে খাই I রাতে বিশেষ একটা খেতে পারিনা I এক প্যাকেট মিল্কভিটা দুইটা বিস্কুট দিয়ে চালিয়ে দেই I ছোটবেলায় এই জন্য মায়ের অনেক বকুনি শুনেছি I মা কাছে বসিয়ে জোর করে ভাত মুখে ঢুকিয়ে দিত I হাঁসফাঁস লাগতো I দম বন্ধ হয়ে আসত আমার I আর এখন মাঝে মাঝে রাতের বেলায় ক্ষুধায় দম বন্ধ হয়ে আসে I
চায়ের দোকানের উল্টোদিকেই একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় I বিশ্ববিদ্যালয় নামটা শুনলেই ছোটবেলায় যেরকম একটা চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠতো সেটা হল বিশাল ক্যাম্পাস সামনে নয়নাভিরাম বাগান I এক ডিপার্টমেন্ট থেকে আরেক ডিপার্টমেন্ট এ যেতে হলে রিক্সা নেওয়া লাগে I আজকাল দিব্যি এক ডিপার্টমেন্ট থেকে আরেক ডিপার্টমেন্টে লিফটের বাটন টিপে চলে যাওয়া যায় I এখানে ও ব্যাপারটা সেরকমই I ছয়তলা একটা বিল্ডিং I দুটো ডিপার্টমেন্টে এখানে I বিবিএ আর সম্ভবত ফার্মেসি কিং ল’ কিছু একটা হবে I সে যাই হোক চায়ের দোকানটাতে এরা চা বেশ ভাল বানায় I খদ্দের ও সেরকম I যতটা না লোকে চা খেতে আসে তার চেয়ে বেশি আসে সময় কাটাতে আর মেয়েদের দেখতে I অল্প বয়সি সুন্দরী মেয়ে দেখতে দেখতে চা খাওয়ার মজাই অন্যরকম I এই যেমন ঠিক এখন আমার উল্টোদিকে লোকটা বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আর সামনের দিকে তাকিয়ে মেয়েগুলোকে মনে হয় চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে Iতাকে দেখে কোনভাবেই ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে না I অথচ একটার পর একটা অর্ডার দিয়ে যাচ্ছে I প্রথমে এক কাপ চা দুটো বিস্কুট I সেটা শেষ করে একটা কলা I এরপর একটা কেক I কেক শেষ করার পর আবারও এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়েছে I আমি কৌতুহলী হয়ে বসে আছি দেখার জন্য যে এর পর কি হয় I আবারও দুটো বিস্কুট একটা কলা এভাবেই কি চলতে থাকবে ? লোকটার দিকে ভাল করে তাকালাম I হৃষ্টপুষ্ট শরীর I পেটের কাছে শার্টের বোতাম ফেটে বেরিয়ে আসছে ভুঁড়িI আমি নিশ্চিত এই লোক বাসা থেকে পেট ভরে নাস্তা করে বেরিয়েছে I পাশে একটা হলুদ রঙের টিফিনবাক্স ও দেখা যাচ্ছে I হয়তো বউ যত্ন করে দুপুরের খাবার দিয়ে দিয়েছে I
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলিম ভাই কে আমার সকালের নাস্তা দিতে বললাম I সকালের খাবার আমি এখানেই খাই I একটা বন রুটি একটা কলা আর একটা ডিম সিদ্ধ I কলিম ভাই পুরনো একটা কেতলিতে আমার জন্য এই ডিমটা সেদ্ধ করে রাখেন I এই ব্যবস্থা সবার জন্য না I মানে বলতে চাইছি যে এই দোকানে সিদ্ধ ডিম বিক্রি হয়না I আমার সঙ্গে কলিম ভাইয়ের একটা অন্য রকম সম্পর্ক আছে I সে বিষয়ে পরে আসছি I আপাতত ডিমের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে দেখলাম সামনের ভদ্রলোক একটা ডিম সিদ্ধ অর্ডার দিয়ে ফেলেছেন I খোসা ছাড়িয়ে শেষ করা গেল না তার আগেই কলিম ভাইয়ের সঙ্গে ভদ্রলোকের বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে গেল I এক কাস্টমারকে দেয়া হবে অন্যজনকে দেয়া হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি I ঝগড়াটা আরো কিছু দূর এগোতো কিন্তু তার আগেই উল্টোদিকের ইউনিভার্সিটি থেকে একটা মেয়ে এসে দোকানের সামনে ঝুলিয়ে রাখা কলা থেকে একটা ছিঁড়তে নিলে ভদ্রলোক সুযোগের শতভাগ সদ্ব্যবহার করে ফেললেন I ঝগড়ার মধ্যে একটু করে মেয়েটার গায়ে হাত দিয়ে দিলেন I আমি পেছন থেকে দেখে হা হয়ে গেলাম I এরকম উত্তেজনাকর মুহূর্তেও ভদ্রলোক কি করে সময়ের সদ্ব্যবহার করলেন I পরবর্তী ঘটনা ঘটল অত্যন্ত দ্রুততার সাথে I মেয়েটা চিৎকার, চেঁচামেচি, কাউকে দোষারোপ না করে একটা হাঁটু ভাঁজ করে ভদ্রলোকের বিশেষ জায়গায় আঘাত করলো I মুহূর্তে ভদ্রলোক মাটিতে পড়ে কুমড়ো গড়াগড়ি I মেয়েটা ততটুকুতে থামল না I লোকটার বিশাল আকার পশ্চাৎদেশের একটা লাথি বসিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে দোকানিকে বলল
এইরকম কাস্টমার যদি আপনার দোকানে আর দেখি ,দোকানে আগুন ধরায়ে দিবো I
আমি মেয়েটার দিকে ভাল করে তাকালাম I আপাদমস্তক বোরকায় মোড়া I শুধু চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না I কাধে একটা সস্তা ধরনের বড় ব্যাগ I মেয়েটা আমার পাশ কাটিয়ে রাস্তা পার হতে নিলে আমি লক্ষ্য করলাম উল্টোদিক থেকে একটা রিক্সা আসছে I নিজের অজান্তেই ওর একটা হাত ধরে টান মেরে ফুটপাতের ওপর তুলে নিয়ে আসলাম I মেয়েটা অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো I সেই দৃষ্টি দেখে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল I কিছুক্ষণ আগের ভদ্রলোক এর জায়গায় নিজেকে চিন্তা করেই শিঁউরে উঠলাম I মেয়েটা কি বুঝলো জানিনা তবে কিছু না বলেই দ্রুত রাস্তা পার হয়ে চলে গেল I ততক্ষণে কুমড়ো ভদ্রলোক উঠে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছেন I কলিম ভাই দোকান থেকে নেমে এসে আমার হাতে একটা আই ডি কার্ড দিয়ে বলল
আপা মনি মনে হয় ফালায় গেছে
আমি কার্ড হাতে নিয়ে দেখলাম তার উপর লেখা
সুমাইয়া চৌধুরি
ফার্মেসি বিভাগ
চলবে………