দিন কেটে যায় আশায় আশায়
#চতুর্থ পর্ব
ডিপার্টমেন্টে এসে জানতে পারলাম আমার নামে একটা চিঠি এসেছে I বেশ অবাক লাগলো I আমাকে চিঠি লেখার মত কে থাকতে পারে ? প্রথমেই যে নামটা মাথায় এলো সেটা হচ্ছে জাবির ভাই I জাবির ভাই , জুই এর বড় ভাই I বুয়েটে পড়ে I ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ার I বুয়েট পড়ুয়া বলেই হয়তো তার এমন একটা ভাব, যেন তার দুই পাশে দুটি অদৃশ্য ডানা আছে এবং সেই ডানায় ভর করে উড়বার জন্য অনেক মেয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে I ওনাকে অবশ্য খুব একটা দোষ দেয়া যায় না কারণ জুই এর আর সব বান্ধবীরাই উনাকে দেখে ক্রাশ খেয়েছে I আমার সঙ্গে উনার পরিচয় উনাদের বাসাতেই I ল্যাব শুরু হবার আগ পর্যন্ত ক্লাস শেষ হলে সাধারণত জুই আমাকে ওদের বাসায় নিয়ে যেতI এর অবশ্য একটা কারন ছিল , চারটা থেকে আমাকে টিউশনিতে যেতে হয় , 2 ঘন্টার জন্য বাসায় যাওয়ার কোনো মানে হয় না I সেভাবেই একদিন জুইদের বাড়িতে ঢোকার সময় উনি দরজা খুলে দিয়েছিলেন I জুই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলে উনি হু বলে চলে গেলেন I সত্যি কথা বলতে আমার রাগ হয়নি একটু বিরক্ত হয়েছিলাম Iমনে হয়েছিল ঢাকার ছেলেরা অযথাই অহংকার দেখায় I কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম যে উনি আমাকে কীটপতঙ্গ সদৃশ্য ভেবে থাকেন I অর্থাৎ আমি যে একটা বস্তু ঘরের মধ্যে বা বাড়ির মধ্যে আছি তা যেন অনুভবই করেন না I আমার অবশ্য তাতে বিশেষ কিছু যায় আসে না I তবে আমিও পরবর্তীতে উনার মতই আচরণ করা শুরু করলাম I প্রথম দেখা হলে সালাম দিতাম পরে সেটাও বাদ দিয়ে দিলাম I দৃশ্যপট অবশ্য সেরকম রইল না I
এক বছর পরের ঘটনা I তখন পুরোদমে ক্লাস চলছে I হঠাৎ করে একদিন বৈদ্যুতিক সংযোগ ভাল না থাকায় ল্যাব ক্যান্সেল হয়ে গেল I সেদিন টিউশনি না থাকায় আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাইছিলাম কিন্তু জুই বলল আমির খানের নতুন একটা সিনেমা এসেছে বাড়িতে কেউ নেই কাজেই ওর বাসায় গেলে সিনেমাটা দেখা যায় I আমি রাজি হয়ে গেলাম I প্রচন্ড গরম ছিল তাই বাড়ি গিয়ে বোরকা খুলে আরাম করে বসেছি I ওদের বাসায় ছোট একটা মেয়ে কাজ করে Iতাকে কোক আনতে নিচে পাঠানো হল I আমি হাতমুখ ধুয়ে এসে বসতেই দরজায় বেল বাজল Iকোক চলে এসেছে ভেবে আমি দরজা খুলে খুব লজ্জায় পড়ে গেলাম I কোক না জাবির ভাই এসেছে I আমার পরনে তখন জিন্স আর গোলাপি রঙের গেঞ্জি I মাথার চুল খোলা I এমনিতেই অনেক লম্বা চুল আমার I জাবির ভাই আমাকে দেখে কেমন যেন থমকে গেলেন I আমি তারাতারি ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লাম I সেদিনের পর থেকে ওনার আচার-আচরণ পাল্টে গেল I আমি দেখতে তেমন কিছু সুন্দরী নই I তবে হয়তো আমাকে এরকম আশা করেননি উনি I ভেবেছিলেন আমি বোরকা পরা ,গাঁইয়া টাইপের মেয়ে I আসলে খরচের সাশ্রয়ের কথা ভেবে ঢাকা কলেজের উল্টোদিক থেকে সস্তায় জিন্স আর গেঞ্জি কিনে পড়ি I বাড়ি থেকে যে কয়েকটা সালোয়ার-কামিজ নিয়ে এসেছিলাম এখানে পড়তে গিয়ে দেখি সবই খুবই আউট- ফ্যাশন মনে হয় I মেয়েরা সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় পড়ে ভার্সিটিতে আসে I তাদের সামনে আমাকে খুবই বেমানান দেখায় I ভেবেছিলাম ঢাকায় আসলে আপাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে কিছু জামাকাপড় বানাবো I কিন্তু এসে দেখি আপার অবস্থা আরো খারাপ I বাড়িতে বাইরে সব জায়গায় শাড়ি পড়ে থাকে I আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– আজকাল তো বাড়িতে কেউ শাড়ি পরো না I তুই শাড়ি পড়ে থাকিস কেন ?
উত্তর শুনে চমকে গিয়েছিলামI বিষয় হচ্ছে বিয়ের সময় যে কয়েকটা সালোয়ার-কামিজ নিয়ে এসেছিল সেগুলো পড়তে পড়তে যখন নষ্ট হয়ে গেল তখন দুলাভাই বললেন
– বিয়েতে এত শাড়ি পাওয়া গেছে সেগুলো কি কাজে আসবে ?
আমি এসব ঝুট-ঝামেলায় গেলাম না I নিউমার্কেট থেকে সুন্দর দুটো বোরকা কিনে নিলাম I বিপত্তি বাধল বোরকার নিচে কি পড়বো I জুই আমাকে ভালো বুদ্ধি দিলো I এক দিন সঙ্গে করে ঢাকা কলেজের উল্টোদিকের মার্কেটে নিয়ে গেল I আমি সস্তায় বেশকিছু প্যান্ট গেঞ্জি টি-শার্ট কিনে ফেললাম I আপার জন্য দুটা মেক্সি ও কিনলাম I দুলাভাই অবশ্য দেখে কিছু জানতে চাইলেন না I ভাবলেন আবার যদি তার কাছে টাকা চেয়ে বসে I তবে এরপর থেকে তার ধারণা হয়ে গেল যে আপার কাছে কিছু গোপন টাকা আছে I কোন কিছুর জন্য টাকা চাইলে সুন্দর বলে বসেন তুমি ব্যবস্থা করে নাও I এসব দেখতে দেখতে এক সময় আমার মেজাজ খারাপ হতে শুরু করল I আমি হালকা পাতলা কিছু প্রতিবাদ করা শুরু করলাম I এবং তারপর থেকে আস্তে আস্তে দুলাভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হতে লাগল I উনি আমাকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করা শুরু করলেন I এই যেমন একদিন আমাকে বললেন
সুমু ঘরটা খুব নোংরা হয়ে আছে মুছে ফেলো তো
আমি ঘর মুছতে পারি না
কিছুইতো শেখোনি দেখছি I শুধু খেতে পারো
আপনি তো অনেক কিছু শিখেছেন I ঘরটা মুছে একটু তার নমুনা দেখান
উনি যখন দেখলেন কথায় আমার সঙ্গে কথায় পেরে উঠছেন না তখন আপার উপর অত্যাচারটা বাড়িয়ে দিলেনI কোন বিষয়ে আমার প্রতি বিরক্ত হলে সেই রাগ আপার উপর দেখানো শুরু করলেন I এরকমই একদিন আমার ঘর থেকে শুনলাম তাদের মধ্যে বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হচ্ছে I অনেকক্ষণ সহ্য করার পর একসময় আর থাকতে পারলাম না I দরজায় টোকা দিলাম I যদিও দরজা খোলাই ছিল I আমাকে বাইরের পোশাক পরা দেখে দুলাভাই বিরক্ত হয়ে বললেন
কি ব্যাপার ?
আমিতো একটু বাইরে যাচ্ছি , পুলিশ আসলে আপনি কথা বলে নিয়েন
দুলাভাই হতভম্ব হয়ে গেলেন I বললেন
পুলিশ মানে ?
আমি পুলিশে ফোন করেছি I কোন ভরসা নেই কখন আবার আপনি কি করে বসেন I আমিও বাড়িতে থাকছি না I কিছু না করলে তো ভালোই Iআপনি কথা বলে নিয়েন I
দেখেছ সুরমা দুধ কলা দিয়ে আমি কাল সাপ পুষেছি
দুধ কলা দিয়ে সাপ পুষেননি বরং সাপের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দুধ-কলা কিনেছেন I
দুলাভাই রাগে গজগজ করতে করতে বাইরের পোশাক পরে বেরিয়ে গেলেন I আপা আমার কাছে এসে ভয়ে ভয়ে বলল
তুই কি আসলেই পুলিশে ফোন করেছিস ?
আরে ধুর I এই ঝামেলাটা কে বাসা থেকে বিদায় করতে চাচ্ছিলাম I তুই একটু রেডি হয়ে নে I চল আমরা সামনের পার্ক থেকে ঘুরে আসি I
পার্কে বসে আমরা অনেকক্ষণ বাদাম খেলাম I আমি অনেকক্ষণ আপার দিকে তাকিয়ে থাকলাম I আপা কেমন যেন অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে I প্রথমদিকে মার সঙ্গে কথা হলে কান্নাকাটি করত Iকিছু কিছু কথা বলতো I মা পাত্তা দিত না I তারপর একসময় কথা বলা বন্ধ করে দিল I দু’পক্ষই জানে সমস্যাটা কোথায় I দু’পক্ষই এড়িয়ে যায় I অথচ আমার মনে আছে আপাকে যেদিন দেখতে এসেছিল সবাই পাত্র দেখে সে কি খুশি I ব্যাংকার ছেলে ,এত সুন্দর দেখতে I দুলা ভাই বসেছিলেন ড্রইংরুমে তার আত্মীয় স্বজনদের মাঝখানে I পর্দার ফাক দিয়ে দেখে সবার ঘন ঘন ফিট যাওয়ার অবস্থা I সেজ খালা ঈর্ষান্বিত গলায় বললেন
আসমা তোর মেয়ের এত ভালো বিয়ে হবে ?
মায়ের গর্বিত কন্ঠ আমি আজও ভুলি না I এখানে আসার কিছুদিন পর দুলাভাইয়ের ব্যাপার-স্যাপার দেখে আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম I মাকে ফোন করে একদিন অনেক ঝগড়া করলাম I মা কিছুক্ষন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন I তারপর আমার সঙ্গে কথায় পেরে না উঠে একসময় বললেন
– তোর কি হিংসা লাগতেছে ?
– হিংসা ? আমার ? কি জন্য?
– তোর বোনের এত ভালো বিয়া হইছে I এখন কি সংসারটা ভাঙছে চাস ?
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দিলাম I বুঝলাম অরণ্যে রোদন I তবে এই সবকিছুতে একটা ব্যাপার হয়েছিল I শিক্ষিত এবং সুন্দর ছেলেদের প্রতি আমার মনে এক ধরনের বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছিল I তাদেরকে দেখলেই আমার মনে হতো এটা বোধহয় তাদের আসল রূপ নয় I একটা মুখোশ মাত্র I হয়তো এর ভেতর একটা কুৎসিত মানুষ লুকিয়ে আছে I আশ্চর্যের ব্যাপার হলো জাবির ভাইকে দেখে আমার এমনটা মনে হয় নি I উনি দেখতে যথেষ্ট সুদর্শন I আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো আমারও মনে হত একটা খুব সুন্দর, ভালো মনের ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হোক I জাবির ভাই যখন আমার সঙ্গে আস্তে আস্তে সহজ হয়ে উঠতে শুরু করলেন তখন আমিও তার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতাম I
একদিন বিকেলের ঘটনা Iজুই সেদিন ক্যাম্পাসে আসেনি I আমি টিউশনিতে যাবার আগে ভাবলাম একবার খোঁজ নিয়ে যাই I দরজা খুললেন জাবির ভাই I ওনার কাছে জানতে পারলাম জুই ডাক্তারের কাছে গেছে I তেমন কিছুনা মাথাব্যথা তাই আই টেস্ট করবে I হয়তো চশমা লাগবে I আমাকে বসতে বললেন I আমার বসতে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল I আমি বললাম
আজ থাক ভাইয়া
এখানে বসতে না চাইলে চলো ছাদে যাই
আমি কিছু বলছি না দেখে উনি কাজের মেয়েটাকে দরজা বন্ধ করতে বলে আমার সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলেন I সিঁড়িঘরে পৌছে আমি দেখলাম জায়গাটা বেশ অন্ধকার I আমার কেনো যেনো ভালো লাগলো না I আমি বললাম
– জাবির ভাই আমি ফোনটা ফেলে এসেছি Iআপনি তালা খুলে ভেতরে যান আমি নিচে থেকে ফোনটা নিয়ে আসছি I
আমি আর উপরে গেলাম না I সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে বাড়িতে চলে আসলাম I সেদিন আমি খুব আশ্চর্য্য হয়েছিলাম নিজের আচরণে I নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম আসলেই কি আমার উনাকে ভাল লাগে ? যদি ভালোই লাগতো তাহলে তো এ রকম অনুভুতি হতো না I বরং অন্ধকারাচ্ছন্ন সিঁড়িঘরে তার কাছাকাছি যেতে ইচ্ছা হওয়াটাই উচিত ছিল I হঠাৎ করেই মনে হলো আমি হয়তো মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি I ভেতরটা খুব শূন্য মনে হল I তবুও কেন জানি আজকে চিঠি পেয়ে জাবির ভাইয়ের কথাই মনে হলো I কি জানি হয়তো মনের গভীরতা ওনার জন্য আমার অনুভুতি আছে কিংবা নেই I আমি জানি না I
খামটা খুলে দেখলাম আমার আইডি কার্ডটা ভেতরে I তার সঙ্গে ছোট্ট একটা চিরকুট I প্রথমেই প্রেরকের নাম দেখলাম নিচে I লেখা আছে রাশেদুল হক I এই নামে কাউকে চিনি বলে মনে পরছে না I তবে চিঠিটা পড়ে ভালো লাগলো I যে লিখেছে তার হাতের লেখা সুন্দর I চিঠির বক্তব্য ও বেশ ভালো I ক্ষমা চেয়েছেন আমার হাত ধরার জন্য আর আমার সাহসের প্রশংসা করেছেন I
এভাবে আরো কযেকমাস কেটে গেল I দুলাভাইয়ের আচরণ এবং আপার শরীরের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হতে লাগল I সেইসঙ্গে উত্তরোত্তর আমার সঙ্গে তার সম্পর্কের আরও অবনতি হল I আমার পড়াশোনার চাপ বেড়েছে I পড়াশোনা টিউশানি সব মিলিয়ে আমি বাসায় খুব একটা সময় দিতে পারি না I সংসারের কাজ করে আপা একেবারে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল I দুলাভাই সংসারের কোন কাজে হাত লাগায় না I আবার কাজে লোক ও রাখেনা I কাজের লোক নাকি সব টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাবে I
অবস্থা দেখে আমি বললাম এত রান্না বান্না করার দরকার নেই I বাসায় কোন খাবার না থাকলে দুলাভাই নিজেই বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসবে I আপা সত্যিই আর পারছিলনা I প্রায় দিনই রান্নাবান্না করা হতো না I আমি চেষ্টা করতাম বাইরে থেকে খেয়ে আসতে I একদিন দুলাভাই বাড়ি ফিরে দেখল কোন খাবার রান্না করা নেই I এ নিয়ে মহা তুলকালাম হলো I পরদিন থেকে আপা অসুস্থ শরীর নিয়েই রান্নাবান্না শুরু করে দিল I ক’দিনের মধ্যেই যা হবার তাই হল I আবার ওর শরীর খারাপ হয়ে গেল I
বৃহস্পতিবার দিন সকালবেলা বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না I আমি কোনমতে সকালের খাবার তৈরি করে দিলাম I দুলাভাই খেয়ে বেরিয়ে গেলেন I আপার অবস্থা দেখে ওকে একা ফেলে যাওয়া সাহস হচ্ছিল না I আমি ক্লাসে গেলাম না I কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আপার ব্যথা শুরু হয়ে গেল I আপার ডেট আরো প্রায় মাসখানেক পর I কিন্তু ব্যথার তীব্রতা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো I আমি দুলা ভাইকে ফোন দিলাম I যথারীতি উনি ফোন ধরলেন না Iআমি কি করবো কিছুই বুঝতে না পেরে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম I ডাক্তারের কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল I উনি বললেন এখনই সিজারিয়ান করতে হবে I রোগী যেন ভর্তি করে ফেলা হয় I আমি কাউন্টারে যেতেই তারা টাকা জমা দিতে বললো I 5000 টাকা জমা দিতে হবে প্রথমে I আমি দুলা ভাইকে অসংখ্য বার ফোন দিলাম I ফোন ধরলে না I আমি মেসেজ পাঠালাম I আমার কাছে 500 টাকা ছিল ওদেরকে সেটাই দিয়ে বললাম
-আমি তো আসলে রেডি হয়ে আসিনি আপনারা উনাকে ভর্তি নিয়ে নিন ,আমি বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসছি I
জুইকে ফোন দিলামI ও বোধহয় ক্লাসে I আমি দেরি না করে রিক্সা নিয়ে ভার্সিটিতে চলে গেলাম I ক্যাম্পাসে গিয়ে জানতে পারলাম যে আজকে ও আসেনি I মাথা একেবারেই কাজ করছিল না I প্রচণ্ড গরমে গলা শুকিয়ে এল Iআমি দরদর করে ঘামতে শুরু করলাম I এখনই আবার হাসপাতালে যেতে হবে I আমার কাছে রিক্সা ভাড়া পর্যন্ত নেই I বাসের জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম I হঠাৎ করেই মনে হলো পরিচিত একজনকে রিকশা থেকে নামতে দেখলাম I ঠিক মনে করতে পারলাম না I তবে দেখলাম উনি আস্তে আস্তে এই দিকে হেঁটে আসছেন I বাস চলে এসেছে I প্রচন্ড ভিড় I কিন্তু আমাকে এই বাসটা ধরতেই হবে I আপাকে ওই অবস্থায় ফেলে রেখে এসেছি I হঠাৎ করেই চোখের সামনে কেমন অন্ধকার দেখলাম I এরপর আর কিছু মনে নেই I
আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করলাম I আমার হাতে স্যালাইন দেয়া I আমি আশ্চর্য হয়ে পাশে তাকিয়ে নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম
– আমার কি হয়েছে ?
-তেমন কিছু না I হিট স্ট্রোক I শরীর থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে গেছে I সকালে খেয়েছিলে কিছু ?
– আমাকে যেতে হবে
– দাঁড়ান ,আপনার হাসবেন্ডকে ডাকছি
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম I বুঝলাম না এখানে আমার হাসবেন্ড কোথা থেকে এলো ? আর আমিই বা এখান কি করে এলাম ? আমি কোন মতে মাথায় ওড়নাটা দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছি তখন দেখলাম রাশেদ ভেতরে আসছে I আমাকে দেখে উনি বললেন
– এখন কেমন লাগছে ?
– আমাকে যেতে হবে I আপনি এখানে আমাকে নিয়ে এসেছেন ?
– জি I আপনি রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন I তাই এখানে নিয়ে আসতে হলো
– আপনি এখানে সবাইকে কি বলেছেন ? আপনি আমার হাসবেন্ড ?
রাশেদ হেসে ফেললো I তারপর বলল
আমি কিছুই বলিনি I ওরাই ধরে নিয়েছে I
আমি উঠে বসতে বসতে বললাম
– আমাকে যেতে হবে I
রাশেদকে তেমন একটা বিচলিত মনে হলো না I শান্ত গলায় বলল
– সিনেমার নায়কদের মত এখন যদি আপনি স্যালাইন ছিড়ে ফেলে চলে যান তাহলে কিছুই করতে পারবেন না I আবার একটু পরে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন I কি হয়েছে আমাকে বললে আমি হয়তো সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারি I
আমি কিছু বলতে পারলাম না হঠাৎ করে প্রচন্ড কান্না পেল I বহু বছর পর এরকম বাইরের কোনো মানুষের সামনে কাঁদলাম I নিজেকে এত অসহায় কখনো মনে হয়নি I রাশেদ আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল না I শুধু বলল
– কি সমস্যা বলুন
আমি তাকে সব বললাম I উনি আমার কাছ থেকে দুলাভাইয়ের ফোন নাম্বার নিয়ে বাইরে চলে গেলেন I কিছুক্ষণ পর এসে বললেন
চলেন
আমি অবাক হয়ে বললাম
কোথায় ?
হাসপাতালে
আমরা একটা সিএনজি নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলাম I হাসপাতালে পৌঁছে দেখলাম আপার অপারেশন শুরু হয়ে গেছে I কিছুক্ষণের মধ্যেই দুলাভাই চলে এল I প্রথমে আমাকে দেখে খুব হম্বিতম্বি করল I রাশেদকে আমি কিভাবে চিনি ? আমার কতদিনকার প্রেমিক ইত্যাদি ইত্যাদি বলে হাসপাতালের করিডরেই হইচই শুরু করে দিল I রাশেদ ঔষধ কিনতে ফার্মেসিতে গিয়েছিল I ফিরে এসে এসব হইচই দেখে আস্তে আস্তে দুলাভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল
– আসসালামু আলাইকুম I আপনি মনে হচ্ছে সুমাইয়ার দুলাভাই I একটু আমার সঙ্গে এদিকে আসবেন ?
ওরা দুজন একটু দূরে চলে গেল I দুজনের মধ্যে কি কথাবার্তা হচ্ছে আমি ঠিক শুনতে পেলাম না I তবে স্পষ্টই দেখলাম দুলাভাইয়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে I উনি তাড়াতাড়ি কাউন্টারে গিয়ে সব বিল মিটিয়ে দিলেন I এমনকি ঔষধের টাকা ও রাশেদকে ফিরিয়ে দিলেন I আমি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলাম I কিছুই বুঝতে পারলাম না I ততক্ষণে নার্স চলে এসেছে I নার্স পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দিলেন I আমাদের তিনজনের মধ্যে সবচাইতে খুশি মনে হল রাশেদকে I বাচ্চা দেখার জন্য অস্থির হয়ে গেল ও I মজার ব্যাপার হচ্ছে বাচ্চাকে প্রথমে রাশেদই কোলে নিল I আমাদের হতবিহবল অবস্থা তখনও কাটেনি I
সব ঝামেলা মিটে গেলে উনি আমাকে বললেন I
– আপনার মনে হয় সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি I
আমার মনে পড়লো সত্যিই আমি সকাল থেকে কিছুই খাইনি I আমি আর কিছু বললাম না I রাশেদ আমাকে ক্যান্টিনে নিয়ে গেল I আমরা দুজন বসে হালকা কিছু খাবার খেলাম I রাশেদ বলল
– আপনার শরীর এখনো খারাপ বাড়ি চলে যান I এখানে সব ঠিকই থাকবে I
– আপনি কিভাবে এত কিছু ম্যানেজ করলেন ?
-ও কিছুনা I আপনি সুস্থ হলে পরে একসময় সব বলবো I
এরপর একটা কাগজে আমাকে একটা ফোন নাম্বার এগিয়ে দিয়ে বললেন
– এটা আমার নাম্বার I যদি কোন প্রয়োজন মনে হয় ফোন করবেন I চলেন আপনাকে রিক্সা করে দিই I
চলবে ……….