অনুভূতিরা মৃত ষষ্ঠ পর্ব

0
299

গল্প- অনুভূতিরা মৃত
ষষ্ঠ পর্ব
.
হারিয়ে যেতে চাই, তোমার ভালবাসার ভাবনায়। সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে হলেও তোমাকেই চাই, জ্যোৎস্না রাতে তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোতে চাই, একসাথে হেঁটে যেতে চাই তোমার শহরে। হাতে হাত রেখে পাড়ি দিতে চাই শেষদিন পর্যন্ত। মোদ্দা কথা ভালোবাসি তোমায়। আমাদের দেশের মেয়েরা সাধারণত প্রপোজ করে না। সকলেই চান, মেয়েরা একটু লাজুক হোক, আর সেই মেয়ে নিজের লাজ ভেঙে, মনের ভাব প্রকাশ করে কোনো ছেলেকে প্রপোজ করেন তখন তা একটু অস্বাভাবিক লাগে। সময়ের সাথে সাথে অস্বাভাবিক বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে উঠছে, পৃথিবীর সকল মানুষই ভালোবাসার মানুষের কাছে ভিতু থাকে। কখনই সাহসী হয়ে উঠতে পারে না, আর সাহসী হয়ে উঠতে পারলে ভীষণ ধন্য হয়। নিঃসন্দেহে মিহি সাহসী কিন্তু ভালোবাসার কাছে ভিতু কেননা রুয়েল এখনও নিশ্চুপ। তার নীরবতা মিহিকে ভাবাচ্ছে, রাতের কিন ব্রিজে আলো ঝলমল করছে, ঝলমল আলোতে মিহির মুখ স্পষ্ট ভেসে উঠছে, মলিন চেহারায় মিহি অপেক্ষায় উত্তরের।
.
রুয়েল নিশ্চুপ; উত্তরে কী বলবে জানা নেই তার। এতদিন ধরে যেটার ভয় পেয়েছে সেটাই হয়েছে, ঠিক এসব কারণেই মেয়েদের এড়িয়ে চলে। নিরবতা ভেঙ্গে সে জবাব দেয়– অ্যাই এম নট ইন্টারেস্ট বাট অ্যাই স্যালুট ইউর চয়েজ। মূহুর্তেই চমকে উঠে মিহি লজ্জায় সে ডুবতে বসেছে। রুয়েল চলে যাচ্ছে, দৌড়ে পথ আটকায় মিহি। মানুষ মাত্রই ভালোবাসার পূজারি। প্রিয় মানুষটি ভালো না বাসুক, তবে প্রাণখুলে কথা বলুক কিংবা মাঝেমধ্যে দেখা করুক, এতেই তো ভালোবাসার সুখ।
— আমাকে ভালবাসতে হবে না৷ কখনো ভালোবাসি বলে বিরক্ত করব না। শুধু বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দাও রক্ষা করে যাব বন্ধুত্বের মর্যাদা।
এবারও রুয়েল নিশ্চুপ। এক অজানা ভয়। যা মনের ভিতর ঝড় তুলে যাচ্ছে, যে ভয়ে মেয়েদের এড়িয়ে চলে সেই অজানা ভয়ের কোন উত্তর নেই তার। চলে যায় সে। পরাজিত সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে মিহি। প্রথম প্রেম কখনোই মুছে যায় না। বিশেষ মুহূর্তগুলিতে হৃদয় ঠিকই বলে উঠে, আমাকে খোঁজ না তুমি বহু দিন, কতদিন আমিও তোমাকে খুঁজি নাকো। জীবনের প্রথম প্রপোজ বিশেষ একটি স্মৃতি হয়ে থাকে আর তা যদি হয় রিজেক্ট তাহলে অজস্র দুঃস্মৃতি বয়ে বেড়ায় বিষাদের ধূসর ছায়া গ্রাস করে হৃদয়ের উঠোনকে। নিমিষেই চোখের কোণে হাহাকার মিশে জমে এক ফোঁটা জল; যাকে আমরা কান্না বলি। এই মূহুর্তে মিহির চোখের কোণে হাহাকার খেলা করছে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে আসছে। বারংবার কানে বাজছে, অ্যাই এম নট ইন্টারেস্ট বাট অ্যাই স্যালুট ইউর চয়েজ। ইনডেরেক্টলি অপমান, তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে, রাগ অভিমান বেড়ে চলছে, এক সময় সে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
.
রাতে ফেইসবুক লগিন করে রুয়েল, স্ট্যাটাস লিখে– নারী না থাকলে পুরুষ জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকতো না এই পৃথিবীতে। একজন নারী হতে পারে আপনার মা, বোন, প্রেয়সী, মেয়ে অথবা সহকর্মী। সম্পর্ক যেটাই হোক একজন পুরুষ হিসেবে নারীকে দেখা উচিত সম্মানের চোখে। উক্ত পোস্টে নীলাশা কমেন্ট করে, ফেইসবুকে নারীবাদী স্ট্যাটাস দিয়ে নিজেকে হিরো সাজাতে চান প্রকৃতপক্ষে আপনি জিরো। মনে পড়ে, কিন বিজে সন্ধ্যা রাতের কথা? রুয়েলের চোখ ছলছল করে। ভাবতে থাকে সে, নীলাশা তাহলে মিহির আইডি? সত্যিই মিহির প্রতি অন্যায় হয়েছে, প্রতিটি মানুষের আবেগ আছে; সেই সাথে রয়েছে ভালোবাসার অধিকার। তাকে তার মতো করে ভালোবাসার সুযোগ দেওয়া যেতো, গ্রহণ করা যেতো বন্ধুত্ব; যেখানে ভালোবাসা অদূর ভবিষ্যতে বন্ধুত্ব ছুটে যেতো আরও বহুদূর।
.
বন্ধুত্ব এমন একটা শব্দ যার অর্থ আজও বুঝে হয়ে উঠা হলো না। বন্ধুত্বকে শুধু একটি কথায় বা শুধু একটি গানে কিংবা শুধু একটি কবিতায় সংজ্ঞায়িত করা যায়না। বন্ধুত্বের সীমানা সীমাবদ্ধ করা যায়না! গল্প উপন্যাসে, বন্ধুত্বের সীমানা অসীম। এই মূহুর্তে হেনরি ডেভিড থিওরোর উক্তিটি বেশ মনে পড়ছে, আমার বন্ধুর জন্যে সবচেয়ে বেশি যা করতে পারি তা হলো শুধু বন্ধু হয়ে থাকা। তাকে দেয়ার মতো কোন সম্পদ আমার নেই, সে যদি জানে যে আমি তাকে ভালবেসেই সুখী। সে আর কোন পুরস্কারই চাইবে না। এক্ষেত্রে বন্ধুত্ব কি স্বর্গীয় নয়? মিহি হয়তো এমনটাই চেয়েছিল। তার চোখ মিথ্যে বলেনি, মানুষের মুখ মিথ্যে বললেও চোখ মিথ্যে বলেনা। সত্যি অন্যায় হয়েছে মিহির উপর ভাবতেই তার চোখ লাল হয়ে উঠছে, অপরাধবোধ বারবার নিজেকে দংশন করে চলছে, একটি রাতের অপেক্ষা। রাত পোহালেই ছুটে যেতে হবে মিহির কাছে, স্যরি বলে মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে গ্রহণ করবে বন্ধুত্ব।
.
পৃথিবীর আলো-বাতাস-রোদ গায়ে মেখে আমরা নতুন একটি ভোরের স্বপ্নে বুঁদ হই, যেই স্বপ্নে অপেক্ষা করি নতুন একটি সকালের। রাতের আঁধার নিভে পূর্বের আকাশে লাল সূর্য জেগে উঠে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে মায়ের ডাক।
— ওই, ওঠ নবাবজাদা!
— আর একটু ঘুমায় আম্মু! ক্লাসের এখনও অনেক সময় বাকি
— আজকে তোর ক্লাসে যেতে হবে না। আজ একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাব।
মূহুর্তেই লাফিয়ে উঠে রুয়েল। বিয়ের অনুষ্ঠান মানে? মা বলে উঠেন, হ্যাঁ বিয়ের অনুষ্ঠান। জলদি করে নাস্তা সেরে রেডি হয়ে আয়।
.
মা ভক্ত রুয়েল। তার জীবনে মায়ের গুরুত্ব বহুভাবে। ওয়াল্ড মোস্ট ইম্পরট্যান্ট পার্সন ইন ইউর লাইফ, মায়ের বাধ্য সন্তানের মতো রেডি হয়ে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মা। মূহুর্তেই বলে উঠলেন, তোর কী চয়েজ, বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে কেউ শার্ট পড়ে? এবার আর কোন ভুল নয়৷ মায়ের পছন্দের নীল পাঞ্জাবিতে সাজিয়েছে নিজেকে, বিয়ে বাড়িতে পা রাখতেই অসংখ্য মেহমান। বাঙ্গালি বিয়ে মানেই, বিশাল ব্যপার, ব্যান্ড বাজবে, ডিজে হবে সাথে থাকবে হলুদ প্রোগ্রাম। প্রচণ্ড ভলিউমে ডিজে বাজছে, পাশের স্টেজে ডান্স চলছে, কেউ সেলফি তুলছে, কেউবা গল্প করায় ব্যস্ত, সুন্দরী রমনীদের আগমনে বিয়ে বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সেদিকে মন নেই তার। বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে মিহিকে, আশেপাশে তাকাচ্ছে রুয়েল। এই বুঝি এখানে মিহির দেখা পেয়ে যাবে। বাংলা সিনেমায় হলে এটা সম্ভব হতো। হিরোইনকে যখন পুরো পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হন্ন হন্ন হয়ে খুঁজে হিরো যখন ক্লান্ত তখনি হিরোইনের দেখা মিলে কোন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। এই মূহুর্তে জীবনটা বাংলা সিনেমার মতো হলে মন্দ হয় না৷ ঠিক তখনি ভেসে আসে, এক্সকিউজ মি! আপনি বরপক্ষ না কনে পক্ষ? উত্তর দেবার সময় নেই কেননা এর আগেই যে মায়ের ডাক। মায়ের ডাকে ছুটে যায় রুয়েল।
— এই যে, আমাদের রুয়েল।
— ওমা, এ আমাদের রুয়েল? কত বড় হয়ে গেছো বাবা। ছোট বেলায় যা দুষ্টু ছিলে না। তা বাবা এখনও কি দুষ্টুমি করো?
এই বলেই হেসে উঠলেন তারা। লজ্জা পেয়ে সড়ে যায় সে। ছোটবেলায় তাদের বাসায় একবার আন্টির আগমন হয় সাথে ছিলেন উনার মেয়ে। সমবয়সী বন্ধু পেয়ে আনন্দে আত্মহারা রুয়েল। এক পর্যায়ে বেদনার জল। এবার যে বিদায়ের পালা। চলে যাবে তার সাময়িক খেলার সাথী কিন্তু সে তো বিদায় জানাতে অপারগ। বিয়ে করে রেখে দিবে মেয়েটিকে, তবুও ছাড়বে না। এই নিয়ে বিশাল কাহিনি, এখন মনে হলে হেসে উঠে সবাই৷ লজ্জায় ডুবে রুয়েল৷
.
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, বুকের ভিতর কেমন যেন এক হাহাকার। কি যেন নেই, অপরাধবোধ বারবার নিজেকে দংশন করে চলছে। কোনভাবেই যে মিহির কাছে স্যরি বলা হলো না। একটা স্যরি বলতে চাতক পাখির মতো মন তার আনচান করছে, সময় যেন ফুরচ্ছে না। সকাল হতেই ছুটে চলল বিশ্ববিদ্যালয়ে। শান্ত সকাল। পাখির কিচির মিচির শব্দে ক্যাম্পাসকে সুন্দর করে তুলেছে, অপেক্ষা করে চলছে মিহি নামক এক চাতক পাখির। যার ডাক শুনা যাচ্ছে না। ক্যাম্পাসের কোন ডালে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবনায় পড়ে যায় রুয়েল। ভাবনার দুয়ার তার দীর্ঘ হয়। অপেক্ষার প্রহর বাড়ে, এক পর্যায়ে মিহির বান্ধবী এসে জানায়, যা শুনার জন্য কখনোই প্রস্তুথ ছিল না রুয়েল। অশ্রু টলমল করে ঝরছে, নিজেকে যে বেশ অপরাধী মনে হচ্ছে; না! মিহি এমন করতে পারে না।
.
চলবে…………
সাকিব হাসান রুয়েল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here