#জীবনে_তুমি_সেরা_সত্যি
পর্ব – ১১
দিশানের এত শূন্যতা হাহাকার কখনো বোধ হয়নি। পড়াশোনার ব্যাপারে বরাবরই ভীষণ সিরিয়াস সে। কিন্তু কোনভাবেই পড়াতে সে মন বসাতে পারছে না । চোখ বারবারই ভিজে উঠেছে,এমনিতে কিন্তু নেহাল সারাদিন বাসাতে থাকতেই পারেনি,তবুও এখন দিনরাত ফাঁকা লাগছে চারপাশ৷ রাতে বিছানাতে শুতে মন চায় না কোনভাবে, বুকের কাছে কষ্ট মনে হয় জমাট বেঁধে থাকে,একা বিছানায় হাতড়ে সেই জমাটের বরফ গলে বালিশ ভিজায় ৷ ফোলা চোখে কলেজে এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে অভিমানে চোখে জল আসে যে আমি পড়ে মরে গেলেও তার কি?আমাকে রেখে তো চলেই গেছে। ফলশ্রুতিতে পরীক্ষা বেশ খারাপ হতে লাগলো ।
নেহাল ফোনে অনেক বোঝায়,তবুও দিশানের অবুঝ মন মানে না। পড়া বাদ দিয়ে এমন পাগলামী সে আগে করে নি। একটা দুটো করে শেষের পরীক্ষাগুলো বেশ খারাপ হলো দিশানের। কষ্টে অভিমান রাগে চিন্তায় পাগল সে । তার ছোট মাথাটাকে এত বোঝা কখনোই নিতে হয়নি।
– কি হাল করেছো দিশান নিজের?এমনটা হবে জানলে আমি তোমার মনের এত ঘনিষ্ঠ কখনোই হতাম না৷দূরে সরে থাকতাম তেমার থেকে। তোমার জন্য এত ভাবার পরও এমন ভুল আমি কিভাবে করলাম?
মিনমিন করে দিশান বললো,
– এভাবে বলবেন না প্লিজ। আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না৷
– পারতে হবে। তুমি কি চাও না আমার কাছে আসতে?তোমার রেজাল্ট এইচএসসিতে খারাপ হলে কিভাবে এখানকার ভালো ইউনিভার্সিটিতে তোমার এডমিশন নেওয়াবো বলো তো?তখন তো তোমাকে দেশে থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে পরে অ্যাপ্লাই করতে হবে। আরো প্রায় ৫ বছরের ধাক্কা, তখন পারবে তো?
দুই পাশে মাথা নাড়ে দিশান,
– দরকার হয় লেখাপড়া ছেড়ে দিবো,তবু আমি আপনাকে ছাড়া এতদিন থাকবো না,কোনদিনও না।
– দেশের নামকরা কলেজের টপারের এইচএসসি পরীক্ষার আগে মাথায় আসে সে জামাইয়ের ভালোবাসায় দেওয়ানা হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিবে! এত ভালোবাসা আমার দরকার নাই তো। ইন্টার ফেল বউ তো আমি মানবো না আমার জন্য। চুপ করে আমার কথা শোন। এইচএসসি র আগ অবধি তোমার সাথে আমার কোন কথা হবে না। আমি আগের মতো নায়রার ভাই হয়েই থাকবো৷ তোমার আমাদের বাসায় থাকার দরকার নেই,আমি আম্মুর সাথে কথা বলছি,তুমি তোমাদের বাসায় থাকবে। একদম আগের মতো। তোমার এইচএসসির রুটিন দিয়েছে? দিলে শেষ পরীক্ষার দিনটা ক্যালেন্ডারে বড় করে মার্ক করে রাখো,ঐদিন আমাদের কথা হবে আবার। তুমি একটা লম্বা ব্রেক নিবে। তোমার পায়ের প্লাস্টার খুলবে সামনের সপ্তাহে, এই সপ্তাহটা তুমি শুধু গল্পের বই পড়ে কাটাবে৷ আমি কয়টা নাম সাজেস্ট করে দিচ্ছি তোমায়,আমার বইয়ের তাক থেকে নিয়ে নাও৷ একদম বই পড়ায় ডুবে যাবে তুমি। তারপর প্লাস্টার খুললে তোমার নানুবাড়ি গিয়ে দুই দিন থেকে আসবে৷ এসে সেই আগের পড়ুয়া দিশান হবে। এই কদিন সময় পার করবে বলে যে অপরাধবোধ তৈরী হবে সেটাকে ১০০% কাজে লাগাবে তখন । টেস্টের রেজাল্ট খারাপ হবে বুঝাই যাচ্ছে,এটা তোমার শাস্তি হিসেবে মাথা পেতে নিতে হবে। নিজেকে শতভাগ তৈরি করে নিবে মেইন পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষা যুদ্ধটা শেষ করে আমাদের ঘরে ঢুকবে। এরমাঝে তুমি আমাদের বাসায় তো যাবে কিন্তু তোমার-আমার রুমটাতে ঢুকবে না। তোমার যা যা নেবার প্রয়োজন সব গুছিয়ে নিয়ে যাবে একবারে । আমাকে যতটা অনুভব করবে মনে মনে আমি তোমার মনের ততটা কাছেই থাকবো। তোমার অস্তিত্বে মিশে থাকবো কিন্তু তোমার ঘড়ির কাঁটাতে নয়। তোমাকে কথা দিয়ে গিয়েছিলাম তোমার সাথে লেগে থাকবো সারাদিন, চুটিয়ে প্রেম করবো।কিন্তু শুধু তোমার ভালোর জন্য তোমাকে দেয়া কথা থেকে সরে গেলাম। তোমার ভবিষ্যত নিয়ে আমি কোন রিস্ক নিতে দিবো না। সবশেষ একটা কথা বলো দিশান,আমাকে কতটা ভালোবেসেছো এইকদিনে?
দিশান চোখ বন্ধ করে উত্তর দেয়,
– অনেক বেশি নেহাল,আমি আপনাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি৷ নিজের আবেগের উপর আমার খুব ভালো দখল আছে জানতাম। সেই ক্লাশ নাইন থেকে ক্লাশমেট,ব্যাচমেট,কোচিং এর ভাইয়া,এমনকি আত্মীয় স্বজনদের মধ্যেও অনেকের প্রেমময় চাহনি দেখেছি আমি। কারো জন্য কোনদিন দ্বিতীয়বার ভাবার বোধ মনে আসে নি বরং কেমন অসহ্য লাগতো। প্রেম ভালোবাসা আবেগ টিনএজের এসব অনুভূতি আমার ভিতরে আসতো না। আমি বরাবরই নিজেকে অনেক ভালোবাসতাম, পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসাটাও নিজেকে ভালোবাসার অংশ,তাই পড়তে কখনোই খারাপ লাগতো বা আমার। চোখের সামনে আপনাকেও অনেক পড়ুয়া দেখতাম। আপনি আমার একরকম আইডল ছিলেন৷ আপনার কথা তাই মেনে চলতাম আমি। আপনার মনে আছে, টেনে কোচিং এর পরীক্ষার খাতা দেখে আপনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন খাতায় লেখার সৌন্দর্যের ব্যাপারে। অক্ষরের প্যাটার্ন, মার্জিন, আন্ডারলাইন কিভাবে কি করলে টিচারের নজরে পড়বে লেখাগুলো, আমি কিন্তু সব মাথায় একবারে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম।আপনি কোন পড়া বুঝিয়ে দিলে সেটা খুব সহজে বুঝা হয়ে যেতো। আপনার প্রতি মুগ্ধতা ছিলো আমার তবে সেটা শুধুমাত্র শ্রদ্ধার অনুভূতিতে,প্রেম ছিলো না সেটা৷ আপনার দেশের বাইরে যাবার খবরে আমি বরং টুকে রাখছিলাম যে আর কোন কোন টপিকস আপনার কাছ থেকে একটু ঝালিয়ে নিবো। তারমাঝে যখন বিয়ের কথা উঠলো আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। আম্মু, মা,নায়রা মিলে বুঝালো আমাকে আপনাকে নিয়ে। আপনি মানুষটাকে আমার না করার কারণই ছিলো না। আর এত অল্প বয়সে বিয়ে করা নিয়ে আমি কিন্তু বেশ এক্সাইটেডই ছিলাম। আমাদের বিয়ের কদিন আগেই এক ফ্রেন্ডের বড় বোনের বিয়ে হয়েছিলো। তার বিয়ের রংঢং দেখে আমাদের সবার মনেই তখন বিয়ে করার পিতলা শখ জেগেছিলো। বউয়ের সাজ,শাড়ি গহনা নাচানাচি সব কিছুর মোহের মাঝে আপনার মতো মানুষের সাথ বিয়ের প্রস্তাব আমাকে কখনো বিয়ে নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতেই দেয়নি৷ কখনো আফসোস করার সুযোগই আসেনি কেন বিয়ে করলাম।
কিন্তু এই যে এখন আপনার প্রতি উথলে পড়া আবেগ,বিরহ বিচ্ছেদ আমি সইতে পারছি না নেহাল। আমার ভিতর এলোমেলো হয়ে গেছে৷ নিজের উপর কোন কন্ট্রোল আর নেই আমার৷ কোনদিন মনে না আসা ভালোবাসার আবেগ যখন এমন বানভেসে এলো,আমি হারিয়েই ফেললাম নিজেকে। যাবার দিন নিজে থেকে জড়িয়ে ধরে ভেবেছিলাম আমাকে খারাপ ভাবছেন কিনা, এইটুকু আত্মসম্মানবোধ তখনও মনে ছিলো আমার। কিন্তু প্রশ্রয়ে আপনি যে আদর আমার ঠোঁটে মাখিয়ে দিয়ে গেছেন তাতে তো আমার কোন পাপবোধ হয়নি৷ বরং মনে হয়েছে এরচেয়ে পবিত্র অনুভূতি বুঝি দ্বিতীয়টি নেই,এর চেয়ে আবেগের বোধহয় আর কিছু হয়না।এখন নিঃসংকোচে আমি আপনাকে বলতে পারি আমি এখন আপনাকে কাছে পেলে সেই আবেগের একশো গুণ আমি আপনাকে ফেরত দিতে মুখিয়ে আছি। অধিকারবোধ এখন আমিও দেখাতে পারবো। সেই অধিকারবোধটা আমার ভালোবাসার নেহাল,আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি নেহাল,আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।
নেহাল থ মেরে গেলো। তার মন জুড়ে চাইছে মেয়েটার কাছে উড়ে চলে যেতো। তার জন্য ঝরে পড়া চোখের জলটুকু শুষে নিতে। পাগলের মতো চুমু দিয়ে আদর দিয়ে জলে ভেজা মুখটাতে লজ্জার রং লাগাতে। নিজের করে নিতে চাইছে তার দিশানকে৷ দিশান,তুমি অধিকারবোধ দেখাতে আসলে আমি যে তোমাকে স্বামীর অধিকারে কতটা জড়িয়ে নেবো তার আয়ত্ত তো তখন আমার থাকবে না। আমাকে আর পাগল করো না দিশান। স্বামীর দায়িত্বে নিজের উপর জোর খাটিয়ে হলেও এখন আমাকে পাষাণ হতে হবে। তোমার জন্য তোমার উপর আমাকে কঠোর হতে হবে দিশান। তোমার ভবিষ্যতটা উজ্জ্বল করতে তোমাকে সাময়িক একটা কষ্ট যে আমাকে দিতেই হবে। তবে কথা দিচ্ছি পরীক্ষা শেষে সেই কষ্টটুকুর একশোগুণ উসুল আমি করে দিবো। এই নেহালের পাগলামি তো তোমাকে দেখানোর সুযোগ হয়নি৷ মনের উপর সকল বিধিনিষেধ তুলে তখন তুমি তোমার নেহালের উদ্দাম প্রেম দেখবে দিশান। তোমার আবেগ বানভাসি হলে আমি তাতে হাওয়া দিয়ে তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবো। ক্যালেন্ডারে মার্ক করে সেই দিনের প্রতীক্ষা আমিও করবো দিশান৷ তোমার মাঝে বিলীন হবার প্রতীক্ষা।
চলবে…..