#ময়ূখ
#পর্ব-৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১৬.
নাজমুল সাহেব ফার্মগেটের একটা কোচিংয়ে মৌনকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। সাথে প্রয়োজনীয় সকল বই খাতাও কিনে দিয়েছেন। মৌন অনেক খুশি। বিয়ের পরে পড়াশোনা করা হবেনা ভেবেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলো সে। নতুন করে পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে যারপরনাই অনেক খুশি মৌন।
মৌন ‘একগুচ্ছ সুখ’ নামক বাড়িটিতে আছে আজ প্রায় তিনমাস। বাবা-মায়ের সাথে খুবই সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। বাড়ির প্রতিটা কোণা যেন তার অস্তিত্বের সাথে মিশে গিয়েছে।
‘এই গ্রামারগুলো তোর বাড়ির কাজ।’
‘ঠিক আছে।’
শাশুড়ী মায়ের কাছে পড়া বুঝে রাতে যখন মৌন ঘরে এলো তখন প্রায় নয়টা বাজে। নিচে বিছানা করে বইখাতা নিয়ে পড়তে বসেছে সে। এমনিতেই অনেক গ্যাপ গিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। রাত জেগে হলেও পড়াগুলো শেষ করতে হবে। মৌন হালকা আওয়াজে পড়ছে। বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো নিভৃত। মৌন পড়ছে আর আড়চোখে নিভৃতকে পর্যবেক্ষণ করছে। একটু পরেই ছাইপাঁশ গিলবে তারপর তাকে কোলে নিয়ে বিছানায় ওঁরই বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে। সারাদিন ভাবখানা এমন যেন মৌনকে চিনেই না। যখনই কথা বলবে তখনই তা হবে ঝগড়া। নিভৃতের পাগলামি আগের থেকে কমেছে। যদিও এটা সম্ভব হয়েছে কেবল কাজে ফিরে যাওয়ায়। ব্যস্ততায় এখন পাগলামিগুলো কমিয়ে করে। তবে রাত হলে ঠিকই ছাইপাঁশ গিলবে। মৌন গুনগুন করে পড়েই যাচ্ছে। হঠাৎ করেই ঠাস করে ল্যাপটপটা বন্ধ করলো নিভৃত। মৌন জিঘাংসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
‘এই মেয়ে কানের কাছে এমন মশার মতো ঘ্যানঘ্যান করছো কেন?’
‘অদ্ভুত তো! আমি কোথায় ঘ্যানঘ্যান করছি। আমি তো পড়ছি।’
‘পড়া বন্ধ। আমার সমস্যা হয়।’
‘এহ্, বললেই হলো। আমার পরীক্ষাটা আপনি দিবেন?’
‘তুমি এবং তোমার থার্ড ক্লাস পরীক্ষা!’
‘দেখুন আপনি কিন্তু বেশি করছেন। আমি বাবাকে বিচার দিবো।’
‘তোমার বাবাকে তো আমি খুব ভয় পাই। বিশ্বাস করো তোমার থ্রেটে আমি প্রচুর ভয় পেয়েছি।’
‘হুম, ভয় পেলেই ভালো।’
‘তুমি তো আচ্ছা বেয়াদব মেয়ে। আমার ঘরে থাকতে দিয়েছি এটাই বেশি। আমাকে ডিসটার্ব করলে সোজা বের করে দিবো।’
‘আপনি বললেই হলো।’
‘তোমার তো খুব সাহস। অফিসে স্টাফরা আমার ভয়ে কাঁপে আর তুমি এই টুকু একটা মেয়ে আমার সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছো!’
‘আমি খুব সাহসী। গ্রামের লোকে আমাকে সাহসের জন্য সাহসী বুড়ি খেতাব দিয়েছে।’
‘একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেনা আমি এখন ঘুমাবো তাই লাইট অফ থাকবে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আজ ছাইপাঁশ গেলবেন না।’
‘কি বললে তুমি?’
মৌন আস্তে করে বইটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো তারপরে বারান্দার দিকে দৌঁড়ে যেতে যেতে বললো,
‘বলেছি মদ গিলে নিজেকে ধন্য করবেন না। এতদিন তো পাগল ছিলেন আজ এতো সভ্য কেন?’
‘এই মেয়ে দাঁড়াও। বেয়াদব!’
১৭.
তার আগেই মৌন বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বাইরে নিভৃত রাগে গরগর করছে আর পায়চারি করছে।
‘ননসেন্স মেয়ে। একবার হাতে পাই তোমার বেয়াদবির মজা বুঝিয়ে দিবো।’
দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে মৌন। আজ বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে। নিভৃত সামনে পেলে নিশ্চিত থাপ্পড় খাওয়া লাগতো। অতঃপর হেসে উঠে মৌন।
আজ নিভৃত নেশাদ্রব্য খায়নি। লাইট নিভিয়ে বিছানায় শোয়ে পড়লো সে। অনেকটা সময় ধরে এপাশ ওপাশ করলো তবুও ঘুম ধরেনা। কি আশ্চর্য! কি যেন নেই। কিছু তো একটা নেই! সেই কিছু একটার অভাবে ঘুম আসছেনা তার।
মৌন বারান্দায় হালকা আলোয় পড়ছে। ছিটেফোঁটা আলোয় যদিও একটু কষ্ট হচ্ছে। তবুও সে পড়ছে। একসময় ঘুমিয়ে গেলো। তবে একটা অভাববোধ রয়েই গেলো। নেশার ঘোরে হলেও মানুষটা তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতো। মিষ্টিমুখটা দেখেই রাত কেটে যেতো মৌনর। আজ সেই সুযোগ নেই। তার সম্পর্কটাই এতো ব্যাতিক্রম, এতো অদ্ভুত কেন!
___________________
মৌনর আজ রেজাল্ট দিয়েছে। ৪.৯৬ পেয়েছে সে। আর্টস থেকে এই রেজাল্ট করাও অনেক কঠিন। বাড়ির সবাই খুশি। মৌন নিজের বাবা-মাকে ফোন করেও কথা বলেছে। বোনদের সাথে কথা বলেছে।
সোফায় বসে আছেন নাজমুল সাহেব। পুত্রবধূর ফলাফল শুনে আজ তার মনটা বেজায় খুশি। নিভৃত রেজাল্ট শুনে বিরক্তের সাথে বলেছে,
‘এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। আমি গোল্ডেন পেয়েও এতো লাফালাফি করিনি। যতসব।’
মৌন একটা ভেংচি কেটে দৌঁড় দিয়েছে। এই লোকটা যে তার রেজাল্টে জ্বলছে তার ভালো করেই জানা আছে।
‘মৌন মা। তুই কি চাস? যা চাওয়ার চেয়ে নে। আজ তোর বাবা তোকে সব দিবে।’
‘বাবা, আমি বাড়ি যেতে চাই।’
‘কিন্তু তোর কোচিং?’
‘কয়েকদিনে কিছু হবেনা। আমার বড়বোন নিতুর বিয়ে। বাবা-মা অনেক জোর করে বলেছেন আপনাদের সবাইকে নিয়ে যেনো আমি ফরিদপুর যাই। বাবা হয়তো বিকালের দিকে ফোন দিতে পারে আপনাকে।’
‘আমার আর তোর শাশুড়ীরও ইচ্ছে ছিলো গ্রামে যাবো। তবে নিভৃত যাবে কিনা…..
‘সবাইকে নিয়ে গেলে বাবা অনেক খুশি হতেন।’
‘আচ্ছা, আমি দেখছি। কবে যেতে চাস?’
‘বিয়ে শুক্রবার আমরা কালকে সকালে রওনা দেই?’
‘ঠিক আছে মা। তাই হবে।’
বিকালে নিভৃত বাড়ি ফিরেছে। তার সাথে তার দুই বন্ধু মহিন আর আয়মানও এসেছে। তিনজন একসাথেই পড়াশোনা করেছে বুয়েটে। এখন নিজেদের মতো চাকুরী করছে। নিভৃতের দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটা বন্ধুমহলে কারো জানা নেই। সোফায় বসে নানা রকম গল্প করছে, কথা বলছে তারা। প্রাণপ্রিয় বন্ধুর স্বাভাবিক রূপ দেখে অনেকটাই খুশি দুজনে। নয়তো রুহানির মৃত্যুর প্রথম তিনমাস একেবারে জীবন্ত লাশের মতো ছিল নিভৃত।
১৮.
দুজনে অনেক বুঝিয়েছে। তবে নিভৃত কোনো কথাই কানে তুলেনি। জুলেখা বাড়ি নেই আর শরিফা কাজ করছে তাই মৌন অতিথিদের জন্য চা, মিষ্টি আর আপেল কেটে নিয়ে এসেছে। চুপচাপ টি-টেবিলে খাবার দিয়ে আবার চলে এসেছে। মহিন একধ্যানে হলুদ বর্ণের সুন্দরী রমণীর দিকে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটা অনেক সুন্দর। বেগুনি থ্রি-পিস পরনে মাথায় উড়নাটা ঘুমটার মতো দেওয়া। কোমড় সমান চুলে বেণী করা। মহিন হা করে মেয়েটার চলে যাওয়া দেখছে। পাশে বসে আয়মান মিটিমিটি হাসছে। নিভৃত যারপরনাই বিরক্ত। এই মেয়েকে নাস্তা আনতে কে বলেছিল!
‘এই পরী কে কেরে?’
মহিনের কথায় কপাল কুঁচকে গেলো নিভৃতের। মুখটা বিকৃত করে সে বললো,
‘হবে নতুন কাজের লোক। বাবা-মা তো রাস্তা ঘাটে যাকে পায় তাকেই ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে।’
মৌন উপরে যাচ্ছিল। নিভৃতের এই কথাটায় থমকে যায় সে। তাহলে তার পরিচয় সে এই বাড়ির কাজের লোক! দৌঁড়ে ছাদে উঠে যায় সে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। খুব। মানুষের কথার চেয়ে বিষাক্ত বিষ হয়তো এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এই বিষ অন্যজন মানুষের মনকে মেরে ফেলতে সক্ষম। মৌন চোখ মুছে ঘরে আসে। আলমারির নিজের কাবার্ড থেকে একটা ডায়েরি বের করে সে। বারান্দায় বসে দুটো লাইন লেখে তাতে।
‘প্রিয়,
তুমি তো আমায় কতো ভালোবাসতে!
আদো কি সেটা ভালোবাসা নাকি আমার কিশোরী মনের ছলনা!’
ডায়েরিটা বন্ধ করে আবার যথাস্থানে রেখে দেয় মৌন। এই ডায়েরির প্রতিটা পাতায় পাতায় কেবল সে এবং তার প্রিয়কে নিয়ে লেখা এলোমেলো ভাবনা আছে।
‘কি বলিস! এতো সুন্দর মেয়ে কাজের লোক!’
‘কেনো তোর কোনো সন্দেহ আছে?’
‘না,তবে মেয়েটা সত্যিই পরীর মতো দেখতে।’
নিভৃত আবার বিরক্ত হয়। কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কেবল।
(চলবে)…..