ময়ূখ #লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি #পর্ব-১৭

0
608

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-১৭

৪৯.
টয়োটা প্রিমিউ গাড়িটি শাহজালাল উপশহর মেইনরোডে প্রবেশ করেছে। নিভৃত একধ্যানে ড্রাইভ করছে। যদিও রাস্তায় দুইবার মৌনর সাথে তার ঝগড়া হয়েছে।
‘এই একটু গাড়ি থামান?’

ব্রেক কষে নিভৃত বললো,
‘এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন তুমি?’
‘আমার ইচ্ছে।’
‘এক ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে বের করে দিবো।’
‘আপনার বের করতে হবেনা। আমিই যাচ্ছি।’
‘এই মেয়ে মাথা নষ্ট তোমার? সিলেট চিনো তুমি?’

কথা না বলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো মৌন। নিভৃত হা করে তাকিয়ে আছে। একটা মানুষ এতোটা ঘাড়ত্যাড়া কিভাবে হতে পারে! কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নিভৃত বের হবে তার আগেই গাড়ির ভিতর উঠে বসলো মৌন। হাতে একটা নীল পলিথিন।
‘কি এনেছো?’
‘আপনাকে কেন বলবো?’
‘স্টুপিড।’

আবারো গাড়ি স্টার্ট করলো নিভৃত। মৌন একটু পরপর একটা টুথপিক দিয়ে আনারসের টুকরো পলিথিনের ভিতর থেকে বের করে খাচ্ছে।লবণ,মরিচ মাখানো ছিল। তাই ট্টা ট্টা শব্দ করছে। নিভৃত গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে দেখছে কেবল।

‘খাবেন?’

বলে একটা আনারসের টুকরো নিভৃতের মুখের সামনে ধরলো মৌন। হলুদ রঙের আনারসের টুকরোটায় লাল গুঁড়ো মরিচ আর লবণ মাখানো।

‘আমি এসব খাইনা। তুমিই খাও।’
‘আপনার ইচ্ছা।’

নিজেই খেয়ে নিলো মৌন। নিভৃত একটু বিরক্ত হলো। আরেকবার কি খাওয়ার জন্য বলা যেত না?

ঢাকা-সিলেট তামাবিল রোডের ডানদিকে প্রবেশ করেছে গাড়ি। পাহাড়ি রাস্তা উঁচু-নিচু। দুইপাশে বন্যতরুর দল। সবুজের সমারোহে এক অভাবনীয় মায়া। কানে ভেসে আসছে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ। ঐ তো দূরে চূড়ার মতো দেখা যায় জয়ন্তপুরের পাহাড়। মৌন গাড়ির জানালা দিয়ে মুখটা বের করলো। স্নিগ্ধ, শুদ্ধ, নির্মল বাতাসে ছেয়ে যাচ্ছে তার মন, মস্তিষ্ক। প্রাণহীন, ছন্দহীন, সুরকাটা, তালকাটা জীবনে যেন ফিরে আসছে নতুন প্রাণ, নতুন ছন্দ, নতুন সুর আর নতুন তাল। বিকেল হয়ে এসেছে। অজানা, অদেখা পাখিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের নীড়ে।

৫০.
অবশেষে দীর্ঘ ছয়ঘন্টা পর তারা পৌঁছালো সিলেটের নাজিমগড় রিসোর্ট। গাড়ি রিসোর্টের ভিতরে প্রবেশ করেছে। গাছগাছালি ঘেরা অনন্য সুন্দর একটা জায়গা নাজিমগড় রিসোর্ট। ডানপাশে গাড়ি রাখার গ্যারেজ। তবে রিসোর্ট আরো উপরে। মাটির উপর কৃত্রিম রাস্তা। আধার ঘনিয়ে আসছে চারপাশে। বাঁশগাছগুলো দেখে মৌনের মনে পড়ে তার নিজের বাড়ির কথা। ফরিদপুরের বাঁশবাগানের কথা। গাড়ি ক্রমশ উপরে উঠছে। উৎকন্ঠা বাড়ছে মৌনের। টিলার উপরে থাকার অভিজ্ঞতাটা কেমন হতে পারে?

রিসোর্টের সামনে গাড়ি থামলো। নিভৃত নেমে গেলো। মৌনের জন্য অপেক্ষা না করেই লাগেজ নিয়ে ভিতরের দিকে হাঁটা দিয়েছে সে। মৌন অবশ্য চারপাশ দেখছে। পাশে একটা দেয়াল। সেই দেয়ালের ভিতরে চারকোনা আকারের বক্স করে রাখা। সেখানে জ্বলছে হারিকেন। লাল রঙের দেয়ালে হলুদ রঙা আলোগুলো যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। পাশ ফিরে বিশাল বড় রিসোর্টার দিকে ক্ষানিকটা সময় তাকিয়ে রইলো মৌন। খয়রী আর লাল মিশেলে বিশাল আকৃতির বাড়ি। জায়গায় জায়গায় কৃত্রিম আলোয় ঘেরা। পাশে একটা বাগান বিলাস গাছ। গোলাপি ফুলগুলো চিকচিক করছে যেন। চোখ সরিয়ে কিছুটা ভিতরে ঢুকলো মৌন। পাশে একটা সুইমিংপুল। নীল রঙা পানি। সুইমিংপুলের ডানপাশে গাছগাছালি ঘেরা। বামপাশে বিশাল বড় লবি। লবিতে টেবিল, চেয়ার সাজিয়ে রাখা। মুগ্ধতার ভীড়ে মনে পড়লো তারপাশে নিভৃত নেই। দিকবিদিকশুন্য শূন্য হয়ে পড়লো মৌন। মানুষজন একেবারেই কম। কোথায় যাবে? কি করবে ভেবে পেলোনা মৌন। লবিতে রাখা একটা চেয়ারে বসে রইলো কেবল। নিভৃত তাকে একা ফেলে চলে গেল!

_________________

‘এই মেয়ে।’

পরিচিত কণ্ঠে জানে পানি এলো মৌনর। সে ভয় পেয়েছিল প্রচুর। নিভৃতের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
‘আপনি আমায় রেখে কোথায় চলে গিয়েছিলেন?’
‘রিসিভশনে চাবি আনতে গিয়েছিলাম মেয়ে। চলো এবার। আমাদের ঘর দুতালায়।’

নিভৃতের পিছুপিছু হেঁটে যাচ্ছে মৌন। খুবই ইচ্ছে করছিলো একটু ঝাপটে ধরতে। তবে কিসের যেন একটা বাঁধা।

সারি সারি ঘরের সামনে কাঠের বারান্দা। পাশে দুতালায় উঠার প্যাঁচানো সিঁড়ি। তা দিয়েই উপরে উঠছে তারা। বিশাল লম্বা বারান্দা দুতালায়। এককোনায় রুম পড়েছে তাদের। টিলার উপর রিসোর্ট হওয়ায় বারান্দা দিয়ে নিচে তাকালে ভয় লাগে প্রচুর। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারপাশে। বিভিন্ন পোকার আওয়াজ ভেসে আসছে। অদ্ভুত! খুবই অদ্ভুত সে ডাক। 3204 রুমের দরজাটা চাবি দিয়ে খুলে নিলো নিভৃত।

মৌন অবাক দৃষ্টিতে দেখছে। অভাবনীয় সুন্দর ঘরটা। সুসজ্জিত করে রাখা সবকিছু। কাঁচের টানা দেয়াল। দেয়াল না ঠিক এটা বারান্দায় যাওয়ার দরজা। দরজা সরাতেই বিস্তৃত বারান্দা। কাঠের চেয়ার, টেবিল রাখা এককোণে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গাছগাছালির মিষ্টি স্যাঁতস্যাতে গন্ধ নিচ্ছে মৌন। অন্ধকারে জোনাকি পোকাগুলো টিমটিমে আলো ছড়াচ্ছে। কানে ভেসে আসছে হরেক রকম ডাক। শরীরে লাগছে শুদ্ধতার বায়ু।

‘এই মেয়ে?’

নিভৃতের ডাকে ধ্যান ভাঙে মৌনর। পিছু ফিরে বলে,
‘কি?’
‘বারান্দায় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমার প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। তুমি তো রাস্তায় গো গ্রাসে গিলেছো।’

মৌন তেড়ে এলো সামনে। কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
‘আপনি নজর লাগিয়েছেন। তাই না? আমার যদি পেট খারাপ করে?’
‘একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেনা!’
‘আপনি বলবেন না উল্টাপাল্টা কথা। আপনাকে খেতে বলি নাই আমি?’
‘যাও তো মেয়ে। ফ্রেশ হয়ে এসো। তোমার সাথে ঝগড়া করার মুডে নেই আমি।’
‘ইস্। আপনার সাথে ঝগড়া করার জন্য আমি কি মরে যাচ্ছি?’
‘দেখো মেয়ে, কথা বাড়িয়ো না। বারান্দা থেকে ফেলে দিবো।’
‘আপনি বললেই হলো? পড়লে আপনাকে নিয়ে পড়বো।’
‘স্টুপিড। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। ফ্রেশ হয়ে এসো। নয়তো একাই খেতে চলে যাবো।’

৫১.

নিচে নেমে লবিতে হেঁটে গেলো তারা। লবির পাশ দিয়ে রাস্তা। সেই রাস্তার পাশ দিয়ে দু’তালায় উঠার সিঁড়ি। দুতালায় উঠলে রেস্টুরেন্ট। মানুষজন খুবই কম। একটা টেবিলে বসলো তারা। মেনুকার্ড হাতে নিয়ে মাথায় বাজ পড়লো মৌনের। এতো দাম!
‘এতো দাম খাবারের!’

আশেপাশের সবাই ফিরে তাকালো তাদের টেবিলে। নিভৃত কপাল কুঁচকে মৌনের হাত থেকে মেনুকার্ড টেনে নিয়ে চোখ রাঙালো। ফিসফিসিয়ে বললো,
‘সারা সিলেটেই খাবারের দাম বেশি,স্টুপিড। এতো জোরে চেঁচাতে হয়!’
‘না, মানে…..
‘চুপ। আর কোনো কথা না।’

মুখটা চুপসে গেলো মৌনের। সে কি ভুল কিছু বলেছে? এক গ্লাস লেমন জুসই নাকি আড়াইশ টাকা! ভাবা যায়! তাদের গ্রামে এই আড়াইশ টাকায় কতকিছু পাওয়া যায়!

নিভৃত বিরিয়ানি অর্ডার করেছে। একটা মাটির পাতিলে আটার প্রলেপ দিয়ে ঢাকা বিফ বিরিয়ানি। ওয়েটার এসে খাবার সার্ভ করে দিয়ে গেলো। নিভৃত চাকু দিয়ে মাটির হাড়ির উপরের আটার প্রলেপটা কেটে নিলো। খাবারটা ভালোই খেতে। তবে দামটা তুলনামূলক অনেক বেশি।

_________________

ঘরে ঢুকে নিভৃত ধপাস করে শুয়ে পড়লো বিছানায়। মৌন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে কোথায় ঘুমাবে? এ ঘরে কোনো ডিভান কিংবা সোফা নেই। নিচে থাকাও সম্ভব না। কোনো চেয়ারও নেই। কেবল বারান্দায় দুইটা চেয়ার আছে। তবে অন্ধকার বাড়ছে ক্রমশ। পোকার ডাক ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। গাছগাছালি যেগুলো বিকেলে চিত্তাকর্ষক লাগছিলো তা এখন ভুতুড়ে লাগছে। এদিকে ক্লান্তিতে, অবসাদেও শরীর নেতিয়ে আসছে। মৌনকে বারান্দার দিকে তাকিয়ে গভীর মনোযোগী হতে দেখে নিভৃত বললো,
‘এই মেয়ে আবারো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে কি ভাবছো?’

মৌন নিভৃতের গলাটা বোধহয় শুনেনি। নিভৃত বিরক্তি নিয়ে আবার বললো,
‘এই মেয়ে?’
‘জ্বি।’
‘এভাবে দাঁড়িয়ে কেন?’
‘কোথায় ঘুমাবো বুঝতে পারছিনা।’
‘বেডটা তো বড় তুমি ঐপাশে ঘুমিয়ে পড়ো।’
‘কি!’
‘এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। একদম যেন আমার কাছে যেন ঘেষতে না দেখি। একদম বেড থেকে ফেলে দিবো তবে।’

মৌন বিছানার পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ে বিরবির করে বললো,
‘দেখা যাবে কে কার কাছ ঘেঁষে।’
‘কি বললে?’
‘কিছুনা।’

মধ্যরাতে ঘুমের ঘোরে ঠিকই মৌনকে জড়িয়ে ধরলো নিভৃত। মৌন মুচকি হাসলো কেবল। নিভৃতের চুলগুলোতে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে বললো,
‘আপনি এমন কেন নিভৃত? আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায়না? আপনার রুহানির জায়গা তো আমি চাইনি। কেবল আপনার বুকের বাঁ পাশটায় ধুকপুক ধুকপুক করা যন্ত্রটার অদৃশ্য অংশে একটু ঠাঁই চেয়েছি কেবল।’

নিভৃত আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মৌনকে। ঘুমের ঘুরে বললো,
‘হুম।’

মৌন শব্দহীন হেসে বললো,
‘কি হুম? নিভৃত মশাই?’

কোনো জবাব আসেনা। একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসে সে। ছোট করে ভালোবাসার পরশ দেয় নিভৃতের কপালে। অতঃপর একধ্যানে তাকিয়ে থাকে নিভৃতের মুখটার দিকে। হয়তো তার বাকীটা সময় এভাবে তাকিয়েই কেটে যাবে। কে বলবে এই নিষ্পাপ মুখের অধিকারী লোকটা তার সাথে সারাদিন ঝগড়া করে!

(চলবে)……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here