নানান বরণ মানুষ রে ভাই বড় গল্প ত্রয়োদশ পর্ব (১৩ তম পর্ব) নাহিদ ফারজানা সোমা

0
251

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
বড় গল্প
ত্রয়োদশ পর্ব (১৩ তম পর্ব)
নাহিদ ফারজানা সোমা

সকালে শিমুল সোজা উঠে গেলো দোতলায়। বারান্দায় বিরাট পেট নিয়ে রিয়া দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছয় মাস হয়নি এখনো, তবু পেট বিশাল উঁচু হয়ে গেছে। হাত-পা-মুখ কেমন ফোলা ফোলা। ওমর খান বসেছিলেন ইজি চেয়ারে। শিমুল সোজাসুজি কিন্তু সংযত গলায় বললো,”সামনে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা। আপনারা এতোদিন পরে মা’কে কেন ডেকেছেন জানিনা।তবে অনুরোধ, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের ছেড়ে দিন। আরেকটা কথা, আমি মনে করিনা আমার মা কারোর স্ত্রী বা পুত্রবধূ, তাঁর পরিচয় তিনি একজন ভালো,পরোপকারী, পরিশ্রমী, অতি উন্নতমনা সহজ,সরল মানুষ। তিনি এমন বাবা-মায়ের কন্যা যাঁদের আশেপাশের দশটা গাঁয়ের মানুষ এখনো ভক্তি করে,ভালোবাসে তাঁদের অসাধারণ মানবিক গুণাবলির জন্য। তাঁর আরেকটা পরিচয়,তিনি পলাশ-শিমুলের মা। যা বলতে চাচ্ছি, তাঁকে যেন আগের মতো এ বাড়িতে ট্রিট না করা হয়। তাঁকে অতিথির সম্মান দিয়ে রাখতে হবে,অবশ্য আপনারা অতিথির সম্মান কি করে করতে হয় তা সম্ভবত জানেন না। তাঁকে এবং আমাকে গত দুপুরে কোনো খাবার দেওয়া হয়নি।আমার ভাইয়ের খাবারের ব্যবস্থা আমাকেই করতে হয়েছে। মা’কে আপনাদের যে কারণে দরকার,সেই কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করুন।তবে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ তাঁকে দিয়ে করাবেন না। মঞ্জু বলে আপনাদের যে সার্ভেন্ট আছেন,তাঁকে দয়া করে বলে দিবেন কোনো অশোভন আচরণ তিনি আমাদের সাথে না করেন।”

ওমর-রিয়া দুজনেই মনে মনে চমৎকৃত। এই সেই বোকাসোকা, ভীরু, অসুন্দর বাচ্চাটা! এখন দেখতে ভারী মিষ্টি হয়েছে, রেখার মুখের আদল।ছিপছিপে গড়ন, মাথা ভরা চুল। খুব সাধারণ কিন্তু পরিস্কার সালোয়ার-কামিজ-ওড়না পরা। সবচেয়ে আকৃষ্ট করে তার ব্যক্তিত্ব। দাঁড়ানো ও কথা বলার ভঙ্গিতে ব্যক্তিত্ব ও আত্মবিশ্বাস প্রবল। স্পষ্ট ভাষী কিন্তু উদ্ধত নয়।

ওমর বললেন,”তোমার মা’কে কতোদিন থাকতে হবে,সেটা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। যতোদিন কাজ না মিটবে,ততোদিন থাকতে হবে।”

” আপনাদের দরকারে আমার মা এসেছেন। দরকারটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলুন। আমাদের একটা বাড়ি আছে, আমার পড়ালেখা আছে, আমার অসুস্হ ছোট ভাই আছে, সবচেয়ে বড় কথা,আমার মায়ের নিজের একটা লাইফ স্টাইল আছে। তিনি কেন নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকবেন?”

“কারণ আমার মা অসুস্থ। তাঁর সেবাযত্নের দরকার।”
” তার সাথে আমার মায়ের সম্পর্ক কি? আপনার মায়ের সেবা করার দায়িত্ব আপনার,আপনার স্ত্রীর।দরকার হয় নার্স রেখে দিবেন। এখানে আমার মায়ের প্রশ্ন আসছে কেন?”

” আইনত তোমার মা আমার স্ত্রী। শাশুড়ির সেবা করা তাঁর কর্তব্য। ”
” আপনার স্ত্রীর প্রতি কি কি কর্তব্য পালন করেছেন আপনি? কোন্ লজ্জায় মা’কে আপনার স্ত্রী দাবী করেন? কোন্ লজ্জায় আমার মায়ের সেবা গ্রহণ করবেন আপনার মা? মা আপনার স্ত্রী হলে আমি ও আমার ছোট ভাই আপনার সন্তান,যদিও এটা ভাবলেই আমার বিবমিষা হয়, তবুও চরম দুঃখজনক সত্য হলো,আমরা আপনার সন্তান। কি কর্তব্য পালন করেছেন আমাদের জন্য? ”

রিয়া অবাক হয়ে ওমরের দিকে তাকিয়ে আছেন।এই লোক এতো কথা হজম করছে কি ভাবে? ইদানিং একটুতেই বাঘের মতো গর্জে ওঠা, গায়ে হাত তোলা, পান থেকে চুণ খসলে বাচ্চাদের ধরে পিটানো,গালাগালি ওমর খানের মজ্জাগত হয়ে গেছে। তিনি শিমুলের এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা সহ্য করছেন কি করে? আরও আশ্চর্যের কথা, মেয়েটার ঝকঝকে উজ্জ্বল চোখ, মিষ্টি চেহারা, কথা বলার ধরণ, মিষ্টি কন্ঠস্বর তাঁরও বেশ ভালো লাগছে অথচ ছোট বেলায় বাচ্চা মেয়েটাকে দেখলে তাঁর আছাড় লাগাতে ইচ্ছা হতো।

ওমর বললেন, “দেখি কি করা যায়! ঠিক আছে,যাও এখন।”

তাঁর তাড়াহুড়োর কারণ, তিনি রেখাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। কাজের কথা বলতে হবে।

শিমুল চলে যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেখা এলেন। ওমর বললেন,”ভালোই তো আছো দেখছি। হাসান নামের গুণ্ডাটার জন্য? ”

রেখা চুপ করে থাকলেন।

“সব খবরই আমার কানে আসে। পরপুরুষের সাথে ফস্টিনস্টি করে বেড়াও,লজ্জা হয়না তোমার?”

এসব বলার উদ্দেশ্য, রেখাকে ভয় পাইয়ে দেওয়া। ভয় পেলে মহিলা দুর্বল হয়ে পড়বে আর তাকে দিয়ে কর্মসাধন সহজেই হয়ে যাবে।

“মুখে রা নেই। ফের যদি এসব কথা কানে আসে, সোজা ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো।”

রেখা তাঁর স্বভাব সুলভ শান্ত মুখে বললেন,”আমিও সেটাই চাই। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব, ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিন। আমিও পাঠাতে পারি।”

ওমর-রিয়া ভয়ংকর চমকে উঠলেন। এ কি রেখা?

” চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিবো। লটকালটকি এই পর্যায়ে উঠেছে? ”

” যে যেমন,সে অন্যকে তেমনই ভাবে। আপনি চরিত্রহীন, আমি নই। যার সম্পর্কে কথা বলছেন,তাঁর নাম উচ্চারণ করার যোগ্যতাও আপনার নেই।
আপনি যথেষ্ট বিপদের মধ্যে আছেন। নিজেকে আরও বিপদে না ফেলাই ভালো। আমাদের তিনজনের দিকেই হাসান সাহেব খেয়াল রাখছেন। আমাদের উপরে সামান্য অত্যাচার হলেও কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশ আপনাকে নিয়ে যাবে। আমার এবং আপনার মায়ের দিক থেকেও আপনার বিপদ আছে। ”

ওমর-রিয়া স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। রেখা বললেন,”হাসান সাহেব কিছুক্ষণের মধ্যে আসছেন। আপনার জন্য খুব বড় বিষ্ময় অপেক্ষা করছে।একটু ধৈর্য্য ধরুন। ”

রিয়া বললেন,”পুলিশ ডাকো। ঐ মাস্তান এসে কি না কি করে! এই বাড়িতে ঢোকার আগেই তার ঠ্যাং যেন ভেঙে ফেলা হয়।”

রেখা হেসে ফেললেন। তাঁর হাসি খান দম্পতিকে আরও ভড়কে দিলো। রেখা বললেন,”ডাকুন।তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি আসছি।”

“আমি আসছি মানে? আমার হুকুম ছাড়া এক পাও নড়বে না।”

“খান সাহেব, আপনার দিন শেষ। আসি।”

কিছুক্ষণের মধ্যে অনেকেই এলো। তারমধ্যে একজন হলেন ওমর খানের বাবার উকিল। হাসান ও এলেন একজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে।

নিচের ড্রইং রুমে জড়ো হয়েছে সবাই। শিমুলও এসেছে পলাশকে সাথে নিয়ে। বৃদ্ধ উকিল বললেন,” কি হে ওমর, আমার সাথে যোগাযোগের দরকার মনে করো নি কেন এতোদিন? তোমার বুড়ি মা’কে বন্দী করে অত্যাচার করছো সম্পত্তির জন্য। বহু প্রোপার্টি নষ্ট করেছো,বিক্রি করেছো,যেটা তোমার বাবা বা মায়ের নামে ছিল। তোমার মাও বিনা দ্বিধায় তোমাকে নিজের অনেক কিছু দিয়ে দিয়েছেন। মা মরলে বাড়িতো আপনা আপনি তোমার হতো। কিন্তু তুমি পাগল হয়ে গেলে। তোমার মায়ের এমন করুণ অবস্থার কথাতো আমি জানতামই না। বহুদিন তোমাদের বাড়ি আসিনি, আসার রুচি হয়নি। তোমার বাবা কি ছিলেন আর তুমি কি হয়েছো। আর তোমাকে তোমার মায়ের অতি আহ্লাদ ই নষ্ট করেছে। তোমার বা তোমার মায়ের যোগাযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আজ দায়মুক্ত হতে যাচ্ছি।”

” মা সবসময়ই বলে এসেছেন বাড়ির দলিল,গয়নাপাতি সব মায়ের কাছে।তাই আপনার কাছে যাই নি।তবে শিগগিরই যেতাম, আপনার পরামর্শ নেয়ার জন্য । মা তো আমার সম্পত্তি আটকে রাখতে পারেন না। এখন আমার প্রচুর টাকা দরকার। আমি লোনে ডুবে আছি। তাও উনি আমাকে কিছুই দিচ্ছেন না,কিছুই বলছেন না।”

” সেই অপরাধে মা’কে এমন ভয়ংকর অবস্থায় রেখেছো? বাকি জিনিস গুলো দিলে তো সেকেন্ডের মধ্যে তুমি তা উড়িয়ে দিতে। ”

“আমার সম্পত্তি, আমি যা খুশি তাই করবো।”

“এ যাবৎ যতো জিনিস বিক্রি করেছো, কোনোটা কি তোমার নামে ছিল? ”

“মায়ের নামে ছিলো। মা’কে বলেছি বিক্রি করার কথা,মা স্বেচ্ছায় কো-অপারেট করেছেন। এখন আমি নিজের ভাগ বুঝে নিতে চাচ্ছি, কিন্তু উনি খামোখা ঘুরাচ্ছেন।”

“শোনো বাবা, গভীর আস্হা ছিলো যে বাপ তোমার জন্য বহুৎ সম্পদ রেখে গেছেন। আসলে না। সব সম্পত্তি তোমার মায়ের নামে যেগুলোর অনেকখানি তুমি নষ্ট করেছো। এখন এই বাড়ি আর কিছু জমি অবশিষ্ট আছে যা তোমার মায়ের নামে।”

“অসম্ভব। এটা হতে পারেনা।এটা ক্লিন জালিয়াতি কেস।মা আর আপনি মিলে ষড়যন্ত্র করেছেন। যা আছে সব আমার।”

“কিছুই তোমার না। তোমার মা ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারেন। উনি যে কেনো আমাকে এতোদিন খবর দেন নি,আমি বুঝতে পারছি না। সন্তান স্নেহ, অন্ধ স্নেহ। ”

আফরোজা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,”এখন আর মায়া দয়া কিছুই নেই। সন্তানের এতো কুৎসিত রূপ যেন কোনো মা কে দেখতে না হয়। অনেকদিন সহ্য করেছি মায়ায়।কিন্তু এখন এই কুলাঙ্গারের জন্য কোন মমতাই অবশিষ্ট নেই। তিল পরিমাণ সম্পত্তি আমি ওকে দিবো না। কাকে দিবো,অনেকদিন ধরে ভেবে রেখেছি। সেই অনুযায়ী প্ল্যান ও করেছি। কুলাঙ্গার ছেলে রেখাকে নিয়ে এসেছিল এক উদ্দেশ্যে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য পূরণ হলো না বরং আমার ইচ্ছাটা পূরণ হয়ে গেলো। আমার এই বাড়ি,আশি ভরি গয়না, জমি সব রেখাকে দিয়ে যাবো। ”

কথা শেষ হতে পারলো না, ওমর খান ঝাঁপিয়ে পড়লেন তার মায়ের উপর। তার চোখ-মুখ টকটকে লাল,উদভ্রান্তের মতো বলতে লাগলেন,”বুড়িকে আমি গলা টিপে মেরে ফেলবো,মেরে ফেলবো।”

রিয়াও তীব্র স্বরে বললেন,” আমার ছেলেমেয়েরা কি বানের জলে ভেসে এসেছে? ওদের ভাগ কই?”

কয়েকজন মিলে ওমর খানকে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে নিলো। আফরোজা বলতে শুরু করলেন,”আমার পাপের অনেক শাস্তি আমি দুনিয়াতেই পেয়ে গেলাম। আমার এতো লক্ষী বৌ,আমার দুই নাতি নাতনিকে আমি কতো যে কষ্ট দিয়েছি! শুকরিয়া, আল্লাহ দেরিতে হলেও আমার মধ্যে অনুশোচনা দিয়েছেন, আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। দিন রাত তওবা করি আল্লাহর কাছে। জানি না আল্লাহ আমাকে মাফ করবেন কিনা।উকিল সাহেব, ব্যবস্থা করেন। আমি আমার সব সম্পত্তি রেখা কে দিয়ে যাচ্ছি। না,না,রেখা, আপত্তি কোরোনা। নিজের জন্য না নাও,সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে নাও।আমার শিমুল বুবুকে ভালো করে লেখা পড়া করাও,আমার পলাশ ভাইয়াকে ভালোভাবে চিকিৎসা করাও। আর আমাকে ক্ষমা করে দাও,মা।আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি ওমর আর ওর ঐ বৌয়ের নামে মামলা করবো আমাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করার জন্য। ”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here