দিন কেটে যায় আশায় আশায়
#অষ্টম পর্ব
– তুই আমাকে বলিস নি কেন ,যে তুই প্রেম করছিস ?
জুঁইয়ের কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম I ও আমার দিকে অভিমানী মুখ করে তাকিয়ে আছে I যেন আমি মহা কোন সত্য গোপন করে ফেলেছি I আমি অবাক হয়ে বললাম
– আমি প্রেম করলে তুই জানতি না ?
– তাহলে কার সঙ্গে সেদিন রেস্টুরেন্টে বসে ছিলি ?
এবার আমি ব্যাপারটা বুঝলাম I বললাম
– তোকে কে বলেছে?
-যেই বলুক I
-আমিতো রাশেদকে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম I তোকে তো বলেছি সে কথা I
-ওইটা রাশেদ ছিল ?
-হ্যাঁ I আর কার সঙ্গে আমি যাব ?
জুঁই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল I আমি আর আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না I তবে ও ছাড়লো না I খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানতে চাইল I কি খেলাম , কি গল্প করলাম I আমি সবই ওকে বললাম I শুধু ওর মত জাবির ভাইয়ের অংশটুকু এড়িয়ে গেলাম I প্রথমদিকে চাইলেও এখন আমি কোনভাবেই জুঁইয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা নষ্ট করতে চাই না I এটাও একটা কারণ ,আমি জাবির ভাইকে এড়িয়ে যাই I তাছাড়া ওনাকে আমার যতটা টিপিক্যাল মনে হয়েছিল ,সেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা হওয়ার পর মনে হলো উনি তার থেকেও বেশি টিপিকাল I রেস্টুরেন্টে একটা ছেলের সঙ্গে বসে হাসতে দেখেই আমার সম্পর্কে একটা ধারণা করে নিল I এ ধরনের মন-মানসিকতা আমার খুব খারাপ লাগে I যাক ,কি আর করা I ভাগ্যিস আমি লোকটার প্রেমে পড়িনি I তাহলে নেহাত আমার কপালে দুঃখ ছিল I তবে এর বাইরেও যে আমার কপালে দুঃখ আছে সেটা বাড়িতে গিয়ে টের পেলাম I
টিউশনি শেষ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল I বাড়ি এসে দেখি দুলাভাই আগেই চলে এসেছে I আমাকে দেখে আপা বলল
হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয় I সেই সকালে বেরিয়েছিস I
দুলাভাই তখন টেবিলে বসে চা খাচ্ছিল I অথচ তখন আমাকে কিছুই বলল না I রাত দশটার দিকে যখন ঘুমাতে যাব ,তার আগে হঠাৎ করে আমাকে আর আপাকে ডেকে বলল
– আমার অফিসের কলিগ রায়হান সাহেব I তার সঙ্গে সুমাইয়ার বিয়ে ঠিক করেছি I
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম I হঠাৎ করে বলার মতন কিছু খুঁজে পেলাম না I আপার অবস্থা হলো ঠিক তার বিপরীত I যে আপা কখনোই দুলাভাইয়ের উপর কথা বলে না, আজ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল
– বিয়ে ঠিক করেছ মানে ?
– তোমার বোনের গতি করেছি বল I রায়হান ভাই আমার সেইম পোস্টে আছে I এক পয়সা নেবে না I 2 লক্ষ টাকা কাবিন নগদ দেবে I পাঁচ ভরি সোনা ও দেবে I এমনকি খাবারটা পর্যন্ত তারাই ব্যবস্থা করবে I আর কি চাও তোমরা ? তোমার এই বেয়াদব বোনের এর থেকে ভালো আর বিয়ে হবে ?
– ছেলের বয়স কত ?
বয়স আর কত ? আমার থেকে কয়েক বছরের বড় হবে I
আপাকে দেখতে হিংস্র বাঘিনীর মত দেখাচ্ছে I পারলে এখনি দুলাভাই এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে I আমি ওর একটা হাত ধরে শান্ত গলায় বললাম
– আমাকে জিজ্ঞেস না করে আপনি আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন ? বাসায় জানানোর তো একটা ব্যাপার আছে I
আমি ভেবেছিলাম এই কথা বলে হয়তো দুলাভাইকে একটু দমানো যাবে I কিন্তু দেখলাম , না উনি আটঘাট বেঁধে নেমেছেন I আমার কথা শুনে তির্যক হেসে বললেন
– আম্মার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে I কালকে বাদ আছর বিয়ে হবে I
আপা চিৎকার করে বলল
– তোমার কথাতে নাকি ? ছেলে এখন পর্যন্ত দেখলাম না I ছেলেও তো সুমাইয়াকে দেখেনি I
দুলাভাই বলল
– সুমাইয়ার ছবি দেখে রায়হানের পছন্দ হয়েছে I আর কি চাও ?
– ছেলের বাড়িতে কে কে আছে ?
– কেউ নেই I একাই থাকে I
– বাপ-মা নাই ?
– না
– এতিম ?
– ইয়ে মানে, আগে একটা বিয়ে হয়েছিল I ডিভোর্স হয়ে গেছে I
আপা আঁতকে উঠে বললো
– কি !
– হ্যাঁ I সেই মেয়ের চরিত্র ভাল ছিলনা I
– এই বিয়ে কিছুতেই হবে না Iএরকম ছেলের সাথে আমি সুমাইয়ার বিয়ে হতে দেবো না I
দুলাভাই এইবার তার আসল রূপটা দেখালো
-বিয়ে না করলে এক্ষুনি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যেতে হবে I
যা বুঝলাম, আপাও এবার ছেড়ে দেবার মতো অবস্থায় নেই I ও বলল
– চলে যেতে হলে চলে যাবে , কিন্তু এই বিয়ে করবে না I
দুলাভাই চিবিয়ে চিবিয়ে বললো
– যেতে হলে তোমাকেও যেতে হবে I দুই বোন বাচ্চা নিয়ে এখনই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও I
আপা চিৎকার করে কান্না শুরু করলো I তারপর কাঁপতে কাঁপতে বললো
– আমার জন্য আমি আমার বোনটার জীবন নষ্ট করতে পারবো না I
আমি দৌড়ে এসে আপাকে জড়িয়ে ধরলাম I কেন জানিনা হঠাৎ আমারও কান্না পেয়ে গেল I আমাদের কান্নাকাটিতে বাবু উঠে পরল I দুলাভাই কর্কশ গলায় বললেন
– এসব নাকি কান্না বন্ধ করো I আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দাও I কালকে অনেক কাজ I তারপর আমার কাছে এসে বললেন
-বাড়ি থেকে যদি পালানোর চেষ্টা করো তাহলে লাথি মেরে তোমার বোনকে বাচ্চাসহ রাস্তায় নামিয়ে দেব I
আমি আর কোন কথা বললাম না I বাবু আর আপাকে নিয়ে আমার ঘরে চলে এলাম I আপাকে শান্ত করতে আমার বেশ কিছুটা সময় লাগলো I আমি বললাম
– মাকে ফোন দিয়ে দেখি I
আপা কাঁদতে কাঁদতেই বললো
– কোন লাভ নেই রে I
তবুও আমি আশা নিয়েই মাকে ফোন দিলাম I এবং যথারীতি হতাশ হলাম I আপার কথাই ঠিক I মা খুশিতে গদগদ হয়ে আছে I এতটাই আনন্দিত যে বিয়েতে আসতে পর্যন্ত চাইছে না I বিয়ের দিন পিছিয়ে গেলে যদি বিয়েটা না হয় I আমি আর বলার মত কিছু খুঁজে পেলাম না I
বাবু ঘুমিয়ে পড়েছে I আপা সমানে কেঁদেই যাচ্ছে I কেন জানিনা আপাকে দেখে আমার হঠাৎ খুব মায়া হল I আপা হয়তো ভেবেছিলো বাবু জন্ম হলে দুলাভায়ের একটু পরিবর্তন হবে I হয়তো মনে মনে অনেক আশা করেছিল I মানুষ তো আশা নিয়েই বেঁচে থাকে I আপা বলল
-ফজরের নামাজের পর তুই চলে যাবি I আমাকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না I
-এটা কি হয় আপা ?
-এটাই হবে I দরকার হলে আমি ছেলে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করবো I তবুও ওই লোকের সঙ্গে তোর বিয়ে হতে দেবো না I
-আচ্ছা ঠিক আছে I কাল দেখা যাবে I
আমি অনেকক্ষণ আপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম I এক সময় দেখলাম ও কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে I কিন্তু আমি এক ফোঁটা ঘুমাতে পারলাম না I মাথা কিছুতেই কাজ করছে না I বুঝতে পারছিনা কি করবো I সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে পারি I কিন্তু কোথায় যাব ? বাড়ি ফিরে যাবার কোনো উপায় নেই I মা কিছুতেই ঢুকতে দেবেনা I জাবির ভাইয়ের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি তাতে তাদের বাসায় যাওয়া সম্ভব না I নির্ঘাত উনি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন I
একটু তন্দ্রা মতো এসে গেছিল I ফজরের আযান শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল I আমি উঠে নামাজ পড়লাম I আপাকে ডাকার সাহস হলো না I ঘুম ভাঙলেই হইচই শুরু করে দেবে I মাথা একেবারেই কাজ করছে না I কারো সঙ্গে একটু পরামর্শ করতে পারলে ভালো লাগতো I হঠাৎই মনে হলো রাশেদকে একটা ফোন দেই I ওর তো মাথা অনেক ঠান্ডা I নিশ্চয়ই একটা কোন উপায় বলতে পারবে I আমি ফোন করে বললাম
– এত সকাল ফোন করে কি আপনাকে বিরক্ত করলাম ?
– না I আমি নামাজ পড়ে ফিরছিলাম I
– আমিও সেটাই ধারণা করেছিলাম I
– কি হয়েছে সুমাইয়া ? কোন সমস্যা ?
– হ্যাঁ I একটা সমস্যা হয়েছে I
– কি হয়েছে বল
আমি সবটা ওকে বললাম I সব শুনে ও কেমন এলোমেলো গলায় বলল
কি বলছ এসব ? আমার তো মাথাই কাজ করছে না I
এত ঝামেলার মধ্যেও আমি হেসে ফেললাম I তারপর বললাম
আপনার যদি মাথা কাজ না করে তাহলে আমার কি হবে ?
দাঁড়াও দাঁড়াও I একটু ভাবতে দাও I কবে বিয়ে বললে ?
আজকে বিকালে I
আমি তোমাকে এক ঘন্টা পরে ফোন করছি I
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম I কেন যেন খুব ক্লান্ত লাগছে I সব চিন্তা বাদ দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে I আমার বাবা যখন মারা যায় তখন আমার বয়স 11 বছর I বাবা সবসময় একটা কথা বলতেন জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে তিনটা নাকি আল্লাহর হাতে I আমার মনে হলো যদি এভাবেই আমার বিয়ে আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছেন তাহলে এভাবেই হবে I আমি চাইলেও সেটাকে আটকাতে পারব না I আমি সব ভুলে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম I
ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছি আমি জানিনা I আপার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙলো I ঘুম ভাঙ্গার পর কিছুক্ষণ পর্যন্ত বোধহয় মানুষের ব্রেইন কাজ করে না I আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম আপার দিকে I আপার মুখ হাসি হাসি I ও আমাকে তাড়া দিয়ে বলল
– তারাতারি ওঠ I বর এসে গেছে I
আমি কোনমতে বললাম
-কয়টা বাজে ?
-11 টা I তাড়াতাড়ি যা I গোসল করে নে I
আপা আমার হাতে জামা কাপড় দিয়ে আমাকে গোসল করতে পাঠিয়ে দিল I নিজেকে কেমন যন্ত্রচালিত রোবটের মতন মনে হচ্ছে Iআমি আশাবাদী কোনো মানুষ নই Iতবে এটা সত্যি যে আমি ঘোর আস্তিক I আমি বিশ্বাস করি ,আল্লাহ আমার জন্য যা নির্ধারণ করে রেখেছেন সেটা নিশ্চয়ই আমার ভালোর জন্য I তাছাড়া উনি তো আমাকে কবুল বলার স্বাধীনতা দিয়েছেন I এটাতো আমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না I আমি এক ফোঁটা কাঁদলাম না I খুব স্বাভাবিকভাবে গোসল সেরে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলাম I
বাথরুম থেকে বেরিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম I আমার ঘরের আলমারিতে হেলান দিয়ে রাশেদ দাঁড়িয়ে আছে I আমাকে দেখে ও হড়বড় করে বলল
– সরি সুমাইয়া I এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না I আমাকে বিয়ে করতে কি তোমার কোন আপত্তি আছে ?
আমি অনেকক্ষণ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না ঠিক কি হচ্ছে I যখন বুঝলাম তখন বললাম
আমি আপনাকে সাহায্য করতে বলেছিলাম I আমাকে উদ্ধার করতে তো বলি নি I
চলবে………