উপন্যাস: রোদেলা
লেখক: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ২
কেনাকাটার ধুম পরে গেছে গত কয়দিন ধরে। সময় হাতে খুব কম। হলুদে পরার জন্য সবাই হালকা রঙের কাস্টমাইজড ড্রেস বানাবে। নাতাশার জন্য আনা হয়েছে মেজেন্টা রঙের কাতান। ওর সব কিছু গুছানোর দায়িত্ব রোদেলার। গত তিন দিন একটানা মার্কেটে যেতে হচ্ছে বড় মামী আর বড় খালামনির সাথে, নাতাশাও সাথে আছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব খুশি। খুশির প্রধান কারণ বিয়ের পর ওকে নিয়ে ওর বর ফ্রান্স চলে যাবে। তাছাড়া বিয়ে জিনিসটা নিয়ে মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই একটা স্বপ্ন, চাপা আনন্দ থাকে, সেটা ফুটে উঠেছে ওর কথাবার্তায়, চালচলনে। বোঝাই যাচ্ছে বিয়ে নিয়ে ও ভীষণ রকম এক্সাইটেড।
অথচ ও যদি এমন কোন ভাব প্রকাশ করতো তাহলে ওর মা শুনিয়ে দিত এতগুলো কথা। অথচ নাতাশার এমন অস্বাভাবিক উত্তেজনা নিয়ে কারো কোন প্রশ্ন কিংবা মাথা ব্যাথা নেই। ওদের অহেতুক আবদার, বিয়ে নিয়ে এমন উচ্ছ্বাস সবই স্বাভাবিক। রোদেলাদের নানু বাড়িতে এখন পর্যন্ত কেও বরের সাথে বিয়ে আগে দেখা করে নি। বড়োজোর টেলিফোনে কথা বলছে। কিন্তু ও সব রেকর্ড ভেঙে বিয়ের শাড়ি আর বৌভাতের লেহেঙ্গা কিনতে দুইদিন গিয়েছে। এটা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই, এ যুগে হওয়া উচিত ও না। কিন্তু নাতাশাকে দেখতে আসার দিন রোদেলা শুধু নাশতা নিয়ে গিয়েছিল, তাও বড় মামী পাঠিয়েছিলেন তাই। তারপরও কত কথা ওকে শুনতে হয়েছে। বড় মামী রোদেলাকে নাতাশার সাথে যেতে বলেছিলো বিয়ে শাড়ি কিনতে যাওয়ার সময়। কিন্তু রোদেলা অসুস্থতার বাহানায় এড়িয়ে গিয়েছে। কারন ও জানে মা এ কথা শুনলে আর রক্ষা নেই। এতগুলো শুনিয়ে দিবে।
রোদেলা এসব ভুলে থাকতে চায়। ও যতক্ষণ কলেজে কিংবা টিউশনিতে থাকে ততক্ষণ শান্তিতে থাকে। বাড়িতে ওর কখনোই ফিরতে মন চায় না। এই বাড়িটা ওর জন্য জেলখানা। আর পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ যে জায়গা- মায়ের কোল…
সেটা সবচেয়ে অনিরাপদ ওদের কাছে। একটা মানুষ মানসিক ভাবে চাপে থাকতে পারে, কষ্টে কিংবা হতাশায় থাকতে পারে। তারজন্য সন্তানদের সাথে এমন করা কতটুকু যুক্তিসম্মত। ভাইবোনদের সমবেদনা আর সহানুভূতি পাবার জন্য আজ যে ওর মা ওদের সাথে এমন করছে। জীবণের শেষ পর্যন্ত তারা তাকে এমনি ভাবে সমবেদনা সহানুভূতিতে ডুবিয়ে রাখবে তো….?
এই যে সন্তানরা যাদেরকে আজ ডাস্টবিন ছাড়া কিছু ভাবছে না তারা কাল যখন তার আয়ত্তের বাইরে গিয়ে স্বাধীন হবে বিয়ে করে কিংবা সাবলম্বী হয়ে তখন কি তারা এই সব দিনের কথা ভুলে যাবে। বৃদ্ধ বয়সে তার দায়িত্ব নিতে চাইবে….?
তাঁর এমন ব্যাবহারের কারনে ওদেরকে কেও কাজের মানুষের চেয়ে বেশী কিছু ভাবে না। এর এই করো, ওর ওই করে দাও। একমাত্র নাতাশা আর ওর মা ভিন্ন। বাকী সবার মনোভাব ওরা বসে বসে তাদের অন্ন ধ্বংস করছে। অথচ রোদেলার মায়ের যে টাকা মাসে ভাড়া বাবদ আসে তা দিয়ে তাদের তিনজনের সংসার সুন্দর চলে যাবে। তার উপর রোদেলাও বেশ ভালো টাকার টিউশনি করায়। এ কথা বেশ কয়েকবার বোঝাতে চেয়েছে রোদেলা। জবাবে একরাশ অকথ্য গালাগাল শুনতে হয়েছে ওকে। ও নাকি টাকা পয়সার খবরদারী করে। পাখা নাকি গজিয়ে গেছে ওর। অকৃতজ্ঞ আর বেইমান এই শব্দ দুটি সবচেয়ে শালীন সেই কথা মালার মধ্যে। বাকীগুলো অকথ্য। অথচ পিঠ পিছনে একেকজন একেক কথা বলে তা তো তার কান অব্দি পৌঁছায় না। এ পরিবারে সাবাই তাকে ভয় পায়, আর তিনি ভাবেন তাকে সবাই সম্মান করে। ভয় থেকে যে ঘৃণার জন্ম তা তিনি এ জন্মেও জানতে পারবেন না। কারন তার জ্ঞান এই মিথ্যে দায়িত্ব আর সম্মানের অহমিকার মোহরে মোড়ানো। সবাই অগোচরে বলে ওদেরকে সবাই দেখে রাখছে, পালছে, মানুষ করছে। এসব শুনতে আর ভালো লাগে না ওর। সংসারে রোদেলার মা সব দায়িত্ব পালন করে। কে কি খাবে, কার কি খেতে মন চায়, কার
কোন মেহমান আসবে, কার বাড়ি পিঠা পায়েস পাঠাতে হবে সব…..। পুরো সংসারটা তার হাতে। দুই মামী ব্যাস্ত তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুল আর কোচিং নিয়ে। রোদেলার মায়ের ধারনা তিনি না থাকলে সব ভেসে যাবে। ইদে কিংবা অন্য কোন উৎসবে সবাই এদিক সেদিক বেড়াতে যায় বছরে দুইবার। আজ পর্যন্ত তিনি কোথাও যান নি এই সংসার ছেড়ে। তারও তো একটু অবসর দরকার। উল্টো সবাই তাকে দায়িত্বের মিথ্যে আসনে বসিয়ে নিজেরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরছে। এদিকে তিনি মরছে রান্নাঘরে আর ওরা মরছে আড়ালে আবডালে এর ওর কথা শুনে। এসব ব্যাপারে তার নিজের ধারনাই চুড়ান্ত। ভাইয়ের বৌদের হাতে সংসার না জলে যায় এই ভাবনায় তার এমন আত্নত্যাগ। অথচ এদিকে জীবণ যাবার উপক্রম সেদিকে খেয়াল নেই তার। রোদেলার বুঝ হওয়ার পর হতে একটা গোপন ইচ্ছে আছে। সেটা হলো ও যখন চাকরী করবে তখন মাকে ভালো একটা সাইক্রিয়েট্রিকস্ দেখাবে। দায়িত্বের এই অহমিকা, মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার এই খেলাটা তার মানসিক রোগ। সেই দিন কতদূরে কে জানে…
দেখতে দেখতে হলুদের দিন এসে পরেছে। হলুদের ডালা এসেছে বরদের বাড়ি থেকে। এ বাড়ি থেকেও ডালা যাবে ছেলে পক্ষের বাড়িতে। রোদেলা সকালেই সব গুছগাছ করে রেখেছে। ডালা পাঠাতে মুরব্বিদের সাথে ছোটরাও যাচ্ছে। রোদেলা এখান থেকে সরে ওর জিনিসপত্র গুছাচ্ছে। আজ সকাল থেকে হঠাৎ কেন যেন ওর লজ্জা এবং খারাপ লাগা শুরু হয়েছে। পাশের বাড়ির বৌরা এসেছে পান-সুপাড়ি খেতে। বড় বোন রেখে ছোটজনের বিয়ে কেন এ বিষয়ে কি যেন কানাঘুষা চলছে। তাঁদের তো এই কাজ। কিন্তু একজন হঠাৎ বললো সমস্যা আছে মনে হয় কোন… নাহলে এমন কেন হবে। দেখতে তো খারাপ না, কারো লগে লাইন আছে মনে হয়। নাইলে পিচ্চি মাইয়্যার বিয়ে হইয়্যা যায় আর এই বুইড়া বেটির জন্য জামাইর আকাল পরছে…..
বাইশ বছর অনেক বয়স এই সম্প্রদায়ের মহিলাদের কাছে। তারা ভাবে নিশ্চয়ই কোন সমস্যা আছে নাহলে এতদিন অবিবাহিত থাকার কথা না। কি সুন্দর লজিক………..
আজ ওরা এমন ছন্নছাড়া বলে কেও এ কথাটা ভাবে নি। যদিও নাতাশ আপন বোন নয়, তবুও বড়মামা তার মেয়ের জন্যই সম্বন্ধ টা এনেছিলো। একটাবারও ভাবে নি একই বাড়িতে বিবাহ উপযুক্ত আরেকটা মেয়ে আছে। যার বিয়ের দায়িত্ব তাকে দেয়া। রোদেলার মা তো বড় ভাই বলতে অজ্ঞান। ভাই যা বলবে সেটাই শেষ কথা, তিনিই হয়ত মাকে আগেপাছে কিছু বুঝিয়েছে একটা। রোদেলা জানে এই যে এত অন্ধ বিশ্বাস, এত ভালোবাসা ভাইয়ের প্রতি একদিন এসব গলার কাটা হবে ওর মায়ের জন্য।
বড় মামা পূর্বাচলে জায়গা কিনেছে বেশ কিছু বছর আগে। সস্তায় পেয়ে কিনে রাখা । মাকে বলেছেন সাত তলা ফাউন্ডেশন করে বাড়ি করবে। বড় ভাইর বাড়ি মানে তার বাড়ি। তারও ভাগ থাকবে সেখানে। সে তো ভাড়ার টাকা নেয় না কখনো। তিনি সেই বাড়ির স্বপ্নে বিভোর। সেই বাড়িতে উঠবে মেয়েদের বিয়ে দিবে। বাড়ির কাজ চলছে ফুল স্পিডে৷ সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে নতুন বাড়িতে উঠতে পারবে।
এই বাড়ির কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে মায়ের আচরণে দাম্ভিকতা আরো বেড়েছে। তার ভাগের দোকান গুলো ভালো দামে বিক্রি করে বাড়ির কাজে খরচ করছে। বড় মামা আগেই নিজের দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন বাড়ির গাঁথুনির সময় । বাড়ি করতে পানির মতো টাকা চলে যায়। তাদের ভাগবাটোয়ারা কীরকম তা তারাই ভালো জানেন। এ ব্যাপারে মামী কিংবা রোদেলারা দুই বোন কিছুই জানে না। ছোট মামা ব্যাস্ত তার কাগজপত্র তৈরীতে। তিনি দেশের বাইরে চলে যাবেন ফ্যামেলি নিয়ে। ছোট মামীর বোনও পুরো পরিবার নিয়ে ইংল্যান্ড থাকে। তার কারো দিকে কোন খেয়াল নেই। তিনি নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত।
চলবে…..
Previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1468532903607896/
Next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1476290956165424/