নানান বরণ মানুষ রে ভাই ২৯ তম পর্ব বড় গল্প

0
257

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
২৯ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

বুবলির কথা

বজ্রাহতের মতো বসে আছি আমি আর মেজ আপা। আমরা ভয়ংকর খুনীর সন্তান! সবসময় নিজেকে দুর্ভাগা সন্তান মনে হতো। ভাবতাম,ভালোবাসাহীন-নীতিবর্জিত-অবিবেচক-উচ্চাভিলাষী বাবা-মায়ের ঘরে কেন জন্মালাম? স্কুলে রচনা লিখতে দিতো, ” তোমার প্রিয় মানুষ কে?”
বন্ধুরা যার যার বাবা বা মায়ের কথা লিখতো। কেন প্রিয় এটা বোঝাতে বাবা-মায়ের নানা গুণাবলি তুলে ধরতো। আমি ভেবেই পেতাম না কার নাম লিখবো। দাদী,নানাভাই আর নানু আমার খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। তাঁদের কথাই ঘুরে ফিরে লিখতাম। আম্মু হোমওয়ার্ক, ক্লাস ওয়ার্ক সব খাতা চেক করতেন। রচনাগুলোও তাঁর চোখে পড়তো। এসময়ে তাঁর কঠিন মুখ আরও কঠিন হয়ে যেতো। কিন্তু কিছু বলতেন না। মেজ আপাও স্কুলে একই কাজ করতো। তার প্রিয় মানুষদের তালিকায় নানাভাই, নানু,দাদী,মামা-খালা এবং আমার নাম ঘুরে ফিরে আসতো, কিন্তু ভুলেও বাবা-মায়ের কথা না। আম্মু দুই আপার সব খাতা ই সবসময় চেক করতেন, রচনাগুলো দেখতেন, কিন্তু কোনো অভিযোগ বা রাগারাগি করতেন না।একদিন শান্তভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ” তোমার প্রিয় ব্যক্তির মধ্যে আমি পড়ি না?” ভয়ে ভয়ে উত্তর দিয়েছিলাম,”সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তির কথা লিখতে বলেছে।” আম্মু বলেছিলেন, “তাহলে আমি তোমাদের তিন বোনের কারোরই প্রিয়তম ব্যক্তি না। প্রিয়তম না হই, এমনি প্রিয় ব্যক্তিদের মধ্যে পড়ি কি?” কি জটিল প্রশ্ন! আমাকে চুপচাপ দেখে আম্মু বলেছিলেন, ” বুঝেছি। আমার কারো প্রিয় হওয়ার ইচ্ছাও নাই।” মেজ আপা একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলো,”আম্মু, পৃথিবীতে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো কাকে?” সরল প্রশ্ন, কিন্তু আম্মু ভীষণ চমকে উঠেছিলেন। তারপরে চেঁচিয়ে উঠে বলেছিলেন, “তাতে তোমার কি? খালি পাকা পাকা কথা। আমি কাউকেই ভালোবাসি না। যাও এখান থেকে। ” কিশোরী বয়সে যদি কেউ শোনে মা তাকে ভালোবাসে না, তাহলে তার মনের অবস্থা কেমন হয়,তা আমরা তিন বোনই ভালো করে জানি।

অনেক কষ্ট জীবনে ভোগ করেছি,কিন্তু এতো কষ্ট, লজ্জা, অপমান জীবনে পাইনি। আম্মু খুনী। তিন তিনটা মানুষের খুনী।

মেজ খালা প্রথম থেকেই আমাদের জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন। কোমল গলায় বললেন,”চুপ করে আছিস কেন? এতো কাঁপছিসই বা কেন? আম্মু খুনী, এজন্য? ”

আমরা কথা বলতে পারলাম না। গলার কাছে ভীষণ ব্যথা। মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবো।

মেজ খালা বললেন,”তোদের মা খুনী না, বরং তাকেই খুন করা হয়েছে বহুবার। তার নিজের বাবা,সৎ মা,দাদী,মামা-মামীরা বারবার তাকে নির্মম ভাবে খুন করেছে। একটা ছোট্ট, মিষ্টি, মায়াভরা,মেধাবী মেয়েকে তার স্বজনেরা হত্যা করেছে বারবার। তাকে জোম্বি বানিয়ে ছেড়েছে। মা’কে ঘেন্না করছিস, কিন্তু এতো কিছু শুনে তার জন্য মায়া হচ্ছে না? ঠান্ডা মাথায় তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা কর্, দেখবি তোর মায়ের মতো দুঃখী, অসহায় মেয়ে দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টা নেই। ”

মেজ আপা ধরা গলায় বললো,”এগুলো আমাদের জানালে কেন? একবার ভাবলে না,এগুলো জানার পরে আমাদের মনের অবস্থা কেমন হবে?”

” ইনি সবকিছু তোদের দু’জনকে জানানোর জন্য বড্ড অস্হির হয়ে পড়েছিলেন।” নানীকে দেখিয়ে মেজ খালা বললেন, “মায়ের প্রতি তোদের রাগ,ক্ষোভ, বিদ্বেষ ক্রমশ বাড়ছিল। বুবলি তো রাগ করে আজ পাঁচটা বছর মা’কে না দেখে আছে। সবাই মিলে বলে কয়েও ওর অভিমান ভাঙাতে পারিনি আমরা কেউ। এদিকে তোদের মা ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে মেয়েকে দেখতে না পেরে।এতো যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে কোন্ দিন স্ট্রোক করে মরে,কে জানে! আমরা আপাকে যেমন মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বুঝতে পারি,তোরাও যেন তাকে সেই ভাবে বুঝতে পারিস।তার রাগ, জেদ, নানারকম খারাপ আচরণের পিছনে যে কান্না,হাহাকার, অসহায়ত্ব, মানসিক অসুস্থতা লুকিয়ে আছে, সেটাকে যেন তোরা অনুভব করতে পারিস, ভালোবেসে তার ক্ষতগুলোতে মলম লাগাতে পারিস। আপার অতীত না বললে তোরা তাকে তার মতো করে ফিল করতে পারবি না, ভালোবাসতে পারবি না। আর তোদের ভালোবাসার অভাবে তোদের জনমদুখি মা পাহাড় সমান অভিমান আর কষ্ট নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে যাবে,এটা তো হতে দেওয়া যায় না।”

“তাহলে আরও অনেক আগে, আমরা যখন ছোট ছিলাম,তখন সবকিছু খুলে বলো নি কেন?”

” কিছু কঠিন সত্য থাকে যেগুলো সব বয়সে হজম করা যায় না মা। ”

“খালা, আম্মু খুনী? আমরা খুনীর সন্তান? কিছুতেই মানতে পারছি না খালা।”

“তোরা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো,সবচেয়ে দুঃখী, সবচেয়ে অসহায় মায়ের সন্তান। আমার দেখা কোনো মেয়ে আমার আপা আর আমার মায়ের মতো ভালো না। আমার মা,আমার হারিয়ে যাওয়া সোনা মা।”

মেজ খালার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

আরেকজনের চোখ দিয়ে অবিরল পানি গড়াচ্ছে। নানী। কোনোদিন কল্পনা ই করিনি, ইনি আমাদের সৎ নানী। যতোটুকু সময় কাছে পেতেন, আদরে-মমতায়-ভালোবাসায় আমাদের ভরিয়ে রাখতেন। আমাদের অন্যান্য খালাতো বা মামাতো ভাইবোনকে এতো ভালোবাসতেন না। নানীর এই ভালোবাসা কি তবে অভিনয় ছিলো? নাঃ, তা হতেই পারে না। অথচ ইনিই সেই রিয়া যিনি কিনা আমার আম্মুকে মেরে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলতেন।

মেজ খালা আলমারি খুলে কয়েকটা ফটো বের করলেন। একটা তিন চার বছরের বাচ্চা মেয়ের ছবি। নিষ্পাপ, মায়াভরা বড় বড় দুটো চোখ। ভারি মিষ্টি মুখ। দেখলেই কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছা করে। সাদা-কালো ফটো।

মেজ খালা বললেন,”ইনিই তোদের মা, আমাদের সবার বড় বোন। মা আমার এক দূর সম্পর্কের চাচাকে অনুরোধ করে আপার এই ছবিটা তোলার ব্যবস্থা করেছিলেন। ঐ সময়ে আপার আব্বারও নিজের দামী ক্যামেরা ছিল। কিন্তু সেটা দিয়ে তিনি তাঁর প্রথম সন্তানের কোনো ছবি তুলেন নি। নিজের, সেকেন্ড ওয়াইফের, নতুন শ্বশুর বাড়ির লোকজনের,বন্ধু বান্ধবদের বিস্তর ছবি তুলেছেন। এই যে বাচ্চা মেয়েটা, তখনই সে যখন তখন বাপ,সৎমা,দাদীর, সৎ মায়ের মা’র, এমনকি বাড়ির কাজের লোকদের হাতে নিয়মিত মার খেতো, ছোট্ট একটা ভাই-এর দেখাশোনা করতো, গভীর রাত ছাড়া মায়ের দেখা পেতো না, মন ভরে তো দূরের কথা পেট ভরেও দিনের পর দিন খেতে পেতো না, কেউ তাকে আদর করতো না মা ছাড়া, তার চেহারা নিয়ে নানা কথা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলা হতো, সে কালো, সে দাঁড়কাক, সে শকুন, সে লোভী, সে পেটুক,সে অলক্ষুণে। প্রতিদিন সে তার সবচেয়ে প্রিয় দুইটা মানুষ মা আর ভাইএর চরম দুর্দশা দেখতো। বল্ এখন, এতো ভয়ংকর পরিস্থিতিতে বছরের পর বছর থাকলে একটা শিশুর মনোজগতে বড় পরিবর্তন হয় কি না।”

আমরা আরেকটা ছবি দেখলাম। এক আদরকাড়া কিশোরী, চোখ দুটিতে রাজ্যের মায়া, এটাও আম্মুর ছবি, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়।

পরের ছবিটিতে দুদিকে বেণী করা আম্মু,এসএসসির ফর্ম ফিলআপের সময় তোলা। এখানেও মায়াবী মুখ, টলটলে দুটি চোখ।

অনার্সে পড়ার সময় তোলা আম্মুর ফটো। কঠিন চেহারা, দু’চোখে রুক্ষ দৃষ্টি। ততোদিনে অলরেডি আম্মু খুনী। ইন্টারমিডিয়েটেট রেজাল্ট আউট হওয়ার দিনই তিনি নিজের দাদীকে বালিশচাপা দিয়ে খুন করে গায়ে খুনীর তকমা লাগান।

পরের ছবির মেয়েটাকে চিনতে পারলাম না। হাড্ডি চামড়া সর্বস্ব একটি মেয়ে, মাথায় চুল নেই বললেই চলে, চোখ দুটো কোটরের ভেতরে ঢোকা, সেই চোখে বোবা দৃষ্টি, সরু সরু হাত-পা। আমাদের চোখে প্রশ্ন দেখে ছোট মামা বললেন,”চিনতে পারছিস না,তাইতো? তোদের মা। দুই বোনইতো দেখি আঁতকে উঠলি। বাঁচার কথা ছিলো না আপার। সাড়ে চার-পাঁচ বছর এমন চেহারা নিয়েই ছিলো সে। কাউকে চিনতো না, কথা বলতো না, কাঁদতো না,হাসতো না। চুপ করে খাটে হেলান দিয়ে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতো, মাঝেমধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো, সেই দীর্ঘশ্বাসের ভাষা বুঝতে পেরে আমরা কেঁদে ফেলতাম, কি ভয়াবহ হাহাকার ঐ দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে। পৃথিবী খুব নিষ্ঠুর আচরণ করেছে আপার সাথে। তোরা আর তাকে কষ্ট দিস না। আমরা জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেও তাকে পুরোপুরি সুস্থ করতে পারিনি, তোরা তাকে আগলে রেখে সুস্থ করে দে।”

মেজ খালা একটা বড় ছবির ফ্রেম দিলেন আমাদের হাতে। আমরা দুই বোন ই চমকে উঠলাম। মনে হচ্ছে মেজ আপা বসে আছে ফ্রেমের মধ্যে।
খালা ভেজা গলায় বললেন,”ইনি আমাদের মা। ”

আমরা অনেকক্ষণ ধরে রাখলাম ফ্রেমটা। হাত বুলালাম ছবিটার উপরে,যেন ছবির মানুষটা আমাদের আদর অনুভব করতে পারছেন। এই প্রথম তাঁর সম্পর্কে জানলাম,এই প্রথম তাঁকে দেখলাম। আমাদের নানী,রেখা যার নাম, যিনি এই নির্মম পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। তাঁর বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল ছেলেমেয়েরা। কন্যা একজন খুনী, এই ভয়াবহ সত্যটা তিনি বুঝে ফেলেছিলেন মন্জুর মৃত্যুর পর, এবং ঐ সময়ই বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর মেয়ে শুধু মন্জুরই নয়,নিজের দাদীরও খুনী। সন্তান স্নেহে কাতর মা এতোবড় অন্যায় গোপন রাখার ভার আর নিতে পারছিলেন না, তীব্র আত্মগ্লানিতে আর মেয়ের প্রতি নিদারুণ অভিমানে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন।

খালা আরেকটা ফ্রেম আমাদের হাতে দিলেন। মা’কে ঘিরে সাত সন্তান, সবাই হাসছে, নির্মল হাসি।
খালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,”ঐ সময়টা ছিল আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়,সবচেয়ে রঙিন সময়। এতো সুন্দর সময় আমাদের জীবনে আর আসে নি, আসবেও না কোনদিন। ”

ছবিটা দেখলাম। ঐ যে আমাদের সদ্য তরুণী মা, কি সুন্দর প্রাণখোলা হাসি, দুহাতে মেজ খালাকে জড়িয়ে ধরে আছে, মেজ খালা আবার তাদের মায়ের কোমর পেঁচিয়ে আছে, আমাদের মায়ের অন্য পাশে বড় মামা মানে মুকুল মামা,কিশোর হলেও স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে, মাথাটা রেখেছে তার বড় আপার পিঠে, ছোট্ট মুকুল মামা দুটো দাঁত বের করে হাসছে তার মায়ের কোলে, এরপরে পিচ্চি ছোট খালা যাকে আমরা সবাই মুমু বলে ডাকি,আর এইতো সেজ খালা। এই দুই বোন হাসিমুখে দুইদিক দিয়ে জাপটে আছে যাকে, তাকে প্রথম দেখলাম। সহজ,সরল চেহারা,মুখে চওড়া হাসি। চাহনি, হাসি,দুটো পা আর বডি ল্যাংগুয়েজ স্পষ্ট চিনিয়ে দেয় তাকে। আমাদের পলাশ মামা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here