নানান বরণ মানুষ রে ভাই ২৬ তম পর্ব

0
256

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
২৬ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

ধীর গতিতে গ্রামে ঢুকছে গাড়িবহর। শেষ পর্যন্ত রেখা আসতে পেরেছেন তাঁর গ্রামে।

অ্যাম্বুলেন্সে কফিন জড়িয়ে ধরে বসে আছে মৌরী। মাথাটা রেখেছে কফিনের ডালাতে। লম্বা চুলগুলো সপসপে ভেজা। বারবার জ্ঞান হারায়, বারবার মাথায় পানি দেওয়া হয়। মৌরী আচ্ছন্নের মতো আঁকড়ে আছে কফিনটাকে, চোখ বন্ধ করে, একটানা মৃদু গোঙানি বের হচ্ছে তার গলা থেকে। মাঝেমধ্যে চমকে উঠে চোখ মেলছে, তারপরই গগনবিদারী চিৎকার করে কান্না।

মিথুন,মুকুলও আঁকড়ে ধরে আছে কফিনটা। একটু পরপরই চুমু খাচ্ছে বাক্সটাকে। চোখের পানি শুকাচ্ছে না কোনো ভাইবোনেরই,শিমুল ছাড়া। প্রথম থেকেই চোখ খটখটে শুকনো। পোস্ট মর্টেমের ঝামেলার জন্য সোমবার সকাল এগারোটায় অবশেষে গ্রামে নিজের বাড়ির আঙিনায় নামতে পারলেন রেখা। কি ছটফটই না করেছেন কয়েকমাস ধরে গ্রামে আসার জন্য।

আগের থেকেই মানুষ গিজগিজ করছে উঠানে, আশেপাশের খোলা জায়গায়। বোনের আর্থিক অবস্থার রাজকীয় পরিবর্তনের সাথে সাথেই চেহারা পাল্টে ফেলেছিলেন ভাই-ভাবীরা। কতো চিঠি। “আগের কথা ভুলে যা বোন, বাড়িতে আয়।” “তখন আসলে নানা ঝামেলায় মাথার ঠিক থাকতো না,বেড়াতে আয় বোন।” ” রূপার বিয়ে ঠিক করেছি, বনেদি ঘর। ভাইঝিকে কিছু দিবি না? ধনী ফুপুর কাছে ভাইঝি একটা সীতাহারের আব্দার করেছে নিজমুখে।” শিমুলের একেকটা পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়, মামা-মামীদের আদর ততো ফুলে ফেঁপে উঠে।

আত্মীয়-অনাত্মীয়, চেনা-অচেনা শত মানুষের ভীড়। সুর তুলে কান্নাকাটি, ফিসফাস,নানা জল্পনা কল্পনা। রেখার মুখের কাপড় সরানো হলো। শেষ দেখা দেখে নিন। মৌরী জ্ঞান হারালো। মুকুল হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে, মাথা ঝাঁকাচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে তার। মিথুন, মুমু,মিতুল উপুড় হয়ে পড়লো খাটিয়ার উপরে।

অবাক হয়ে গর্ভজাত সন্তানদের গতকাল হতে দেখছেন রিয়া। তাঁর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না ছেলেমেয়েরা। রেখার জন্য তাদের শোকের গভীরতা দেখেই বুঝা যায় ওদেরকে কতোটা আদরে রেখেছিলেন তিনি। রেখার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় এবং নিজের প্রতি ঘৃণায় মাথা নুয়ে এলো রিয়ার।

ওমর খানকে চরম বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। অসম্ভব মুষড়ে পড়েছেন তিনি। রেখা তাঁকে ক্ষমা চাওয়ার কোনো সুযোগ দিলেন না কেন? কেন ওমর জড়তা কাটিয়ে আগেই রেখাকে বললেন না,”আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।” অনুতাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরছেন ওমর।

শিমুল নির্বিকার। সে গতকাল সকালে নাস্তা খায় নি,কিন্তু তারপর থেকে স্বাভাবিক ভাবেই খাওয়া দাওয়া করছে। পুলিশ যা যা জিজ্ঞেস করেছে,শান্ত ভাবে সেগুলোর উত্তর দিয়েছে। যখন ভাইবোনেরা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো, সে তাদের বুকে জড়িয়ে ধরেছে, পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছে। গত রাতে এক গামলা ভাত মাখিয়ে পাঁচ ভাই -বোনকে জোর করে মুখে তুলে খাইয়েছে। এখন বাসার সিঁড়ির উপরে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খাটিয়ার দিকে।

রিয়ার ভীষণ ইচ্ছে হলো শিমুলের পাশে বসে তার মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরতে। মেয়েটা ভিতরে ভিতরে কতোটা দগ্ধ হচ্ছে বেশ বুঝতে পারছেন তিনি। কিন্তু কাছে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। গতকাল একটু ছুঁতে গিয়েছিলেন, শিমুল সরে যেয়ে শান্ত গলায় বলেছে,”আমাকে ছোঁবেন না প্লিজ। মা আর ভাইবোনদের ছাড়া কারোর ছোঁয়া আমি পছন্দ করিনা। আমার গা ঘিন ঘিন করে।”

জনতার মধ্যে নানা গুন্জন, ” খুব ভালো মানুষ ছিলেন,” “হাসান তো এনারে না পাইয়া বিষ খাইলো” ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে জোরালো গুন্জন হলো,” লুলা বাচ্চাডারে দেখতেছি না। হে কি মইরা গ্যাছে?”

গত সকালে মৌরীর তীব্র আর্তনাদে সবাই ছুটে এসেছিল। শিমুল দৌড়ে যেয়ে মায়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরেছিল। মুকুল অনেক লম্বা। সে খাটে উঠে দ্রুত মায়ের গলার ফাঁস খোলার চেষ্টা করে। ভাইবোনেরা মিলে কসরত করে রেখাকে নামায়। তখনও মনে আশা মা মারা যান নি।বেঁচে আছেন।শিমুল ছাড়া বাকি সবাই মা’কে ব্যাকুল হয়ে ডাকতে থাকলো। মুকুল দৌড়ালো ডাক্তার সাহেবকে ফোন করতে। মতির মা,পাখি,নাজু সবাই কাঁদছিলো। তারা মৃত মানুষ দেখে দেখে অভিজ্ঞ। প্রথমেই বুঝে গিয়েছিল রেখা আর নেই। শিমুলও বুঝেছিল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে তাকিয়ে ছিল শূন্য চোখে। ডাক্তার সাহেব এসে সত্যটা বলার পরে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। পাঁচ ছেলেমেয়েকে সামলাতে পারছিলো না কেউ। ইতিমধ্যে আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশীরা জড়ো হয়েছেন। সবাই হতবাক। ডাক্তার সাহেব বললেন,”এটা পুলিশ কেস। গার্জিয়ান কাউকে খবর দাও।” তখনই শিমুল তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলো,”পলাশ কোথায়,পলাশ?”

মৌরী ছাড়া সবাই একটা ধাক্কা খেলো। ঘটনার ভয়াবহতা ও আকষ্মিকতায় প্রতিবন্ধী ভাইটিকে বেমালুম ভুলে যাওয়ায় অনুশোচনা আর লজ্জা ঘিরে ধরলো তাদের। মুকুল কান্নাভাঙা গলায় বললো,”আজ ভোর রাতে মা এসে ভাইয়াকে তুলে নিয়ে গেলো। বললো,ভাইয়াকে একটু দরকার আছে। ঘুম ভাঙার পরে ভাইয়াকে তো দেখিনি।” হুড়োহুড়ি করে সবাই ছুটলো পলাশকে খুঁজতে। বাড়ি,ছাদ,বাগান তন্ন তন্ন করে খুঁজে ও পলাশকে পাওয়া গেলো না।

ডাক্তার সাহেব একই পাড়ার মানুষ। ওমর খানের প্রায় সমবয়সী। এই বাড়ির সব ঘটনা তাঁর জানা। তিনি মুকুলকে বললেন,”বাবা, এমন পরিস্থিতিতে তোমার বাবাকে তো খবর দিতেই হয়। তোমার মায়ের অপমৃত্যু, ভাই নিখোঁজ, এগুলো তোমরা সামলাতে পারবে না।আমি তোমাদের কাছে আছি,অন্য পড়শীরাও আছেন, কিন্তু এই সময় একদম কাছের অভিভাবক দরকার হয়।”

শিমুল বললো,”উনি আমাদের কেউ না। বিশেষ করে মা,আমার বা পলাশের কেউ না। কাজেই উনাকে ডাকবেন না প্লিজ। ”

” এখন মান-অভিমানের সময় না,মা। থানা-পুলিশ -মর্গ, অনেক জটিল ব্যাপার। পলাশকে খুঁজে পেতে চাও না?”

খবর পেয়ে ওমর-রিয়া যখন ছুটে এলেন,তখন বাড়ি উপচে পড়া মানুষ। পুলিশও চলে এসেছে। ছেলেমেয়েরা যত্ন করে মা’কে শুইয়ে রেখেছে খাটে।

তারপরে তো কতো কিছু হয়ে গেলো। জিজ্ঞাসাবাদ, থানায় কতো ফর্মালিটিজ, পোস্ট মর্টেম, হিমঘর। পলাশকে সম্ভাব্য -অসম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজা। পলাশ যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

রেখার ভাইরা জানতে চাচ্ছেন পলাশ কোথায়। পাড়া প্রতিবেশীরা জানতে চাচ্ছে পলাশ কোথায়। যদি বেঁচে থাকে, নিয়ে আসা হলো না কেন?লুলা হোক আর যাই হোক, পেটের ছেলে মায়ের কবরে মাটি দিবে না? সতালো ছেলে দিয়ে কি সবকিছু হয়?

রেখা শায়িত হলেন তাঁর বাবা-মায়ের পাশে। যোহরের নামাজের পরে। তর্ক উঠেছিল তাঁর জানাজা পড়ানো ঠিক হবে কিনা। আত্মহত্যা মহাপাপ। কবরের জায়গা নিয়েও বাক্ বিতন্ডা হয়েছিল। তর্কটা শুরু করেছিলেন শিমুলের মামারা। আত্মহত্যা করে রেখা ভয়াবহ পাপ করেছেন, তাঁকে পুণ্যবান বাবা-মায়ের পাশে কবর দেওয়া যাবে না। পারিবারিক কবরস্থানটি যথেষ্ট বড়। কোণার দিকে রেখাকে কবর দেওয়া হোক। শত কথা খরচের পরে অবশেষে জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত ও পরাজিত রেখা বাবা-মায়ের কোলে ঠাঁই পেলেন।

গত রাত ছিল নিদ্রাহীন। আজও কারোর চোখে ঘুম নেই। রেখার কবরের কাছে ওমর খান ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন সারা রাত। একটু দূরে মুকুল।মেয়েরা কবরস্থানে ঢুকতে পারবে না। ঈমাম সাহেবের নির্দেশ মেনে ভিতরে না যেয়ে দেওয়ালের বাইরে সারারাত দাঁড়িয়ে রইলো শিমুল ও মৌরী। প্রাচীরটা বেশি উঁচু না,এখান থেকে রেখার কবর দেখা যায় স্পষ্ট। রিয়া যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু মৌরী বললো,”আমাদের মা চলে গিয়েছেন। আমরা যতক্ষণ পারি, আমাদের মায়ের কাছাকাছি থাকার চেস্টা করছি। আমাদের ফিলিংস আমাদের মধ্যে থাকুক। বাইরের লোকের সামনে আমরা মন খুলে কাঁদতে পারবো না,মায়ের সাথে কথা বলতে পারবো না। আপনি প্লিজ এখান থেকে চলে যান।”

ভোরের আলো ফুটলো। সকাল হলো। ওমরকে চলে যেতে হলো পলাশের কারণে। রিয়ার উপস্থিতি ছেলেমেয়েরা কেউ সহ্য করতে পারছিলো না। তবু তিনি জোর করে থেকে গেলেন।

তিনদিন পার হয়ে গেলো। পলাশকে পাওয়া গেলো না। ইচ্ছা না থাকলেও বাড়িতে তো ফিরে যেতেই হবে। তাছাড়া পলাশের জন্যেও সবার প্রবল দুশ্চিন্তা। ঠিক হলো আর দুইদিন থেকে বাড়ি ফেরা হবে। পঞ্চম দিন সকালে এলো আরেক দুঃসংবাদ। শিমুলের বড় মামা মারা গেছেন ঘুমের মধ্যে। ভদ্রলোক অসুস্থ ছিলেন। দুই বার স্ট্রোক করেছিলেন। তবে কয়েকমাস ধরে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটা চলা করতে পারতেন।বর্তমানে রাতে একাই ঘুমাতেন। কারণ তাঁর নাক ডাকার শব্দে কেউ টিকতে পারতো না।

তাঁর দাফনও সম্পন্ন হলো বাদ যোহর। মানুষ নানা কথা বলতে থাকলো। বোন তার প্রিয় ভাইকে নিয়ে গেছেন। এমন হয়,আকছার হয়। মৃত্যুর পরে আত্মা তার প্রিয় একজনকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

সকাল থেকে শিমুলের প্রচন্ড জ্বর। অনবরত প্রলাপ বকা। রিয়া মাথায় পানি ঢালছেন, সারা শরীর স্পন্জ করে দিচ্ছেন, জ্বর কমছেনা। ওমর এসেছিলেন সম্বন্ধীর জানাজায় অংশ নিতে। মেয়ের অবস্থা দেখে তাঁরা আর দেরি করলেন না। অ্যাম্বুলেন্স ও মাইক্রোবাস ভাড়া করে সপরিবারে রওনা হলেন , শিমুলকে ভর্তি করলেন হাসপাতালে। শিমুলের এই অবস্থা, পলাশের খোঁজ নেই, বাধ্য হয়ে বানু ফুপুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওমর-রিয়া উঠলেন খান বাড়িতে, সসংকোচে।

হাসপাতালে চলছিল যমে -মানুষে লড়াই। এরই মধ্যে মৌরীর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। বোর্ডে সপ্তম হয়েছে সে। আনন্দের বন্যা বইলো না বাড়িতে, মৌরী কান্নায় ভেঙে পড়লো। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করেছে সে, মা কি টের পাচ্ছেন? আরেকজন ভীষণ ভীষণ খুশি হতো, সে বাঁচবে কি না কে জানে? এতো কষ্ট আর নিতে পারছে না মৌরী।

এদিকে শিমুলের ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি পেয়েছেন রিয়া। অন্যের ডায়েরি পড়া শোভনীয় নয়, রিয়া এমন কাজ আগে কখনো করেন নি, তবু কি মনে করে সবার আড়ালে পড়তে শুরু করলেন শিমুলের ডায়েরি। এক পর্যায়ে হাত -পা ঠান্ডা হয়ে গেলো তাঁর। এই ডায়েরি সরিয়ে ফেলতে হবে দ্রুত।

রিয়া বাসায় এসে শিমুলের ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। ৬ টি ডায়েরি উদ্ধার হলো। রিয়া ডুবে গেলেন ডায়েরিতে।

“মায়ের সাথে আজ যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছি। মা হতভম্ব। কখনোতো আমার কাছ থেকে এমন ব্যবহার পায় নি।ইদানিং অকারণে রাগ লাগে। ইচ্ছা হয় সব ভেঙে চুরে ফেলি। এমন হওয়ার কারণ কি?আগের থেকে তো অনেক ভালো আছি। গ্রামে যখন পলাশ,আমি আর মা আলাদা বাড়িতে থাকা শুরু করলাম, তখন মনে হয়েছিলো আমাদের দুঃখের দিন শেষ। শুধু আমরা তিনজন। তারপরে আবার শহরে আসলাম,সেই ভয়ংকর খান বাড়িতে। এখন আমরা প্রভু, ওরা গোলাম। ডাইনি বুড়িটা মায়ের নামে সব লিখে দিল। এতো অল্প বয়সেই আমার মনে হলো,মায়ের নামে থাকলে দুদিনেই সব বেহাত হয়ে যাবে। আমার নামে সব করেও নিলাম। ইচ্ছা ছিলো মৌরীদের সাথে সেই ব্যবহার করবো যে ব্যবহার তার বাপ-মা-দাদী আমার সাথে করেছিল। পারলাম না। ওদের মুখগুলো দেখে এতো মায়া লাগলো! আমি ওদের ভালোবেসে ফেললাম। ওদেরকে দেখে এতোটুকু ঘৃণা বা ঈর্ষা হয়নি। ওরাতো আরও হতভাগ্য। আমার তো গর্ব করার মতো মা আছে,ও বেচারাদের তো তাও নেই। ভাবতেই বুক ফেটে যায়,প্রথম রাতে মিতুলকে একা পেয়ে আমি কি চিন্তা করেছিলাম। যতো দিন গেছে,ওদের প্রতি ভালোবাসা আমার আরও বেড়েছে। আমরা সাত ভাই বোন আর মা মিলে যদি বাড়িটায় থাকতাম,কি ভালোই না হতো। কিন্তু ডাইনি দুটোর জন্য শান্তি নেই। মা জানে না মন্জু কতো খারাপ ব্যবহার করেছে আমার আর পলাশের সাথে। আমি বলিনি কখনো। আজ মা’কে বললাম মন্জুকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কথা। মা জিজ্ঞেস করলো,”কেন?” আমি বললাম,”এমনি। ওকে আমার ভালো লাগে না।” মায়ের আবার প্রশ্ন, “কেন ভালো লাগে না?ও কি কোনো অন্যায় করেছে?” আমি বললাম,”আমরা কি কোনো অন্যায় করেছিলাম, তাওতো আমাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো।” মা আবার জানতে চাইলো মন্জু আমার সাথে কোনো অন্যায় করেছে কিনা। অন্যায় করে নি শুনে মা বললো,’বিনা কারণে তাকে চলে যেতে বলতে পারিনা শিমুল। দুনিয়ায় তার কেউ নেই। এই বাড়িতে বহু বছর ধরে আছে।” আমি মায়ের সাথে খুব রাগারাগি করলাম। আমার বক্তব্য ছিলো, আমার ইচ্ছার মূল্য দেওয়া হয়না। মা বললো,অন্যায় ইচ্ছার কোন মূল্য তার কাছে নেই। রাগারাগি করতে করতে মনে হলো,আরে,মন্জু থাকলেই তো ভালো। বিদায় দিলে সে কোনো না কোনো বাসায় কাজ নিয়ে নিবে,খাবে-দাবে,একদিন মরে যাবে। আমার তো তাহলে শোধ নেওয়া হবে না। আমি মায়ের উপরে খুব চোটপাট করছিলাম,মা তো এক অর্থে আমার বিরাট উপকার করলো।থ্যাংকস মা। কিন্তু মা’কে আমি মন্জুর শয়তানির কথা বললাম না কেন?কি যে অকথা-কুকথা সে বলতো আমাকে আর পলাশকে! উত্তরটা হলো, নিজের উপরে হওয়া অত্যাচারের কথা মা’কে বলতেও আমার ভীষণ লজ্জা লাগে,অন্য কাউকে দূরের কথা।”

রিয়া বেছে বেছে তাঁর শাশুড়ীর মৃত্যুদিনের পৃষ্ঠা বের করলেন। ঐদিনই শিমুলের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছিল, ঐদিনই তাঁর বাবা ও শাশুড়ি মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

“প্লেস করবো জানতাম। তাই বলে সারা দেশে প্রথম? ওহ্ আল্লাহ! ভাবতেও পারিনি। মা আমার এমন কান্নাটা কাঁদলো আমাকে জড়িয়ে ধরে। তোমার জন্য ই তোমার মেয়ে প্রথম হয়েছে মা। ছোট বেলা থেকে মগজে গেঁথে দিয়েছো ভালো করে লেখাপড়া করতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। খান বাড়িতে ও তোমার ভাইদের বাড়িতে সারাদিন হাড়ভাংগা খাটুনির পরও রাতে আমাকে পড়াতে,গল্প শোনাতে তোমার এতোটুকু ভুল হতো না। তখন ভালো বুঝতাম না,এখন বুঝি, ঐ সময় তোমার কতো কষ্ট হতো, তোমার ক্লান্ত শরীর ঘুমাতে চাইতো, কিন্তু তোমার অসম্ভব সুন্দর, চিরসবুজ মন আমাকে পড়াতে বলতো,পলাশকে ব্যায়াম করাতে বলতো, আমাদের সামনে হাসিমুখে থাকতে বলতো, আমাদের রূপকথার গল্প শোনাতে বলতো, আমাকে হতাশ না হয়ে জীবনের প্রতি আশাবাদী আর উৎসাহিত করতে বলতো।তুমি শরীরের কথা না শুনে মনের কথাই শুনতে। আজ আমি যা,তা তোমার জন্যই মাগো। তুমি নাকি লেখাপড়ায় ভালো ছিলেনা, কিন্তু আমাকে যে কি সুন্দর করে পড়াতে! এজন্য লেখাপড়াকে কোনদিন ভয় লাগেনি আমার।গ্রামে আমরা তিনজন যখন এক বাড়িতে থাকতাম, তখনো আমার উঁচু ক্লাসের পড়া দেখিয়ে দিতে,ইংরেজি আর অংকটা পারতে না অবশ্য, আলিফ,বা,তা, সা কি যে কঠিন লাগতো আমার, অথচ তুমি কি সুন্দর করে আমাকে আরবী শেখানো শুরু করলে, স্কুলে আরবী পরীক্ষা আমার কাছে পানির মতো সহজ হয়ে গেলো, তোমার তত্বাবধানে আরবী শিখে তিন মাসের মধ্যে আমি কোরান শরীফ খতম করলাম। ঐদিন গুপ্তধনের মতো তুমি একটা মোটা আর লম্বা গলার চেইন বের করলে। খান বাড়ি তোমার গয়নাগাটি সব আত্মসাৎ করেছিল, এই হারটাকে পারে নি।তোমার আম্মার হার বলে এটাকে তুমি বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলে। লুকিয়ে রেখেছিলে কোথাও। হারটা তুমি আমার গলায় পরিয়ে দিলে। তোমার উপহার। পলাশ পারবে না জেনেও তুমি স্লেটে বড় করে অআকখ লিখে পড়ানোর চেষ্টা করতে। ও ভালো করে বুঝতে পারছে না জেনেও তুমি ওকে বুকে জড়িয়ে রূপকথার গল্প, ঈশপের গল্প শোনাতে। কি মধুর সেই দিনগুলো। হাবিয়া দোজখে জন্ম থেকেই বাস করছিলাম, তারপরে তুমি,আমি আর পলাশ যখন একসাথে থাকতে লাগলাম,আমার দগ্ধ শরীর ঠান্ডা হলো। আমার লেখাপড়া সংক্রান্ত সব কৃতিত্ব আমি তোমাকে উৎসর্গ করলাম। তুমি সাধারণ মানুষ নও।

কিন্তু মা, তুমি তো আরও অনেক কিছু শিখিয়েছো। সেই শিক্ষাটা আমি গ্রহণ করতে পারছি না কেন? আমার মন যদি তুমি দেখতে পেতে,তাহলে আঁতকে উঠতে। কুচকুচে কালো। রাগ, ঘৃণা, প্রতিশোধের আগুনে আমার মন পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। তোমাকে যদি আমি অনেক গোপন কথা বলতে পারতাম! কিন্তু আমি তোমাকে কিছুই বলতে পারিনা,শুধু রাগ টুকু তোমার উপরে ঢেলে দিই। তুমি আর হাসান মামা কতোবার চেষ্টা করেছো আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিতে। আমি যাইনি,উপরন্তু রেগে আগুন হয়েছি,উল্টাপাল্টা কথা বলেছি, ভাত না খেয়ে থেকেছি। আমি এমন কেন?অতি ভালো মায়ের অতি খারাপ মেয়ে?আমি যদি অতি খারাপই হই তারজন্য দায়ী কি আমি না নর্দমার কীটগুলো? এর উত্তর জানার জন্য তোমাকে সব খুলে বলা দরকার। সব ঘটনা, আমার চিন্তা ধারা, সব তোমাকে খুলে বলা উচিৎ। কিন্তু পারছি না যে!

নিমকহারাম বুড়িটা বলে কিনা আমি এমন রেজাল্ট করেছি বাপ দাদার মেধার গুণে। ডাইনিটাকে পুড়িয়ে মারতে ইচ্ছা করছে। শয়তানি কমেনি একফোঁটাও।

মৌরীর নানা মারা গেছে। এক ব্যর্থ বাবা। তিনটা ছেলেমেয়েই অমানুষ। আমি নিষেধ করেছিলাম মা তোমাকে ওখানে যেতে। কি দরকার মৌরীদের ওদের নানাকে শেষ দেখার? কি দরকার ওদের ঐ জেল খাটা মহিলাকে দেখার?ওরা তো ওই মহিলা বা তার বাড়ির কাউকে ফিল করে না? খামাখা ওদের মনে বাড়তি চাপ পড়া।

তারপরও ধন্যবাদ মা,সুযোগ করে দিলে।”

পরের তারিখে লেখা, ” মন শান্ত হচ্ছে না কেন?”

তিন চারটা পৃষ্ঠাতে নানা কথা লেখা। একটা লাইনে রিয়ার চোখ আটকে গেলো, “বালিশ ট্রিটমেন্ট খুব সহজ ও ফলপ্রসূ ট্রিটমেন্ট হলেও আমার জন্য শান্তিদায়ক না।”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here