#ময়ূখ
#পর্ব-১৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৪০.
জুলেখা কাজে ব্যস্ত। তাই মিরার হাঁক শুনে মৌন চা, ফুলকপি বড়া আর মাল্টা কেটে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলো। নিভৃত সিঁড়িতে দাঁড়ানো অবস্থায় কপাল কুঁচকে মৌনর দিকে তাকিয়ে আছে। বাড়িতে কি কোনো কাজের লোক নেই নাকি! এই মেয়ে খাবার নিয়ে এলো কেনো!
মৌন ড্রয়িং রুমে এসে টি-টেবিলে খাবার রেখে চলে যেতে চেয়েছিলো। মহিন তার মাকে ইশারা করতেই তিনি পিছু ডাকেন,
‘শুনো মেয়ে।’
মৌন পিছু ফিরে বলে,
‘আমায় কিছু বলছেন আন্টি?’
‘হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। এদিকে এসো। একটু মহিনের পাশে বসোতো।’
মিরা অনেকটা অবাক হলেন। এটা আবার কেমন কথা তাদের বাড়ির বউ পরপুরুষের সাথে বসবে কেন? মৌন কিছু না বুঝেই মিরার দিকে তাকালো। মিরা দাঁড়িয়ে বললো,
‘মানে ভাবি আপনি কি বলতে চাইছেন?’
‘দেখুন ভাবি যে কারণে আপনার বাড়িতে আসা। জুলেখাকে আমার মহিন পছন্দ করেছে। যদিও আমার মত ছিলোনা। তবে একমাত্র ছেলে বুঝেনই তো। জুলেখাকে আমি পুত্রবধূ করতে চাই।’
মিরা যারপরনাই অবাক হচ্ছেন। হচ্ছে কি এসব! তিনি আবার হাঁক ছাড়লেন।
‘জুলেখা!’
এবার জুলেখা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। হাতে তার আটা লেগে আছে।
‘জ্বি, বড়আফা।’
মিরা রেগে বললেন,
‘এই আমি তোর আফা লাগি! আমার ছেলের বউও আফা আবার আমিও আফা! গর্দভ।’
‘সিলিপিং অপ টেং বড়আফা ছরি খালাম্মা।’
‘ভাবি ও জুলেখা।’
মহিন দাঁড়িয়ে বললো,
‘না, আন্টি।’
অতঃপর মৌনকে দেখিয়ে বললো,
‘ও জুলেখা। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।’
মিরা দপ করে সোফায় বসে পড়লেন। এমন কান্ড ইহ জনমেও তিনি দেখেননি। তার ছেলের বউয়ের জন্য তার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা হয়েছে! এদিকে মৌনর লজ্জা, রাগে হলুদ চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মিরা মহিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তোমাদের সাহস দেখে আশ্চর্য হচ্ছি। আমার বাড়িতে এসে আমার পুত্রবধূর জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছো!’
রুনা দাঁড়িয়ে গেলেন। মৌনর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আপনার পুত্রবধূ মানে ও তো আপনাদের নতুন কাজের লোক।’
‘আপনাকে এই অদ্ভুত কথা কে বললো?’
মিরার রাগে শরীর জ্বলে উঠেছে। নাটক শুরু করেছে নাকি! মহিন হঠাৎ নিভৃতের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ঐতো নিভৃত। এই নিভৃত তুই না বলেছিলি এই মেয়েটা তোদের নতুন কাজের লোক।’
মিরা রাগী দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন। রুনা, জিল্লুর সাহেব আর মহিনের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘মৌন নিভৃতের বিয়ে করা বউ। আশাকরি আপনাদের আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই। আপনারা এখন আসতে পারেন।’
মহিন খুবই মর্মাহত হলো। রুনা রাগে গজগজ করতে করতে স্বামী, সন্তান নিয়ে প্রস্থান করলেন। মৌনর চোখের কোণা বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। এতোটা লজ্জা সে কখনো পায়নি। মিরা নিভৃতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘নিভৃত এসবের মানে কি! বিয়ে করা বউকে তুমি মানুষের কাছে কাজের লোক বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছো কোন সাহসে?’
নিভৃত নিচে নেমে এসেছে। মায়ের গলা শুনেই বুঝলো মা রেগে আছেন। আর রাগলেই কেবল তাকে বাবুই না ডেকে নিভৃত ডাকে।
‘মা, আমি…..
‘কোনো কথা শুনতে চাচ্ছিনা। এসব যেন দ্বিতীয়বার না শুনি।’
৪১.
পড়ন্ত বিকেলের হালকা আলো ঘরে প্রবেশ করছে। বারান্দায় ঢুকার দরজার পাশে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে মৌন। তার পাশেই মিটির খাঁচা রাখা। মিটিকে খাঁচা মুক্ত করলো মৌন। ছেড়ে দিলো বারান্দায়। মিটি উড়ছে আর খুশিতে বাকবাকুম করছে। তাকে মুক্ত করায় সে ভিষণ খুশি। মৌনর মিটির খুশি দেখে ভালোলাগছে। নিজে সুখী না হলেও অন্যের সুখে সে মন খুলে হাসতে জানে। উদাস ভাব কাটিয়ে মনে নেমে এলো স্নিগ্ধতা। যে রাগটুকু লোকটার জন্য ছিল তা কোথায় গেলো কে জানে! মৌন অনেক চেষ্টা করে রেগে থাকতে। তবে সে পারেনা। মিটি ঘরে উড়ে বেড়াচ্ছে। পাখা ঝাপটিয়ে নিজের স্বাধীনতা উপভোগ করছে।
তখনই ঘরে প্রবেশ করলো নিভৃত। সে আজ নিজের প্রিয় কালো রঙের পোলো টি-শার্ট পরেছে। ঘরে ঢুকেই নজর গেলো বারান্দায় দরজায় দ আকারে বসে থাকা উদাস মেয়েটার দিকে। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিজের টি-শার্টে কিছু পড়তে দেখে উপরে তাকালো সে। একটা কবুতর তার উপর বিষ্ঠা ত্যাগ করছে।
নিভৃত একচিৎকার দিলো।
‘স্টুপিড!’
মৌন হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘরের ভিতর প্রবেশ করতেই মিটি তার কাঁধে উড়ে এসে বসলো।
‘এই মেয়ে এটা তোমার?’
‘হ্যাঁ।’
‘এটারে যেন আর ঘরে না দেখি।’
‘কেনো?’
‘কেনো তোমার মাথা স্টুপিড।’
নিভৃত রাগে গজগজ করতে করতে বাথরুমে ঢুকে গেলো। মৌন হা করে তাকিয়ে মিটিকে জিজ্ঞেস করে,
‘তুই কিছু করেছিসরে, মিটি?’
মিটির চেহারাটা বড়ই অসহায় দেখালো। অর্থাৎ সে কিছুই করেনি। মৌন নিশ্চিত বদলোকটা নিজের দোষ ঢাকতে ঢং করছে।
____________________
কেটে গিয়েছে কয়েকমাস। মৌন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করছে সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন জীবনে মৌন অনেকটা ডুবে গিয়েছে। দুই-তিনজন নতুন বান্ধবী হয়েছে তার। টিএসসিতে বসে আড্ডা দেওয়া, চা খাওয়া, ফুচকা খাওয়া। ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ানো। রবীন্দ্র সরোবরে বান্ধবীদের সাথে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ানো। ভালোই সময় কাটছে তার। শশুর-শ্বাশুড়ি কখনো তাকে কোনো কাজেই বাঁধা দেয়না। তবে নিভৃতের সাথে সম্পর্কটা রয়ে গেছে ঠিক আগের মতো।
বিগত কয়েকটা মাসের ঘটনাগুলো ছাদের দোলনায় বসে পর্যবেক্ষণ করছে মৌন। এতো আনন্দের মাঝেও কি যেন নেই। প্রিয় মানুষটার ভালোবাসা নেই। তার আদর সোহাগ নেই। তার অবহেলা পূর্ণ আচরণগুলো তীরের মতো বুকটাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। লোকটা কেন বুঝেনা! মাঝেমাঝে মৌনর রুহানির উপর হিংসা হয়। রুহানির ভাগের একভাগ ভালোবাসা যদি সে পেতো! কিংবা প্রিয় মানুষের বুকে রুহানির পাশে একটু জায়গা!
৪৩.
দিলারা বিছানায় শুয়ে আছেন। তিনি হুইলচেয়ার ছাড়া চলাচল করতে পারেন না। মৌন প্রবেশ করে দিলারার ঘরে। বিছানায় বসে বলে,
‘দাদুমনি, শরীর কেমন তোমার?’
দিলারা মিষ্টি হেসে বললেন,
‘ভালো আছি। তোমার দেখাই তো পাইনা নাতবউ। কই থাকো তুমি?’
‘পরীক্ষার ঝামেলায় আসতে পারিনা দাদুমনি। এবার যে হজ্জে যাবে কেমন লাগছে তোমার?’
‘আমি অনেক খুশি নাতবউ। ভাগ্য করে এমন ছেলে আর ছেলের বউ পেয়েছি। নয়তো আজকালকার যুগে এমন পঙ্গু মায়ের খেয়াল কে রাখে।’
‘এভাবে বলোনা। তুমিও অনেক ভালো।’
মৌনর অবাক লাগে। এই দিলারাই এককালে তার শাশুড়ী মিরাকে অত্যাচার করতো। অথচ এখন বৌমা বলতে অজ্ঞান। সত্যিই সময় পাল্টায়, মানুষ পাল্টায়। কেবল ধৈর্য ধরতে হয়।
_____________________
আজ মিরা, নাজমুল আর দিলারাকে এয়ারপোর্টে প্লেনে তুলে দিয়ে এসেছে নিভৃত। একমাস পর একেবারে ঈদুল আজহার পরে ফিরবে তারা। মিরা বারবার বলে দিয়েছেন নিভৃতকে সে যেন মৌনর সাথে খারাপ ব্যবহার না করে, সে যেন মৌনকে কষ্ট না দেয়।
বাড়িতে জুলেখা, শরীফা কেউই নেই। তারা ইদের পর আসবে। মৌন, নিভৃতই কেবল আছে। আর আছে মিটি। নিভৃত এই মিটি নামক অদ্ভুত পায়রাটাকে দুচোখে সহ্য করতে পারেনা। তার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। এই বজ্জাত পায়রা প্রথম কয়েকমাস তার উপর বিষ্ঠা ত্যাগ করতো। রেগে তাকালে এমন ব্যবহার করতো যেন সে কিছুই করেনি। এখন সে স্বভাব গেলেও তাকে দেখেই উড়ে এসে তার কাঁধে বসবে।
নিভৃত মাত্রই সোফায় এসে বসেছে। মিটি উড়ে এসে বসলো তার কাঁধে। নিভৃত বিরক্ত হয়ে বললো,
‘এই বজ্জাত পায়রা! তুমি আবার আমার কাঁধে বসেছো! যাও বলছি!’
কে শুনে কার কথা। হাল ছেড়ে দেয় নিভৃত। মৌন একগ্লাস শরবত নিয়ে আসতেই নিভৃত বলে,
‘এই মেয়ে!’
‘এই মেয়ে না। আমার নাম মৌনতা সুবহা মৌন।’
‘তাতে আমার কি?’
‘আমার নাম নিয়ে ডাকবেন।’
‘দেখো ফালতু কথা বাড়াতে পারবোনা। বাবা-মা তো এখন বাসায় নেই। তুমি আমার রুমে থাকবেনা। গেস্ট রুমে থাকবে।’
‘কেন?
‘কারণ আমি বলেছি তাই।’
‘আপনার ঘরে কি আমার একটুও অধিকার নেই?’
‘না, নেই।’
মৌন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘আচ্ছা, তাহলে তাই হবে।’
পিছু ঘুরে নিজের চোখের কোণের পানিটা মুছে নিলো মৌন। এই যে সে লাল রঙা শাড়ি পরেছে, গাঢ় করে চোখে কাজল এঁকেছে। চুল গুলোকে এলোমেলো খোঁপা করেছে এসব কার জন্য!
‘এই মেয়ে শুনো।’
‘আরো কিছু বলবেন?’
‘তোমার বজ্জাত পায়রাটাকে নিয়ে যাও।’
(চলবে)…….