নানান বরণ মানুষ রে ভাই ষোড়শ পর্ব (১৬ তম পর্ব) বড় গল্প

0
264

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
ষোড়শ পর্ব (১৬ তম পর্ব)
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

এবারে আর সেকেন্ড না, বোর্ডে তো বটেই, সারা বাংলাদেশে ফার্স্ট। রেহনুমা খান শিমুল। সারা বাড়িতে উপচে পড়া আনন্দ। রেখা অনবরত কাঁদছেন, “মা, দেখেন,আপনার নাতনি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় সারা দেশে ফার্স্ট হয়েছে। ওকে দোয়া করে দেন।” বিছানার সাথে মিশে যাওয়া শীর্ণকায় আফরোজা মাড়ি বের করে হাসেন,আবার আনন্দের কান্না কাঁদেন এবং একটি বেফাঁস কথা বলে ফেলেন,” ফার্স্ট হবে না?বাপ-দাদার ব্রেইন পেয়েছে। ভাগ্যিস রেখা,তোমার ব্রেইন আমার নাতনি পায় নাই।” রেখা সামান্য নিস্প্রভ হলেন। কি কথার কি উত্তর। শিমুল খুব স্বাভাবিক গলায় বললো,”দেখেছো মা, যার জন্য প্রাণপাত করছো,রোজ যার গু-মুত দুহাতে সাফ করছো,সে তোমাকে কি দারুণ একটা উত্তর দিয়ে দিলো? তুমি কি মনে করো বুড়ি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে?সারাক্ষণ রেখা,রেখা,রেখা।আসলে সে নিজ স্বার্থে তোমার নাম জপে। পেট ভরে খাওয়া, সাফসুতরা থাকা, নিশ্চিন্তে ঘুমানো, কাঁড়ি কাঁড়ি ওষুধ সময় মতো খেয়ে আয়ুটাকে আরও লম্বা করা, এসব কোন্ বাঁদী করে দিতো রেখা ছাড়া?আজকেও তার গুমাখা চাদর, ম্যাক্সি কেচেছো না তুমি? তোমার ব্রেইন নাই বলেই কেচেছো। ব্রেইন থাকলে বুড়িকে তার ছেলে -ছেলে বৌএর মতোই মেরে ফেলার সুযোগ খুঁজতে। ”

রেখা বললেন,”ছিঃ মা ! উনি একটা কথার কথা বলে ফেলেছেন,তারজন্য তুই এমন বিচ্ছিরি কথাগুলো বললি? মা,তুই শিক্ষিত মেয়ে। শিক্ষা তোকে নম্র, বিনয়ী, সহনশীল, উদার করবে,ভালো-মন্দ বুঝতে শিখাবে, তুই যদি এভাবে কথা বলিস,তাহলে শিক্ষার ছাপটা রাখলি কোথায় মা? আমি তো চাই,আমার মেয়ে শুধু পুঁথি মুখস্থ করা শিক্ষিত হবে না, সে হবে সত্যিকারের আদর্শ ও শিক্ষিত মেয়ে, তার কথা-কাজ-চিন্তাভাবনা সবকিছুই শুভ হবে,সুন্দর হবে।”

” তোমার মতো অমেরুদণ্ডী প্রাণী আমি হতে চাই না মা। এক অত্যাচারী, স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ বুড়ির সেবা যত্ন করে আমি মহান হতে চাই না।”

“মেরুদণ্ড থাকা মানে ঔদ্ধত্য না। প্রতিবাদ ভদ্রভাবেও করা যায়।”

“সেদিন বুড়ি তোমাকে বলছিল, লুলা,পাগল-ছাগল ছেলেটার ভবিষ্যৎ নিয়ে তুমি কি চিন্তা ভাবনা করছো? তুমি কি উত্তর দিয়েছিলে? আল্লাহ জানেন।এই ছিল তোমার উত্তর। আল্লাহ তো জানেনই, তুমি জানার চেষ্টা করো না কেন? পরকে নিয়ে মেতে থাকো,তোমার নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার সময় পাও? সবচেয়ে বড় কথা,তোমার সামনে লুলা,পাগলা-ছাগলা বলার সাহস কি করে পায়?আমার সামনে এসব কথা বললে আমি জুতিয়ে বুড়ির মুখ ভেঙে দিতাম।”

রেখা জীবনে এই প্রথম মেয়ের গালে কষে এক চড় লাগালেন।

“ভালো রেজাল্ট করে তুমি হাতির পাঁচ পা দেখছো, নিজেকে সব বিষয়ে বিশাল জ্ঞানী ভাবছ, মুখে যা আসছে তাই বলছো। তোমার এই ফার্স্ট -সেকেন্ড হওয়াতে আমার কিছু যায় আসে না। মানুষই যদি না হতে পারলে,ফার্স্ট -সেকেন্ড হয়ে লাভ কি? কতো স্বপ্ন ছিলো তোমাকে নিয়ে। তোমার মধ্যে আমি আমার মায়ের রূপ দেখতে চেয়েছিলাম। ”

“তোমার মা কি ছোটবেলা হতে আমার মতো লাথি ঝাঁটা খেয়ে বড় হয়েছিলেন? পেটে খিদে নিয়ে তাকে ঘুরে বেড়াতে হতো? ভাইকে খাওয়ানোর জন্য দুধের কৌটা চুরি করতে হয়েছিলো? চুরি ধরা পড়ার পরে বাপ,সৎ মা, বাপের মায়ের হাতে মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে হয়েছিল? ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তোমার মা’কে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল? মামার বাড়িতে ঝিএর মতো থাকতে হয়েছিলো? নিজে বাচ্চা হয়েও আরেকটা বাচ্চা ভাইকে মায়ের মতো পালতে হতো?”

রেখা মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে গেলেন। শিমুল সরে এলো।

“তোমাকেও আমার ভালো লাগে না মা।”

“আমি কি করতে পারতাম মা? কি করার ছিলো আমার?”

“এই তিনজনকে মন থেকে ঘেন্না করতে পারতে। এদের মুখে থুথু ফেলতে পারতে। এই বুড়িকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারতে। তোমার তিন ভাই এর রুজি রোজগারের পথ বন্ধ করে দিতে পারতে হাসান মামাকে বলে।ওরা পথে বসতো।”

“এমনই যদি করতাম,তাহলে তোর বাপ-দাদী-মামাদের সাথে আমার পার্থক্য কোথায় থাকতো মা?”

“আমাদের কষ্ট যদি তোমার বুকে লাগতো, তাহলে কিছুটা হলেও তুমি প্রতিশোধ নিতে মা। দুঃখের দিন কেটে যাওয়ার পরে আমাদের দুই ভাই বোনকে নিয়ে সুখে সময় কাটাতে পারতে।”

“তোরা শুধু দুই ভাই বোন?মৌরি,মুকুল,মিথুন,মুমু,মিতুল এদেরতো তুই আমার চেয়ে কম ভালোবাসিস না?”

শিমুল থমকে গেলো।ভাইবোনগুলোকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। সব ক’জনকেই। পিচ্চি মিতুলকে নিয়ে তার মাথায় হিংস্র চিন্তা এসেছিলো ভাবলেই কষ্টে বুক ফেটে যায়। মিতুলের থেকে দূরে সে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। ওদেরকে সৎ ভাইবোন মনে করেনা শিমুল। ওরা সাত ভাইবোন,এর বাইরে ওরা কেউই কিছু ভাবতে পারে না। তবে পলাশের উপরে টান আরও অনেক বেশি, মা আর অন্য ভাইবোনদের যতোটুকু ভালোবাসে শিমুল, তার চাইতে অনেক ভালোবাসে পলাশকে।

“আমার ভাইবোনেরা নিষ্পাপ। তাদেরকে ভালোবাসা, দেখাশোনা করা অপরাধ না। ”

শিমুল নিজের ঘরে চলে গেলো। আফরোজা বললেন,”শিমুলের বিয়ের বয়স হয়েছে রেখা। ছেলে দেখতে বলো। মরার আগে নাতনির বিয়ে দেখে যাই।”

“শিমুলকে কোনোভাবেই আমি এখন বিয়ে দিবো না। ও লেখাপড়া শেষ করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, নিজের পছন্দে বুঝেশুনে বিয়ে করবে। ”

“বুড়ি মেয়েকে তখন বিয়ে করবে কে? মৌরির মায়ের মতো দোজবরের গলায় ঝুলতে হবে।”

” রিয়াকে কেউ ঝুলিয়ে দেয়নি। সে নিজেই আপনার ছেলের গলায় ঝুলেছে। আপনার ছেলেও গলা বাড়িয়ে ছিলেন। আপনারও অনেক ইন্ধন ছিল। এসব কথা থাক্। ”

জেলে বসে খান সাহেব ও রিয়া শিমুলের অসাধারণ সাফল্যের কথা শুনলেন। তার কিছুক্ষণ পরে শুনলেন রিয়ার বাবার মৃত্যু সংবাদ।

বাবা-মায়ের প্রতি রিয়ার সাংঘাতিক ক্ষোভ ছিল। নিজেদের ভালো রাখার আশায় ছেলেদের তালে তাল দিলেন, তাঁদের কতো সম্পদ দুই ভাই আত্মসাৎ করলো তার বিচারতো বাবা-মা করলেনই না,উপরন্তু সমর্থন করলেন। রিয়ার পক্ষের একজন আত্মীয় স্বজনও মৌরি-মুকুলদের দায়িত্ব নেয়নি। দায়িত্ব বহুদূর, ওদের দেখতেও আসেনি। রিয়ার মা প্যারালাইজড হওয়ার আগে দু-তিনবার নাতি-নাতনিদের নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, মুমুতো যায়ইনি, রেখার গলা আঁকড়ে পড়েছিল, বাকিরাও যেয়ে কোনোভাবেই দুইদিনের বেশি থাকেনি। তাদের দুনিয়া জুড়ে শুধু রেখা ও তারা সাত ভাইবোন। মিতুল হওয়ার সময়তো তাঁরা দুজনেই খুব অসুস্থ, রিয়া যখন পুলিশ হাসপাতালে, তখন যেয়ে কয়েকদিন দেখে এসেছেন।

বাবাকে দেখানোর জন্য রিয়াকে আনা হলো।যতো যাই হোক, বাবা তো! রিয়া খুব কাঁদলেন। অনেক দুঃখ, কষ্ট,রাগ,ক্ষোভ, অনুশোচনা মিশে ছিল এই কান্নাতে। তাঁর ছেলেমেয়েদের দেখলেন কতোদিন পরে! ওরা জেলখানায় দেখতে যায় না। রিয়াই নিষেধ করেছেন। তাছাড়া কে নিয়ে যাবে ওদের জেলখানায়?

মৌরিটা ভারি মিষ্টি হয়েছে। ক্লাস ফাইভে পড়ে। পরীক্ষায় খুব ভালো করে। রেখা ভালো প্রাইভেট টিউটর রেখে দিয়েছেন। শিমুল নিজেও ভাইবোনদের পড়ালেখা দেখিয়ে দেয়। শিমুলের মতো মেরিটোরিয়াস না হলেও ভাইবোনেরা সবাই লেখাপড়ায় ভালো। বাচ্চাগুলোর সবার স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। সবার ক্লান্ত, ভীত,মলিন মুখগুলো এখন দীর্ঘদিনের যত্নে, আদরে উজ্জ্বল, ঝকঝকে। ছোট্ট মুমুটাও কত্তো বড় হয়ে গেছে। তাঁর পাঁচ সন্তানই দুধেভাতে আছে,বুঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। নিজের বাবা-মায়ের কাছেও শুনেছিলেন,রেখা আর শিমুল খুব যত্ন করে তাঁর সন্তানদের। আর তিনি একসময় কি ব্যবহারই না করতেন পলাশ-শিমুলের সাথে।

বাচ্চারা তাঁর কাছে ভিড়তে চাচ্ছে না। অপরিচিতদের মতো তাকাচ্ছে। তিনি মৌরি-মুকুলের মাথায় পরম আদরে হাত রাখলেন। ওরা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কে একজন বললো,”তোমাদের মা। আম্মু বলে ডাকো।”
মৌরি-মুকুল কিছুই ডাকলো না। নিজেদের আরও গুটিয়ে নিলো। ওরা নিজের মা-বাপের কর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। রেখার অগোচরে আফরোজা, মন্জু, মতির মা দফায় দফায় সব ইতিহাস ই ওদের শুনিয়েছেন। খুব ভালো না বুঝলেও মৌরি, মুকুল,মিথুন এটুকু বুঝেছে ওদের বাবা-মা ভালো না। রেখাকে ই তারা মা জ্ঞান করে।

রিয়া মিথুনকে জড়িয়ে ধরলেন। আস্তে করে বললেন,”মা’কে একটা চুমু দাও আম্মু। ”

চুমু দূরের কথা, মিথুন জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।তারপর দৌড়ালো রেখার দিকে। রেখা রিয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। কোলে মিতুল।রিয়া দু’হাত বাড়ালেন। মিতুল সভয়ে রেখার গলা জড়িয়ে ধরে তাঁর কাঁধে মুখ গুঁজলো। পাঁচ সন্তানের কেউই রিয়ার কাছে এলো না। রেখা নরম গলায় বললেন,”আসলে ছোট মানুষ তো। অনেকদিন দেখে না।সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

রিয়ার দম আটকে আসছিলো। আচমকা রেখাকে জড়িয়ে ধরে তিনি চিৎকার করে কাঁদতে থাকলেন। তিনি যে মহিলার সংসার ভেঙেছেন, দাসীর মতো ব্যবহার করেছেন, যাঁর বাচ্চাদেরকে নির্মম ভাবে মেরেছেন, বকেছেন, আজ সে-ই রেখাই তাঁর সবচেয়ে ভরসার জায়গা। নিজের বাবা-মা,মামা-চাচা,খালা-ফুপু কেউই তাঁর দুঃসময়ে কাজে আসেন নি। ভাই-ভাবীরা দূরের কথা। যাদের নিয়ে ঘন ঘন পার্টি করতেন, খাওয়াতেন,দামী দামী গিফট করতেন, প্রাণের বন্ধু মনে করতেন, সেই সব সুখের পায়রারা তো হাওয়া হয়ে গেছে সেই কবে। কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, তিনি পাপ করেছেন,পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করছেন। নিজেকে অনেকদিন ধরে বড় ছোট,নোংরা মনে হয় রিয়ার।

রিয়ার কান্নায় ভয় পেয়ে মিতুল চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। রেখা সরে গেলেন। আর তখনই কে যেন রিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। রিয়া চমকে উঠলেন। ফোলা মুখ, চ্যাপ্টা নাক, পুরু ঠোঁট, স্হূলদেহী এক কিশোর। চোখ দুটিতে বেদনা আর সহমর্মিতা ঝরে পড়ছে। রিয়া চিনে ফেললেন। তারপর তাকে জাপটে ধরে আবার কাঁদতে শুরু করলেন। তার কপালে,গালে চুমু খেলেন। পলাশ বিমাতার চোখের পানি পরম যত্নে মুছিয়ে দিলো। মৌরি,মুকুল ডাক দিলো,”এই ভাইয়া, এদিকে আয়।” পলাশ আবারও রিয়ার অশ্রু মুছিয়ে দিল। দুই চোখ ভরা মায়া। রিয়া আবার পলাশকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। পলাশের হাত ধরে নিয়ে গেলো মৌরি। শরীর ভারি হয়ে যাওয়ায় এখন হাঁটতে আরও কষ্ট হয় পলাশের। বাসায় হুইল চেয়ার আছে।

সময় সীমিত। আবার ঢুকতে হবে অন্ধকার কুঠুরিতে। রিয়া তাঁর মা’কে দেখতে গেলেন। বিছানায় পড়া। নিজের বাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘরে জায়গা হয়েছে তাঁর। গুমোট,বদ্ধ ঘরে পেশাবের ঝাঁঝালো গন্ধ। অনেক রাগ ভেতরে জমা, তবু মা বলে কথা। মায়ের অবস্থা দেখে রিয়া কাঁদলেন। ভাবীদের জিজ্ঞেস করলেন,”এই ঘরে মা কেন?”

উত্তর এলো, “সংসার এখন বড় হয়েছে। বাচ্চাকাচ্চারাও বড় হয়ে গেছে।তাদের আলাদা রুম লাগে।”

রিয়া চিৎকার করে বললেন,” তাই বলে আমার বাপ-মা’কে তাঁদের নিজেদের ঘর থেকে সরাতে হবে?”

ধারালো গলায় প্রশ্নটা এলো,”তুমি কি করেছিলে ননদিনী? আমরাতো তোমার লেভেলে চেষ্টা করলেও যেতে পারবো না। জেল খাটছো কেন মনে নেই? ”

এই সেই ভাতৃবধূরা যারা উঠতে আপা, বসতে আপা করতো। পারলে আপার পা মালিশ করে। তখন রিয়ার বাপ,বিশেষ করে মায়ের প্রতাপ ছিল সাংঘাতিক। ছেলে,ছেলের বৌরা মিউ মিউ করতো। এখন পাশা উল্টে গেছে।
রিয়ার মা রিয়ার হাত ধরে কাঁদছেন। ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে,মা-মেয়ে দুজনেই হাড়ে হাড়ে বুঝছেন।

রিয়ার মা তার মেয়ের হাত ধরে কাঁদছিলেন। বেশ বুঝা যাচ্ছিলো এই শেষ দেখা। রেখা মৌরিদের বললো,”যাও, নানুকে আদর করে আসো।সালাম দাও।” বাচ্চারা যেতে চাচ্ছে না। এই বাসায় তাদের ভালো লাগছে না। ভীড়,গ্যাঞ্জাম, সাদা কাপড় পরানো নানা, দুর্গন্ধ ছড়ানো নানী, রিয়াকে নিয়ে আত্মীয় বন্ধুদের নানা টেরা বাঁকা কথা, এইসব অসহ্য লাগছে।এরমধ্যে মিতুল শুরু করলো তার বিখ্যাত কান্না। রেখা বড় একটা ব্যাগ থেকে তোয়ালে মোড়া ফিডার বের করলেন। হাত দিয়ে পরীক্ষা করে নিলেন বোতল বেশি গরম কিনা। তারপরে মিতুলকে খাওয়াতে বসলেন। অন্য ছেলেমেয়েদের বললেন,” আমি কিন্তু নানুর কাছে আর মায়ের কাছে তোমাদের যেতে বলেছি। কাছে যাও,সালাম দাও,আদর করো।”

নিতান্ত অনিচ্ছার সাথে বাচ্চাগুলো গেলো। মা বা নানীকে আদর করলো না, শুধু সালাম দিলো। রিয়া আর তাঁর মা বাচ্চাগুলোকে জড়িয়ে ধরলেন। বাধা দেওয়ার আগেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে পলাশ যেয়ে হাজির। রেখা ডাক দিলেন,”পলাশ,এদিকে আসো বাবা।” রিয়া পলাশকে জড়িয়ে ধরলেন।
বললেন,”তোর এই খারাপ মা কে ক্ষমা করে দিস। মা, তুমি তওবা করো।রেখা আপা আর পলাশের কাছে মাফ চাও।শিমুল কোথায়?ও আসে নি?”

শিমুলকে আসার জন্য অনেক বলেছিলেন রেখা। মেয়ে আসে নি। রিয়ার বাপের বাড়ি কখনো যায়নি শিমুল। রিয়ার মা, ভাই ও ভাবীদের প্রতি তার প্রবল ঘৃণা। শিশুকালে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত সে ঐ মহিলার হাতেই হয়েছে। চড় থাপ্পড়, কানমলা,চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানো, গালাগালি কিছুই বাদ দেন নি মহিলা। পরবর্তীতে নিজের নাতি নাতনিকে দেখতে খান বাড়িতে এসেছিলেন মহিলা আর তাঁর স্বামী বারকয়েক। শিমুলের সাথে খাতির করারও চেষ্টা করেছিলেন কিছুটা। তাঁর মুখের দিকেও তাকায়নি সে, কথা দূরের কথা। তাঁর কথা মনে হলেই ঘৃণা আর রাগে সারা শরীর কাঁপে। রেখা প্রায় বলেন,”মনের থেকে সব রাগ,ঘৃণা মুছে ফেলতে না পারলে তোরই কষ্ট, শিমুল। অপছন্দের মানুষদের থেকে দূরে থাক্, কিন্তু মনে কারোর বিরুদ্ধে বিষ জমিয়ে রাখিস না। ওই বিষে তুইই ক্ষয় হবি, অন্যদের কিছু হবে না।”

রিয়ার বাবার বাড়ি আসার সময় রেখা সবাইকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছেন। পাখি যেন সারাক্ষণ আফরোজার ঘরে থাকে। মতির মা, মন্জু রান্নাবাড়া,কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে যেন আফরোজার দিকে লক্ষ্য রাখে।সময় মতো খাবার খাওয়ায়,ওষুধ খাওয়ায়। বাথরুমের দরকার হলে বেডপ্যান দেয়। এই কাজটা রেখা নিজেই করেন। গৃহকর্মীদের এসব কাজ দিতে তাঁর খুব খারাপ লাগে। শিমুল যদি আজ অন্তত এই কাজের দায়িত্ব নিতো,তাহলে তিনি খুব খুশি হতেন। কিন্তু শিমুলকে এই প্রস্তাব দেওয়ার সাহস তাঁর নেই। এমনিতেই মেয়ে রেগে আছে তাঁর উপরে।তাঁরা বের হওয়ার সময় বলছিলো,”আমি ফার্স্ট স্ট্যান্ড করলাম। কতো সাংবাদিক এসেছিলেন,আরও আসবেন, কিন্তু তুমি আমার মা,তুমি এখানে আমার পাশে থাকবে না। মেয়ের সাফল্যে পোলাও-কোর্মা রাঁধবে না। তুমি সতীনের বাবার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে যাবে।”

“ওরে, আমি না গেলে এই বাচ্চাগুলোকে কে নিয়ে যাবে? বিশ্বাস করে কার হাতে পাঁচটা বাচ্চাকে দিবো? তুই ই বল্,মৌরিদের কার হাত দিয়ে পাঠাবো?”

“মৌরিরা যাবে কেন? আজ আমরা সবাই আমাদের বাসায় থাকবো, পোলাও-রোস্ট খাবো, আনন্দ করবো। ওদের যেতে হবে কেন?”

“ওদের তো নানা, শিমুল। তাছাড়া ওদের মা আসবে সেখানে।”
“ওরা কিন্তু মা,নানা নিয়ে মাথাব্যথা করছে না।ওরা যেতেও চাচ্ছে না।”

“তবু ওদের যেতে হবে। অবুঝ হোস না শিমুল। ”
“যাও মা, কর্তব্য পালন করো। পলাশকেও নিয়ে যেও।সাংবাদিকরা আসলে ওর দিকে আমি হয়তো খেয়াল করতে পারবো না। ওকে নিয়ে যেও এবং প্লিজ, ওর দিকে খেয়াল রেখো।”

মেয়েটা খুব কষ্ট পেয়েছে তার সাফল্যের দিনটা কারোর সাথে শেয়ার করতে পারলো না বলে। রেখারও মন খারাপ হয়েছে, কিন্তু তাঁর বিকল্প কিছু করার ছিলো না।

বাসায় আসতে আসতে রাত এগারোটা। দরজা খোলার পরই বাচ্চারা ছুটেছে শিমুলের ঘরের দিকে, আপার সাথে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য। রেখা বাসার ভেতর ঢুকতে ঢুকতে মন্জুকে জিজ্ঞেস করলেন,”সব ঠিকঠাক আছে তো?মা খেয়েছেন ঠিকমতো? শিমুল? তোমাদের সবার খাওয়া হয়েছে? ”

“জ্বী আম্মা।”

রেখা আগে শাশুড়ির ঘরে ঢুকলেন। পাখি একটা চৌকিতে ঘুমাচ্ছে। আফরোজা বেগম তাঁর বিরাট পালংকে শুয়ে আছেন সোজা হয়ে, নীরব,নিথর। ঠোঁটে একটা মাছি বসে আছে। রেখা অস্ফুট কন্ঠে ডাকলেন,”মা”।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here