ময়ূখ #পর্ব-১০ #লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

0
613

#ময়ূখ
#পর্ব-১০
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

২৮.
‘এই যে মহিলাগণ আপনারা কি নিভৃত ভাইকে খেয়ে ফেলবেন নাকি!’

হঠাৎ একটা পুরুষালী কন্ঠে নিভৃত ভিড়ের ফাঁকে সেদিকে তাকায়। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। পরনে সেন্টু গেঞ্জি আর লুঙ্গি। ঘাড়ে গামছা। নিভৃতের সমান কিংবা তারচেয়ে ছোট হবে হয়তো। ছেলেটা হাসিমুখে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো।

‘আসেন ভাই। মৌনি যে কি করে না। আপনাকে রেখেই চলে গেছে। আপনে আমার সাথে আসেন। আমি মৌনির চাচাতো ভাই রিপ্ত।’

ভিড়ের মাঝে পাশের বাড়ির জিল্লুরের মা বললেন,
‘কেনো গো রিফ্ত! তোমাগো বাড়ির জামাইরে কি আমরা দেখতেও পারুমনা।’
‘এখনো দেখা হয়নাই কাকি! পরে দেইখেন। ভাই এখন ক্লান্ত।’

অতঃপর রিপ্ত নামের ছেলেটি নিভৃতকে বললো,
‘চলেন ভাই। আমাদের গরিব মানুষের ঘরে একটু বসবেন।’

ভিড় ঠেলে নিভৃতকে মৌনদের টিনের ঘরটায় নিয়ে গেলো রিপ্ত। পিছনে কয়েকটা ছোট ছোট বাচ্চাও নাচতে নাচতে এসেছে। নিভৃতের নিজেকে জোকার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে একটা জোকার সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বাচ্চাগুলো তার পিছন পিছন নাচতে নাচতে আসছে। কি একটা অবস্থা! রিপ্ত নামের ছেলেটার লাল ফর্সা গাঁয়ের রং। কাজ করতে করতে মুখটা রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে। দরজার কাছে ছোটবাচ্চাদের দেখে রিপ্ত ধমক দিলো,
‘এই পেনাপোনার দল যা ভাগ!’

বেচারা বাচ্চাগুলো ভোঁ দৌড়। বাড়িতে প্রচুর মানুষ। কাল বিয়ে বলে কথা! রিপ্ত হাসিমুখে বললো,
‘ভাই বুঝি আপনার সমস্যা হচ্ছে। একটু বসেন। চাচি নাস্তা নিয়ে আসতেছে পরে আপনাকে মৌনির ঘরে নিয়ে যাবো।’

নিভৃত কিছু বলতে যাবে তার আগেই মর্জিনা, রথি চারথালা নিয়ে এলো। তেলের পিঠা, ফুলপিঠা, হাতের সেমাই আর নতুন চালের পায়েস। সামনে টি-টেবিলে রাখলো। মর্জিনা হাসিমুখে বললেন,
‘বাবা, তোমার জন্য বানিয়েছি। খাও।’

রথির অনেককিছু বলতে ইচ্ছে করছে তবে রিপ্তর জন্য বলতে পারছেনা। উল্টাপাল্টা কিছু বললেই কিল খেতে হবে।

নিভৃত পড়েছে বিপাকে। সে তৈলাক্ত খাবার একদম খায়না। মুখের উপর কিছু বলতেও পারছেনা। তাই হাসিমুখে একচামচ সেমাই মুখে দিলো। মর্জিনা দাঁড়িয়ে আছেন। রথি ভিতরের ঘরে আপাদের কাছে গেছে। রিপ্ত পাশের জানালার কাছে দৌঁড়ে গেলো। হাতটা বাড়িয়ে কলার টেনে ধরলো একটা ছোটছেলের। উঁচু কন্ঠে বললো,
‘এই পেনাপোনা না করছিনা এখানে আইতে আবার আইসোত?’

বাচ্চাটার এমন দশা ছেঁড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। নিভৃত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গলায় খাবার আটকে কাশতে লাগলো। হচ্ছে কি এসব! এই বাড়ির সবাই কি পাগল, ঘাড়ত্যাড়া আর তারছিঁড়া! নিভৃতকে কাশতে দেখে বাচ্চা ছেলেটিকে ছেড়ে দৌঁড়ে এলো রিপ্ত। পানি এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘কি হলো ভাই? কি হলো?’

নিভৃত পানি পান করে বললো,
‘ঐ বাচ্চাটাকে ঐভাবে ধরেছিলেন কেন?’
‘প্রথমত আমি আপনার ছোট তাই তুমি করে বলতে পারেন। তুইও বলতে পারেন আপনার ইচ্ছা। দ্বিতীয়ত ঐ পুনা আসছিলো আপনারে রং ছুঁড়ে
মারতে। এদের আমি আগে থেকেই চিনি।’

নিভৃত আবার বিষম খেলো। এটা কোথায় এসে পড়লো সে!

২৯.
নিতুর ঘরে বসে গল্প করছে মৌন, রথি, পুষ্প, পাশের বাড়ির রুজিনা আর ময়মুনা।
‘ও বড়আপা বিল্লাল ভাইয়ের সাথেই তাহলে শেষমেষ বাবা বিয়ে ঠিক করলো।’

নিতু লাজুক হেসে বললো,
‘হুম।’

মৌন মিষ্টি হাসে। বোনদের মুখের হাসির জন্যই তো নিজেকে বলিদান করেছে সে। এই যে বাবার ব্যাংক লোনের টাকা, পুষ্পর এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন, বিল্লালের মায়ের আবদার করা যৌতুক সবই তো হচ্ছে তার শশুড় বাবার টাকায়। রথি পাশে বসে বলে,
‘দুলাভাই কি কম কথা বলে আপা?’
‘হুম। উনার সাথে কোনো দুষ্টামি করিসনা। পুষ্প তোরেও বলি। উনি কিন্তু অনেক রাগী।’

রথি, পুষ্প দুজনেই বলে,
‘আচ্ছা, আপা।’

আজো নিমগাছের ডালে দুইটা শালিক পাখি বসেছে বিয়ের দিনের মতো। এই নিমগাছটা তার ঘরের জানালা থেকেও দেখা যায়। কিচিরমিচির আওয়াজ তুলে কথা বলছে। আজ তাদের মাঝে বাকবিতন্ডা নেই। যা আছে তা হলো মিষ্টি ঝগড়া। নিমগাছের ছোট ছোট পাতাগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। এতক্ষণ বোনদের জড়িয়ে ধরে বসেছিল মৌন। পুষ্প উঠে গিয়ে প্লেট ভর্তি নতুন চালের পায়েস নিয়ে এলো। তার আপা খেতে খুব পছন্দ করে। মৌনকে সে আপা বলেই ডাকে। নিতু বড়আপা, রথি ছোটআপা আর মৌন কেবল আপা। তাই মৌনের প্রতি একটা আলাদা টান কাজ করে তের বছরের পুষ্পের।
‘আপা, খাও। মা তোমার জন্য নতুন চালের পায়েস করছে।’

মৌন প্লেটটা নিয়ে একচামচ মুখে দেয়। আহা! অমৃত যেন। মায়ের হাতের পায়েস!

কাঠের চৌকিটাতে বসেছিল চারবোন। পাশে রাখা একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে ময়মুনা আর রুজিনা দাঁড়িয়ে আছে। কথায় কথায় হঠাৎ ময়মুনা বললো,
‘মৌনের বাপে এটা কি করলো বুঝলাম না। বড় মাইয়ার আগে ছোটমাইয়ার বিয়া দিলো। তাও আমাগোরে জানাইলোও না। কি গো মৌন শশুর বাড়িত যাওয়ার আগে তো কইয়াও গেলানা।’

মৌন চুপ করে থাকে। নিতু বরাবরই শান্ত। তবে রথি জবাব দেয়,
‘কেন ভাবি। বিয়ে করলে কি সাড়া দুনিয়া জানাই করা লাগবো?’

ময়মুনা কপাল কুঁচকে তাকান। এই মেয়েটার কথায় ঝাঁজ অনেক। মুখটা বিকৃত করে বলেন,
‘বুঝিনা তোমাগো মতিগতি। বিয়াইত্তা জামাইত্তে বোন দিসো। আমাগো কি?’

রথি কিছু বলতে গেলে মৌন হাত চেপে ধরে। গ্রামের বিষয়। কথা বললেই কথা বাড়ে।

৩০.
মৌনর ছোটঘরটায় বসে আছে নিভৃত। ছোট ছিমছাম ঘরটায় একটা পুরানো দিনের খাট। পাশে একটা পড়ার টেবিল আর একটা ছোট আলমারি। বিছানায় এভাবে বসে থাকা খুবই বিরক্তিকর। তারউপর জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর দলেদলে মেয়েরা উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে। নিজেরাই হাসছে, লজ্জা পাচ্ছে। মেয়েটাকে খুঁজেও পেলোনা সে। সেই কখন রিপ্ত তাকে এই ঘরে বসিয়ে দিয়ে গেলো।

হঠাৎ ঘরে ঢুকলো মৌন। সবুজ রঙের শাড়ির আঁচলটা টেনে মাথায় দিয়ে পিছনে নিভৃতকে দেখে চমকে গেলো। সে এসেছিলো মাগরিবের নামাজ পড়তে। সত্যি বলতে সে একদম নিভৃতের কথা ভুলে গিয়েছিলো। তার কল্পনারও বাইরে নিভৃত এতক্ষণ থাকবে। মৌন ভেবেছে হয়তো চলে গেছে।

নিশ্চিত তার সাথে আবার ঝগড়া করবে। নিভৃত কিছু বলবে তার আগেই মৌন বললো,
‘আপনার যা বলার পরে বলবেন। আমি নামাজটা সেরে নেই।’

নিভৃত রাগে গজগজ করছে। ভেবেছিলো সামনে পেলেই ঠাটিয়ে একটা গালে বসাবে। তবে ওজুরত দেখে কিছু বললোনা। মৌন জায়নামাজ বের করে মাগরিবের সালাত আদায় করে নিলো। নিভৃত বিছনায় বসে মোবাইল চালানোর ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটাকে দেখছে। নামাজরত মেয়েটাকে অনেক স্নিগ্ধ আর পবিত্র লাগছে।

নামাজ শেষে জায়নামাজটা ঠিক জায়গায় রেখে মৌন বললো,
‘দেখুন প্লিজ চেঁচামেচি করবেন না। আশেপাশে প্রচুর মানুষ। তারউপর আমার মনে হয় জানালায়ও ভাবিরা কান পেতে আছে। তাই আপনাকে আল্লাহর দোহাই লাগে উঁচু গলায় কিছু বলবেন না। যা বলার ঢাকা গিয়ে বলবেন।’

এক নিঃশ্বাসে বলে থামলো মৌন। নিভৃত কি বকবে মেয়েটার কথা শুনেই হা হয়ে আছে। নিজেকে ধাতস্থ করে নিভৃত বললো,
‘এজন্যই বলি তোমার মাথার তারছিঁড়া কেন!’

মৌন বুঝতে না পেরে বললো,
‘মানে?’
‘তোমার বাড়ির সব মানুষই দেখলাম তারছিঁড়া, অর্ধ তারছিঁড়া নয়তো পাগল।’

মৌন কোমড়ে হাত দিয়ে নিভৃতের সামনে এসে বললো,
‘একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না।’
‘সত্য বলছি বলে গাঁয়ে লাগছে? আহারে! কিন্তু এটাই সত্যি।’

বলে নিভৃত গাঁ জ্বলানো হাসি দেয়। মৌন কোনো কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে আসে। থাকুক একা। বদলোক!

বাইরে জোরে জোরে সাউন্ড বক্স বাজানো হচ্ছে। পাশে চেয়ারে মানুষ বসে। তিনজন ছেলে আনা হয়েছে। তারা নাচছে। আর সবাই বসে দেখছে। কিছুক্ষণ পরপর হাততালি দিচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোও মিউজিকের তালে তালে লাফালাফি শুরু করেছে। ছনের রান্নাঘরে বসে মর্জিনাসহ বাকি মহিলারা পিঁয়াজ, রসুন বাটছেন। মুরগী পরিষ্কার করছেন। মৌন এগিয়ে যাবে রান্নাঘরের দিকে তার আগেই পথ আটকালো রিপ্ত।

(চলবে)…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here