জীবনে_তুমি_সেরা_সত্যি পর্ব – ৬

0
429

#জীবনে_তুমি_সেরা_সত্যি

পর্ব – ৬

-আপনার কি মাথা ধরেছে?
দিশানের প্রশ্নে চোখ মেলে তাকালো নেহাল। কলেজ ড্রেস পড়া, দুইবেণী করা বাচ্চা একটা মেয়ে,হাতে এখনো স্টারশিপের চকলেট মিল্কের প্যাকেট ধরা,স্ট্র টা মুখে ধরে প্রশ্ন করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই দিশানকে একটা প্রথম সারির আইটি কোম্পানির অন্যতম শেয়ার হোল্ডার নেহাল চৌধুরীর স্ত্রী হিসেবে বাইরের কারোর ধারণায়ও আসবে না। নেহাল গ্র্যাজুয়েশনের পর তার দুই বন্ধুর সাথে ছোট করে একটা আইটি ফার্ম খোলে। তাদের কর্মদক্ষতা, পরিশ্রম আর কাজের পারফেকশনে খুব অল্প সময়েই এই ফিল্ডে তারা নজরে চলে আসে। পরবর্তীতে বড় একটি কোম্পানি তাদের পার্টনার করে নেয়। সেই কোম্পানিরই ইংল্যান্ডের অবস্থিত মেইন ব্রাঞ্চে যোগ দেয় নেহাল কারণ তাহলে পাশাপাশি সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেবার সুযোগ হবে তার। খুব অল্প বয়সেই অনেকটা উপরের দিকে উঠে আসতে পেরেছে সে। নেহাল জানে,দিশানও সময়মতো যোগ্যতায় নেহালকে ছাড়িয়ে অনেক উপরে যাবার ক্ষমতা রাখে। যথাসময়ে দিশানকে সেই উপরে উঠার সিঁড়িতে উঠাতে নেহাল পুরোপুরি সাপোর্ট দিবে,কোন বাঁধা আসতে দিবে না সে দিশানের এই জার্নিতে। কিন্তু তার তো সেই সময়টাই আসে নি এখনো।তার আগেই বিয়ে হয়ে আরেকটা পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। সেই হিসেবে “মিসেস নেহাল চৌধুরী” পরিচয়টা অবশ্যই তার অধিকার। সেটা না দিয়ে নেহাল অনেক বড় ভুল করেছে। বাইরের মানুষ কি ভাবলো তারচেয়েও বড় কথা হলো নেহাল কেন তার মনে এই অস্বস্তিটাকে ঠাঁই দিলো যে এই ছোট্ট দিশান তার সাথে মানায় না? বিয়েটা যেহেতু সে নিজে পরিবারের কথা মেনে করেছে সেটাকে বাইরে প্রকাশ করার চেয়েও নিজের মনে প্রতিষ্ঠার দরকার ছিলো তার। এক্ষেত্রে তো দেখা যাচ্ছে দিশান তার চেয়ে বেশি ম্যাচুরিটি দেখিয়ে দিয়েছে। ওর কলেজ,টিচার,বন্ধুমহল সবাই জানে দিশান তার হাজব্যান্ড। কলেজে তাই কোন অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তে হয়নি নেহালকে। কিন্তু সে কি করলো,এই প্রথম যখন দিশান তার কাজের গন্ডিতে এলো,নেহাল পিছিয়ে গেলো দিশানের পরিচয় প্রকাশ করতে। নিজের উপর রাগটা ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগলো। নেহালের নিজের উপর রাগ উঠলে সেটার কন্ট্রোল করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে,এটা তার অন্যতম একটা দোষ। তার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো। দিশান একটু উদ্বিগ্ন মুখে তাই আবারো জিজ্ঞেস করলো,
– আপনাকে এমন লাগছে কেন?শরীর খারাপ লাগছে আপনার?
পরিবেশটা হালকা করা দরকার। শখ করে ওদের ট্রিট দিতে এনেছে সে। এখানে তার অস্বস্তি মানায় না। নিজের রাগ নিজের ভিতর চাপা দিয়ে একটু হেসে মাথা নাড়লো। নায়রা ফোড়ন কাটলো,
– দিশান, এটা তোমার জামাইয়ের মাথা ধরার এক্সপ্রেশন না,এটা তার রাগের চেহারা৷ কপাল থাকবে কুচকানো,দাঁতে দাঁত ঘসবে,চোখ লাল হয়ে যাবে,ঘন ঘন শ্বাস নিবে,মাথার চুল টানবে ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য দেখতে দেখতে মুখস্থ। তুমিও ভালো মতো মুখস্থ করে নাও,আমি ওয়াসরুম থেকে আসতেছি। পড়া ধরবো কিন্তু এসে।
নায়রা চলে গেলে দিশান বললো,
– এত রেগে গেলেন কেন? আমাদের উপর রাগ করেছেন? আমরা কিছু করেছি?
নেহাল দিশানের দিকে একটু ঝুকে বললো,
– তোমরা করো নি,আমি করেছি।
– আপনি আবার কখন কি করলেন? আপনি তো কথাই বললেন না এতক্ষণ?
– কথা না বলাটাও অনেক সময় বড় অপরাধ দিশান।
– কি করলে আপনার রাগ কমবে তাহলে?
– বাদ দাও, ঠিক হয়ে যাবে এমনিতেই । তোমার রাগ হলে কি করো বলো।
– আমি চুপ করে থাকি। রাগ উঠলে আমার খুব কান্না পায়, আমি কান্না আটকে চুপ করে বসে থাকি। পরে সুযোগ মতো কেঁদে ঠিক হয়ে যাই।
– ওকে,তাহলে এখন থেকে আর চেপে রেখে কাঁদতে হবে না। তুমি সাথে সাথে সরে এসে আমাকে বলবে,সামনে না থাকলে ফোন দিবে,আমি তোমার মন একেবারে ঠিক করে দিবো। দেখি তোমার নাকের ডগায় রাগ কি করে বসে থাকে?
বলে দিশানের নাক টিপে দিলো। নায়রা এসে দেখলো দিশান আর নেহাল কি সুন্দর করে হাসছে। বসতে বসতে বললো,
– বাব্বা!!ভাইয়ার রাগ এত তাড়াতাড়ি পড়ে গেলো!!!জনসম্মুখে কি এমন করলি রে দিশান?
নেহাল কপট ধমকে বললো,
– এই জনসম্মুখেই মাইর খাবি কিন্তু নায়রা।
– তুই এর মাঝে ঢুকিস কেন? আমি আমার ফ্রেন্ডকে তার জামাই কে নিয়ে বলতেছি,তুই এখানে কথা বলিস কেন?বাদ দে এসব,এখন বল হঠাৎ এমন ট্রিট!!!বলে কয়ে খাওয়া যায় না তোর থেকে,সেখানে নিজে থেকে নিয়ে এলি,বিষয়টা কি ?
– বিষয়টা হলো যে তোদের সামনের পরীক্ষা তো রবিবার,তার আগেই শনিবার রাতে আমার ফ্লাইট, তে আপনাদের কেয়ার টেকার হবার ডিউটি আমার আজই শেষ। তাই খাওয়ানোর প্ল্যান ছিলো। ঐদিন এখানে খেয়ে খাবারটা মজা লেগেছিলো খুব, তাই নিয়ে এলাম৷
নায়রা মুখটা কালো করে ফেলল।
– দিলি তো মনটা খারাপ করে। তুই যে চলে যাবি আবার সেটা ভাবতে মন চায়না ভাইয়া।
– ধুর পাগলী। আবার চলে আসবো দেখতে দেখতে। মন খারাপ না করে খা তো।
দিশান কিছু না বললেও মাথাটা নীচু করে রাখলো। নেহাল খেয়াল করলো সে খাবারটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে, খাচ্ছে না। বলল,
– খাবারটা ভালো লাগছে না তোমার কাছে? আমি তো জানি তুমি চাইনিজ অনেক পছন্দ করো।
দিশান চটপট মুখে পুরে নিলো চিকেনটা। বললো
– না না,খাবারটা দারুন। আমি খাচ্ছি তো।
নেহাল আর কথা বাড়ালো না। খাওয়া শেষে ওদের নিয়ে বাসায় ফিরলো। যদিও নীচ থেকেই তার চলে যাবার কথা ছিলো তবুও ফাইল নিতে উপরে উঠে এলো৷ ফাইল খোঁজার ফাঁকে দিশানকে খেয়াল করতে থাকলো। এখনো মুখটা ভার। নেহাল রুমে আছে বলে চেঞ্জ করতে পারেনি,আলমারি খোলে পোষাক বের করে রাখছে । নেহাল এবার পিছন থেকে হাতটা টেনে ধরলো দিশানের,
– কি হয়েছে তোমার?
মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়লো,কিছু হয়নি তার৷
– আমি চলে যাবো শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো?
এখন মুখ খুললো দিশান,
– এবার আমি পরীক্ষার হলে উঠতে গিয়ে সিড়ি থেকে পড়ে যাবো কি না সেটার চিন্তা আর হবে না আপনার? অসুবিধা নেই, আমি একাই উঠতে পারবো।
হেসে উঠলো নেহাল। থুতনি ধরে মুখটা তুললো দিশানের।
– দূরে গেলে কি বউ পর হয়ে যাবে বোকা? আমার পা ভাঙা একটামাত্র বউকে নিয়ে আমার চিন্তা তো যাবে না। কিন্তু কি করবো বলো। আমার রিটার্ন টিকেট কাটা, ফিরতে হবে যে। এরপর দুই মা থাকবে ঢাল হয়ে,কিচ্ছু হতে দিবে না।
তবুও মুখের আধাঁরটা কাটলো না দিশানের।কিন্তু নেহালকে এবার মিটিং এর জন্য বের হতেই হবে। বললো,
– দিশান….আচ্ছা যাও,কাল একটা বেলা শুধু তোমার জন্য। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে তোমার ডাক্তারের কাছে,তারপর আমরা একটু ঘোরাঘুরি করে ফিরবো।
– এই ভাঙা পা নিয়ে ঘুরবো? আমাকে মিথ্যা ভুলিয়ে লাভ নেই।
– সেটা তো আমার ব্যাপার, তোমাকে ঘুরাবো বলছি তো ঘুরাবোই। কাল কিন্তু তাহলে আমাদের অফিসিয়ালি ফার্স্ট ডেট। কি পড়ে বের হবে,কিভাবে সাজবে তাড়াতাড়ি ভেবে নাও। আজই ফাইনাল করে রাখবে। আমার আলমারির চাবিটাও তো কোথায় থাকে জানোই,আমি কি পড়বো সেটাও বের করে রাখবে। আমার কিন্তু সময় হবে না এসব চুজ করার। তোমার উপর দায়িত্ব দিয়ে গেলাম কিন্তু।
এই টোটকায় কাজ হলো। সাথে সাথে হাসি ফুটে উঠলো দিশানের মুখে।
– নো টেনশন । আমি সব রেডি করে রাখবো আজ।
– গুড গার্ল। বের হলাম আমি। ফ্রেশ হয়ে একদম লম্বা হয়ে শুয়ে আগে রেস্ট নাও৷ আজ অনেক ধকল গেছে কিন্তু। তারপর সব রেডি করবে । ওকে?
– ওকে বাই।
নিশ্চিন্ত মনে বেরিয়ে গেলো নেহাল। গাড়ি চালাতে চালাতে তার মাথায় ঘুরছে কয়টাদিনেই দিশান কি আপন হয়ে উঠলো। গতবার তার যাবার ব্যাপারে দিশান একদম নিরুদ্বেগ ছিলো। যাবার পরও দু’পক্ষের কারোরই কোন উদ্যোগ ছিলো না যোগাযোগের। কিন্তু এবার আসার পর একটু একটু করে তাদের সমীকরণের জট খুলতে শুরু করেছে। সম্পর্কটা ডানা মেলার আগেই আবার সাময়িক বিচ্ছেদ। এবার এই মেয়েটার মায়াও কেটে বেরিয়ে যেতে হবে নেহালকে। ওর ও খুব কষ্ট হবে। মায়ের ভাষায় এটাকেই বউ থাকার পিছুটান বলে বোধহয়।
রাতে ফিরে দেখলো দিশান খুব হাসি মুখে তার জন্য বসে আছে। নেহাল ঢুকতেই হড়বড় করে বলতে থাকলো সে কাল বাইরে পড়ে যাবার জন্য কোন কোন অপশন শর্ট লিস্ট করেছিলো,পরে কেন সেগুলো বাদ দিলো। তারপর খুব আগ্রহ নিয়ে দেখালো যে সব গবেষণার পর কোনটা ফাইনাল হয়েছে। দিশান নিজের জন্য হালকা আকাশী রঙের একটা জামদানী থ্রিপিস বের করে রেখেছে আর নেহালের জন্য একদম সেইম কালারের শার্টটা বের করে রেখেছে। নেহাল ঢোক গিলে বলল,
– মানে দিশান একদম সেইম কালার পড়বো দুজন? কাছাকাছি কিছু পড়ি?
– আরে না,আপনার এটার সাথে কালার মিলেছে জন্যই তো আমি এই জামা বের করে রেখেছি। সালোয়ারটা সাইড কেটে হুকও লাগিয়ে দিতে বলেছি মাকে। হয়ে গেছে বোধহয় মার। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি মায়ের রুম থেকে।
দিশান বের হলে প্রমাদ গুনলো নেহাল। তখন দিশানের মন ভালো করতে বলে গিয়েছিলো পোশাক বাছাই করতে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী এক রঙের পোশাকে তার আপত্তি। ওর কাছে স্কুল ড্রেস টাইপ লাগে ব্যাপারটাকে। এখন বেচারী শখ করে অনেক সময় নিয়ে এই পোষাক রেডি করেছে,না পড়লে কষ্ট পাবে। কাল আবার যাবেও তো আবীরের দুলাভাইয়ের চেম্বারে, ভাইয়া না পচাঁলেই হয়৷ মনে মনে নিজেকে বলল,
– আরো করো আট বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে। তারপর তাকে পেলে পুষে বড় করো। এই ছিলো কপালে!!!!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here