ময়ূখ #লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি #পর্ব-২৮

0
761

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২৮

৮২.
রিপ্ত শাপলাবিলের পাশে বসে একটানা সিগারেট টানছে। একটার পর একটা। চোখ দুটো লালবর্ণ তার। আজ প্রায় পনেরো দিন মৌন নিখোঁজ। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে। রিপ্ত সামনে তাকিয়ে আছে। কালচে সবুজ পানির রং। রিপ্তের চোখ দুটো হঠাৎ অশ্রুতে ভরে গেছে। নীল শার্টের হাতায় চোখ মুছে রিপ্ত।
‘মৌনিরে তুই কই গেলি মৌনি।’

______________________

কাঁচের ল্যাম্পটা নিচে পড়ে ভেঙে গেলো। একে একে আসবাবপত্র সব ফ্লোরে ছুঁড়ছে নিভৃত। গত দুইদিন যাবত তাকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। নিভৃত দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে জোরে জোরে দরজায় আঘাত করে।
‘আম্মু, দরজাটা খুলে দেও। প্লিজ আম্মু আল্লাহর দোহায় লাগে আম্মু।’

মিরা বাইরে বসে আছেন। দেয়ালে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করেন তিনি। ছেলের এমন দশায় তিনি বড্ড ভেঙে পড়েছেন।
‘ও আম্মু, আম্মুগো। আমি শ্বাস নিতে পারছিনা তো! একটাবার খালি একটাবার আমার মৌনটাকে এনে দাওনা আম্মু।’

কোনো জবাব না পেয়ে নিভৃত ধপাস করে বসে পড়ে। বুকটা জ্বালা করছে। ভিষণ জ্বালা করছে। নিভৃত হঠাৎ অনুধাবন করলো তার এখন মেয়েটার শরীরের গন্ধ নিতে হবে। নয়তো সে মরে যাবে। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। নিভৃত দৌঁড়ে আলমারির কাছে যায়। পায়ে ভাঙা ল্যাম্পের কাঁচ ফুটেছে। সেসব খেয়াল নেই তার।

আলমারিতে মৌনের কাভার্ডে হাত বাড়ায়। একটা শাড়ি যদি পাওয়া যায়! একটু ঘ্রাণ যদি নেওয়া যায়! হঠাৎ শাড়ি টান দিতে গিয়ে একটা কালো ডায়েরি নিচে নিভৃতের পায়ের কাছটায় পড়লো। নিভৃত অবাক হয় খানিকটা। এটা কি মৌনর ডায়েরি? নিভৃত ডায়েরিটা উঠিয়ে খাটে নিয়ে বসে। অনেকটা পুরানো ডায়েরি। মাঝারি আকৃতির। কালো রঙের কভার। উপরে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা ‘মৌন’। নিভৃত বিছানায় হেলান দিয়ে ডায়েরিটা খুলে। প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা,
‘আমি এবং আমার প্রিয়।’

নিভৃত অনুধাবন করলো সে ঘামছে। বড্ড ঘামছে৷ তবে কি মৌনর মনে অন্য কারো বসবাস।

নিভৃত মনের কোণে প্রশ্ন জাগে। কে মৌনর প্রিয়?
নিভৃত ডায়েরিটা ফেলে দেয়। মাথা চেপে ধরে বসে থাকে অনেকটা সময়। তার মনটা যে বড়ই দুর্বল। অন্যকারো সাথে মৌনর সম্পৃক্ততা নিভৃত একদম মেনে নিতে পারবেনা। নিভৃতের শরীর শুকিয়ে গেছে। সারামুখে দাঁড়ি ভর্তি। চোখের নিচে কালো দাগ। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে উঠে দাঁড়ায় নিভৃত। ডায়েরিটা উঠায় পাশ থেকে। তাকে যে জানতে হবেই!

৮৩.
দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় কিছুই লেখা নেই। আবার পৃষ্ঠা উল্টালো নিভৃত। তার কপালের পাশ দিয়ে সূক্ষ্ণ একটা ঘামের রেখা দেখা যাচ্ছে।

প্রিয়,
কি নামে ডাকবো তোমায়? রাজপুত্র বলে ডাকি? এই তুমি কি রাগ করবে? জানো আগামীকাল আমার দশম শ্রেণীর টেস্ট পরীক্ষা আর আমি তোমাকে নিয়ে লিখছি। আমি কি বড্ড পাগল? আজ থেকে দুইবছর আগে ব্যারিষ্টার বাড়ি গিয়েছিলাম। আরু, নিরু বললো তাদের নাকি কোন ভাই আসবে। আমি কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাইনি। আসলে আসুক আমার কি? কে জানতো সে ভাই আমাকে পাগল করে দিবে?

সবুজ রঙের টি-শার্ট পরনে একটা রাজপুত্র এলো ব্যারিষ্টার বাড়ি। আমি বড় জামগাছটার পিছনে লুকিয়ে কেবল একটা নজর দেখেছিলাম। বিশ্বাস করো, আমার বেহায়া চোখ আটকে গেলো তোমাতে। আমার হৃদপিণ্ডটা ধুকপুক ধুকপুক আওয়াজ করতে লাগলো। আমি চেপে ধরলাম বাঁ পাশটা। লোকে আওয়াজ শুনে ফেললে কি লজ্জা! কি লজ্জা!

নিভৃত হঠাৎই মুচকি হাসে। মৌন এত ছেলেমানুষ! পড়ায় মনোযোগ দেয় সে।

কতবার চেষ্টা করলাম। তোমার সামনে যাবো তোমাকে প্রাণভরে দেখবো। আমি পারিনি। কেনো পারিনি কে জানে? তারপর তুমি চলে গেলে। কেনো চলে গেলে? আমার ভিতরটা যে খা খা করে রাজপুত্র!

আর কিছু লেখা নেই। নিভৃত পৃষ্ঠা উল্টায়। কেবল লেখা রাজপুত্র ভালোবাসি। আমার স্বপ্নে রোজ এসে জ্বালানোটা কি খুব প্রয়োজন? পঁচা রাজপুত্র।

প্রিয়,
জানো আজ প্রায় দুইটা বছর তোমায় দেখিনা। এ কেমন জ্বালা দিয়ে গেলে আমায়। আমার কিশোরী মনে একোন আবেগ! আমি যে কইতেও পারিনা আর সইতেও পারিনা। তুমি আসোনা। আজ ভর পুর্নিমা। আকাশে কত তারা! তোমার সাথে আমি পূর্নিমার আকাশ দেখবো। কোনো এক বিস্তর মাঠে পাশাপাশি শুয়ে আকাশে ভরা জোৎস্না দেখবো। তোমাকে নাকি তোমার প্রিয় মানুষটা বাবুই পাখি ডাকে? আমি ডাকি। বেশি না একটু। একটু।

বাবুইপাখি, বাবুইপাখি, বাবুইপাখি পরের পাঁচটা পৃষ্ঠা কেবল এটাই লিখা। নিভৃত অবাক হয়। সে ঘুনাক্ষরেও জানতোনা তার একটা এমন পাগলাটে প্রেমিকা ছিল!

নিরুর মুখে শুনলাম তুমি নাকি আগামীকাল আসবে? আমি ঠিক কতটা খুশি আমি তোমায় কি করে বোঝাই? আচ্ছা, একটা উদাহরণ দেই? বিকালে কলেজ থেকে ফিরে উঠানে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ একলা লাফিয়েছি। মা, ঝাড়ু নিয়ে ছুটে এসেছিলেন। আশেপাশে লোকজন জমা হয়ে গিয়েছিলো আমার লাফানো দেখে। জানো মা,বাবা মিলে রাতে হুজুর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে! তাদের কি করে বোঝাই এই পাগলামী জ্বীনে ধরার পাগলামি না। এই পাগলামি আমার নিভৃতের জন্য করা পাগলামি। নিভৃত রহমান। দেখো তোমার নাম আর আমার নামে কতো মিল! নিভৃত, মৌন। দুজনের নামের অর্থই নিরবতা।

আজ পহেলা বৈশাখ। জানো, আজ আমি লাল পাড়ে সাদা শাড়ি পরেছি, পায়ে আলতা দিয়েছি। হাতে কাঁচের চুরি পরেছি। তুমি আজ আসবে। তোমায় আমি মনের কথা বলবো। খুব করে বলবো। এই যে দেখেন, মিঃ নিভৃত আমি কিন্তু আপনার পাগলাটে প্রেমিকা। আচ্ছা, আমি কি খুব বেহায়া? তোমার ভালোবাসার মানুষ আছে শুনেও আমি এতোটা বেহায়া কি করে হতে পারি। থাক। থাকনা কিছু অজানা। যা কেবল আমি জানবো। মিরা আন্টি কি কিছু বুঝে গেলো? আমি বারেবারে তোমার ঘরে উঁকি দেই। একদিন তো হাতেনাতে ধরেও ফেলেছিলো আমি দৌঁড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি।

পরের পৃষ্ঠাগুলো ফাঁকা। নিভৃত আরো পৃষ্ঠা উল্টায়।

তোমার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে? রুহানি আপু খুব সুন্দরী। বেশ মানিয়েছে তোমাদের। সেদিন তোমাদের বাড়ি ছুঁটে গিয়েছিলাম। মিরা আন্টিকে সামনে পেয়ে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম তুমি কই। আন্টি বললো তুমি নাকি ব্রক্ষপুত্রের পাড় গেছো। আমাকে আর পায়কে। আমিও দৌঁড়ে গেলাম সেখানে। তুমি যখন রুহানি আপুর হাতে হাত রেখে পাড় ঘেঁষে হাঁটছিলে কি সুন্দর লাগছিলো! আমি কিন্তু দেখে ফেলেছি। তুমি যে রুহানি আপুর কপালের মাঝখানটায় চুমো খেয়েছো। আমি দেখেছি। হি হি হি।
ফিরে আসার সময় দেখলাম আমি হাঁটছি আর মাটি লাল হচ্ছে। আমার পায়ের ছাপ বসছে মাটিতে। জুতা খুলে দেখি একটা বড় কাটা ফুটেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। এই রক্তক্ষরণ আমি বন্ধ করলাম। তবে আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ?

৮৪.

তোমার সাথে নাকি আমার বিয়ে! আমি এমনটা কখনো চায়নি। বিশ্বাস করো রাজপুত্র। আমি এটা চাইনি।

পরের পৃষ্ঠা গুলো সাদা। নিভৃত উদভ্রান্তের মতো পৃষ্ঠা উল্টায়।

আমার খুব কষ্ট হয় নিভৃত। আমার সাথে কেন এমন করো তুমি?

রাজপুত্র, ও রাজপুত্র ভালোবাসি তোমায়।

আমাকে কি খুব ঝগড়াটে ভাবো তুমি? এই যে রাজপুত্র আমি কিন্তু মোটেও ঝগড়াটে নই।

আজ আমরা প্রথম মিলিত হয়েছি। আমার শত চিৎকার আর্তনাদ শুনোনি তুমি। আর দোষটা তুমি আমার দিলে নিভৃত?

তোমার সাথে ঘুরে বেড়ানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার হৃদয়ের গহীনে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছি। সিলেটে তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা সময় আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রাখবো রাজপুত্র। আমার জন্য তোমার উদ্বিগ্নতা আমায় লজ্জা দিচ্ছে তো!

সিলেটে আমরা দ্বিতীয়বার মিলিত হয়েছি। তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছো কেন? আমি তো তোমার স্ত্রী!

তুমি বড্ড জটিল নিভৃত। তুমি একটা মায়াজাল।

তোমার বুকে একটু ঠাঁই কি আমি পাবোনা?

আমি একটা ভেসে বেড়ানো কচুরিপানা।

পরের পৃষ্ঠাগুলোতে কেবল এসবই লেখা।

বড় স্বাদ ছিলো তোমায় নিয়ে বাঁধবো ঘর।
তুমি বন্ধু আমায় করে দিলে পর!

আর কিছু লেখা নেই। নিভৃত পৃষ্ঠাগুলো উল্টায়। দুয়েকটা কবিতা, ছন্দ তাকে ঘিরে।

তবে শেষের পাতায় এসে হাত থমকে যায় তার। এটা কি? নিভৃত মনোযোগ দিয়ে দেখে। এটাতো একটা আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট! নিভৃতের মনে হচ্ছে তার হৃৎস্পন্দনের হার বেড়ে যাচ্ছে। শ্বাস আটকে আসছে। তাহলে মৌন!

নিভৃত চোখ বুলায় নিচের লেখাগুলোতে।

তোমার বাবা তোমায় চায়না সোনা। তুমি যে তার ভালোবাসার ফল না। তুমি তার চাহিদার ফল। তোমাকে কখনো কষ্ট পেতে দিবোনা আমি। তোমার বাবাকে ছেড়ে আমরা চলে যাবো দূরে। তোমার বাবা তার রুহানিকে নিয়ে থাকুক। ভালো থাকুক। আমি তোমাকে নিয়ে চলে যাবো। তোমার বাবা খুব পঁচা। খুব খুব খুব।

আপনি কি পুরো ডায়েরিটা পড়েছেন নিভৃত? আমি জানতাম আপনি হয়তো কোনোদিন পড়বেন। যেদিন আমি আপনার থেকে বহুদূরে চলে যাবো। শুনোন, আপনি আমার কিশোরী বয়সের আবেগ, ভালোবাসা। দীর্ঘ সাড়ে পাঁচটা বছর আপনার জন্য জ্বলেছি। বিয়ের পর তা বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। আপনি একটা স্বার্থপর নিভৃত। আপনাকে আমি ভালোবাসি। তাই হয়তো ঘৃণা করতে পারবোনা। নয়তো আমি আপনাকে ঘৃণা করতাম নিভৃত। অনেক ঘৃণা করতাম।

নিভৃতের হাত থেকে ডায়েরিটা খসে পড়ে। বাইরে ঝড় শুরু হয়েছে। এতো তীব্র ঝড়! আমগাছের মগডালটা ভেঙে ধরণী কাঁপানো আওয়াজ হলো। নিভৃতের সেদিকে খেয়াল নেই। সে স্তব্ধ, হতভম্ব, নিথর, নিশ্চল।

(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here