রোদেলা
লেখা : মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ২৭
এরি মধ্যে সুফিয়ান ডাব হাতে কোত্থেকে এসে হাজির হল ওর সামনে….
রোদেলা হাতের ভর ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। সুফিয়ান বললো অনিমাকে দেখেছো…? অনিমা আবু সুফিয়ানের ছোট বোন, রোদেলা সাথে সাথে বললো-
– নাতো…
যেমনি হুট করে এসেছিল তেমনি হুট করে চলে গেলো, রোদেলা মনে মনে ভেবেছিলো হয়তো ডাব নিয়ে এসে ভাব জমাবে…. একা একাই হাসে রোদেলা।
কিছু দুর হেঁটে মোবাইলে ছবি তোলে, প্রকৃতি ও নিজের। এরকম ট্যুরে আসার খুব দরকার ছিলো ওর। কি যে যাচ্ছিলো দিন, বলার মতো না। সেই সকালে উঠে দৌড়ে বের হয়। কোনদিন খায় তো কোন দিন না খেয়েই ছুঁটতে হয় ইঁদুর দৌড়ে। জীবণটা কেমন পানসে লাগছিলো ওর কাছে। কেমন দমবন্ধ অবস্থায় কাটে প্রায় প্রতিটা দিন। ওর বয়সী অন্য সবাই যখন চুড়ি, ফিতা আর দুল ম্যাচিং এ ব্যাস্ত রোদেলা তখন খাবার অন্বেষণ করে নিজের ও পরিবারের জন্য। সেক্ষেত্রে এই দুই-তিন দিনের আনন্দের চার্জ দিয়ে পুরোটা বছর উচ্ছাসে চলা যাবে। সুন্দর সুন্দর স্মৃতি গুলো আউড়ে খুব ভালো থাকা যাবে এই যান্ত্রিক জীবণ।
জীবণে সুখের উপকরণ গুলো যতক্ষন আমরা আমাদের সামর্থের মধ্যে রাখতে পারি ততক্ষণ ই আমরা সুখি। সুখে থাকাটাকে আমরা যখন আমাদের সামর্থ্যের চেয়ে বেশী প্রত্যাশা করি তখন আমরা অসুখী হই। সুখে থাকাটা সম্পূর্ণ নিজের কাছেই থাকে বলে দৃঢ় বিশ্বাস করে ও। কৃতজ্ঞ থাকলে দুনিয়ার কারো সাধ্য নেই তার জীবণকে অসুখি করবার।
রোদেলা চোখ বন্ধ করে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে ইশ্বরের প্রতি। পৃথিবীর এত সুন্দর একটা জায়গা ওকে দেখার সুযোগ করে দেবার জন্য। এমন সময় ফোন আসে নাতাশার ওরা নাকি ফিস-ফ্রাই অর্ডার করেছে, দ্রুত ওকে আসতে। ও ফোনটা রেখে যাবার উদ্যোগ করতেই দেখে শোভন সাইকেলে চড়ছে। খুব দ্রুত ওকে পাস করে চলে গেলো সাইকেলটা।
রোদেলা হাসে, মনে মনে বলে…
এত সোজা রোদেলাকে কষ্ট দেয়া….!
এমনি সময় অনিমা এসে হাজির। কোরাল কিনেছে, ও রোদেলাকে সাধে একটা। রোদেলা নিতে চায় না, তবুও জোড় করে দেয় অনিমা, বলে তোমার উদ্দেশ্যেই কেনা হয়েছে, না নিলে কষ্ট পাবো। ছোট মেয়ে, দুনিয়ার সব কিছু ওদের চোখে এখন সুন্দর। এক টুকরো পাথরও ওদের চোখে সুন্দর কিছু। পৃথিবীর কলুষতা যত ছুঁবে, ততই পৃথিবীকে দেখার চোখ বদলে যাবে।
একটু হাঁটতেই সুফিয়ান যোগ দেয় ওদের সাথে। অনিমা বলে
– ভাই আমাদের একসাথে ছবি তুলে দাও না…
অনিমার সাথে বেশ কিছু ছবি তোলে রোদেলা । রোদেলা ও বেশ কিছু ছবি তুলে দেয় ওদের ভাইবোনের।
এমন সময় নোভেল আর শোভন আসে এদিকটাতে, হয়তো রোদেলাকে ডাকতে এসেছে। কিন্তু শোভন কিছু না বলেই হাঁটতে থাকে, নোভেল রেগে বলে আপা তোকে নাকি ফোন করেছে নাতাশা, তুই এখনো এখানে….
বড় ভাই, মামা সবার জন্য ফিশফ্রাই অর্ডার করেছে, চল। আর ভাই আপনারাও চলেন, বড় মামা আপনাদেরকে ও যেতে বলেছেন।
সুফিয়ান বলে-
আরে না, মা আর রেজওয়ান তো রুমে, ওরা পরে খুঁজবে।
তোমরা যাও, নোভেল জোড় করে নিয়ে যায় সবাইকে, বলে একটা ফোন করে তাদেরকেও আসতে বলুন।
কি আর করা, সবাই মিলে গেলো সেই দোকানটাতে ফিশফ্রাই খেতে। রোদেলার খুব ইচ্ছে ছিলো কাঁকড়া খেতে, কিন্তু কাঁকড়া খাওয়া হারাম তাই বলারও সাহস হয় না ওর।
সেখান থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ওরা যেই রিসোর্টটাতে রয়েছে সেটার নিজস্ব একটা স্পেস আছে বীচ ভিউয়ের জন্য। রাতে যাতে কারো বীচে যেতে ইচ্ছে করলে
অনেক ঘুরে যেতে না হয় তাই এই ব্যাবস্থা হয়তো। সেখানে বসে আড্ডা দিলো সবাই, নাতাশা আর কল্লোলের বিয়ের পরের মিষ্টি কিছু মুহূর্ত শেয়ার করলো ওরা। রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত চললো এই আড্ডা।
ডিনারে ছিলো ফিশ বারবিকিউ আর নান…
ডিনারটা ছিলো আবু-সুফিয়ানের পক্ষ থেকে। খেতে বসে রোদেলা মনে মনে ভাবে, এতগুলো টাকা তোমার পানিতে গেলো আবু-সুফিয়ান। তোমার উদ্দেশ্য হাসিল হবে না মাই ডিয়ার…!
আবু সুফিয়ান ঘুরে ঘুরে সবাইকে খাবার তুলে দিচ্ছে, ড্রিংস সার্ভ করছে, রোদেলা ওর কাছে গিয়ে বললো আরেহ্ খুব হয়েছে সার্ভ করা, এবার আপনি খেতে বসুন তো, বলে ওর হাত থেকে মাছের ডিশটা নিয়ে নেয় রোদেলা। রাগী ভঙ্গিতে বসতে বলে ওকে, সুফিয়ান ও বাধ্য ছেলের মতো খেতে বসে। রোদেলা নান আর ফিশ বারবিকিউ ওর পাতে তুলে দেয়, শোভন এসব দেখে ড্রিংকসের ক্যান হাতে করে উঠে পরে। রোদেলা মুচকি হেসে বলে – বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান…..! দাঁড়াও তোমাকে শায়েস্তা করার রাস্তা খুঁজে পেয়েছি।
বড়রা রাতের খাবার খেয়ে রুমে চলে যায়, লেট নাইট আড্ডা তাদের পোষাবে না, তার উপর গত রাতের জার্নি…
বাকী সবাই এসে বসলো সেই বীচ পাড়ে। সাদা চাদর নিয়ে এলো এ্যামি আপু। কিছু চিপস আর সফট ড্রিংকসও আনা হলো। কাজের ছেলেটাকে সবার সামনে ধমকা ধমকি করছেন তিনি। কেন এমন করছেন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কল্লোল তাকে বললো-
কিরে তোর বরের সাথে কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি, মেজাজ এত গরম যে….
ও বললো- ধূর কি যে বলিস ভাইয়া….!
তিনি সম্ভবত উটকো মানুষ গুলোকে পছন্দ করছেন না। এটা তাদের পারিবারিক ট্যুর ছিলো। কিছু উটকো মানুষ এসে জুটেছে। এটাই হয়তো এই রুক্ষ মেজাজের কারন। বিশেষ করে সুফিয়ানদেরকে তার তেমন পছন্দ হচ্ছে না। দায়ে পরে খাবারটা কোন মতে খেয়েছে তারা।
বীচে আড্ডা দেবার বেশ কিছু সময় পর কল্লোল সুফিয়ানকে ফোন দিয়ে আসতে বললো। যতই হোক শ্বশুর বাড়ির পরিচিত লোক। আলাদা খাতির তো করাই লাগে, তার উপর এতগুলো লোককে তিনি ডিনার করালেন, চক্ষু লজ্জা বলে যে ব্যাপার সেটা তো আছেই…..
সুফিয়ান আর ওর ভাই রেজওয়ান এসেছে প্রায় আধঘন্টা পরে। নাতাশা অনিমার কথা জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন-
: অনিমা….! ও তো এই জগৎ এ নাই, ও ঘুমে বেহুঁশ…
তার কথা বলার ধরন দেখে সবাই হেসে দিলো। তাকে চেনা বড় দায়। মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি খুবই সরল এবং মজার মানুষ, আবার মাঝে মাঝে কথার গাম্ভীর্যে যে কেও চিন্তা করতে বাধ্য হবে এই মানুষটাই কি সেই মানুষ যে মজা করেছিলো একটু আগে…!??
নোভেল ওর গিটর নিয়ে এসেছে। গান গাইছে সবাই মিলে। একটার পর একটা গান হচ্ছে… রাত প্রায় দেড়টার মতো বেজে গেলো। সুফিয়ান উঠে একটু আসছি বলে কোথাও একটা গেলো…
নোভেল বললো আপা- ঐ গানটা গা না…
রোদেলা দূর বলে উঠে গেলো বীচের কাছে। পেছন ফিরে দেখলো অনেক দূরে ফেলে এসেছে ও। যদিও ভয় করছে না ও, কারন প্রকৃতি নিজেকে আড়াল করেনি এখানটাতে। মেলে দিয়েছে, ঢেলে বিছিয়ে দিয়েছে তার সব সৌন্দর্য এখানে…
দূরে হলেও সবইকে দেখা যাচ্ছে। এই সমুদ্র এমন এক জায়গা যেখানে এলে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়। সব কষ্ট দুঃখ পানির স্রোতে যেন ধুয়ে যায়। একটু পর ফিরে যায় ও। গান হচ্ছে-
– ভ্রমর কইও গিয়া, শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে…..
আমার অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে…
ভ্রমর কইও…
গিয়া
গানটা বিরহের, মন দিয়ে শুনলে বিচ্ছেদের অনলে না পোড়া কারোর ও চোখ ভিজে যাবে….
বিশেষ করে প্রাক্তন ছবির গানটা…
কলিজায় লাগে….
রোদেলার ভিতরটা হাহাকার করে উঠে, চাপা কোন অনল যেন জ্বলে উঠে বহু বহু বহু দিন পর…
একটু পরই সুফিয়ান এসে বসে, খুব সম্ভবত তিনি সিগারেটের জন্য উঠেছিলেন। এটা ধরনা করে রোদেলা। কারন তার মুকে এখন সেন্টার-ফ্রেশ। মেক্সিমাম ছেলেপেলে সিগারেট ফেলে এই কাগ করে।
বেশ কিছু পরে এ্যামি আপু চলে যায় তার বাচ্চা কান্না শুরু করেছে তাই… আড্ডার লোক কমতে শুরু করেছে। নোভেল বললো আপা প্লিজ একটা গান গা…
নাতাশাও জোর করে, কল্লোল বলে, আচ্ছা আমরা চোখ বন্ধ করে রাখছি ওকে…
হেসে দেয় রোদেলা…
বলে – ভাইয়া এতটাও লাজুক নই আমি…
চোখ বন্ধ করা লাগবে না…
এ্যামি আপু যাওয়ায় একটু ইজি লাগছে ওর…
নোভেলকে ইশারায় জানায় কোন গানটা গাইবে ও…
এরপর রোদেলা চোখ বন্ধ করে, জোরে নিশ্বাস নেয়—
তুমি হয়তো বহু দূর, তবু তোমার কথার সুর
দেখো বাজছে আমার বেসুরো জীবনে।
তুমি কোথায় নিরুদ্দেশ, তবু তোমায় ছোয়ার রেশ
আমার একলা জীবন মুহূর্তরা জানে।
আজ রাত্রি যখন আসে, এই জীবন খানিক হাসে
বলে পারলি নাতো ছুঁতে, তুই আরেকটা দিন।
আজো স্বপ্নে তোমায় খুঁজি, বড় আশায় এ চোখ বুঁজি
ভাবি নামবে দু চোখ জুড়ে সেই আদুরে দিন।
—————————————————
গান শুনে সবাই মুগ্ধতায় স্তব্ধ। অনেকটা সময় যাওয়া পর সবাই বুঝলো গান শেষ হয়েছে। সবাই খুব প্রশংসা করলো। সুফিয়ান বললো – মনটা শান্ত হয়ে গলো গানটা শুনে, আরেকটা শুনাবে প্লিজ….
রোদেলা বললো অবশ্যই, আপনি এত স্পেশাল একজন আপনাকে শুনাবো না তো কাকে শোনাবো….
বলে একটা রহস্যময় হাসি হাসলো শোভনের দিকে চেয়ে। শোভন কটমট করে তাকিয়ে ওর দিকে, রোদেলার চোখে চোখ পরতেই অন্য দিকে তাকায় ও…
নাতাশার ঘুম আসে, ও চলে যেতে চায়, বলে আমাকে দিয়ে তুমি এসো আবার… কল্লোল বলে আরেকটু থাকো, একটু পর সবাইই চলে যাবো….
এরপর আর জমে না আড্ডা। দুইটা দশে সব গুছাতে বলে হাবিবকে। হাবিব সবকিছু গুছগাছ করে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে।
রোদেলা আবার বীচের কাছটাতে যায়, ঘড়িতে দুইটা সতেরো। এই গভীর রাতে, এমন জোৎস্নার আলোতে আর কখনো এখানে কি আসার সুযোগ হবে জীবণে..? জুতো জোড়া হাতে নিয়ে পা ভিজায়, এমন জোৎস্নার আলো সমুদ্রের গর্জন সব মিলিয়ে অপার্থিব কোন জগৎ মনে হচ্ছে এ জায়গাটাকে।
দূর থেকে ওকে ডাকে নোভেল।
আপা আমরা চলে যাচ্ছি….
তুই দ্রুত আয়…..
বলে সত্যি সত্যি হাঁটা দিলো নোভেল , নাতাশা কল্লোল দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর জন্য। ওকে কাছে আসতে দেখে ওরাও ধীর গতিতে হাঁটা শুরু করলো। বালির মধ্যে দ্রুত হাঁটলে ও পথ ফুরায়না। তবুও দ্রুত হাঁটতে লাগলো রোদেলা।
রিসোর্টের বীচ পারের যে গেট তার কাছটায় গাছের ঝোপঝাড়ের মতো। সেখানে আসতেই পেছন থেকে ওর হাত টেনে নিয়ে যায় কেও….
আরেক হাতে মুখে চেপে ধরা। রোদেলার তখন দমবন্ধ অবস্থা.. কাওকে যে ডাকবে তাও পারছে না।
রোদেলা দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করছে কে হতে পারে…..
চলবে…
(তোমরা অবশ্যই পড়ে কমেন্ট করবে, তাহলে পেইজের রিচ বাড়বে)
Previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1516454925482360/
Next :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1517850978676088/