ময়ূখ #লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি #পর্ব-৮

0
564

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৮

২২.
বিশাল দুইতালা বাড়ি। পুরানো দিনের হলেও নতুন করে রং করা হয়েছে। দুইপাশে সবুজ ধানক্ষেত। বাড়ির সামনে হরেকরকম গাছপালা। পিছনে কলাগাছের স্তুপ। এই বাড়িটা সারা ফরিদপুরে ব্যারিষ্টার বাড়ি নামে পরিচিত। নাজমুল সাহেবের বাবা আলতাফ ছিলেন নামকরা ব্যারিষ্টার। বড় গেটটা খুলে দেওয়া হয়েছে। নিভৃত নিজের সাদা রঙা মার্সিডিজটা নিয়ে গেটের ভিতরে ঢুকছে। সে ফরিদপুর এসেছে খুব কম। বড়হয়ে বুঝ হওয়ার পর পড়াশোনার চাপে একদমই আসা হতোনা । শেষ একবার এসেছিলো বছর দুয়েক আগে। বিয়ের পর রুহানিকে নিয়ে। তারপর মায়ের কথায় দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে আর আজ এলো।

এই বাড়িতে থাকেন নিভৃতের বড়চাচি সুমনা। আর উনার চার ছেলেমেয়ে। বড়ছেলে, ছোটছেলের বউ। তাদের সন্তানাদি। নাজমুলের বিধবা বড় বোনও এই বাড়িতে থাকেন। নিভৃতের বড়চাচা ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। এছাড়াও পাশে টিনের লম্বা করে ঘর তোলা। সেখানে বাড়ির কাজের লোকেরা থাকে। বিস্তর জমিজমা হওয়ায় সারাবছরই জমিতে ধান, পাট, সবজি চাষ করা হয়। সুমনার ছেলেরা এসব খেয়াল রাখে। তাই এই বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই।

মৌন এই বাড়িতে অনেকবার এসেছে। এই বাড়ির প্রতিটা কোণাই তার চেনা। ছোটবেলা থেকেই আসছে এই বাড়িতে। তবে আজ সে এই বাড়িতে প্রবেশ করবে এই বাড়ির ছোট ছেলের বউ হয়ে। যা মৌনর কল্পনাতীত। তারমতো নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে এতোবড় বাড়ির বউ হবে তা অনেকটা অমাবস্যার চাঁদের মতোই ঘটনা।

বাড়ির সামনের বিশাল উঠানটায় একপাশে ধান শুকাতে দেওয়া হয়েছে। পাশে ছোটএকটা ডোবা আছে সেখানে হাঁসের দল খেলা করছে। ডোবাটার পাশে কয়েকটা আনারস গাছ লাগানো। দেখতে বেশ লাগে মৌনর। গাড়ি কখন থেমে গেছে মৌন খেয়ালই করেনি। নিভৃত তাকে রেখেই বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মৌন একধ্যানে আনারস গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। কি সুন্দর! দেখতে অনেকটা সবুজ বড় ফুলের মতো লাগে। ধারালো ফুল। নিভৃত মেয়েটাকে বের হতে না দেখে বলে উঠে,
‘এই মেয়ে!’

অতঃপর ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে বাড়ির প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে যায়। ধ্যান ভাঙে মৌনর। লালরঙা শাড়িটার আঁচলটা টেনে মাথায় দেয় সে। গাড়ি থেকে নামতেই দিথি, মিথি দৌঁড়ে আসে। তারা নিভৃতের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে। জমজ দুইটা। মৌনকে অনেক পছন্দ করে তারা। কাঁদা দিয়ে রান্নাবান্না খেলছিল । আর কাঁদা নিয়েই জড়িয়ে ধরে মৌনকে।
‘আয়হায় মেয়ে দুইটা করছে কি দেখছো! এই সর তোরা। মৌনরে তো কাঁদা দিয়ে মাখামাখি করে ফেলছোত!’

২৩.

বলতে বলতে এগিয়ে আসেন রুমি। মৌন তাকে বড় ভাবি ডাকে। মাকে এগিয়ে আসতে দেখে দুজনেই দৌঁড় দিয়েছে।

‘তুই আয়তো মৌন। মেয়ে দুইটা তোর শাড়িটা নষ্ট করে দিলো।’

মৌন হাসিমুখে বলে, ‘সমস্যা নেই বড় ভাবি।’

রুমি তাকিয়ে দেখেন ছোটমেয়েটাকে। এই তো সেদিনও খেলতে আসতো আরু,নিরুর সাথে। আর আজ লাল শাড়ি পরে বউ সেজে এসেছে।
‘আয় ঘরে আয়। ছোটমা, ছোটবাবা তো কখন এসে পড়ছে।’

দুজনে কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকলো। বিশাল বড় বৈঠকখানার মতো ঘর। সেগুন কাঠের সোফা, টেবিল, পুরানো দিনের ২১ ইঞ্চি টিভি, দূরে বিশজন বসার মতো বিস্তৃত ডাইনিং টেবিল। নানারকম পুরানো শো পিস।

সোফায় বসে নাজমুল, মিরা, সুমনা, নাজমুলের বড়বোন নাজমা কথা বলছে। মৌনকে দেখে মিরা বললো,
‘কাঁদায় মাখামাখি হলি কিভাবে মৌন?’

মৌন জবাব দেওয়ার আগে রুমি বললো,
‘আরে তোমার দুষ্টু দুই নাতনির কারবার ছোটমা।’

মিরা হাসিমুখে বললেন,

‘আচ্ছা, মৌন ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।’
‘আচ্ছা, মা।’

মৌন এবাড়িতে অনেকবার আসলেও দুতালায় গিয়েছে কেবল হাতেগুনা কয়েকবার। নিভৃতের ঘরে দুয়েকবার উঁকি দিয়েছিলো। তবে কখনো যাওয়া হয়ে উঠেনি। মৌনর খুব ইচ্ছেছিলো এই ঘরে ঢুকার। তবে এইবাড়ির ছোটছেলের ঘরে প্রবেশ নিষেধ ছিল। তাই ভিতরে যাওয়া হয়ে উঠেনি। ভাগ্যের কি খেলা! আজ সে সেই ছোটছেলের বউ হয়ে অধিকার নিয়ে ঘরে ঢুকছে।

রুমি দরজার বাইরে এসে থামলো। মুচকি হেসে বললো,
‘তাহলে তুই ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়।’
‘ঠিক আছে। বড়ভাবি।’
______________

নিভৃত সবেমাত্র শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। পরনে কেবল টাউজার। খাটে বসে সে তার চুলগুলো মুছে যাচ্ছে। এমন সময় ভিতরে ঢুকে মৌন। নিভৃতকে খালি গায়ে দেখে লজ্জা পায় সে। লজ্জায় তার হলদে গাল লাল রং ধারণ করেছে। নিভৃত বিরক্তি নিয়ে তাকায়। ধমকে বলে,
‘এই মেয়ে কারো ঘরে প্রবেশ করলে নক করে আসতে হয় সেই শিক্ষা পাওনি?’
‘দেখুন এটা আমারও ঘর।’
‘কি! তুমি এখানেও আমার সাথে থাকবে? এই মেয়ে তুমি এতো বেহায়া!’
‘আপনার কাছে অনুরোধ এখানে অন্তত এভাবে চেঁচামেচি করবেন না। বাড়ির সবাই খারাপ ভাববে।’
‘দেখো তুমি একদম কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবেনা। বের হও ঘর থেকে।’

নিভৃতের গলা উঁচিয়ে বলা কথাটা অনেকেই শুনেছে। অপমানিতবোধ করে মৌন। তবুও কিছু বলেনা। এখন সে ক্লান্ত। ঝগড়া করার ইচ্ছে তার নেই।
‘আপনার যত ইচ্ছে আপনি চেঁচান। আমি ফ্রেশ হতে গেলাম।’

মেয়েটার সাহস দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে নিভৃত। এই মেয়ে এতো সাহস পায় কোথায়! নয়ন মিয়া মৌনর ব্যাগটা বাইরে রেখে গেছে। রুমি হয়তো নিচে গিয়েই নয়নকে পাঠিয়েছিলো।

মৌন একটা শাড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। নিভৃত যারপরনাই অবাক।

২৪.
‘মিরা তুমি মৌনর মাঝে কি পেলে আমি বুঝিনা। কত ভালো ভালো মেয়ে ছিলো। আমাদের নিভৃতের নখের সমানও তো মৌন না।’

নাজমার কথায় চা খাওয়া থামিয়ে স্বামীর দিকে তাকান মিরা। নাজমুল ব্যাপারটা বুঝে বলেন,
‘বড়আপা মৌন মেয়েটা কিন্তু অনেক ভালো।’
‘মেয়ে ভালো সে তো আমরাও জানি। ছোট থেকেই তো এই বাড়িতে আসছে। আরু, নিরুর সাথে খেলে বড় হয়েছে। তবে সামান্য প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের মেয়েকে বউ করে ঘরে তুললি! আমি একজন এডভোকেট ছিলাম, বড় ভাই হাইস্কুলের হেডমাস্টার, তুই এতো বড় ইন্জিনিয়ার। আমাদের সাথে ওদের যায়!’
‘থাক না বড়আপা। আমরা তো শুধু এমন কাউকে চেয়েছিলাম যে আমাদের ছেলেকে ভালো রাখবে। রুহানি মারা যাওয়ার পর থেকে ছেলেটা জীবন্ত লাশ হয়ে গেছে।’
‘তা ঠিক। তবে কোথায় রুহানি আর কোথায় মৌন! আকাশ-পাতাল তফাৎ। তা নিভৃতের মাঝে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে?’
‘আস্তে আস্তে হচ্ছে বড়আপা। যতযাই হোক এতো সহজে তো আর রুহানিকে ভুলবেনা সে।’
‘তোদের ছেলে তোরাই ভালো বুঝিস।’

নাজমুল এবিষয়ে আর কথা বাড়ালেন না। মৌন শুনলে কষ্ট পাবে। তার বড়আপা সবসময় এভাবেই কথা বলেন। তিনি বাস্তববাদী।

___________________

‘আহা, বাবুইপাখি ছাড়ো। কেউ চলে আসবে।’
‘কেউ আসবেনা। নিভৃতের ঘরে অনুমতি ছাড়া কেউই আসেনা। তারউপর নতুন বিবাহিত দম্পতিকে কোন পাগলে ডিসটার্ব করতে আসবে।’

রুহানি খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
‘তা নিভৃত মহাশয় এখন কি চায়?’
‘জাস্ট এ্যা কিস্।’
‘বাবুইপাখি! কিসব লাগামছাড়া কথাবার্তা!’

নিভৃত রুহানির ঘাড়ে মুখ গুঁজে বললো,
‘তোমার জন্য আমি আরো বেহায়া, বেশরম হতে পারি জান।’

শিউরে উঠলো রুহানি। তখনই ঘরে ঢুকেছে আরু,নিরু। রুহানি, নিভৃত দুইজন ছিটকে দু’দিকে সরে যায়। রুহানি লজ্জা পেয়ে দৌঁড়ে চলে যায় বারান্দায়। নিভৃত বিরক্তি চোখে তাকিয়ে বলে,
‘কি চাই তোমাদের?’
‘ছোট ভাইয়া তোমাদের ছোটমা ডাকে।’
‘আসছি, যাও।’

আরু, নিরু চলে আসে। বেচারিরাও লজ্জা পেয়েছে। নিভৃত দৌঁড়ে যায় বারান্দায়। আকাশে পুর্নিমার চাঁদ উঠেছে। দূর থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে।
‘জান।’
‘তুমি আমার সাথে কথা বলবেনা বাবুইপাখি। তোমার জন্য আজ লজ্জা পেলাম।’
‘আমার যে তোমার সাথে কথা বলতে না পারলে দম বন্ধ লাগবে! তুমি কি চাও তোমার বাবুইপাখি শ্বাস নিতে না পেরে কষ্ট পাক।’

রুহানি জড়িয়ে ধরে নিভৃতকে। বুকে মুখ গুঁজে বলে,
‘উঁহু।’
‘তাহলে দাও।’
‘কি দিবো?’
‘জাস্ট এ্যা কিস্।’
‘ইস্, বাবুইপাখি তুমিও…..

আর বলতে পারলোনা রুহানি তার ঠোঁট এখন অন্যকারো দখলে।

রুহানি সামনে দাঁড়িয়ে। পিছনে তাকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে নিভৃত।
‘বাবুইপাখি?’
‘হুম?’
‘আমি যদি কখনো মরে যাই। তুমি কি আমায় মনে রাখবে?’
‘রুহানি!’

নিভৃত গর্জন করে উঠে। রাগে ভিতরে চলে যায় সে। রুহানি গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। নিভৃত ভগ্ন স্বরে বলে,
‘আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো ভাববেনা তুমি।’
‘আমি আমার বাবুইপাখিকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারি!’

কে জানতো রুহানির কথাটাই সত্যিই হবে!

(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here