রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ১৭
কোথায় যেন পড়েছিলো রোদেলা ” দুনিয়াতে অনেক খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই” কথাটা খুব সম্ভবত হুমায়ুন আহমেদ স্যারের। একটা সময় পর্যন্ত রোদেলাও হয়তো তাই-ই ভাবতো। ওর বাবা কত্ত ভালো। ছেলে আশা করে মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ওর বাবা ওকে ছেলের মতো মানুষ করেছেন। খেলনা কিনে দেবার সময় কখনো ভাবেননি খেলনাটা ছেলেদের নাকি মেয়েদের। সন্তানের শখ পূরণের জন্য তিনি সাধ্য মতো চেষ্টা করেছেন। এজন্য তিনি সেরা বাবা। ছোট্ট থেকে রোদেলা ওর মাকেই অপছন্দ করতো। শুধু শুধু ঝগড়া বাঁধায় ওর বাবার সাথে। আজেবাজে কথা বলে আর এসবের ঝাল ওর সাথে রাগারাগি, খারাপ ব্যাবহার করে মিটাতেন। বছরের তিন মাস ওরা বাবার সাথে থাকে তো নয় মাস নানুদের বাড়িতে। এজন্য ছোটবেলার স্মৃতিতে নানু-মামা-খালামনিরা সবচেয়ে বেশী।
ওর বাবা ওদের ঘর ভাড়া, খওয়ার খরচ, ওর পড়াশোনার খরচ কোত্থেকে আসে, জামাকাপড় কোথায় পায় এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। তিনি ব্যস্ত তাকে নিয়ে। আজ এই ব্যাবসা তো কাল অন্যটা। কয়দিন পরপর তার শুধু ইনভেস্ট লাগে।
তিনি হয়তো ভাবতেন যেভাবেই হোক সুন্দরই তো চলছে তো সংসার…. অথচ ওর মায়ের জীবণের উপর তুফান চলতো।
ওর মা নিজে কাপড় সেলাই করে, ছোট ক্লাসের ছেলেমেয়েদেরকে পড়িয়ে সংসার চালাতো। বাবা মায়ের অমতে পালিয়ে বিয়ে করে তাদের কাছেও যাবার মুখ নেই তার। তাই যখন খরচে আর কুলাতে পারতো না বাধ্য হয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে উঠতো। ততদিনে তার ভাগের সম্পদ মামারা বুঝিয়ে দেয় নি।
একে তো সবার অমতে বিয়ে করেছে তার উপর
ওর বাবা সুবিধার লোক না।
একটু যখন বড় হলো ও বুঝতে পারতো ঝগড়ার প্রেক্ষাপট তখন মনে মনে ভাবতো বাবাটা এমন কেন। ও যখন জিজ্ঞেস করতো বাবা তুমি আমাদেরকে ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিলে। তখন তিনি এমন এক গল্প জুড়ে দিতেন, তার কষ্ট আর দূর্ভোগের কথা শুনাতেন। তখন মনে হতো
দূর ছাই… যাই হোক হয়েছে বাবা তো ফিরে এসোছেন…
অথচ রাস্তা-ঘাটে, দাওয়াতে কিংবা বেড়াতে গেলেও কেও দেখলে জিজ্ঞেস করতো না কেমন আছো…?
পড়াশোনা কেমন চলছে…? জিজ্ঞেস করতো – তোমার বাবা কি আসছেন? লজ্জায় মরে যাবার মতো অবস্থা হতো ওর। এসব ব্যাপার ওদের তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ফেস করতে হয়েছে রোদেলাকে। ওকে এসব জিজ্ঞেস করে কষ্ট দিয়ে তারা হয়তো পৈচাশিক কোন আনন্দ পেতো কিনা কে জানে….
আর এদিকে ব্যাবসায় লোকেশান করে ঋণে জর্জরিত অবস্থা। সংসারের ঘানি তার উপর পাওনাদারদের তাগাদা, কটুকথা এসবও সহ্য করতে হয়েছে ওদেরকে।
জীবন এত্ত কিউট কেন……?
অথচ এত বছর বয়সের সংসারে তিনি বলতেই পারেন না তার কোন মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে….?
মেয়েদের প্রিয় খাবার কি…?
কোন রংটা তাদের দু বোনের পছন্দ…?
কোথায় যেতে ভালোবাসে ওরা…?
কে ওদের কষ্ট দেয়…?
কেনো ওরা কষ্ট পায়….?
এ প্রশ্নের উত্তর না আছে ওর বাবার কাছে না মায়ের…
মেয়েদের উঠতি বয়সে চিন্তা থাকে কোন রঙের জামা এখনো পরা হয় নি, কোন হেয়ার কাটে তাকে মানাবে, কোন রঙের নেইলপালিশ তার সংগ্রহে নেই, নতুন ব্যাগ, নতুন জুতা কিংবা কানের দুল। আর ওদের ভাবতে হয়েছে আগামীকাল কি খাবে ওরা, ঘর ভাড়া কোত্থেকে জোগাড় হবে… স্কুলের জমে যাওয়া বেতন পরীক্ষার ফিস কোত্থেকে আসবে, তা না হলে তো স্যাররা পরীক্ষা ও দিতে দিবে না। “বেসিক নিড যখন অনিশ্চিত শখ তখন বিলাসিতা”। তাই ও কখনোই বলতে পারে নি যে ওর একজোড়া নুপুরের শখ, একটা হারমোনিয়ামের ও।
টাকা জমিয়ে ওর মা একবার ওকে এক আনা সোনা দিয়ে একজোড়া সোনার রিং বানিয়ে দিয়েছিলো, নিচে পাতা দিয়ে। সোনার দাম এত সস্তা হওয়া সত্ত্বেও ওদের সংসারে সোনা বলতে ওর মায়ের নাক ফুল আর ঐ রিং জোড়াই ছিলো। বাকী সবি গেছে ঋণে….!
সব সময় রোদেলা দুল পরে থাকতে পারে না তাই রিং জোড়া খুলে আলমারিতে রেখে দেয় ওর মা। অনেক দিন পর নানুবাড়ি যাবার জন্য রেডি হচ্ছিল ওর মা, ও বললো মা আমার রিং গুলো দাও পরে যাই। ওর মা বললো ভালো কথা মনে করেছিস, দিচ্ছি দাড়া…
রিং আনতে গিয়ে মা পুরো আলমারির কাপড় এলোমেলো করে ফেলে সেটা খুঁজে। কোত্থাও নেই সেই ব্যাগ। অবশেষে দুলের বাক্স পাওয়া গেলো বাবার টেবিলের ড্রয়ারে। মা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রোদেলাও কিছুই বলে নি। কোন কথা না বলেও অনেক কথা বলা হয়ে গিয়েছিলো দুজনের মনে। সেদিন আর ওদের নানুবাড়ি যাওয়া হয় নি….
সংসারের এসব টানাপোড়েনে খুব ছোট্ট বয়সেই রোদেলাকে অনেক বড় হতে হয়েছিলো। একটা টাকার দাম যে একশত পয়সা তা ও খুব ভালো ভাবেই জানতো। আর এজন্যই ক্লাস সিক্স থেকেই টিউশনিতে ঢুকতে হয় ওকে। প্রথম প্রথম ওর মায়ের স্টুডেন্ট গুলো দিয়ে শুরু করে। তারপর বাইরে একজন দুজন করে পড়াতো। একটু উপরের ক্লাসে উঠে বড় ক্লাসের স্টুডেন্ট পড়ানো শুরু করে ও । রোদেলার অল্প বয়স হওয়ায় কম বেতন দিয়ে গার্জিয়ানরা পার পেতো। ভালো সার্ভিস ও পেতো, দুজনেরই উপকার। ও যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন ও ক্লাস সেভেনের এক মেয়েকে পড়াতো। এজন্য এরপর থেকে গণিতের নোটগুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতো ও । যাতে স্টুডেন্ট পড়ানোয় কাজে লাগে। ধীরে ধীরে কিভাবে যেন ও সংসারে একমাত্র উপার্জনকারীতে পরিণত হয়। জীবণ কত দ্রুত দৌড়ায়। জীবণে এত ব্যাস্ত সময় পার করতো ও যে আয়নাতে নিজের চেহারা দেখবারও সময় পেতো না।
একবার ওর বন্ধু ইরার সাথে কষ্টে কথা বলতে বলতে কেঁদে দেয় রোদেলা, বলে জানিস দিনটা ২৪ ঘন্টার হয়ে সমস্যা হয়ে গেছে। আরেকটু বড় হলে আরো কয়েকটা টিউশনি করা যেতো। এত ব্যাস্ত থাকি যে কি বলবো….
জানিস আমার থুতনিতে যে এত সুন্দর টোল আছে সেটা আমি এই কিছুদিন আগে জানলাম….
এবার বুঝ কোন জীবণ যাপন করি আমি…….
হুমায়ূন স্যারের বাবা প্রসঙ্গের কথাটা যে মিথ্যা তার প্রমাণ রোদেলার বাবা। তিনি তার স্বার্থের জন্য পারেন না হেন কাজ নেই। মেঝো মামার বিয়ের ঘটনার পর থেকে রোদেলা ওর বাবার সাথে কথা বলে না তেমন একটা। ভুল মানুষ একবার দুইবার করেন। তিনি বারবার ভুল করতেই আছেন করতেই আছেন….
ভুল করার বয়স এখন তার মেয়েদের। অথচ ওদের সমাজের কাছে ছোট হয়ে থাকা লাগছে বাবা মায়ের ভুলের জন্য। এখন সবাই বলবে এখানে ওর মায়ের কি ভুল….? ওর মায়ের ভুল বারবার ভুল করার পরও তাকে আবার ধুয়েমুছে ঘরে তোলা…, ক্ষমা করে দেয়া, তার মিথ্যা বানোয়াট বিপদে অর্থের জোগান দেয়া…
এই দুই মানুষের জন্য দুই পরিবারই অর্থনৈতিক ভাবে ভঙ্গুর। মামা, খালামনি, খালু, ফুফু, কেও বাকী নেই যার কাছে তিনি টাকা ধার করেন নি। একটা মানুষ কত নিচে নামতে পারে….
টাকা পয়াসা ইস্যুতে মেঝো খালামনির সংসার পর্যন্ত ভাঙার উপক্রম হয়েছিল।
এসব ভাবতেই নিজের জীবণের উপর ঘৃণা হয় ওর। এসব ভাবতে ভালো লাগে না। ভুলে থাকাই শ্রেয়… কিন্তু ওরা যখন নিজের মতো করে ভালো থাকার চেষ্টা করে তখন মানুষগুলো ওদের এসব ক্ষতগুলো মনে করিয়ে দেয়।
তো সেবার রোদেলার সামনে এসএসসি পরীক্ষা হওয়ায় বড় মামা ওর মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন সামনে রেদেলার জীবণের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। এ-সময় এমন করলে চলবে না। যা করার পরীক্ষার পরই তারা সিদ্ধান্ত নিবেন।
এমন করে জীবণ চলে না। অথচ রোদেলার মাকে তারা রোদেলার জন্মের আগেও আটকে রেখেছিলেন। বিয়েও ঠিক করেছিলেন অন্য জায়গায়। কিন্তু তিনি পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন তার স্বামীর কাছে। জীবণে বিয়ে কয়টা হয় এই ভেবে। আজ নিজে জ্বলছে, মেয়ে দুইটারও জীবণ অনিশ্চিত। রোদেলা মনে করে সেবার ওর মা পালিয়ে চলে না গেলেই বোধহয় ভালো হতো। ওদের জন্মও হতো না, কষ্ট ও করতে হতো না। এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল….
চলবে….
previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1500729357054917/
Next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1502112916916561/