ময়ূখ #পর্ব-২৬ #লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

0
690

#ময়ূখ
#পর্ব-২৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৭৬.
‘আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।আমি মৌন।’
‘মৌন তুই? কেমন আছিস?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, আছি কোনো রকম। তুই কেমন আছিস? তোর ছেলেটা কেমন আছে?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।’
‘সুমি, একটা কথা বলতাম। কিভাবে যে বলি।’
‘আরে, বল। এতো ফর্মালিটি কেন?’
‘সুমি আমাকে একটু তোর বাড়িতে আশ্রয় দিবি। বেশি না দুইটা মাস। তারপর দেখি কি করা যায়।’
‘এই মৌন কি হইছে? ভাইয়ার সাথে কোনো ঝামেলা?’
‘সেসব না হয় পরেই শুনবি। আমাকে একটু আশ্রয় দিবি কিনা বল। নাহয়, একটা ঘর ভাড়া দিস আমাকে। চিন্তা করিসনা। টাকা প্রতিমাসে পাবি।’
‘একটা থাপ্পড় খাবি বেয়াদব মেয়ে। আমি টাকা চাইছি তোর কাছে। চলে আয় খুলনা। আমি আছিনা।’

মৌন মলিন হাসে। বিপদের সময় পর আপন হয়ে যায় আর আপন মানুষ পর! আরো কিছু কথা বলে কল কাটে মৌন। খাটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে জীবন উপলব্ধি করছে সে।

সুমির সাথে ফরিদপুর সরকারি কলেজে পড়া কালে পরিচয়।ইন্টার ২য়বর্ষ থাকাকালেই বিয়ে হয়ে যায় সুমির। খুবই সখ্যতা ছিলো মৌনর সাথে। সুমি পাড়ি জমায় খুলনা। সেদিন নিউমার্কেটে দেখা। সুমির স্বামী উসমান দুবাই প্রবাসী।একটা ছেলে আছে একবছরের।শ্বাশুড়ির সাথে খুলনা থাকে। মৌনকে অনেক করে বলেছিলো যেতে।মৌন সুযোগটা বিপদে গ্রহণ করলো। নিমগাছটায় আজ একটা শালিক পাখি বসে। তার সঙ্গী নেই। উড়ে গেছে কি? দূর-দূরান্তে।

_________________

রাত আটটা বাজে। মৌনর বাড়ির সামনে এসে থামলো সাদা মার্সিডিজ গাড়িটা। রাস্তায় জ্যামের কারণে নিভৃতের ফরিদপুর পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেছে। সাদা টি-শার্ট আর টাউজার পরনে নিভৃত। তার ঝাকড়া চুলগুলো এলোমেলো, অবিন্যস্ত। ফর্সা মুখমন্ডল ঘর্মাক্ত। উঠানে চেয়ারে বসে আলম পাশের বাড়ির মফিজের সাথে গল্প করছিলেন। নিভৃতকে দেখে হেসে উঠে দাঁড়ালেন। কুশল বিনিময় করলেন অনেকটা সময়। নিভৃতের ছটফটানি বেড়ে চলেছে দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হারে। লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেললো,
‘আংকেল, মৌন কোথায়?’
‘মৌন ওঁর ঘরে। যাও আব্বা তুমিও যাও। হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম নেও। অনেকটা পথ আসছো।’

বাড়ির সবাই নিভৃতকে দেখে উচ্ছ্বসিত। রথির মনে হচ্ছে আপদ বিদায় হবে আর মর্জিনা ভাবছেন ঘরের চাল বাঁচবে।

৭৭.
মৌন খাটে বসে পেটে হাত বুলাচ্ছে। কত কথা জমে আছে তার মনে। সব কিছুর বিচার দিচ্ছে দুইমাসের বাবুটাকে। বেশ লাগছে তার।
‘মৌন।’

এই প্রথম প্রিয় মানুষটার মুখে নিজের নাম শুনে থমকে যায় মৌন। মাথা উঁচিয়ে সামনে তাকায় সে। এলোমেলো, বিধস্ত নিভৃত দাঁড়িয়ে। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে তার দিকে। নিভৃত ধপ করে ফ্লোরে হাঁটু ভর দিয়ে বসে পড়ে। মাথা নিচু করে মুখটা চেপে ধরে রাখে অনেকটা সময়। অতঃপর লালবর্ণ চোখ নিয়ে তাকায় মৌনর মুখপানে। নিভৃতের চোখে একরাশ অসহায়ত্ব। মৌন মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সে। নিভৃত টলমলে পায়ে মৌনর পাশে এসে বসলো। কাঁপা কাঁপা হাতে মৌনের মুখটা স্পর্শ করার চেষ্টা করলো। তবে মৌন তা হতে দিলোনা। সড়িয়ে দিলো নিভৃতের হাত।
‘এই মেয়ে। আই এম সরি।’

মৌন অপরদিকে নিশ্চল তাকিয়ে আছে। নিভৃতের কোনো কথাই তার কানে বাজছেনা। নিভৃত হাতটা ধরতে গেলে মৌন সড়িয়ে নেয় নিজের হাত। সিক্ত অথচ শক্ত কন্ঠে বলে,
‘অধিকার ফলাতে এসেছেন? নিন আমি উন্মুক্ত করে দিলাম নিজেকে। নিজের চাহিদা মিটিয়ে বেরিয়ে যান।’
‘এই এসব কি বলছো তুমি?’
‘কেন? শুনতে পাচ্ছেন না? আপনাদের সবার হাতের পুতুল তো আমি। একবার খেলবেন আবার ছুঁড়ে ফেলবেন। আবার ইচ্ছে হলে উঠাবেন। ইচ্ছে না হলে পায়ে পিষে ফেলবেন।’
‘প্লিজ, মৌন। আমি সরি বলছি তো। বাসায় চলো।’
‘একদম আমার নাম মুখে নিবেন না। একটা বছর সংসার নামের ছেলেখেলা করেছি তখন তো আমার নাম ধরে ডাকেন নি। আজ কেন? নাকি আমাকে মেরে আপনার স্বাদ মেটেনি? মারতে এসেছেন? মারতে পারেন। আমি কিছু বলবোনা। আমার বাড়ির লোকগুলো না বড্ড স্বার্থপর। তারাও আপনাকে বাঁধা দিবেনা।’

নিভৃত আবার মৌনর হাতটা ছুঁতে চায়। তবে মৌন এবারেও নিজের হাত সরিয়ে নিয়েছে। নিভৃত অসহায় ভঙ্গিতে চেয়ে আছে কেবল। মৌন উঠে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। সবাই পেয়েছেটা কি! যে যেভাবে পারছে সে সেভাবে ব্যবহার করে যাচ্ছে তাকে। তার কি কোনো আত্মসম্মান নেই। নিভৃতের এই দ্বিমুখী জটিল ব্যবহার আর কতদিন সহ্য করবে মৌন!নিভৃত মৌনর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মৌন হালকা কন্ঠে বললো,
‘আপনি চলে যান নিভৃত। আমি আর ফিরবোনা। আমি আপনার আর রুহানি আপুর মাঝে একটা কাঁটা। আমি নিজে থেকে সরে আসলাম নিভৃত। আপনি চলে যান।’

নিভৃত নরম কন্ঠে বলে,
‘আমি ক্ষমা চাচ্ছিতো। আর এমন হবেনা প্লিজ চলো।’
‘আপনি এই মুহূর্তে চলে যাবেন নিভৃত। নয়তো আমার মরামুখ দেখবেন আপনি।’
‘মৌন!’

নিভৃত রাগে, অভিমানে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। মর্জিনা, রথি বাইরে কান পেতে ছিলেন। তারা শত ডেকেও নিভৃতকে আটকাতে পারেনি। মৌনকে ইচ্ছে মতো কথা শুনালেন মর্জিনা। মৌন টু শব্দটি করেনি। কেবল নিচের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসেছে। মনে মনে বিরবির করেছে,
‘তুমি কিন্তু আমার গর্ভধারিণী ছিলে মা!’

নিজের ঘরে গিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে নিভৃত। আশেপাশে যা ছিলো সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সে। বাড়ির মানুষ সবাই অবাক নিভৃতের ব্যবহারে। রুমি ফোন দিয়ে সব জানায় মিরাকে। মিরা নিভৃত কিংবা মৌন কাউকেই ফোনে পাচ্ছেন না। কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন। তবে রাত অনেক। নাজমুল এমনতেই অসুস্থ। ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছেন। শত ইচ্ছা
সত্ত্বেও ফরিদপুর ছুটে আসতে পারেননি তিনি।

৭৮.
পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙে পুষ্পর। পাশে তাকিয়ে মৌনকে খুঁজে পায়নি সে। ভালোভাবে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কোথাও নেই তার আপা।
হঠাৎ চোখ যায় টেবিলের উপরে। একটা চিঠি আর একহাজার টাকার নোট চাপা দেওয়া। চিঠিটা ধরে কিছু লাইন পড়ে চিৎকার করে মাকে ডাকে পুষ্প। পুষ্পের চিৎকার রথি, নিতু, মর্জিনা ছুটে আসেন। রথি হাই তুলতে তুলতে বলে,
‘এই চেঁচাচ্ছিস কেন তুই?’

পুষ্প রথির কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,
‘মা, আপা চলে গেছে।’

মর্জিনা যেন খুশি হয়ে যান মুহূর্তে। হেসে বলেন,
‘ভালোই তো হইছে। জামাইবাড়িই তো মাইয়াগো আসল বাড়ি।’

পুষ্প ভিজা কন্ঠে বলে,
‘মা, আপা দুলাইভাইদের বাড়ি যায় নাই।’
‘তাইলে?’

পুষ্প চিঠিটা পড়া আরম্ভ করেছে।

মা,
আমি চলে যাচ্ছি। তোমার আপদ বিদায় হচ্ছে মা। অনেক কষ্ট আর বুক ভরা যন্ত্রণা নিয়ে তোমার কাছে আসছিলাম মা। ভেবেছিলাম তোমার আঁচলের তলায় একটু ঠাঁই পাবো। আমি কি খুব বেশি বোঝা হয়ে গেছিলাম মা। কতটা যন্ত্রণা! ঠিক কতটা কষ্ট নিয়ে আমি এসেছি তুমি যদি জানতে মা! একহাজার টাকা রেখে গেছি মা। আশাকরি, আমরা তিনদিনে এর চেয়ে বেশি খাইনি। রথি, আমি তোর সংসার ভাঙতে আসিনি। এসেছিলাম একটু আশ্রয়ের আশায়। আমার উপরে রেগে থাকিসনা বোন। তোদের বড্ড ভালোবাসি।

মৌন।

চিঠিটা শুনে থমকে আছে সবাই। নিতু মুখে উড়না চেপে কাঁদছে। পুষ্প মর্জিনার হাতে টাকাটা দিয়ে ভেজা কন্ঠে বললো,
‘নেও, মা। তোমার খাবারের দাম নাও।’

সকালে উঠে নিভৃত ছুটে আসে মৌনদের বাড়িতে। তবে কাঙ্ক্ষিত মুখটা যে এখানে নেই। নিভৃত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

মিরা, নাজমুল গাড়িতে বসে আছেন। ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে দুজনে রওনা দিয়েছেন।দুজনেই উদ্বিগ্ন। নাজমুলকে আসতে মানা করেছিলেন মিরা তবে তিনি শুনেননি। হঠাৎ মিরার কাছে একটা কল এলো।
‘হ্যালো?’
‘ফরিদপুর হাইওয়েতে একটা গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। ছেলেটার অবস্থা ভালোনা। আমরা ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি যেই হোন উনার পরিবারকে একটু জানিয়ে দিবেন। ইমার্জেন্সি কলে আপনার নাম্বারটা পেয়েছি।’

হাত থেকে মোবাইলটা নিচে পড়ে গেলো মিরার। তিনি ‘বাবুই’ বলে এক চিৎকার দিলেন। পাশ থেকে নাজমুল বলে যাচ্ছেন,
‘এই কি হয়েছে? কি হয়েছে?’

(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here