নানান বরণ মানুষ রে ভাই ১১ তম পর্ব বড় গল্প

0
286

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
১১ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

শিমুলের মেধা তাক লাগিয়ে দিল সবাইকে। খান মন্জিলে সারাদিনের পরিশ্রমের পরও রেখা রাতে মেয়েকে পড়াতে বসাতেন। শিমুলের মাথায় তিনি এটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, পড়াশোনা ঠিক ভাবে না করলে তার কোনো সম্মান নেই, কদর নেই। যেমন তিনি নিজে। আজ লেখাপড়া জানা থাকলে তাঁকেও সবাই মান্যগণ্য করতো, রিয়াকে যেমন করে।শিমুলকে অনেক পড়তে হবে,অনেক। ডাক্তার হতে হবে শিমুলকে। সবাই ম্যাডাম বলে ডাকবে।আর শিমুল ডাক্তার হয়ে পলাশকে সুস্থ করে তুলবে,পলাশের মতো আরও অনেক বাবুকে সুস্থ করে তুলবে। রেখার মুখের বুলি হয়ে গিয়েছিল, “পড়ো, পড়ো, পড়তে হবে,বড় হতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।”

শিমুল নিজেও পড়তে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু মামা-মামীরা শুধু পড়ার মধ্যে ডাক দিতেন। “অ্যাই শিমুল, পেঁয়াজটা কেটে দিয়ে যা।” “কই গেলে শিমুল? খুকির এই কাঁথাগুলো কেচে দে।” “শিমুল,পানি দে।” “শিমুল,দুধ জ্বাল দে।” রাত নয়টার পরে হ্যারিকেন বা কূপি জ্বালানো নিষেধ। কেরোসিন বাড়তি খরচ করা যাবেনা। কাক ডাকা ভোরে শিমুল উঠে পড়তে বসতো।রেখা ঘুম ঘুম গলায় বলতেন,”আরেকটু ঘুমা,মা।” আরেকটু ঘুমালে কি আর শিমুলের চলে? সাত বছর বয়সে খান মন্জিল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল শিমুলদের, মাত্র নয় বছর বয়সে সে ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে সারা জেলার মধ্যে প্রথম হয়ে পাশ করলো।

এদিকে হাসানের ব্যবসার অবস্হা তখন খুবই ভালো। শুধু গ্রামে নয়, পুরো থানাতেই তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি। তাঁর আপন চাচাতো ভাই তখন এলাকার এম.পি। আপন বড় ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান। হাসান এবারে রেখার ভাইদের ধরলেন। বললেন,” রেখার যে সম্পত্তি পাওনা, সুদে আসলে ফেরত দিবি। বিনা পয়সায় বছরের পর বছর ও আর ওর মেয়ে তোদের বাঁদীগিরি করেছে, সব পয়সা হিসাব করে রেখাকে বুঝিয়ে দিবি,আমার সামনে। তারপরে রেখার পা ধরে কুলাঙ্গার ভাইরা আর তাদের বৌরা মাফ চাইবি,নাকে খত দিবি। রেখা তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকবে,আলাদা খাবে। কোনোদিন যদি রেখা বা তার ছেলেমেয়েদের গায়ে ফুলের টোকাও দিস, জ্যান্ত কবর দিবো,আল্লাহর কসম।”

শান্ত, সুবোধ, পরোপকারী হাসানের এ কেমন মূর্তি। শিমুলের মামা-মামীরা প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গেলেন,তারপর শুরু হলো হুংকার,চিৎকার, অশ্লীল গালাগাল। শিমুলের মেজ মামা হাসানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আর তারপর ঘাড়ে বিশাল এক রদ্দা খেয়ে লুটিয়ে পড়লেন। আবারও হৈ হৈ রব,কান্নাকাটি। রেখা বললেন,”কি করছেন হাসান ভাই? থামান এগুলো। আপনি শুধু আমাকে আমার ভাগটা বুঝিয়ে দেন, আমি মেয়েটাকে মানুষ করতে চাই,ছেলেটার চিকিৎসা করাতে চাই।ওদের তিনবেলা পেট ভরে খাওয়াতে চাই। আর কিছু চাই না।”

রেখা জন্ম থেকেই এমন ছিলেন। শান্ত, চুপচাপ, সরল,আবার কিছুটা বোকাও, ভীরু। খুব সেবাপরায়ণ। কারো সাতে নেই, পাঁচে নেই। মিথ্যা বলেন না, পাড়ার মেয়েরা যখন কারোর নামে কূটকাচালি করতো,রেখা ওখান থেকে সোজা উঠে আসতেন। শুধু লেখাপড়াটা কিছুতেই মাথায় ঢুকতো না। বিশেষ করে অংক। এমন সোজা,সরল,প্যাঁচহীন, প্রতিবাদহীন, মায়াকাড়া চেহারার মেয়ে বলেইতো রেখার শাশুড়ি আফরোজা বেগম নিজের ফুপাতো বোনের মেয়েকে একমাত্র পুত্রবধূ করে নিয়ে আসেন। এই মেয়ে কোনোদিন শ্বশুর -শাশুড়ি থেকে স্বামীকে আলাদা করার কথা ভাববেনা, স্বামীকে কুমন্ত্রণা দিবেনা, বকা ঝকা-গালমন্দ খেলেও স্বামীর কাছে নালিশের ঝাঁপি খুলে বসবে না।ছেলের বৌ হিসাবে এমন মেয়েই ভালো।সাত চড়েও রা নেই।

রেখা হাসানের কাছে হাতজোড় করছেন গন্ডগোল থামানোর জন্য, তখন শিমুলের ছোট মামী ফুট কাটলেন,” কতোবার বলেছি না, ওই দুজনের মাঝখানে ফস্টিনস্টি আছে। ঐ মহিলা এমন মুখ করে রাখে যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারেনা, আসলে পেট ভরা শয়তানি বুদ্ধি। ভাতারকে দিয়ে সে-ই গোলমাল পাকিয়ে এখন ভালো মানুষ সাজছে। ঝাঁটা মার্ মাগীর মুখে।”

বড় বৌ হিসহিস করে বললেন,”বারো ভাতারী মাগী,তোকে আজ মজা দেখাচ্ছি। ”

মেজ ভাইকে কলাগাছের মতো দড়াম করে পড়তে দেখে বাকি দুই ভাই ছুটে এসেছে হাসানকে মারতে। আর তখনই বড় বড় রাম দা আর লাঠিসোটা নিয়ে বেশ কয়েকজনের আবির্ভাব।

হাসান একজনকে বললেন, “তিনজন মহিলাকে ডেকে নিয়ে আয়তো। তোর তিন বোনেরেই ডাক্।”

বাকীদের বললেন, “এই অমানুষ তিনটাকে পিটা। যতো পারিস,পিটা। তারপরে তিনটা কবর খুঁড়ে জ্যান্ত পুঁতে দে। রাম দা গুলো এখন রাখ্। আগে লাঠি দিয়ে বাড়িয়ে হাড়গোড় গুলো ভাঙ।”

সবাই হাউমাউ করে উঠলো। আশেপাশে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। সবাই হাসানের পক্ষে। লাঠির বাড়ি পড়তে লাগলো। সেই সাথে ভয়ংকর আর্তনাদ। হাসান চিৎকার করে বললেন,”এইগুলা মানুষ না,রাক্ষস। মায়ের পেটের আপন বোনকে ঠকায়, বাঁদীর মতো খাটায়, খান বাড়ি থেকে খরচা পাঠায়, তাও রাক্ষসগুলা নিজের বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নীকে পেট ভরে খাওয়ায় না।আপনারা বলেন,এই জন্জালগুলোকে কি করবো?জ্যান্ত কবর দিবো? ‘

রেখা চিৎকার করে বললেন, “খবরদার! আমার ভাইদের গায়ে আরেকটা বাড়ি পড়লে আমি বিষ খাবো। এই দেখেন বিষ।”

হাসান পাড়া কাঁপিয়ে ধমক দিলেন। ” এতো দরদ তোমার ভাইদের জন্য? ছেলেমেয়ের জন্য দরদ নেই? মেয়ে যে এই বয়সে নিজের নানার বাড়িতে ঝি এর কাজ করে লেখা পড়া করে, তোমার ছেলেকে নিয়ে বাড়ির সবাই হাসাহাসি করে, তোমার ভাস্তে ভাস্তিরা অসহায় বাচ্চাটাকে সার্কাসের জানোয়ারের মতো ট্রিট করে, ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়, কাঠি দিয়ে খোঁচা দেয়, সবার সামনে প্যান্ট খুলে দেয়, তখন দরদ হয় না তোমার? শেষ কবে মাছ,মাংস খেয়েছে তোমার ছেলেমেয়ে, বলতে পারবে? তুমি মা হিসাবে খুব খারাপ, খুব খারাপ। ছেলেমেয়েদের জন্য মা অনেক লড়াই করে। আর তুমি শুধু অন্যদের খুশি রাখতে চাও। ”

“আমার ভাই-ভাবীদের ছেড়ে দেন,আপনার দোহাই লাগে।”

“তুমি ঘরে যাও। বুবু,তুমি ওকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। দেখেশুনে রেখো। রেখা বেগম,ভয় নেই, তোমার ভাই -ভাবীদের জানে শেষ করবো না।”

হাসানের বড় বোন রেখাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। পলাশকেও। বেচারা ভয়ে কাঁদছিলো। শিমুলকে যদি আবার নিয়ে যায়,এই ভয়ে শিমুল একটা মোটা গাছের পিছে লুকিয়ে রইলো। কি হচ্ছে না হচ্ছে, এইটা না দেখে সে যাবে না।

লোকটা তিনজন ডাকসাঁইটে মহিলাকে নিয়ে এসেছে। হাসান বললেন,”এসেছো?ঐ মহিলা তিনটাকে ধরো। তারপরে ন্যাড়া করে দাও।এরা মহিলা নামের কলংক। নিজেরা নোংরা, তাই সবাইকে নোংরা ভাবে।”

মামীরা আতংকে চেঁচিয়ে উঠলেন।মেজ মামী কাঁপতে কাঁপতে বললেন,”আমি তো রেখা আর আপনাকে জড়িয়ে কোনো কথা বলিনি। আমাকে ছেড়ে দেন।”

হাসান বললেন,”তোমাকে হাড়ে হাড়ে চিনি। তুমি সবচে ‘ বড় শয়তান। পলাশকে তুমি প্রায় মারধোর করো। শিমুলকে ন্যাড়া করে দিয়েছিলে ও লুকিয়ে মোরগের দুই টুকরা মাংস খেয়েছিলো বলে।”

তিন মামীকে নেড়া করে দেয়া হলো। শিমুলের খুব ভালো লাগছে। মামা-মামীরা আর তাদের ছেলেমেয়েরা ভীষণ কষ্ট দেয় মা’কে, পলাশকে,শিমুলকে। নিজেদের ছেলেমেয়েদের কাঁসার গ্লাস ভরে দুধ দেন, শিমুলেরই হাত দিয়ে, নিজেরাও রাতে তরকারি দিয়ে খাওয়ার পরে দুধভাত খান। খায়না শুধু মা,শিমুল, পলাশ। তাদের মাছ গোশতোও দেয়া হয় খুব কম। মামীরা বলেন,’ তোদের বাপে যে টাকা পাঠায়, তাতে নুন ভাত জোটে। বাকিটা খাচ্ছিস আমাদের ঘাড়ের উপর দিয়ে। ” আর হাসান মামা ঠিকই বলেন। মা কেন সবার অত্যাচার থেকে তাদের দুই ভাইবোনকে রক্ষা করতে পারেনা?কেমন মা?পলাশকে নিয়ে যখন তার মামাতো ভাইবোনেরা হাসাহাসি করে,গায়ে পানি ঢেলে দেয়, চিমটি কাটে, লুলা,লুলা,লুলা খায় মূলা এসব ছড়া কেটে হাসাহাসি করে, পলাশ কিভাবে হাঁটে তা অভিনয় করে দেখায়,তখন মা কেন রুখে দাঁড়ায় না, কেন ওদেরকে নিষেধ করেনা,বকা দেয় না?

হাসান আশেপাশের গণ্যমান্য মানুষদের নিয়ে সালিস বসালেন। রেখাকে তাঁর সম্পত্তি বুঝিয়ে দেওয়া হলো। কাগজপত্র তৈরি,সইসাবুদ সব আইন মেনে হলো। চার রুমের আলাদা একতলা ভবন বেছে নিলেন রেখা,হাসানের পরামর্শে। এতো ঘটনার পরে ভাইদের সাথে এক ছাদের তলায় থাকা যায়না,এক হাঁড়িতে খাওয়া যায়না। হাসান সাহেব রেখার ভাইদের নামে জিডি করে রাখলেন। রেখা বা সন্তানদের এতোটুকু ক্ষতি হলে দায় সম্পূর্ণ তিন ভাইএর।

রেখা বাড়ি পেলেন,ফসলি জমি পেলেন,একটা পুকুর পেলেন। পলাশকে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি রাখলেন কয়েকদিন। ডাক্তাররা কোনো আশার বাণী শুনাতে পারলেন না। এই ছেলে পেটে থাকার সময় দুর্দশার সীমা ছিলো না রেখার। স্বামী এই সময়ই দ্বিতীয় বিয়ে করেন। শাশুড়ি, স্বামীর অত্যাচার এই সময়েই সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দুঃখে কষ্টে রাতের পর রাত না খেয়ে থাকতেন রেখা। পানি ভাঙা শুরু হলো নির্দিষ্ট তারিখের অনেক আগেই। খুব অল্প অল্প করে। নিজেই প্রথমে টের পান নি রেখা। বিশ্রাম বলতে রাত বারোটা -একটায় ঘুমানো আর ফজরের ওয়াক্তে উঠা। তারপরে আবার ঘন্টা খানিক ঘুম। একদিন সন্দেহ হলো পানি একটু একটু ভাঙছে কিনা।শাশুড়িকে জানালেন। শাশুড়ি মুখ ভেংচে বললেন,”পানি পড়ে কিনা বুঝতে পারছো না?তুমি ছোট খুকি? একটা কালিন্দীকে তো জন্ম দিয়েছো,তাও কিছু বুঝতে পারছো না?ন্যাকা! কাজে ফাঁকি দেওয়ার ধান্দা। যাও চোখের সামনে থেকে।”

তারপরে একদিন ঝপাস করে পানি ভাঙলো। স্বামী,শাশুড়ি নয়, তাঁদের নির্দেশে দূর সম্পর্কের কয়েকজন নিয়ে গেলো কাছের একটা ছোটখাটো ক্লিনিকে যেখানে ভ্রূণ নষ্ট করা হয়, আর নিম্নবিত্তরা আসে নরমাল ডেলিভারি করাতে। অনেক টানা হ্যাঁচড়ার পরে পলাশের জন্ম হয়।

পলাশ বুকের দুধ টানতে পারতো না।রোগা,কাকলাস বাচ্চা। বুকে দুধও ছিল কম। রেখা চেপে চেপে দুধ বের করে ড্রপারে করে খাওয়াতেন। তাতে কিছুই হতো না। ক্ষুধার জ্বালায় পলাশ কাঁদতো, বেশি কাঁদার শক্তিও বেচারার ছিলোনা। কি অসহনীয় কষ্ট করেছে তিনজন, রেখা,শিমুল, পলাশ। খান সাহেব তখন সুন্দরী, বিদূষী,উদ্ভিন্নযৌবনা রিয়াতে বিভোর, ছেলেকে তোয়াজ করার জন্য শিমুলের দাদীও তখন কম ভয়ংকর নন। রেখা তাঁর নিজের ফুপাতো বোনের মেয়ে, শিমুল-পলাশ তাঁর নিজেরই নাতি নাতনি। তাও কেন এতো দয়াহীন? শিমুল মেয়ে, গায়ের রং শ্যামা, মুখশ্রী ভালো নয়, পলাশ প্রতিবন্ধী, এগুলোই তাদের অপরাধ?

হাসপাতাল থেকে পলাশকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন হাসান, রেখা, শিমুল, হাসানের ভাবী।ভাবীকে নেওয়ার কারণ যেন কোনো গুজব না উঠে। এখন পর্যন্ত হাসান-রেখা পরস্পরের আঙুল পর্যন্ত স্পর্শ করেন নি, তবু মুখরোচক কথা উঠতে সময় লাগে কতক্ষণ?

খান মন্জিলের নানা খবর রেখার কাছে আসে। রিয়াকে নিয়ে ভীষণ সুখে সময় কাটছে খান সাহেবের। মৌরির পরে আরেকটি ছেলে জন্ম নিয়েছে। সেই আনন্দে জমকালো অনুষ্ঠান হয়েছে খান মন্জিলে।দুই বছর পরে আরেকটি মেয়ে জন্মেছে। আফরোজা বেগমের প্রতাপ অনেকটা কমেছে। রিয়া তাঁকে একদম পছন্দ করেন না। রিয়ার সময় কাটে কলেজে আর পার্টিতে। কাজের লোকজন দুই বাচ্চাকে দেখাশোনা করেন। সুপারভাইজ করেন রিয়ার মা। প্রায় সময় তাঁরা মেয়ের বাসাতেই থাকেন।কর্তৃত্ব মূলত তাঁর হাতেই। ওমর খান বড় বেশি টাকা উড়াচ্ছেন,পাল্লা দিয়ে রিয়াও।

একদিন খান মন্জিলে ডাক পড়লো রেখার। রেখা যেন দ্রুত চলে আসেন,তবে বাচ্চা-কাচ্চা আনা যাবে না। আফরোজা বেগম খুব অসুস্থ। উনার সেবা যত্নের দরকার। ভালো কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছে না। পুরানোদের কয়েকজন নেই।

শিমুল তখন সদ্য ক্লাস টেনে। অসম্ভব মেধাবী। সারাক্ষণ লেখাপড়া নিয়ে থাকে। পলাশকে বড্ড ভালোবাসে। ওকে তিন বেলা মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, টয়লেটের ব্যাপারে সাহায্য করে, যখন লেখাপড়া করে তখনও পলাশকে একহাতে ধরে থাকে। মায়ের কাজেও সাহায্য করতে চায় শিমুল, মা দেন না।বলেন,”আমার কাজ তো এখন অনেক কম শিমুল। তুই এগুলো করে সময় নষ্ট করিস না। তোকে ডাক্তার হতে হবে,মা।আমি বেঁচে আছি এই আশা নিয়ে। ”

আফরোজা বেগম অসুস্থ, তাই রেখাকে যেতে হবে সেবা করার জন্য। হাসান বললেন,”রেখা,আমার অনুরোধ, তুমি ওই লোককে তালাক দিয়ে দাও। আমি জানিনা,কিসের আশায়,কেন তুমি ওই লোকটাকে তালাক দিচ্ছ না? আর ঐ বাড়িতে তোমার যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।”

শিমুলেরও একই মত। রাগে তার শরীর কাঁপছে।এতো বড় সাহস,বাঁদীগিরি করার জন্য তার মায়ের ডাক পড়েছে। সন্তানদের নেওয়া যাবেনা,তাই রেখা অস্বস্তিতে পড়েছেন। শিমুলের পরীক্ষা সামনে,খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়, পলাশের অসুস্থতা আরো বাড়ছে। ওদিকে যতো যাই হোক,শাশুড়ি অসুস্থ। সেবা করার কেউ নেই। মানুষটা কষ্ট পাচ্ছেন। আইনত তিনি এখনো আফরোজার বৌমা,ওমর খানের স্ত্রী, আর এই সম্পর্কটার কথা ভাবলে এতো কষ্টের মধ্যেও হালকা সুখ আর স্বস্তি অনুভব হয়। তিনি মনের এই গোপন কথাটা মেয়েকে জানালেন।

শিমুল রাগে আর বিষ্ময়ে কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে গেলো। তারপরে ফেটে পড়লো প্রচন্ড ক্ষোভে।

” তোমার এতোটুকু মানসম্মান বোধ নেই মা? তুমি নিজেই তোমার জীবনকে নষ্ট করেছো। তোমার মতো মেরুদণ্ডহীনকে কে ভালোবাসবে?
তুমি আমার জীবন নষ্ট করেছো, আমার পলাশ তোমার জন্য ই পঙ্গু হয়ে জন্মেছে। নিজেকে অনেক মহান মনে করো,তাই না মা? মাদার তেরেসা? আসলে তুমি নামলোভী,ব্যক্তিত্বহীন এক অপদার্থ মহিলা। ”

রেখা নীরবে সারারাত চোখের পানিতে বালিশ ভিজালেন।সন্তান তাঁকে ভুল বুঝেছে। তিনি কখনোই নাম প্রত্যাশী ছিলেন না। কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্ক আর সেবাপরায়ণাতাকে তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। মা আর নানীকে দেখে তিনি এটা শিখেছিলেন। মায়ের কুলের,বাপের কুলের সব আত্মীয়দের সাথে তিনি যোগাযোগ রাখতেন বাসায় যেয়ে,চিঠি লিখে। আর আত্মীয়রা বাসায় আসলেতো কথাই নেই। আদরে-আন্তরিকতায় ভরিয়ে দিতেন স্বজনদের। আর কি কপাল, অন্য আত্মীয় স্বজনতো দূরের কথা, এখন নিজের তিন ভাই এর সাথেই তাঁর সম্পর্ক নেই, তিনি কয়েকবার ভাইদের বাড়ি দেখা করতে গিয়েছেন, ওদিক থেকে ভাইদের গালিগালাজ শুনেছেন, এদিক দিয়ে শিমুল আর হাসান তাঁর উপরে প্রচন্ড ক্ষেপে গেছে। স্বামী থেকেও নেই। এতোদিন পরে যখন ডাকছেন, তখন যাওয়াটাই তো ভালো। শাশুড়ি অসুস্থ, তাঁকেও একটু দেখে আসা উচিৎ। কিন্তু শিমুল রেগে যেয়ে কি ভয়ংকর কথাগুলো বললো! রেখা ঠিক করলেন যাবেন না।

কয়েকদিন পরে খান সাহেবের দু’জন লোক আসলো। রেখা যদি খান মন্জিলে না যান,তাহলে তালাকনামা পাবেন। রেখার মাথা ঘুরে উঠলো।শিমুল বাসায় ছিলো। সে লোক দুটোকে বললো,”আপনাদের খান সাহেব কে বলেন,উনাকে কষ্ট করতে হবে না,আমার মা-ই তাঁকে তালাকনামা পাঠাবেন। এবং খুব শীঘ্রই। ”

কিছু দিন পরে আবার খান মন্জিল থেকে চিঠি আসলো। আফরোজা বেগমের বয়ানে কেউ লিখে দিয়েছে। চিঠির বিষয়বস্তু হলো, আফরোজা বেগম খুব অসুস্থ, যে কোনো সময় তিনি চলে যেতে পারেন, দয়া করে রেখা যেন ছেলেমেয়ে সহ আসেন। মরার আগে তিনি এদের দেখে যেতে চান।

রেখা এবার কারোর কথা শুনলেন না। মৃত্যুশয্যায় শায়িত শাশুড়ি কাতর হয়ে ডাকছেন, আর তিনি এখানে বসে থাকবেন,তা হবে না।

দুই সন্তানসহ রেখা খান মন্জিলে ঢুকলেন। বাড়ির সেই চাকচিক্য নেই। সামনের বিরাট ফুল বাগান এখন একটা জঙ্গল বিশেষ। ওমর খান বুড়োটে হয়ে গেছেন, দাপুটে ভাবটা একটু কম, রিয়ার চেহারাও বেশ রুক্ষ, কাঠকাঠ।
রিয়ার বড় মেয়ে মৌরির বয়স আট বছর,ফুটফুটে চেহারা। মৌরির পরে রিয়ার ছেলে,নাম মুকুল। মুকুলের পিঠাপিঠি বোন মিথুন, তার পিঠাপিঠি ওমর-রিয়ার ছোট মেয়ে মুমু, রিয়া এখন আবার গর্ভবতী। একজন ইন্জিনিয়ার কাম বিজনেসম্যান আর একজন কলেজ শিক্ষিকার একের পর এক সন্তান হওয়া নিয়ে আড়ালে বন্ধু মহলে হাসাহাসি হয়।

শাশুড়ির ঘরে ঢুকে ভয়ংকর চমকে উঠলেন রেখা। এ কি অবস্থা হয়েছে! বিছানায় কি কোনো মানুষ শুয়ে আছে? জটা পাকানো চুল, সারা শরীরে ঘা,ঘা থেকে রস গড়াচ্ছে, অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘর, তাঁর নিজের ঘর হতে অনেক আগেই তাঁকে উৎখাত করা হয়েছে, ওমর-রিয়ার সন্তানেরা বড় হচ্ছে, তাদের জন্য ভালো ঘরের দরকার।কাজেই আফরোজার জায়গা হয়েছে নীচের তলার এক বদ্ধ ঘরে। দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। পুরানো কাজের মেয়ে মন্জু এসে বললো,”আপনারা আপনাদের আগের ঘরে থাকবেন। ম্যাডাম বলে দিয়েছেন। ”

পলাশের ক্ষুধা পেয়েছে। সে কাঁদছে। রেখার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি শাশুড়ি আর শাশুড়ির ঘর পরিস্কার করা নিয়ে ব্যস্ত। মায়ের প্রতি শিমুলের বিরক্তির সীমা রইলো না। সে মঞ্জুকে ডাক দিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো,”আমাদের ঘরে ভাত দিয়ে দাও। ” মন্জু বললো,”ম্যাডাম না বলা পর্যন্ত ভাত দেয়ার নিয়ম নাই।” শিমুল আরো শীতল গলায় বললো,”এই বাড়িতে অনেক ম্যাডাম। আমার মা তোমার ম্যাডাম।ঐ যে বৃদ্ধা মহিলা পাপের জ্বালায় ছটফট করছেন, তিনিও একজন ম্যাডাম।যাও,তিনজনের মতো ভাত তরকারি ঐ ঘরে দিয়ে এসো, থালা-বাটি-গ্লাস যেন ঝকঝকে পরিষ্কার হয়।আর হ্যাঁ, দ্বিতীয় দিন আমার মা বা আমার সাথে মুখে মুখে কথা বলবে না।” মন্জু হতভম্ব হয়ে গেলো।এই সেই পুঁচকে ভীতু মেয়ে!

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here