ভাড়াটে ৪.

0
377

ভাড়াটে

৪.
—“কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
কনক সদর দরজার কাছে যেতে গিয়েও আর গেল না। ধীরস্থির পায়ে বাবার সামনাসামনি সোফায় বসলো। উচ্চস্বরে স্নেহা আক্তারকে ডেকে উঠলো, “আম্মু, কফি আনো।”
তারপর আবার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“বাহিরে যাবো একটু। কেন?”
—“তোমার কালকে মাত্র বিয়ে হয়েছে। আজকে আর বাসা থেকে বের হতে হবে না। রুমে যাও।”

প্রচন্ড বিরক্তিতে তিক্ত চোখে তাকালো কনক। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো, “জোড় করে বিয়ে করিয়েছ। ঠিকাছে, মেনে নিয়েছি। এখন কি আমার ব্যক্তিগত স্বাধীনতাটাও ছিনিয়ে নিবে?”
নাবিল সাহেদ খুকখুক করে একটু কাশলেন। সামান্য আওয়াজে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “আমি তোমাকে জোড় করে বিয়ে দেইনি কনক। তুমি নিজেই ধারাকে পছন্দ করতে। করতে না?”

কনকের চেহারা অদল পালটে গেল। ক্ষুব্ধ হলো মন,মেজাজ। ভ্রু জোড়া কুঁচকে বললো, “নাহ্। করতাম না। এখনো করি না। আমি তোমাকে কখনো বলেছি আমি ওকে পছন্দ করি? আমার আচরণে কি কখনো সেটা প্রকাশ পেয়েছে? সি ইজ নট মোর দ্যান মাই এনিমি, আব্বু। তুমি যে কি বুঝে ওর সাথে আমার বিয়ে দিয়েছ!” বলতে বলতে অন্যদিকে চেয়ে জোড়ালো শ্বাস ফেললো সে। ম্লান কণ্ঠে আবার বললো,
—“যাইহোক, আমার সময় লাগবে। মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি আমি। এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারবো না।”
—“তুমি যদি ধারাকে পছন্দ নাই করে থাকো, তাহলে লেকের পারে ধারার সাথে ঘুরতে গিয়েছিলে কেন? আমি স্পষ্ট দেখেছি তুমি আর ধারা হাতে হাত ধরে হাঁটছিলে!”
—“কখন দেখেছ?” চোখ মুখ কুঁচকে শুধালো কনক।
—“রবিবার। পাঁচদিন আগে।”

শাহাদাত আঙুলের সাহায্যে কপালে জোড়ালো ভাবে আঙুল ঘঁষলো কনক, “ওটা ধারা ছিল না আব্বু।”
—“তাহলে?”
—“আমার ক্লাসমেট আয়রা। আমি পছন্দ করতাম ওকে। ও-ও বোধহয় করতো।”

কনক সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই স্নেহা আক্তার হন্তদন্ত পায়ে কফি হাতে এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কই যাচ্ছিস? তুই না কফি খাবি? বোস, নে।”
কনকের স্বাভাবিক উত্তর,
—“খাবো না। আব্বুর প্রয়োজন কফিটা। তাকে দাও।”

কনক কেমন উদাস ভঙ্গিতে উপরে চলে গেল। বাহিরে আর গেল না। নাবিল সাহেব বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলেন। কি ভুলটাই না করেছেন তিনি! ওইদিন লেকে মেয়েটার চেহারা দেখতে না পেলেও পেছন দিক থেকে মেয়েটাকে হুবহু ধারার মতোই লাগছিল।

বাহিরে হঠাৎ করেই ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। বাতাস শুরু হতে না হতেই কারেন্টও চলে গেছে। আমার বৃষ্টি ভীষণ অপছন্দ। কারণ একটাই। বৃষ্টির পানিতে আমার শরীর চুলকোয়। একটু বেশিই সেনসিটিভ স্কিন কিনা! স্নেহা আন্টির সাথে বাগানে গিয়েছিলাম বিকালে। হঠাৎ বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গেছি। বৃষ্টি ছোঁয়া গায়ে লাগতেই ওমনি চুলকানি মহাশয়ও হাজির হয়েছেন আমার দরবারে।
কনকের বাসায় জেনারেটর নেই। অন্ধকারে কিচ্ছু দেখছি না। রুমের ভেতর পর্দা টেনে কনক রাজাকার ঘুমে বিভোর হয়ে আছেন। আমি পর্দা সরিয়ে দিলাম। এবার একটু হলেও আলো আসছে!

আমার খুটখাট শব্দে কনকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি মনে মনে অবশ্য খুশিই হলাম। সকাল বেলা এই রাক্ষস এমন ভাবেই আমার ঘুম ভাঙ্গিয়েছিল।
ক্ষীণ চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে কনক বিরক্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, “কি সমস্যা ধিন্দি? ঘুমাতে দিচ্ছো না কেন?”
আমি জবাব দিলাম না। রুমের এদিক-সেদিক তোয়ালে খুঁজতে লাগলাম। চেয়ারেই তো রেখেছিলাম। কই গেল? আমাকে কিছু বলতে না দেখে কনক আবার বললেন, “কি সমস্যা কি তোমার? অন্যদিকে যাও। এত বিরক্ত করছো কেন?”
আমার মেজাজ বিগড়ে গেল এবার। এমনিতেই বিরক্ত হয়ে আছি। নখের ধারালো খামচিতে শরীরের অনেক জায়গা লাল হয়ে গেছে। অথচ এই কনক সাহেব চিল্লাচ্ছেন যে চিল্লাচ্ছেনই! তার সাথে কথা বলছি না মানে আমি তাকে ইগনোর করছি। এটুকুও বোঝার ক্ষমতা নেই। বেকুব কোথাকার!
কনক ফের ডাকতেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উঁচু গলায় চিল্লিয়ে উঠলাম, “আমি কি তোরে সাধে ঘুম থেকে উঠাইছি নাকি রে কনইক্কা?”
কয়েক সেকেন্ড কাটলো। কনক তড়িৎ গতিতে উঠে বসলেন। বড় বড় চোখে তেড়ে আসলেন আমার দিকে। আমি কয়েক কদম পিছিয়ে গেলাম। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে চুপসে গেলাম। ভীতু মুখশ্রী একটুখানি হয়ে রক্ত শূণ্য হয়ে গেছে। কনক এগিয়ে আসলেন। আরেকটু এগিয়ে আসলেন। আস্তে আস্তে তার পায়ের গতি কমে গেল। কণ্ঠে বিস্ময় ঢেলে শুধালেন, “তোমার শরীর এমন লাল হয়ে আছে কেন ধিন্দি?”
তার কোমলস্বর শুনে সাহস করে মুখ তুলে তাকালাম। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে সে আমারই শরীরের লালচে স্থানগুলো চেয়ে চেয়ে পরখ করছেন। আটকে আসা কণ্ঠে বললাম, “এগুলো এলার্জি।”
—“কিভাবে হলো?”
—“বৃষ্টির পানি সহ্য করতে পারিনা।”
—“কি খুঁজছিলে?”
—“তোয়ালে।”
—“কেন?”
—“গোসল করবো।”

কনক আর কিছু না বলে কাবার্ড খুললেন। নিজের তোয়ালে নিয়ে আটকে দিলেন আবার। আমার দিকে এগিয়ে দিতেই নাকমুখ কুঁচকে বললাম, “আমি আপনার তোয়ালে ব্যবহার করবো কেন? আমার এত বাজে দিনও আসেনি!”
—“আপাতত বাজে দিনই চলছে তোমার। দুপুরে তোমাকে বারান্দায় তোয়ালে রোদে দিতে দেখেছিলাম। বৃষ্টিতে এতক্ষণে ভিঁজে গেছে। ওইটা নিতে চাচ্ছো?”
আমার মুখ আবারও শুকিয়ে গেল। কনক সবসময় আমাকে হেনেস্তা করার জন্য সুযোগ খুঁজে বেড়ান। আমি তার দিকে আড়চোখে তাকালাম। সে তার চিরচেনা শয়তানি হাসি হাসছেন। বাঁকানো হাসি। আমি মন খারাপ করে পা বাড়াতেই আচমকা বাহু টেনে ধরলেন। লালচে দাগগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “এগুলোয় কি লাগাও? ঔষধের নাম কি? আছে সাথে? নাকি বেক্কলের মতো হারিয়ে ফেলেছ?”
কটমট চোখে চেয়ে বললাম, “আমার কি দেখে মনে হলো আমি বেক্কল?”
কনক সে কথার জবাব দিলেন না। বিন্দু মাত্র পাত্তাও দিলেন না আমাকে। উত্তপ্ত কণ্ঠে আরও একবার প্রশ্ন করলেন, “ঔষধ কোথায়?”
হতাশার নিশ্বাস ফেললাম। মোটেও ঝগড়া করার মনমানসিকতা নেই আমার। ক্লান্ত লাগছে। শরীরের আনাচে-কানাচে বিষ যন্ত্রণা অনুভব করছি ভালো ভাবেই। শান্ত স্বরে উত্তর দিলাম, “নেই। গোসল করলে এমনিই ঠিক হয়ে যাবো।”
কনক এবার আর কিছু বললেন না। পকেট হাতড়ে ফোন বের করলেন। ফোনে লাইট জালিয়ে বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি অবুজ চোখে তাকাতেই বললেন, “অন্ধকারে চোখে তো কিছু দেখো না। গোসল করবে কিভাবে? নাকি বাথরুমে চিৎ হয়ে পরে থাকার প্লেনিং করছো? লাভ নেই। আমি তোমার সেবা-টেবা কিচ্ছু করবো না।”

কনকের কথায় রাগ হলো না। বরং বিমূঢ়তায় স্থির হয়ে গেলাম। এই লোকের হঠাৎ কি হয়েছে? এত উদারতা দেখাচ্ছে কেন? কোনোভাবে আমাকে হেনেস্তা করার নতুন পরিকল্পনা করছে না তো? করতেও পারে। রাজাকারদের দ্বারা বিশ্বাস নেই।

অবাকের ঘটনাগুলো এটুকুতেই থেমে রইলো না। আমি গোসল করে বের হতেই কনক আমার হাত টেনে বিছানায় বসালেন। নিজে আমার ভেঁজা চুল মুছে দিলেন। খুব যত্ন করে। তারপর আবার কোত্থেকে একটা ঔষধের বোতল এনে লালচে দাগে স্প্রে করে দিলেন। পুরোটা সময় তার মুখশ্রী ছিল ভীষণ গম্ভীর, থমথমে। আর আমি, অবাক হয়ে ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে দেখছিলাম তাকে। বারবার পলক ঝাপটাচ্ছিলাম। প্রথমবারের মতো তখনই তাকে গভীর ভাবে খেয়াল করেছিলাম। খুব কাছ থেকে।
কনক নিঃসন্দেহে ভীষণ সুদর্শন একটা ছেলে। লম্বা-চড়া, প্রশস্ত বুক, ঘন চুল-ভ্রুযুগল, নাকটা একটুখানি বোচা। চোখের দৃষ্টি কি দারুণ সূক্ষ্ণ! আমি চেয়েই রইলাম। ভেতরটা কেমন কেমন করছে। কেন করছে? বুঝতে পারছি না।

কনক গাম্ভীর্য নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার লিউইস কোথায়?”
আমার এতক্ষণে মনে পরলো লিউইসের কথা! সেই যে সকালে পালালো, তারপর তো দেখলামই না।
—“জানি না, কোথাও দেখিনি।”
—“আমার বাগা খেয়ে ফেলেছে।” আগের মতোই বললেন কনক।
কথাটা বুঝতে ক্ষীণ সময় লাগলো। পরক্ষণেও নেত্রজোড়া বিরাট আকারে এনে চেঁচিয়ে উঠলাম, “কিসব বলছেন!”
কনক সরে এলেন। মৃদু ভাবে আমার মাথায় টোকা দিয়ে বললেন, “আজকে রাতে তুমি আর তোমার লিউইস গেস্টরুমে ঘুমাবে। আমার কাছে ঘেঁষাঘেঁষি করবে না খবরদার! কিসব ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে বসে আছো! আগে জানলে তো বিয়েই করতাম না।”
ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লাম। রাগ মাথায় উঠে গেছে, “আমার ছোঁয়াচে রোগ আছে? আমার! অসভ্য লোক কোথাকার! এতক্ষণ আপনি আমার পিছু পিছু ঘুরছিলেন। আমি বলেছিলাম ঘুরতে? ম্যানারহীন লোক! মেয়েদেরকে সম্মান করতেও জানে না!”

কথাটা গায়ে লাগলো বোধহয়। কনক খানিকটা ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। ভীষণ জোড়ে নাক টেনে ধরলেন। আমি ব্যথা চোখমুখ খিঁচে চোখ বুজলাম। তবুও সে ছাড়লেন না। হিসহিস করে বললেন, “মেয়েদের সম্মান করতে আমি খুব ভালো করেই জানি। কিন্তু তুমি মেয়ে নও। একটা ধুরন্দর বিড়াল! তোমাদের সামনে আমার ঠিক ভালো ব্যবহার আসে না।”
চোখ বোজা অবস্থাতেই দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, “আপনি ভীষণ বেয়াদব একটা লোক!”
—“বেশি বলছো মেয়ে! বৃষ্টির দিকে ছুঁড়ে ফেলতে সময় নিবো না আমি।”

শত শত হুমকি-ধামকি দিয়ে কনক আবারও বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলেন। আবারও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমার ক্ষিপ্ত দৃষ্টি রাক্ষসটার দিকেই আটকে আছে। আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম, এই লোকের নাম রাজাকার কনইক্কা! যার রক্তে ভালো মানুষি নেই। আছে শুধু ত্যাড়ামো আর ত্যাড়ামো!

কয়েকদিন কেটে গেল এরমধ্যে। কনক আর আমার সম্পর্কের উন্নত ঘটেনি বিন্দুমাত্র। সারাদিন ঝগড়া করতেই লেগে থাকি। ইতোমধ্যে আমি কলেজ যেতেও শুরু করে দিয়েছি। কনক সকালে কলেজে দিয়ে যান, আবার বিকালে নিয়ে আসেন।

আজকে রবিবার। রাস্তায় ভীষণ জ্যাম। আমরা অনেকটা দেড়ি করেই কলেজ পৌঁছালাম। তার বাইক থেকে নামতেই কনক বললেন, “বিকালে আমার একটা কাজ আছে। আসতে দেড়ি হবে। তুমি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করো।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কতক্ষণ দেড়ি?”
—“দশ-পনেরো মিনিট হবে।”
কনকের জবাবের পিঠে আমি কিছু বলতে নিচ্ছিলাম। ওমনি পেছন হতে একটা মেয়েকণ্ঠ ভেসে আসলো, “কনক? এটা তুমি না?”
কনক তাকালেন মেয়েটার দিকে। তারপর মৃদু হাসলেন। গায়ে পরা লোকদের মতো মেয়েটা এগিয়ে এলো। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগলো কনককে। কি বিশ্রী হাসি! আমাকে যেন দেখেও দেখলো না। আমি পুরোটা সময় অসহ্য চাহনি নিয়ে চেয়ে ছিলাম। আমার ঈগলের মতো দৃষ্টি ঘুরঘুর করে দেখছিল মেয়েটাকে।
কনক বারবার ইশারা করলেন চলে যেতে। আমি গেলাম না। ঠায় দাঁড়িয়ে ওদের বিশ্রী লুতুপুতু দেখলাম। মেয়েটা চলে যেতেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “মেয়েটা কে?”
কনক উদাসীন নয়নে মেয়েটার যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে উত্তর দিলেন, “আয়রা।”

‘আয়রা’ এ আবার কোন দেশের দূষিত বিক্রিয়া? কোন দেশ থেকে আমদানি হলো?

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here