ময়ূখ #লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি #পর্ব-২১

0
605

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২১

৬১.
জৈন্তাহিল রিসোর্ট। জায়গাটা খুবই মনোমুগ্ধকর। বিশাল বড় দুইটা রিসোর্ট পাশাপাশি। দেয়ালগুলো সাদারঙা। উপরে লাল রঙের চাল। সামনে কাঁচে আবৃত। সত্যিই দেখার মতো রিসোর্ট। মাঠের এককোণে অবস্থান তাদের। স্ব বিস্তীর্ণ মাঠে যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজ আর সবুজ ঘাস। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা। গাড়ি থেকে নেমে মৌন উৎফুল্ল হয়ে বলে,
‘এখানে যদি সারাজীবন থাকতে পারতাম!’
‘বেশি না কয়েক কোটি টাকা লাগবে।’
‘মানে?’
‘এই রিসোর্টে একরাত থাকতেই পাঁচহাজার প্রয়োজন। আর তুমি সারাজীবন থাকতে চাইলে তো কোটি টাকাই প্রয়োজন। তাই না?’
‘আমি কি সত্যি সত্যিই থাকবো নাকি! এটা তো এখানের সৌন্দর্য দেখে বললাম। আপনি এতো প্যাঁচান কেন?’
‘আমি লজিক ছাড়া কথা পছন্দ করিনা।’

নিভৃতের কথায় মৌন অন্যদিকে ফিরে ভেংচি কাঁটলো। বিরবির করে বললো,
‘তাঁর ছিঁড়া মানুষের আবার লজিক!’
‘এই কি বললে তুমি?’
‘কিছুনা।’
‘কিছুনা বললেই ভালো।’

মাঠে দাঁড়িয়ে তর্ক করার পর মৌন বললো,
‘হইছে। নাকি আরো বাকি আছে? চলেন রিসোর্টটার ভিতরে ঘুরে আসি।’
‘এখানে কি ভিতরে ঢুকে চেয়ার টেবিল দেখার জন্য আসছি নাকি, স্টুপিড!’
‘তাহলে কেন আসছেন?’

নিভৃত বিরক্ত হলো খানিকটা। এই মেয়ের কি কোনো জায়গা সম্পর্কেই ধারণা নেই?

‘বাংলাদেশ লাস্ট হাউস দেখতে যাবো।’
‘তাই!’
‘হুম।’
‘চলুন। কথা বলে দেরি করছেন কেন!’

অবাক হয় নিভৃত। এতক্ষণ নিজেই তো ঝগড়া করলো তার সাথে। আর এখন বলছে সে দেরি করছে! জৈন্তাহিল রিসোর্টের মাঠের পাশ দিয়ে মাটির আঁকাবাঁকা রাস্তা। মৌন, নিভৃত হেঁটে চলেছে। যদিও মৌনর খুবই ইচ্ছে করছিলো নিভৃতের হাতটা ধরতে তবে কিসের যেনো বাঁধা! দুইপাশে হরেকরকম গাছপালা। পাখির কুজনে মুখরিত চারপাশ। হঠাৎই মৌনর ডানহাতটা আঁকড়ে ধরেছে নিভৃত। স্বাভাবিকভাবে সামনে হেঁটে যাচ্ছে সে। ঠিক থাকতে পারছেনা মৌন। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হাতের বন্ধনটার দিকে! এতো দৃঢ় কেন এই বন্ধন! এই বন্ধন ছিন্ন করার ক্ষমতা যে মৌনর নেই।

__________________

একটা বিলের উপর রড দিয়ে তৈরি ঘর। সরু মাটির রাস্তা ধরে সামনে এগোচ্ছে দুজনে। একপাশে বিল। বিলে ফুটে আছে শাপলা, পদ্মফুলের দল। যদিও এখন শাপলা,পদ্মফুল ফুটার সময় না। তবে এ বিলে ফুটেছে। কি মাধুর্য সে দৃশ্যে! অপরপাশে ধানক্ষেত। দূরে ভারতের পাহাড়। রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কাঠগাছের সারি! ঘরটার সামনে এসে থামলো দুজনে। মৌনর অদ্ভুত লাগছে। এই ঘরটি বাংলাদেশের শেষ ঘর। কি অদ্ভুত! এপাড়ে পা রাখলে বাংলাদেশ আর ওপারে ভারত। দু দেশের সীমানায় এখন নিভৃত, মৌন।

৬২.

‘এই মেয়ে’
‘কি?’
‘ঐ যে মেঘের দল দেখছো?’
‘হুম’
‘পাহাড়ের সবুজে ঘেরা অভয়ারণ্য দেখছো?’
‘হুম।’
‘বিলের পানিতে পদ্মফুলের মেলা দেখছো?’
‘দেখছি তো!’
‘এই যে ছোট ঘরটা দেখছো?’
‘হুম।’
‘আমার জংলী বিড়ালটির সাথে এখানে ঘর বাঁধবো। মেঘের দলে দুজনে ভাসবো। সবুজের মায়ায় হারাবো। পদ্মফুল কানে গুঁজে দি…

হঠাৎ থেমে যায় নিভৃত। এসব কি বলছে সে! আজ সকালে গোসল করতে গিয়ে পানি লেগে যখন পিঠ জ্বালা করছিলো তখন নিভৃত নিজের অজান্তেই মৌনর নাম দেয় জংলী বিড়াল। আজ এই প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে মুখ ফুটে এসব কি আসছে তার! কেন এতো অদ্ভুত আচরণ করছে সে! নিজেকে প্রশ্ন করে নিভৃত। কোনো উত্তর আসেনা। মন ক্ষান্ত, মস্তিষ্ক ক্ষান্ত। এতো সহজে রুহানিকে ভুলে গেলো সে!

মৌন জানেনা নিভৃতের কথার মানে। তবে শুনতে খুবই ভালো লাগছিলো তার। নিভৃতকে চুপ থাকতে দেখে মৌন অধৈর্য হয়। উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করে,
‘আর?’

নিভৃত শক্ত কন্ঠে বলে,
‘কিছুনা।’

মৌন দমে যায়। যতই সাহসী হোক। নিভৃতের শক্ত কন্ঠে তার ভিষণ ভয়।

_________________

জৈন্তা হিল রিসোর্টেই দুপুরের খাবার খেলো দুজনে। ভাত, আলুভর্তা, গরুর মাংস আর ডাল। খাবারটা খুবই ভালোলেগেছে মৌনর। যদিও পেটে খিদে থাকলে সবই ভালোলাগে। নিভৃত সারাটা সময় চুপ ছিল। মৌন বুঝে পায়না নিভৃতের আচরণ। কখনো ঝগড়া করছে কখনো আবার গম্ভীর হয়ে থাকছে। নিভৃতকে বুঝা বড় দায়!

সন্ধ্যার দিকে নাজিমগড় রিসোর্টে ফিরে এলো দুজনে। রাস্তার দুপাশে লাইট জ্বলে উঠেছে। হলুদ রঙের ছড়াছড়ি চারপাশে। দুপাশের বাগানের ফুলগুলোর রং গাঢ় দেখা যাচ্ছে। রুমে যাওয়ার আগে মৌন বললো,
‘শুনছেন?’
‘কি?’
‘ঐযে উঁচু দালানটা দেখা যায় ঐটা কি?’
‘ওয়াচ টাওয়ার।’
‘আমি যাই?’
‘একা যাবা কেন তুমি?’
‘আসলে…
‘রুমে আসো। আগে ফ্রেশ হই বিশ্রাম নেই পরে আমি নিয়ে যাবো।’
‘আচ্ছা।’

চুপসে আছে মৌন। নিভৃত কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। এমন নিভৃতকে তো মৌন চায়না। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিয়ে মৌনকে ওয়াচ টাওয়ারে নিয়ে এসেছে নিভৃত।
মৌন অবাক চোখে তাকিয়ে চারিদিক দেখছে। পুরো রিসোর্ট দেখা যাচ্ছে। ঐ তো সারি নদী। স্থানে স্থানে জ্বলে উঠেছে হলুদ টিমটিমে লাইট। লাইটের আলোয় মুখরিত চারদিক। অভাবনীয় সুন্দর চারপাশ।

৬৩.

রিসোর্ট টার প্রতি একটা মায়া জন্মেছে মৌনর। কত স্মৃতি কুড়ালো নিজের ঝুলিতে! ছেড়ে যেতে খুবই কষ্ট লাগছে তার। তবে মানুষের জীবন থেমে থাকেনা। পার্থিব জীবনে অনেক কিছু তাদের ত্যাগ করতে হয়। মানুষের মন বড় নরম। বিশেষ করে মেয়েদের। তাইতো তিনদিন কাটানো স্থানের প্রতিও মৌনর কতো মায়া, টান, আবেগ জড়িয়ে আছে!
খয়রী রঙা টয়োটা প্রিমিউ গাড়িটা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে চলছে। নিভৃত একমনে গাড়ি চালাচ্ছে। মৌন বাইরে তাকিয়ে আছে। নিভৃতকে বোঝা হয়তো তার সান্নিধ্যে নেই। এই কুহকের ধাঁধা বড়ই জটিল।

________________

বাড়ি ফিরেছে আজ বিশদিন হলো। মৌনর সাথে বেশি কথা বলেনা নিভৃত। সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মৌন। বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বাহিরে দেখতে তার ভিষণ ভালোলাগে। মিটি তার কাঁধে বসে। লালচে রংয়ের আকাশের দিকে তাকিয়ে পড়ন্ত বিকেলের মোহে পড়ে গেলো মৌন। বিরবির করে বললো,
‘জানিস মিটি আমার জীবনটা একটা ধাঁধা।’

মিটি কিছু না বুঝে কেবল বাকবাকুম করে। মৌন মলিন হাসে।
‘আমি যদি তোকে স্বাধীন করে দেই তুই আমার হয়ে আকাশটা ঘুরতে পারবি রে মিটি?’

মিটির কি হলো কে জানে। মৌনর কাঁধ আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। সে কোথাও যাবেনা।
‘সবাই আমায় ব্যবহার করে তুই কেন বাদ যাবি রে মিটি।’

মিটি হয়তো মনে মনে বলছে,
‘আমি তোমায় ছেড়ে যেতে পারবোনা মৌন বুবু। আমার মালিক যে তোমায় নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। সে যে তোমাকে দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়েছে আমায়! আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবোনা বুবু।’

মৌন আবার তাকায় পড়ন্তবেলার লালচে আকাশে।

____________________

মৌন এখনো নিচে থাকে। শীত পড়েছে তীব্র। শীতে কষ্ট হয় মৌনর। পাতলা একটা চাদর বিছিয়ে থাকায় শরীর হিম হয়ে থাকে যেন। মৌন নিচে বিছানা করছিলো প্রতিদিনের মতোই। নিভৃত ল্যাপটপে কাজ রেখে বললো,
‘বিছানায় ঘুমাতে পারো তুমি।’
‘না, থাক।’
‘থাকবে কেন! বিছানায় থাকতে বলেছি চুপচাপ শুয়ে পড়ো।’

নিভৃতের ধমকে চুপসে যায় মৌন। পাশে শুয়ে পড়ে সে। নিভৃত আড়চোখে তাকায়। কি করে বলবে সে, এই মেয়েটা পাশে না ঘুমালে তার ঘুম আসেনা। বিগত রাতগুলো সে মৌনের মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছে। মেয়েটা ঠকঠক করে কাঁপতো। সে নিজের কম্বল দিয়ে দিতো মেয়েটার শরীরে। আজ হয়তো নিভৃতের একটু ঘুম হবে। হঠাৎ নীল ডিমলাইটের আলোয় রুহানির ছবির দিকে চোখ যায় নিভৃতের। নিভৃত চোখ সরিয়ে নেয়। একটা অপরাধবোধ কাজ করে তার মাঝে। রুহানির চোখে চোখ রাখার সামর্থ্য তার নেই।

একটুপর ক্লাস শুরু হবে। এখনো বাড়িতেই মৌন। তাড়াহুড়ো করছে প্রচন্ড। ইদানীং খাবারে বড়ই অনীহা তার। মিরা জোর করে দুই লোকমা ভাত মুখে তুলে দিলেন। মৌন বের হবে তার আগেই ফোন বেজে উঠলো তার। মায়ের নাম্বার দেখে হাসি মুখে কল রিসিভ করলো মৌন। ফোনের ওপাশে কেউ কাঁদছে। পুষ্প কেঁদে হেচকি তুলে বললো,
‘আপা, ছোটআপা আত্মহত্যা করছে।’

ছোটআপা মানে তো রথি! ধপাস করে নিচে বসে গেলো মৌন।

(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here