ময়ূখ #লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি #পর্ব-২

0
680

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২

৪.
নারী অবয়বটা স্পষ্ট হতেই নিভৃত দৌঁড়ে গিয়ে তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। মৌন ছাড়া পাওয়ার জন্য ছুটাছুটি করছে। তবে নিভৃতের তুলনায় মৌনর শক্তি ক্ষীণ। চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে রাখলো মৌন। তার হাত কাঁপছে। তার দুইহাত এখন নিভৃতের দখলে।

বাড়িতে ফিরেই শ্বাশুড়ির কথায় ভয়ে, আতঙ্কে এই ঘরে প্রবেশ করেছে সে। হাতে আরো চাপ পড়ায় মৃদু আর্তনাদ করে চোখ খুলে ভয়ে ভয়ে সামনে তাকালো মৌন। সারাঘর অন্ধকার। বাইরের আলোর ছিটেফোঁটার খেলায় ভয়ংকর লাগছে ঘরটা। এই ভয়ংকর আলোর খেলায় মৌনর চোখে পড়লো দুইটা লাল চোখ। মাথার চুলগুলো এলোমেলো।

নিভৃত হঠাৎ করে হো হো হেসে উঠে। মৌন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে কেবল। দেয়ালে দেয়ালে ঝংকার তুলছে সে হাসি। হাসিতে মিশে আছে খানিকটা ক্রোধ, খানিকটা কষ্ট আর খানিকটা দহন জ্বালা। নিভৃত নেশালো কন্ঠে কিঞ্চিৎ অভিমানে বললো,
‘রুহানি। তুমি এসেছো। তুমি খুব পঁচা রুহানি জান।’

অতঃপর একটা ফুঁ দিলো মৌনের মুখে। উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের দহনে কেঁপে উঠলো মৌন। শিরদাঁড়া বয়ে গেলো একটা নতুন শিহরণ। তবে রুহানি নামটা তীরের মতো গিয়ে বিধঁলো বুকে। কিন্তু কেন? স্বামীর মুখে তার প্রাক্তন স্ত্রীর নাম শুনে? নাকি অন্যকারণ। হঠাৎ করেই একটা ধাক্কায় স্তম্ভিত ফিরে মৌনর। নিভৃত তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি মৌন। নিভৃত মাথা চেপে চিৎকার করে বলে,
‘এই মেয়ে এই। আমার ঘরে কি তোমার? বের হও। বের হও।’

ফ্লোরের কাঁচের টুকরোতে লেগে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মৌনর হাত। মৌন হাতটা নিজের চোখের সামনে ধরে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। সবাই বলতো সে নাকি প্রখর আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন। হায়! আজ কোথায় গেলো সেই আত্মসম্মান!

নিভৃত টেনে তুলে মৌনকে। টানতে টানতে নিয়ে যায় বারান্দায়। লালবেনারসির আঁচল ঝুঁলছে ফ্লোর নামক কৃত্রিম মাটিতে। আরেকটা ধাক্কা দিয়ে বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলা হয় তাকে। নিভৃতের পায়ে জুতা ছিলো তবে মৌনের খালি পা ঝাঁঝড়া হয়ে যায় কাঁচের টুকরোতে লেগে। ফ্লোর সাদরে গ্রহণ করে নববধূর পায়ের তরতাজা রক্ত। রক্তে রক্তে বিলীন হয়ে যায় সাদা টাইলসের ফ্লোরটা। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে কনিয়াকের একটা বোতল নিয়ে চুমুক লাগায় নিভৃত। ডুবে যায় অতীতে। সেখানে কেবল আছে রুহানি, রুহানি আর রুহানি।

৫.

ছোটথেকে ভালোবাসতো কেবল নিভৃত। রুহানি পাখি তো ছোট, বোকা। ভালোবাসা কি বুঝতোনা। শুধু জানতো মাথার উপর বাবার পরে আরেকটা হাত আছে। ভরসার হাত। তার বাবুই পাখি। স্কুল, কলেজে কোনো ছেলে রুহানিকে ডিসটার্ব কিংবা প্রপোস করলেই মেরে হসপিটাল পাঠিয়ে দিতো নিভৃত। সবারবেলা সে লাজুক, নরম। রুহানিকে কিছু বললেই নিভৃত হয়ে উঠতো পাগলাটে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের গজদন্তিনীর মুখটায় এতো মায়া। কুঁকড়া চুলগুলোর সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে যেতো নিভৃত। বন্ধুমহলে লাভবার্ডস বলে খ্যাতি ছিলো তাদের। সব ভালো চলছিলো।

রুহানি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স কমপ্লিট করলো। নিভৃত বুয়েট থেকে ইন্জিনিয়ারিং পাস করলো।বাবার অফিসে নিজের যোগ্যতায় চাকরি নেয়। আহা! কি সুন্দর দিন তাদের। মুভি দেখা, রবীন্দ্র সরোবর ঘুরে বেড়ানো, একসাথে হাতে হাত রেখে হাঁটা। পারিবারিক সম্মতিতে তাদের ভালোবাসা পবিত্রতা পায়। বিয়ে নামক সুন্দর একটা বাঁধনে বাঁধা পড়ে প্রেমিকযুগল। একসাথে ঘুরে বেড়ায় সুইজারল্যান্ড, ব্যাংকক, মালদ্বীপ। কি সুন্দর সেসব দিন!

______________

‘আহা রুহানি জান চোখ ধরেছো কেন?’
‘এই তো বাবুই পাখি একটু।’

চোখ খুলে একটা বক্স হাতে পেলো নিভৃত। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে রুহানির দিকে তাকাতেই দেখে তার দুষ্টু পাখি মিটিমিটি হাসছে। সে চোখ ফিরিয়ে বক্স খুলতেই যা দেখলো তাতে ধপ করে পাশে বসে পড়লো। একজোড়া ছোটবাচ্চার জুতা। পাশে বড় বড় করে লেখা, ‘নিভৃত সাহেব আপনার ভালোবাসায় ভাগ বসাতে কেউ একজন আসছে।’

সেদিন খুশিতে রুহানিকে কোলে নিয়ে পুরোবাড়ি ঘুরেছিলো নিভৃত। আশেপাশের সবাই, আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে মিষ্টি পাঠানো হয়েছিলো। ওদের খুশিতে হেসেছিলো এই বাড়ির গাছের প্রতিটা পাতা। তবে সে খুশি বেশিদিন স্থায়ী হলোনা।

রুহানির জ্বর, মাথাব্যথা লেগেই থাকতো। প্রথমে ডক্টর প্রেগ্ন্যাসির সময় এসব হয় বলে চালিয়ে দিতেন। তবে আস্তে আস্তে সমস্যা বাড়তে থাকে। খিচুঁনি হতো প্রচুর। দৃষ্টিশক্তি হ্রাস হয়ে যাচ্ছিলো। প্রেগ্ন্যাসির তখন দুইমাস। ডক্টর মোহরাম সব শুনে কয়েকটা পরীক্ষা দিলেন। ইলেকট্রো এনকেফালোগ্রাফি, ইলেকট্রোমায়োগ্রাফি, এম আর আই সব পরীক্ষা করে রিপোর্টে ধরা পড়ে রুহানির ম্যালিগন্যান্ট ব্রেনটিউমার। যা ক্যান্সারাস।

মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে যেন নিভৃতের। পায়ে তলা থেকে মাটি সরে যায়। এবরশন করানো হয় রুহানিকে। রুহানি প্রচুর ভেঙে পড়ে। নিভৃতের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। নিভৃতের কি কষ্ট হয়নি? প্রচুর কষ্ট হয়েছে।বাচ্চাটা তো তারও ছিলো। তবে তার কাছে রুহানি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

রুহানিকে নিয়ে ছুটে যায় সেই সুদূর আমেরিকা। সাথে ছিলেন রুহানির বাবা-মা।

৬.
একটা ঘটনা আজো খুব মনে পড়ে নিভৃতের। চোখের জলটা মুছে আবারো কল্পনায় ডুব দেয় নিভৃত।
অপারেশনের তিনদিন আগে বোধহয়,

হসপিটালের বেডে শুয়ে রুহানি। শুকিয়ে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে গিয়েছে তার শরীর। পাশেই তার হাত ধরে মাথা নিচু করে বসে আছে তার বাবুইপাখি। রুহানি মৃদু স্বরে ডাকে,
‘বাবুই পাখি।’

নিভৃত হকচকিয়ে বলে,
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ জান বলো। কি?’
‘আমার সারাদেহ গানটা শুনাবে বাবুইপাখি?’
‘রুহানি!’
‘প্লিজ বাবুইপাখি।’

নিভৃত ভগ্ন কন্ঠে গান ধরে,
আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, ও ও ও
এই চোখ দুটো মাটি খেয়ো না
আমি মরে গেলেও তারে দেখার সাধ মিটবে না গো, মিটবে না
তারে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না মন, ভরবে না
ওরে, ইচ্ছে করে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখি তারে
যেন না পারে সে যেতে আমায় কোন দিনও ছেড়ে
আমি এই জগতে তারে ছাড়া থাকবো না গো, থাকবো না
তারে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না মন, ভরবে না
ওরে, এই না ভুবন ছাড়তে হবে দু’দিন আগে পরে
বিধি, একই সঙ্গে রেখো মোদের একই মাটির ঘরে
আমি ওই না ঘরে থাকতে একা পারবো না গো, পারবো না
তারে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না মন, ভরবে না।

গলা ধরে আসে নিভৃতের। ছুটে কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে হাত কামড়ে কাঁদে সে। ভিতরে কাঁদে তার জান। আল্লাহর কাছে দোয়া চায় নিভৃত যেনো তাকে নিয়ে হলেও তার জানটাকে বাচাঁয় রাখে। স্বাভাবিক হয়ে আবার ফিরে আসে কেবিনে।

__________

অপারেশনে যাওয়ার আগের দিন প্রচুর কাঁদে দুজনেই। রুহানি নিভৃতের বুকে মাথা রেখে সিক্ত কন্ঠে বলে,
‘বাবুইপাখি আমি মরে গেলে তুমি বিয়ে করে নিও। বউকে কষ্ট দিয়োনা।’
‘রুহানি চড় খাবে।’

রুহানি শুনেনা সে কথা। তার মতো বলে যায়,
‘এই বুকের বাঁ পাশটায় কেবল আমার জায়গাটা রেখো। কাউকে দিয়োনা।’

পরে আবার বলে,
‘না, দিয়ো। যদি কখনো দেখো কেউ তোমাকে আমার মতো করে ভালোবাসে তাহলে তাকে এই বাঁ পাশটায় জায়গায় দিয়ো।’

‘রুহানি চুপ করো। জান।’
‘আমাকে মনে রেখো। এই পাগলীটা তার বাবুইপাখিকে অনেক ভালোবাসে। আর তুমি কিন্তু ওয়াদা করেছো নিজের কোনো ক্ষতি করবেনা।’

কিছুক্ষণ নিরবতা। ওয়াশিংটনের বাতাস ভারী হয় তাদের নিঃশ্বাসে। রুহানি নিরবতা ভাঙে,
‘ভালোবাসা বড়ই অদ্ভুত। কেউ কখনো ভালোবাসা চেয়েও পায়না আবার কেউ পেয়েও হারিয়ে ফেলে। কাউকে আবার প্রকৃতি পেতে দেয়না। ভালোবাসা চলনশীল। কখনো থেমে থাকেনা। একসময় পুরানো মায়া কাটিয়ে নতুন মায়ায় জড়ায়। সেই মায়া থেকে প্রেম। প্রেম থেকে ভালোবাসা আর ভালোবাসা থেকে প্রণয়। ভালোবাসা হারিয়ে তিমিরে ডুবলেও আবার সবার জীবনে ময়ূখ আসে।’
‘আমার জীবনে আসবেনা। আমার সব আলো তুমি।’
‘আসবে দেখো। তোমার জীবনেও আসবে।’

________________

রুহানির লাশ নিয়ে এক অন্য নিভৃত দেশে ফিরে। অপারেশনের মাঝপথেই এই পৃথিবীর সব বন্ধন, মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমায় রুহানি।

চিৎকার করে আবার বর্তমানে ফিরে নিভৃত। একটা গানের লাইন আওড়ায়,
‘তারে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না মন, ভরবে না।’

দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে নববধূ। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। নিকষকালো অন্ধকার চারপাশে। মৌনের খুব কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে? স্বামীর অবহেলা? হাতে পায়ের ব্যথা? অনিশ্চিত জীবন? অন্যের জন্য স্বামীর ভালোবাসা? কেন?

দূরে থেকে হুতুম পেঁচা ডাকছে। অদ্ভুত! ঢাকার ধানমন্ডির মতো শহরেও হুতুম পেঁচা আছে!

(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here