চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ ছাব্বিশ

0
656

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ ছাব্বিশ
#মম_সাহা

(৭১)

বাহার ভাই বিহীন আজ তিন তিনটে দিন কেটে গেলো। কেমন নীল বিষাদ সমুদ্রে কূল কিনারা বিহীন দিন গুলো। সকাল, দুপুর,রাত নিজেদের মতন মুগ্ধতা ছড়াতে যেন ব্যর্থ হলো তিনটে দিনে। চিত্রার মনে যেই গভীর অমাবস্যা নেমেছে, সেই অমাবস্যার আঁধার ছাপিয়ে সূর্য উঠতে পারে নি। রাত গুলো কেমন ডুকরে কেঁদে উঠে হাহাকার করে অভিযোগ করে যায় অনাকাঙ্খিত বিচ্ছেদের। চিত্রা কেবল ফ্যালফ্যাল করে দেখে সেই আর্তনাদ। এরচেয়ে বেশি কিছুই যে তার করার নেই। তন্মধ্যেই কলেজ থেকে আবারও মডেল টেস্টের তারিখ ধার্য করা হলো। খুব শীগ্রই পরীক্ষা। চিত্রা বিষাদ তুললো বন্দী খানায়। চেয়ার টেনে মুখ ডুবালো বইয়ের পাতায়, কিন্তু কী অদ্ভুত! বইয়ের লিখা কেমন ঝাপসা! চোখের জল গুলোও কী বাহার ভাইয়ের মতন বে*ঈমা*নী করছে? অশ্রু তার অথচ ঝরছে বাহার ভাইয়ের নামে। এমন শোক বিধাতা কেনো আমাদের দেয়?

তীর্যক রোদের তপ্ত দুপুর। জানালা গলিয়ে রোদ এসে পড়ছে চিত্রার পড়ার টেবিলে। ঘরের ফ্যান বন্ধ, কারেন্ট নেই। চিত্রা ছাড়া পুরো ফ্লাটে আর কোনো জনমানসের চিহ্ন নেই। মা নিজের কলেজ গিয়েছে, ভাইজানও গিয়েছে ভার্সিটি। পুরো ফ্লাটে চিত্রা একা। শোক পালনের মহোৎসব তাই ঝেঁকে ধরেছে তাকে। চিত্রা খুব চেষ্টা করলো পৃথিবীর সকল ধ্যান সে বইয়ের উপর দিতে। বারংবার তার চেষ্টা বিফলে গেলো। হাজার চেষ্টা করেও সে ধ্যান দিতে পারলো না বইয়ের পাতায়। কী বিরক্তিকর ব্যাপার স্যাপার! চিত্রা সশব্দে চেয়ার টা পিছে ঠেলে উঠে দাঁড়ালো। না চাইতেও বার বার বাহার ভাইয়ের সেই এলোমেলো চুলের ঢেউ গুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। লোকটা কী জাদু করলো?

ঘেমে-নেয়ে একাকার চিত্রার শরীর। সেই ঘর্মাক্ত মুখখানা নিয়েই সে বারান্দায় দাঁড়ালো। আশেপাশের রাস্তা বেশ নীরব। মাঝে মাঝে রিকশার টুং টাং শব্দ ভেসে আসে এরপর আবার নিশ্চুপ হয়ে যায়। নিশ্চুপ রাস্তার দিকে নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রইলো চিত্রা মিনিট পাঁচ। চোখের সামনে ভেসে উঠলো চিলেকোঠার ঘরটা। বাহার ভাইয়ের গিটারের মোহনীয় সেই টুং টাং সুর। ঠোঁটের ভাঁজে রাখা সিগারেটের ধোঁয়া উড়ানোর দৃশ্য। চোখের বেকারত্বের হাহাকার। বাহার ভাই টা যে বড্ড একা তা এই এক বছরে বেশ ভালো করেই জানা হয়ে গেছে চিত্রার। সেই একা মানুষটাই কিনা চিত্রাকে একা করে দিয়ে গেল! চিত্রার মনে জেগেছে আরও একটা সংশয়। বাহার ভাই কেনো অহি আপার বিয়ের পরই চলে গেলেন? তবে কী বাহার ভাইয়ের মনের মনিকোঠায় অহি আপা যত্নে লুকানো ছিলো? নিজের ভাবনায় নিজেই কেঁপে উঠলো। না, না, বাহার ভাইয়ের মনে অন্য কারো ঠাঁই আছে ভাবলেই কেনো যেন বুক মোচড় দিয়ে উঠে, কেমন ব্যাথা ব্যাথা লাগে। অহি আপার মনে যে বাহার ভাই আছেন, সেটা কী চিত্রা জানতো না? অবশ্যই জানতো। কিন্তু জেনেও সে না জানার ভাব ধরে ছিলো কেবল নিজের স্বার্থে। বাহার ভাই যে কেবল তার। কিন্তু সে ভুল, বাহার ভাইরা হয়তো কারো হয়না। বাহার ভাইদের ভালোবেসে প্রতিটা নারী অহি হয়ে রয়ে যায়। বাহার ভাইরা বিশাল জীবনের অপ্রাপ্তি হিসেবেই হয়তো সদা থেকে যায়। চিত্রার এই আঠারো বছরের জীবনে, পর পর এত অপ্রাপ্তি কখনো মেলে নি। খুব সুন্দর, হাসি হাসিই তো কেটেছে গত হওয়া বসন্ত গুলো। তবে এবার কেন বসন্ত কেবল চৈত্রমাসের খরা হয়ে রইলো? এবার কেনো বসন্ত এত বিবর্ণ।

ভাবনার মাঝেই কলিংবেলের কৃত্রিম শব্দে ভাবনার রাজ্যে ভাঁটা পড়লো। চিত্রা বিষন্ন দেহটাকে টেনে দরজা অব্দি নিয়ে গেলো। কিন্তু দরজা খুলে সে অবাক। আশেপাশে কেউ নেই, তবে কলিংবেল বাজালো কে! বিরক্ত হয়ে যখন চিত্রা দরজা আটকাতে নিবে তখনই দরজার সামনে ইট দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা কাগজ চোখে পড়লো। চিত্রা ক্ষানিকটা কৌতূহল বশত কাগজটা কুড়িয়ে নিলো, আশপাশে বেশ ভালো করে চোখ বুলিয়েই দরজা টা আটকে দিলো। হাতের কাগজটা নিয়ে এসে আরাম করে বসলো নিজের খাটে। কাগজটা মূলত কেবল কাগজ না। চিঠিও বলা যায়।

কাগজটা মেলে ধরতেই অসম্ভব মুগ্ধতা ভরা লিখা জ্বলজ্বল করে উঠলো। চিঠির শুরুতেই ‘প্রিয় রঙ্গণা’ শব্দটা দেখে সে বিমূঢ় হয়ে গেলো। দুই তিনবার চিঠির সম্বোধন করা শব্দটায় চোখ বুলালো। তার বাহার ভাই এসেছিল! এ চিঠি কী তবে বাহার ভাই দিয়ে গেলো? চিত্রা চিঠি হাতে নিয়েই আবার বারান্দার দিকে ছুটে গেলো বাহার ভাইয়ের দেখা পাওয়ার আশায়। কিন্তু চিত্রার এমন আশা পূরণ হলো না। হাজার ছটফট করা মন নিয়ে, আকাঙ্খা নিয়েও সে দেখতে পেলো না বাহার ভাইকে। মন খারাপ হলো তার। তুমুল মন খারাপ নিয়েই সে চিঠিটা পড়া শুরু করলো,

প্রিয় রঙ্গণা,
আমি জানি, চিঠির শুরুর সম্বোধনী টা দেখেই তুমি তুমুল আগ্রহে আমায় খুঁজে বেড়াবে। এই মুহূর্তে তুমি তাই করছো, তাই না? তুমি এত বো* কা কেন গো? যখন আমার অনুভূতিই তোমার হাতের মুঠে তখন আমার উপস্থিতি দিয়ে কী আসে যায়! তুমি অনুভব করলেই দেখতে তোমার হাতের মুঠোয় ঐ চিঠির ভাঁজে আমি আছি। অথচ তুমি তো তত চালাক না, চালাক হলে কী আর আমার অত কাঠখড় পোড়াতে হতো! তুমি নাকি পড়াশোনা শিকেয় তুলে মন খারাপের উৎসবে মেতেছো? এমন হেলাফেলা করলে বাহার ভাইয়ের রিকশার খরচ দিবে কীভাবে? বাহার ভাইয়ের তো ভাগ্যে চাকরি নেই, এখন যদি রঙ্গণাও কিছু করতে না পারে তবে আমাদের সংসার হবে কী করে? বুঝলে রঙ্গণা, তুমি বড্ড বো* কা, তাই তো সংসার করার জন্য খুঁজে খুঁজে একমাত্র বাহার ভাইকেই পেলে। জেনেশুনে কেউ নিজের পায়ে কুড়াল মারে বলো তো? আমায় চেয়ে বড্ড ভুল করলে রঙ্গণা। আমায় চাইলে কেবল দুঃখের উৎসব পাবে, আমায় পাবে না। তুমি কী বিশ্বাস করো তোমার বাহার ভাই কোনো খারাপ কাজ করতে পারে? আমি জানি, তুমি তোমার বাহার ভাইকে এতটাই বিশ্বাস করো যে কখনোই তাকে ভুল বুঝবে না। কিন্তু খুব শীগ্রই হয়তো তোমার সেই বিশ্বাসের আয়না চূর্ণবিচূর্ণ হতে চলছে। তোমার চূর্ণবিচূর্ণ বিশ্বাসের ভাঙন আমি দেখতে পারবো না যে। তোমার হয়তো অনেক মানুষ আছে, আমার কেবল তুমিই আছো। তোমার জন্যই হয়তো আমি চাকরির সন্ধান করে ছিলাম। একটা ছোটো সংসারের সাধ করেছিলাম। সময় ও পরিস্থিতির কাছে আজ সব অসহায়। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত অব্দি আমি চাই তুমি আমায় বিশ্বাস করো। তোমার চোখে অবিশ্বাস আমায় যে বেঁচে থাকার পরও মেরে ফেলবে। খুব শীগ্রই আমাদের দেখা হবে রঙ্গণা। আমাদের সংসারও হবে। আমরা এ শহর ছেড়ে খুব দূরে চলে যাবো। যাবে তো?

ইতি
বাহার ভাই।”

চিঠিটা হাতের ভাঁজে রেখে চুপ করে রইলো চিত্রা। বাহার ভাইয়ের চিঠির মাঝে কেমন ধ্বংসের আভাস! খুব খারাপ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা। চিত্রার বুক কাঁপলো। বাহার ভাই কি তবে কোনো গোলকধাঁধায় আটকে গেলো! এধার ওধার হাতড়েও চিত্রা উত্তর পেলো না নিজের প্রশ্নের। তবে সে বাহার ভাইয়ের সাথে সংসার করবে, যে-কোনো মূল্যে। যেহেতু সংসার করার জন্য অনেকদূর যেতে হবে সেহেতু আগে নাহয় মহিনের মৃত্যুর রহস্য টা পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে। বেশখানিকটা প্রমাণ তো সে পেয়ে গেছেই। এখন কেবল মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা। তারপর চিত্রা আর বাহার নাহয় শহর ছাড়বে। চিত্রা জানে, বাহার ভাইদের কোনো কলঙ্ক হয় না।

(৭২)

রাত তখন এগারোটা। বাহারের চিঠিটা চিত্রা সারাদিনে বোধহয় শ’খানেক বার পড়ে ফেলেছে। এখনও পড়ছিল, তন্মধ্যেই কলিংবেলের শব্দে তার মনযোগে বিঘ্ন ঘটে। বুকের মাঝে আরও একবার ছলাৎ করে উঠে। আবারও দুপুরের মতন অনাকাঙ্খিত চিঠি আসতে পেরে ভেবেই সে ছুটে গেলো মেইন দরজার সামনে। মুনিয়া বেগম রাতের রান্না করছিলেন, দরজার শব্দ শুনে সেও হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো দরজার দিকে।

চিত্রা মাকে দেখে নিজেকে সংযত করে ধীর গতিতে দরজা খুলতেই হতভম্ব চোখে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মুনিয়া বেগমের চোখেও ভরা বিস্ময়। অবাক কণ্ঠে বললো,
“তুমি এখানে যে! আকাশের চাঁদ মাটিতে কেন?”

শেষের কথাটায় তাচ্ছিল্যের ছোঁয়া। দরজার ওপাশে দাঁড়ানো নুরুল সওদাগর তেমন পাত্তা দিলো না বোধহয় সে তাচ্ছিল্যে। বরং বেশ কঠিন স্বরে চিত্রাকে শুধালো,
“ঐ ল* ম্পট ছেলেটা কোথায়?”

চিত্রা ভ্রু কুঁচকালো, অবুঝ কণ্ঠে বললো,
“জি?”

“তোমাদের পছন্দের ঐ ভবঘুরে নে* শাখোর ছেলেটা কোথায়?”

চিত্রা এবার বোধহয় বুঝলো বাবা কার কথা বলছে। বোঝার সাথে সাথেই তার চোখ মুখে বিরক্ত ছড়িয়ে পড়লো। রাগী কণ্ঠে সে তার বাবাকে বললো,
“উনার একটা নাম আছে, আব্বা। ভদ্র ভাবে বলতে পারলে বলুন নাহয় কথাই বলবেন না।”

নুরুল সওদাগর তাজ্জব বনে গেলেন। এতদিন তার মেয়ের চোখ-মুখে যে সম্মান দেখেছিল নিজের জন্য, আজ আর সেটা দেখতে পেলো না। লেবু অতিরিক্ত চিপলে সেটা তিতা হয়ে যায়। চিত্রাই তার বহিঃপ্রকাশ।

নুরুল সওদাগর তবুও দমে গেলেন না, কঠোর হয়ে বললেন,
“তোমার বাহার ভাইকে পেলে অবশ্যই আমাকে কল দিবে। কারণ ওরে আমাদের পুরো পুলিশ টিম খুঁজছে।”

মুনিয়া বেগম অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললো,
“ওরে খুঁজছে কেন তোমার পুলিশ টিম? মানুষের ভালো তোমাদের কী সহ্য হয় না?”

নুরুল সওদাগর উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“ভালো! কার ভালোর কথা বলছো? ঐ খু* নিটার? জানো সে কী করেছে? তার দশম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধ* র্ষণ করে খু* ন করেছে। তোমাদের আদরের বাহার। সে জন্যই তো পালিয়েছে বাসা থেকে।”

চিত্রা হতভম্ব চোখে বাবার পানে তাকালো। অনবরত তার পা কাঁপছে। বাহার ভাই অমন করেছে!

#চলবে

[প্রথমেই রেগে যাবেন না, মনে করুন আমারা প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর জায়গায় চলে এসেছি। এখন থেকে থাকবে টান টান উত্তেজনা। ভালোবাসা রইলো।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here