নানান বরণ মানুষ রে ভাই ৩৫ তম পর্ব

0
273

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
৩৫ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

আম্মুর একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। আর ঘটেছে আমি যেদিন বাসা থেকে বের হয়ে হলে উঠি,তখন থেকেই। এটা ময়না খালার কাছ থেকে পাওয়া রিপোর্ট। আম্মু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, তাহাজ্জুদ পড়েন, ফরজ রোজা তো করেন ই,নফল রোজাও করেন। আব্বু -আম্মু হজ্জের জন্য ও আবেদন করেছেন।

ভীষণ খুশি হলাম,ভীষণ অবাকও। আম্মুকে কখনো নামাজ -রোজা করতে দেখিনি। আমাদের ধর্ম পালনেও আম্মু বিস্তর বাধা দিতেন। বিষয়টা আমাদের খুব খারাপ লাগতো।

আমরা নামাজ শিখেছি দাদীর কাছ থেকে।সূরা,দোয়া,দরুদ সবই দাদী,নানাভাই, নানু বা কোনো খালার কাছ থেকে শেখা। মেজ আপার শেখার আগ্রহ প্রবল। সে স্কুলের বন্ধু বা ধর্ম স্যারের কাছ থেকে আরবী শিখে ক্লাস সেভেনে থাকতেই কোরান শরীফ খতম করেছিল। এখন কোরান শরীফের আয়াতগুলোর অর্থ, তাফসির সব তার জানা। নিয়মিত কিছুটা সময় কোরান শরীফ পড়া তার অভ্যাস। আমার মনে হয়, আমার আপন নানী,মেজ খালা,মেজ আপা এরা সব এক ধাঁচের। ধর্মনিষ্ঠ, দায়িত্বপ্রবণ, নিঃস্বার্থ, মমতাময়ী। নানী আর মেজ খালার সাথে মেজ আপার পার্থক্য হলো,মেজ আপা প্রয়োজনে কঠোর,তেজদীপ্ত।

আহা রে, আমার মা টাও এই দলে পড়তেন যদি না কঠিন মানসিক ব্যধি, কঠিন পরিস্থিতি তাঁকে পর্যুদস্ত না করে ফেলতো।

ফজরের নামাজ পড়ে আব্বু-আম্মুর ঘরে উঁকি মেরে দেখি, আম্মু কোরান শরীফ পড়ছেন। আম্মুকে আমার নানী খুব যত্ন করে নামাজ,কোরান শরীফ পড়া শিখিয়েছিলেন, আমি জানি। ছোট্ট বেলা থেকে কলেজ লাইফ পর্যন্ত আম্মু খুবই ধর্মপ্রাণ, সবদিক থেকে লক্ষী একটা মেয়ে ছিলেন। তারপর নিয়তি আম্মুকে একটা পবিত্র জীবন থেকে ছুঁড়ে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিলো।

সকালে খাওয়ার সময় আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম,”আম্মু,তুমি কোরান শরীফ পড়তে পারো,আমিতো জানতামই না। নতুন শিখেছো?”

“দূর বোকা, নতুন শিখবো কেন? ছোটবেলাতে শিখেছি। ”

” আমি কোরান শরীফ পড়তে পারি না আম্মু। খুব দুঃখ লাগে এজন্য। অর্থ পড়েছি অবশ্য। কিন্তু তিলাওয়াত করতে খুব ইচ্ছা হয়। আমাকে শিখিয়ে দিবে আম্মু? ”

” আপাতত আরবী টিচার রেখে দিই।”

“তুমি কার কাছে শিখেছিলে আম্মু?হুজুরের কাছে নিশ্চয়?”

আম্মুর মুখ সাদা হয়ে গেলো। আমি আসলে আম্মুর রি-অ্যাকশন দেখতে চাচ্ছিলাম।

আব্বু তাড়াহুড়ো করে বললেন,” তুই আর নীতু আদিবকে বল্ বাবুনিকে যেনো সপ্তাহে দুদিন অন্তত আমাদের কাছে পাঠায়। আর ভালো কথা, তোর জন্য আমার একটা ছেলেকে ভারি পছন্দ। তোর নিজের পছন্দ থাকলে বল্। আছে কোনো পছন্দ? ”

পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে, আম্মুর মন অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য আব্বুর এতো কথা।

“বুঝলে, আতাউর সাহেব তাঁর ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছেন। ছেলে সম্পর্কে তো আমার চেয়ে তুমি ভালো জানো। আতাউর সাহেব বারবার আমার কাছে ছেলের বৌ খুঁজে দেওয়ার অনুরোধ জানান। আমাকে নক করছেন আর কি। মনের ইচ্ছেটা বলে দিলেই পারেন বুবলিকে উনাদের পছন্দ। আমি মেয়ের বাপ হয়ে নিজে কথা তুলবো নাকি?”

আম্মু কিছুই শুনছেন না। প্লেটের উপরে হাত। শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। স্পষ্ট বুঝা যায়, আম্মু এই মুহূর্তে এখানে নেই, হারিয়ে গেছেন অন্য কোন জগতে।

কি করি এখন? আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাচ্ছিলাম, মা-ভাইএর কথা আম্মুর মনে আছে কি না। কিন্তু নিজেকে এখন গুরুতর অপরাধী মনে হচ্ছে।

“আম্মু,খাচ্ছো না কেন? খাও। ও আম্মু। ”

আম্মু আমার দিকে তাকালেন । তারপরে আস্তে করে উঠে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। আমার সাহস হলো না আম্মুকে বাধা দেওয়ার।

আব্বু চাপা স্বরে বললেন,” তোমার মা না খেয়ে উঠে গেলো, তোমার ভালো লাগলো বুবলি?”

“আব্বু,আমার কোন্ কথাতে আম্মু কষ্ট পেয়েছেন? কষ্ট পাওয়ার মতো কি বলেছি আমি?”

আব্বু বললেন,”আম্মুর অতীত নিয়ে কখনো কথা বোলো না বুবলি। ”

“কেন আব্বু? আম্মুর অতীত নিয়ে কোনো কষ্টের স্মৃতি আছে? আমাকে বলো না আব্বু? আম্মুতো নানাভাই -নানুর সবচেয়ে প্রিয় সন্তান, মামা-খালাদের সবচেয়ে প্রিয় বোন। তাহলে আম্মুর কি সমস্যা? কি কষ্ট? মেয়ে হিসাবে আমার তো জানার অধিকার আছে আব্বু।”

আব্বু বললেন,”এতো কথা বলার সময় এখন নেই। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তোমার মা আজ অফিসে যাবেন না। মায়ের দিকে খেয়াল রেখো। আর যেটা বললাম,অতীত নিয়ে কোনো কথা নয়।”

“আব্বু, তোমার অফিসের যথেষ্ট দেরি আছে। তুমি আমাকে বলো, আম্মুর কি সিরিয়াস কোনো সমস্যা আছে?থাকলে তুমি আমার আর মেজ আপার সাথে শেয়ার করো,প্লীজ। হয়তো আমরা সবাই মিলে কোনো সমাধান বের করতে পারবো। সন্তান হিসেবে মায়ের সুবিধা অসুবিধা জানা আমাদের খুবই দরকার। আমরা এখন বড় হয়েছি। একটা পর্যায়ে বাপ-মা কিন্তু সন্তানের বন্ধু হয়ে যায়। সুতরাং শেয়ার করো আব্বু,প্লীজ। ”

” তেমন কিছু না। আমি উঠি বুবলি।”

আব্বু বের হয়ে যাওয়ার সময় বললেন,”তোমার আম্মু ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছেন। ঘুম থেকে ডেকো না। ”

আম্মুর ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার সময়। সকালে প্রায় পুরো খাবারটাই নষ্ট করেছিলেন। তার মানে সারাটা দিন না খাওয়া। আর জীবনে যদি আম্মুকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করি!

প্রায় পুরো সময়টা আমি আম্মুর কাছে বসেছিলাম। অঘোরে ঘুম। মুখটা ভীষণ শুকনো,ভীষণ করুণ। আহা রে আমার মা! বড় দুলাভাই , তাঁর পুরো পরিবার,আরও কিছু মানুষ আম্মুকে ভীষণ ঘৃণা করেন। তাঁরা জানেন না, কি ভয়ানক মানসিক ব্যাধিকে সঙ্গী করে বেঁচে আছেন এই মহিলা। জানানোও যাবেনা কখনো।

বড় মামা এসেছেন। একাই। আম্মু বললেন,” কি রে মুকুল, তুই আলাদা হয়ে গেলি, কিছু বলি নি। কিন্তু এখনো তুই ওই বাড়িতে মাসে একবার-দু’বার মেহমানের মতো বেড়াতে যাস,এটা কেমন কথা? তোর বৌও বা কেমন রে?মেয়ে দুটাকে শেষ কবে নিয়ে গেছিস,মনে আছে? খুব খারাপ কথা মুকুল। তুই কি এই শিক্ষা পেয়েছিস?এতো ক্রিটিকাল কন্ডিশন, যে কোনো সময় চলে যাবেন, এখন তো তোদের ঐ বাড়িতেই উঠে আসা উচিৎ। ”

” খোঁজ খবর রাখিতো আপা।”
“এর ওর কাছ থেকে শুনে খোঁজ খবর নিয়েই দায়িত্ব সারা হয়ে গেলো মুকুল? উনি তোর জন্য, তোর মেয়েদের জন্য ছটফট করেন, দেখতে চান,
আর তোরা যাস না।খুব খারাপ কথা মুকুল। তোরা ভাড়া বাসা ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দে, তারপরে নিজেদের বাড়িতে উঠে আয়। ”

“স্যরি আপা, এই আদেশ কোরো না। এই বাড়িতে কিছুক্ষণ থাকলে আমার দম আটকে আসে। তুমি বলছো যখন,তখন না হয় ডেইলি একবার ঘুরে আসবো।কিন্তু ওখানে থেকে যাওয়ার কথা বোলো না।”

” কেন বলবো না? ওটা কি ভূতের বাড়ি? ভয় লাগে তোর?”

” ওসব কথা থাক আপা। উনার অবস্থা যখন-তখন। কোথায় দাফন হবে চিন্তা করেছো? তুমি যেটা বলবে,সেটাই হবে।”

“মুকুল, তুই কি মানুষ ? একজন মানুষ বেঁচে আছেন, তাঁর দাফন কাফনের চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিলি? ছি! উনি অনেকদিন বাঁচবেন ইনশাআল্লাহ। ”

রিয়া নানুর জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হলো। দুই ভাই বোনের কেউই মা উচ্চারণ করছেন না। মেজ খালা,সেজ খালাও ডাকেন না। এটা কেমন কথা?একসময়ে উনি অনেক অন্যায় করেছেন মানছি, পরে তো প্রায়শ্চিত্ত কম করেন নি। আমরা কখনো বুঝতেই পারিনি, আম্মু তাঁর পেটের মেয়ে নন, আমরা তাঁর আপন নাতনি নই। নানীর জন্য অনেক দোয়া করলাম।আল্লাহ,আমার নানীকে সুস্থ করে দাও,আরও অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখো।

আম্মু আজ আমার প্রশ্নে এতো রি-অ্যাক্ট করলেন কেন? রাগ করেন নি, বিরক্ত হোন নি,চোখের পানি ফেলেন নি,শুধু কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন। আম্মু কি স্মৃতিচারণ করছিলেন? ছোট্ট শিমুল ফ্রক আর সালোয়ার পড়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসা, রেখা পরম যত্ন ও মমতার সাথে মেয়েকে কোরান শরীফ শিক্ষা দিচ্ছেন। পাশেই খাটে শুয়ে আছে ছোট্ট পলাশ। তিনজনের সুখী জীবনের চিত্র।

শাশুড়ির ডাকে সাড়া না দিয়ে যদি গ্রামেই থেকে যেতেন রেখা? আমি ভাবতে লাগলাম। কি হতো রেখা যদি আর শহরে না আসতেন? শিমুল অদম্য মেধাবী, গ্রামের স্কুল থেকেই তিনি এসএসসিতে তাক লাগানো রেজাল্ট করেছিলেন, তখনও তাই-ই করতেন। এইচএসসি মোটামুটি মানের কলেজ থেকে দিলেও অদম্য মেধার জোরে ঠিকই খুব ভালো ফল করতেন। মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তিনি হেসে খেলে চান্স পেতেন। যে ভাবেই হোক, রেখা শিমুলের লেখাপড়া চালিয়ে যেতেন,বন্ধ করতেন না। নিজে গায়ে খেটে, জমি বিক্রি করে, যে ভাবেই হোক। তাঁর সব গয়না কেড়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন শাশুড়ি। আব্বুর মতো কোনো একজন ভদ্র ছেলে শিমুলের প্রেমে পড়তেন।মেয়ের বিয়েতে জাঁকজমক করার অবস্হা রেখার ছিলোনা, সাধাসিধা ভাবেই শিমুলের বিয়ে হতো।কিন্তু শিমুল ভালো থাকতেন,সুস্থ থাকতেন। মা -ভাইয়ের দেখাশোনা নিজেই করতেন। এদিকে শিমুলের দাদী না খেয়ে মরতেন। শিমুলের বাবা আর সৎ মা দাদীর গুপ্ত সম্পদের মালিক হতেও পারতেন, নাও হতে পারতেন না। কিন্তু তাঁদের স্বভাবের পরিবর্তন হতো না।সারাজীবন অনাচারে মত্ত থাকতেন। মৌরিদের পাঁচ ভাইবোনের কি গতি হতো, কে জানে!

তবে ঢাকায় না আসলে আমার মা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তেন না, খুনি হতেন না, স্বেচ্ছাচারী-ভীষণ বদরাগী হিসাবে দূর্নাম কুড়াতেন না, আমার নানীকে আত্মহত্যা করতে হতো না, হয়তো এখনো তিনি বেঁচে থাকতেন, আমাদের আদরে আদরে ভরিয়ে রাখতেন। পলাশ মামা হয়তো এতোদিন বাঁচতেন না, তবে যতোদিন বাঁচতেন, মা-বোনের আদরে, হেসে খেলে, আনন্দের সাথে বাঁচতেন। জীবনের শেষ কটা দিন তাঁকে অসহনীয় কষ্ট, যন্ত্রণা, ভয়, অভিমান আর অসহায়ত্ব ভোগ করতে হোতো না।

আবার এগুলোর উল্টোটাও হতে পারতো। হয়তো আরও ভয়ংকর কিছু ঘটতো। হয়তো শিমুলের মামারা রাতের আঁধারে ঘরে আগুন লাগিয়ে বোন,ভাগনে,ভাগনিকে মেরে ফেলতেন, সবাই বলতো দুর্ঘটনা।

আমরা কেউ ভবিষ্যৎ দেখতে পাইনা। কেউ জানি না,সামনে কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here