নানান বরণ মানুষ রে ভাই ২৩ তম পর্ব বড় গল্প

0
248

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
২৩ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

” শিমুল, আমি একটু বাড়ি যেতে চাই।অনেকদিন হলো যাইনি। গ্রামটাতে কয়েকদিন থাকতে ইচ্ছা করছে। পলাশকে নিয়ে যাবো। পাখি সাথে যাবে কাজকর্ম করার জন্য। তোরা থাকতে পারবি তো?”

“গ্রামে তোমার দেখাশোনা কে করবে?”

“আমিই তো আমার দেখাশোনা করি মা। আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না।পাখি থাকবে,হেল্প করবে।”

“এমন সময়ই তোমাকে যেতে হবে?সামনে আমার বিসিএস, মৌরীর ইন্টারমিডিয়েট একেবারেই দোরগোড়ায়, এখনই তোমার যাওয়ার ইচ্ছা জাগলো?”

“জাগলো।অনেকদিন ধরে গ্রামের জন্য মন টানছে খুব। তোরা বড় হয়েছিস, বাসায় মন্জু, মতির মা, নাজু তো আছেই।”

“গ্রামে তোমার আছেটা কে?তিনটা কুলাঙ্গার ভাই ছাড়া?”

“শিমুল, আমাকে নিয়ে তোর মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমার তোকে জানানোর দরকার,জানালাম। ”

” আমার পরীক্ষার পরে যাও। ”

“তোর পরীক্ষার সাথে আমার সম্পর্ক কি?আমি কি তোর পড়াশোনায় কোন সাহায্য করতে পারবো?”

শিমুল চিৎকার করে বললো,” আমার পরীক্ষার সময় যন্ত্রণা করা তোমার একটা স্বভাব। এসএসসি দিলাম একা একা, ইন্টারমিডিয়েটে ফার্স্ট হলাম,সেদিন তোমার দৌড়াদৌড়ি সতীনের বাপ আর তোমার শাশুড়ি মরেছে বলে। মাত্র তিন মাস আছে পরীক্ষার, এখনই তোমাকে যেতে হবে।মৌরীর পরীক্ষার এক মাসও বাকি নেই, এই সময়ে তোমাকে ছুটতে হবে গ্রামে।”

রেখা চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলেন। ছোট্ট শিমুলের কথা মনে হচ্ছে বারবার। ছোট বাচ্চাটা, যাকে সবাই বলতো কালিন্দী, অপয়া,অলক্ষুণে, থ্যাবড়ামুখি, কি বুঝদার আর সহানুভূতিশীল ছিল! মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিতো, ছোট ছোট হাত দিয়ে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো, পলাশকে বুক দিয়ে আগলে রাখতো। কি মিষ্টি ছিল কথাগুলো, মায়ামাখা, আন্তরিকতা আর ভালোবাসায় ভরা। সেই মেয়ে এমন হয়ে গেলো, বাপ আর দাদীর মতোই নিষ্ঠুর, কর্কশ।

ওমর-রিয়ার খুবই ভালো থাকার কথা বানুর আদর যত্নে। বানুর নিজের পুকুরের মাছ,ক্ষেতের সব্জি, বাগানের ফল, ঘরে পালা তেল চকচকে মুরগির মাংস, কখনো কবুতর বা হাঁস, টাটকা দুধ, বানুর আপ্যায়ন আর শেষ হয়না। প্রতি দিনই রাজসিক আয়োজন। নিষেধ করেও লাভ হচ্ছে না। এই ধনবতী মহিলাকে রিয়ারা কিনা ট্রিট করতেন বেতনভুক্ত কর্মচারীর মতোন। বানু রিয়াদের অবহেলা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারতেন। আজ রিয়াকে বাগে পেয়ে তাঁর খারাপ ব্যবহার করার কথা। তার পরিবর্তে এতো সমাদর রিয়াকে লজ্জায় মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। আর দুজনেরই মন পড়ে আছে খান বাড়িতে। লজ্জায় কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না তাঁরা। কি করা যায়,কি করে খান বাড়ির সবার সাথে দেখা করা যায়,ভেবে কূল পাচ্ছেন না দুজনে। রেখা-শিমুল নিশ্চয় দূর দূর করে তাড়িয়ে দিবে। আর বানু যতোই আদর যত্ন করুন না কেন,এখানে আর ক’দিন?

কলবেলের শব্দে দরজা খুললো পাখি। অতিথি দুজনকে তার চেনা চেনা লাগছে, কবে কোথায় যেন দেখেছে, কিন্তু মনে করতে পারছে না। খালাম্মার শরীরটা অসুস্থ, ঘুমাচ্ছেন বোধ হয়, বড় আপা বাইরে, সে অতিথিদের বাইরে দাঁড় করিয়ে মেজো আপাকে ডাকতে এলো।

“আফা,একটা ব্যাডা আরেকখান বেডি আইছে।”

মৌরী মন দিয়ে পড়ছিলো। একটু বিরক্ত হয়ে নীচে নামলো। নামার আগে মায়ের ঘরে উঁকি দিলো। মা অকাতরে ঘুমাচ্ছেন। মায়ের মুখটা কি যে রোগা আর ক্লান্ত লাগছে! মৌরীর চোখে পানি চলে এলো। মা যে কবে সুস্থ হবেন!

সদর দরজার কাছে এসে মৌরী ভীষণ চমকে গেলো। ওমর খান ও রিয়া খান।তার জন্মদাতা ও জন্মদাত্রী। ইনারা যখন জেলে যান আর মৌরীরা মায়ের কোলে আশ্রয় পায়,তখন মৌরীর বয়স আট। অনেক ঘটনা ই তার মনে আছে। ইনারা জেলে কেন গেলেন তার কারণগুলো মৌরীর জানা ও স্বচক্ষে দেখা। ওমর-রিয়া যখন জেলে যান,তখন মুকুল,মিথুনের সাথে মৌরীও ভীষণ কেঁদেছিল। সেটা ছিল ভয়ের কান্না। মায়ের জন্য প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো মৌরীর, কিন্তু আরেক মায়ের পরম আদরে-মমতায়, আপা আর ভাইয়ার সাহচর্যে অল্প দিনেই সব কষ্ট পালিয়ে গিয়েছিল মৌরী,মুকুল,মিথুন,মুমুর। যতো বড় হয়েছে, দাদী আর মন্জুদের মুখ থেকে নানা ইতিহাস জেনে বাবা-মায়ের প্রতি চরম অভক্তি এসেছিল তার।বাবাকে বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই ভয় পেতো মৌরী। বাবা-মায়ের প্রতিদিন ঝগড়াঝাটি, মারামারি, অশ্রাব্য গালাগালি, দাদীর মুখ খিস্তি, দাদীর উপরে ওমর-রিয়ার চরম অত্যাচার, মাতাল হয়ে তাদের সাথেও বাবার চরম দুর্ব্যবহার, সবই মনে আছে মৌরীর। তবে মা খুব খারাপ জেনেও মায়ের প্রতি কিছুটা দুর্বলতা এখনো অবশিষ্ট আছে তার ।

রিয়া দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন। মৌরী শক্ত হয়ে গেলো। ইনার বাহুবন্ধনে ধরা দেওয়া ঠিক হবে না তাহলে মায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। রেখাকেই মাতৃজ্ঞান করে মৌরী। আর আপা যদি এই সময়ে বাসায় ফেরে…কি যে করবে মৌরী? রিয়া হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন,”মৌ,আমার মৌরী সোনা “। পিছিয়ে গেল মৌরী। তারপরে দৌড় লাগালো রেখার ঘরে।

পাখির কাছে মেহমান এসেছে জানতে পেরে মন্জু গেলো দেখতে। রিয়া-ওমরকে দেখে সেও প্রথমে থমকে গেলো। তারপর মহা আদর-আপ্যায়ন করে নিয়ে এলো ভেতরে।সে ছিল রিয়ার খাস চামচা। রেখাকে কম জ্বালায়নি মন্জু সেই সময়। শিমুল -পলাশকে তুইতোকারি করা এবং গালমন্দ করা ছিল তার খুবই প্রিয় একটা কাজ। এখন সে এই রেখা-শিমুলদেরই অধীনে। রেখা তাকে অপমান করেন না বটে, তবে শিমুল মেয়েটা হাড়ে হাড়ে শোধ তুলছে।যতো দিন যাচ্ছে ততোই শিমুল ভয়ংকর হয়ে উঠছে। নিত্যদিনই সে মন্জুকে অন্যদের সামনে বান্দী,শয়তান বুড়ি, আরও নানারকম গালি দেয়। কয়েকমাস ধরে শিমুল এমন ব্যবস্থা করেছে যে কাজ করে কূল পাচ্ছে না মন্জু। এই বয়সে অন্য কোন বাড়িতে কাজ মিলবে না। সাতকূলেও কেউ নেই। তাই এই বাসা ছাড়তে পারছে না মন্জু। তাছাড়া রেখার কল্যাণে তার খাওয়া-পরার অভাব হয়না। আজও বাইরে বের হওয়ার সময় কঠিন অপমান করে গেছে শিমুল। মন্জুকে হাড় হাভাতে,কুচুটে বুড়ি বলেছে।

ওমর আর রিয়া যদি কোনোভাবে এখানে আসন গাঁড়তে পারেন,হারানো ক্ষমতা ফিরে পাবে মন্জু। এরপরে সে চিবিয়ে খাবে শিমুলকে।

ওমর-রিয়া ড্রইং রুমের সোফায় বসলেন। মন্জু তাঁদেরকে সাদরে অন্দরমহলে আমন্ত্রণ জানালো। ঠেকা খেয়ে খেয়ে পরিমিতিবোধ এসেছে ওমর-রিয়ার। তাই তাঁরা মন্জুর আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন না। মন্জু ছুটলো বাচ্চাদের খবর দিতে।

“কই তুমরা? দ্যাখো কারা আইছে?তুমাদের আব্বা-আম্মা আইছে।”
রেখা তাঁর ঘরে খাটে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। তাঁর কাছে মৌরী। মন্জুর চেঁচামেচিতে বাচ্চাদের দল হুড়মুড়িয়ে ছুটলো নীচে। মুকুল পলাশকে ধরে ধরে নীচে নামালো।

শিমুল দূর থেকে দেখলো সদর দরজা খোলা। সে যখন বিস্মিত অবস্থায় ঘরে ঢুকলো,তখন মন্জু সমানে শিমুলের বংশ উদ্ধার করে যাচ্ছে রিয়ার পায়ের কাছে বসে। শিমুল কতো দূর্বিনীত, বেয়াদব, বেহায়া আর রেখা কেমন মাজাভাঙা, নিজের মেয়ের কাছে লাথি ঝাঁটা খায়, কিছু বলার সাহস নাই এগুলোর বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করছিল মন্জু রিয়ার কাছে। রিয়ার কোলে মিতুল,একহাতে জড়িয়ে ধরে আছেন মুমুকে, পলাশকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন খান সাহেব। মুকুল -মিথুন পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে ঘরের পর্দা ধরে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here