ময়ূখ #পর্ব-১৫ #লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

0
627

#ময়ূখ
#পর্ব-১৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৪৩.
রাতে খাবার খেতে বসেছে নিভৃত, মৌন। নিভৃত খুবই আয়েশ করে টক ডাল দিয়ে পোলাও খাচ্ছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে অমৃত খাচ্ছে যেন। মৌন নিভৃতের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
‘সেই তো আমার রান্নাই খাচ্ছে। আর প্রথমদিন কি ঢং দেখিয়েছিলো! বদলোক!’

নিভৃত কপাল কুঁচকে তাকালো মৌনের দিকে।
‘এই মেয়ে কি বলছো?’
‘কিছুনা।’
‘না, তুমি কিছু বলেছো। একমিনিট তুমি কিছু খাচ্ছোনা কেন? খাবারে কিছু মিশাও নি তো!’

মৌন এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। এই লোক নিশ্চিত তার সাথে ঝগড়া করার পায়তারা করছে।
‘হ্যাঁ, একটু বিছুটির রস মিশিয়েছি। মজা হয়েছে না?’
‘হোয়াট!’

মৌন আর কথা বাড়ালোনা। এই লোক একটা আস্ত পাগল। এখানে থাকলে নির্ঘাত ঝগড়া করবে। সে প্লেট নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এলো। থাকুক একা।

নিভৃতের রাগে গাঁ জ্বলছে। এটুকু একটা মেয়ে তাকে ইগনোর করে। একে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে সে।

_________________

দশদিনে তাদের ঝগড়া হয়েছে একশবার। মৌনর সাথে একটা না একটা নিয়ে নিভৃতের কথা কাটাকাটি হবেই। মৌন তো একদিন বলেই বসলো,
‘আপনি স্বামী হয়ে আমার সাথে যতটা ঝগড়া করেন আমার সতীন থাকলেও এতোটা করতোনা।’

নিভৃত বজ্জাত পায়রাটার উপরেও বিরক্ত। বিকেলবেলা সোফায় বসে ইতিহাসের একটি বই পড়ছে মৌন। নিভৃত তার সামনে দিয়েই ঘুরঘুর করছে। নিভৃতের সাথে মিটিও ঘুরঘুর করছে। নিভৃতের উদ্দেশ্যটা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি মৌন। হঠাৎ পাশের সোফায় ধপ করে বসলো নিভৃত। মিটিও টি-টেবিলে বসেছে। নিভৃত সেদিকে তাকিয়ে বললো,
‘এই বজ্জাত পায়রা এখানে বসেছো কেন? তুমি কতোটা অস্বাস্থ্যকর তুমি জানো?’

মিটি কোনো জবাব দেয়না। তার নিভৃতের বকা শুনতে বেশ লাগে। নিভৃত কপাল কুঁচকায়। এতক্ষণ বাকবাকুম করে মাথা খাচ্ছিলো। অথচ এখন জবাব দিচ্ছেনা। বজ্জাত পায়রা!
মৌন কেবল এসব নাটক দেখে যাচ্ছে। লোকটা কি পাগল হয়ে গেলো। শেষ পর্যন্ত তাকে পাগলের সংসার করতে হচ্ছে! মিটির থেকে নজর সরিয়ে নিভৃত মৌনর দিকে তাকালো। উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘এই মেয়ে কি পড়ো?’
‘মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস পড়ছি।’

নিভৃত বিরক্তিতে চো শব্দ করলো। অতঃপর মুখটা বিকৃত করে বললো,
‘এসব কোনো পড়ার বিষয় হলো। এসব রাখো আজ আমি তোমাকে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র বুঝাবো।’
‘মানে কি! আমি তো আর্টসের স্টুডেন্ট।’
‘সমস্যা নেই। আমি তোমাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিবো। একেবারে বেসিক ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’
‘না, আমি এসব পড়বোনা।’

নিভৃত হাল ছেড়ে দেয়নি। এই মেয়েকে আজ সে জব্দ করেই ছাড়বে। খুব শখ না পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার।

৪৪.
‘জানো মেয়ে আমার অনেক ইচ্ছা ছিলো প্রফেসর হবো। তবে বাবার ব্যবসা সামলাতে গিয়ে তা আর হয়ে উঠেনি। মাঝেমাঝে আমার প্রফেসর সত্তা জেগে উঠে। রুহানি প্রতিদিন বিকালে আমার একটা ক্লাস করতো। এখন তো আর কাউকেই পড়াতে পারিনা!’

অসহায় দেখালো নিভৃতের মুখ। মৌনর খুবই মায়া হলো। লোকটা এতো করে চাচ্ছে। একটু শুনলেই তো হবে।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

নিভৃত মনে মনে বাঁকা হাসছে। আজকে একটা মোক্ষম সুযোগ হয়েছে তার। মিটিকে সরিয়ে টেবিলে রাখা খাতা কলমটা হাতে নিলো সে।
‘নিউটন মধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে একটা পড়ন্ত আপেল থেকে।’
‘হ্যাঁ, এটা জানি। পরে বলুন।’
‘পড়ার মাঝে কথা বলবেনা। এটা আমার পছন্দ না।’
‘আচ্ছা, বুঝেছি।’
‘মহাকর্ষ, অভিকর্ষ বল সম্পর্কে জানো?’
‘এসব কি পড়াচ্ছেন আপনি। সবই পড়েছি আমি সপ্তম, অষ্টম শ্রেণিতে থাকতে।’
‘বাহ্, বেশ ভালো। তাহলে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রটাও বলো দেখি।’
‘মনে নেই।’
‘কেন মনে নেই! মনে রাখতে হবে।’

মৌন যারপরনাই বিরক্ত হচ্ছে। এই লোক এসব কি শুরু করেছে।
‘এই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে এবং এই আকর্ষণ বলের মান বস্তু কণাদ্বয়ের ভরের গুণ ফলের সমানুপাতিক, এদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক এবং এই বল বস্তুদ্বয়ের কেন্দ্র সংযোজক সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করে।’

নিভৃত হেসে বললো,
‘বুঝেছো?’
‘না।’
‘ঠিক আছে ব্যাখা করছি।’

দীর্ঘ দু’ঘন্টা নিভৃত মৌনকে মহাকর্ষ সূত্র, কেপলারের সূত্র, মহাকর্ষ সূত্র থেকে কেপলারের সূত্র প্রতিপাদন বুঝালো। মৌনর অবস্থা এমন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। বেচারির মাথাটাও গ্রহের মতো ঘুরছে।

‘এই হলো কেপলারের তৃতীয় সূত্র।’

নিভৃত মৌনর অবস্থা দেখে এমন একটা হাসি দিয়েছে যেনো সে বিশ্ব জয় করেছে।

বসা থেকে উঠে শিস্ বাজাতে বাজাতে উপরে চলে গেলো সে। আজ সে ভিষণ খুশি।

________________

মৌন সবে মাত্র বাড়ি ফিরেছে। নিভৃত রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বললো,
‘তুমি এসেছো?’

মৌনর খটকা লাগছে হঠাৎ এতো ভালো ব্যবহার!
‘এসো খেতে এসো।’

মৌনকে টেনে ডাইনিং টেবিলে বসালো নিভৃত। রান্নাঘর থেকে একে একে সব খাবার ঢেকে নিয়ে এলো সে। মৌন কেবল অবাকই হচ্ছে।

খাবারগুলো মৌনর সামনে দিয়ে বললো,
‘নেও খেয়ে বলোতো কেমন হয়েছে।’
মৌন ঢাকনা সরাইতেই আকাশ ভেঙে মাথায় পড়লো তার। কবুতরের মাংস আর রুটি! সে আশেপাশে তাকিয়ে মিটিকে খুঁজে যাচ্ছে। তবে মিটি নেই। নিভৃত মিটিমিটি হাসছে । মৌন অদ্ভুত এককাণ্ড করে বসলো। নিভৃতের টি-শার্টের কলার ধরে বললো,
‘আমার মিটি কই?’
‘রেঁধে ফেলেছি।’
‘মানে কি! আমার মিটিকে ফেরত দিন।’

নিচে বসে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছে মৌন। নিভৃত যদিও ভয় দেখাতে চেয়েছিলো তবে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মিটিকে এনে দিলো শেষ পর্যন্ত। ঘরেই খাঁচায় ভরে রেখেছিলো।

ভালোবাসা মানুষ বিভিন্নভাবে প্রকাশ করে। এই যে মৌনর প্রতি তার আচরণ এগুলো কি নির্দেশ করে! নিভৃত নিজের কাজ, নিজের মন, নিজের মস্তিষ্ক কোনো কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেনা। হয়তো রাখতে চাচ্ছেনা!

৪৫.

ইদের কেবল বাকি পাঁচদিন। মিরা, নাজমুল, দিলারার সাথে রোজ কথা হয় মৌন, নিভৃতের। মিরা অনেক ভয় পেয়েছিলেন। তারা চলে গেলে নিভৃত যদি মৌনের উপর অত্যাচার করে তবে সবকিছু স্বাভাবিক দেখে তিনি খুশি।

বিগতদিনগুলো ভালোভাবেই কেটেছে মৌনর। তবে হঠাৎ করে এই দুইদিন যাবত নিভৃত চুপচাপ থাকে। কোনো কথা বলেনা, ঝগড়া করেনা। সেদিন পাঁচহাজার টাকা হাতে দিয়ে বলেছিল ইদের জন্য কেনাকাটা করে নিতে। তার হাসোজ্জল চেহারাটা আবার যেন কোনো অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে। মৌন গেস্ট রুমেই থাকছে। একটা পাঞ্জাবি কিনেছে নিভৃতের জন্য তাও দেওয়া হয়নি। ঝগড়ায় মেতে থাকা বাড়িটা হঠাৎই যেন বিরান হয়ে পড়েছে।

______________________

আজ ইদ। চারপাশে খুশির আমেজ। এবার মৌনদের কুরবানি দেওয়া হয়েছে গ্রামে। যেহেতু ঢাকার বাড়িতে মৌন একা এতসব সামলাতে পারবেনা। নিভৃত সারাদিন চুপ ছিল। কোনো কথা বলেনি। রাতের খাবার খেয়েও সোজা ঘরে চলে গিয়েছে। মৌন খুবই কষ্ট পেয়েছে নিভৃতের কাজে। ইদের শুভেচ্ছাটা কি অন্তত জানানো যেতোনা? এতো রান্না-বান্না, এতো সাজগোছ কার জন্য!

সময়টা এভাবেই কাটছে। দুইদিন বাদে বাড়ি ফিরবেন মিরা, দিলারা, নাজমুল। নাজমুল একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

সারাটাদিন নিভৃত বাড়ি ফিরেনি। সকালেও রাগ দেখিয়ে গেছে। মৌনর খুবই চিন্তা হচ্ছে। কাউকে সে চিনেনা। ফোন দিয়ে খোঁজ নিবে সে উপায় নেই। মিরা দুবার ফোন করেছে। তবে সে মিথ্যে বলেছে। নিভৃতের বাড়ি না ফেরার কথা বলেনি।

ঘড়িতে এগারোটা বাজে। অথচ নিভৃতের বাড়ি ফেরার খবর নেই। এমন তো সে কখনো করেনা। কোথায় গেলো নিভৃত!

হঠাৎ দরজায় আওয়াজ হতেই সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় মৌন। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে। নিভৃত এদিক ওদিক ঢলছে। গাঁ থেকে মদের বাজে গন্ধ ভেসে আসছে। শার্টটা এলোমেলো কুঁচকে আছে, টাইটা গলায় ঝুলছে। চেহারায় ছন্ন ছাড়া ভাব। ঠিকমতো হাঁটতেও পারছেনা সে। মৌন এগিয়ে গিয়ে ধরলো নিভৃতকে। নিভৃতও সুন্দরভাবে তাকে ধরে ঘরে এলো। নিভৃত মৌনর হাতটা এমনভাবে ধরেছে যেন হাত ছাড়লেই পালিয়ে যাবে সে। মাঝেমাঝে বলেও যাচ্ছে,
‘রুহানি শুভ জন্মদিন। আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ।’
‘তোমাকে কোথাও যেতে দিবোনা।’

মৌন এবার নিভৃতের উদাসীনতা আর মন খারাপের কারণটা বুঝতে পারলো।

(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here