#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্বঃ৩১
প্রিসিলা ছেঁড়া দ্বীপে থাকায় রুমে রোদেলা একা, হঠাৎ কি হলো দড়জাটা লক করে ড্রেসিং টেবিলের খুব কাছে গিয়ে বসলো ও। আয়নায় ভালো করে দেখলো নিজেকে। গলার স্কার্ফটা খাটে ছুড়ে দিলো। অপলক চোখে তাকিয়ে থাকলো ও। যেন নিজেকে নিজে দেখছে না, অন্য কোন দৃশ্য ভেসে আছে সেই আয়নায়।
একটু আগে যে রোদেলা বললো – প্রমাণ দিতে আমার বয়েই গেছে… হুহ্, মানে এমন একটা ভাব যেন সে এসব বিষয় থোরাই কেয়ার করে। সে আসলে আসল রোদেলা না..
সেটা আসল রোদেলার একটা আবরণ মাত্র।
কি হলো হঠাৎ ওর চোখ বেয়ে পানি চলে আসলো। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। আজ ওর জীবণটা এমন বলে সবাই ওকে সস্তা ভাবে। ভাবে এদের সাথে ইচ্ছে হলেই যা খুশি তা করা যায়। আজ যদি ওর জায়গায় নাতাশা থাকতো। তাহলে কেও কি পারতো একের পর এক এমন ঘটনা ঘটাতে। কিংবা ওদের নিয়ে এমন ভাবে ভাবতে। পারতো না।
শোভন সত্যিই সংযমের পরিচয় দিয়েছে। একবার না দুইবার না পর পর তিনবার। এটা সত্য যে ও ইচ্ছে করলে যা খুশি করতে পারতো তিন বারের প্রত্যেকবারেই। ও তা করে নি সংযমের পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে ওর সাথে এমন কিছু অন্য কেও যে করবে না তার গ্যারান্টি কি। তার উপর সবাই যে সংযমি হবে, সবাই যে ওকে সম্মান করবে তারও গ্যারান্টি কে দেবে।
চিৎকার করে কাঁদে রোদেলা। ওদের জীবণটা এমন কেন…?
কেন এত কষ্ট পেতে হয় সবদিক থেকেই। শোভনের মা, যিনি ওকে খুবই পছন্দ করতেন। সুখদুঃখের কথা বলতেন কাছে পেলেই । তিনিও আজ কেমন একটা নিরব অবজ্ঞা করলো রোদেলাকে। আজ যদি ওর পরিবার এমন না হতো, ওদের আর্থিক অবস্থা, পারিপার্শ্বিকতা, অনেক ভালো হতো তাহলে তিনি কি এমনটা করতেন, করতেন না। বরং সেনামুখ করে ছেলের পছন্দকে মেনে নিতেন।
ব্যাপারটা এমন যে – রোদেলা তুমি কথা, বার্তা, চাল চলনে, কাজে কর্মে খুবই ভালো মেয়ে, তোমাকে খুবই পছন্দ করি, ভালোবাসি, তবে তোমাকে ছেলের বৌ করা সম্ভব না। এমনি নিরব বার্তা ছিলো তার চোখেমুখে। সবাই ওদেরকে ভালো মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে বলে প্রশংসা করে। এ পর্যন্তই…. যে পর্যন্ত ভালো বললে প্রশংসা করলে তাদরে কোন ক্ষতি হবে না ততটুকুই করে সবাই।
তাদেরকে দোষ দেয় না ও, তারা তাদের দিক থেকে শতভাগ সঠিক। কে চায় এমন পরিবারের একটা মেয়েকে নিজের ঘরে তুলতে। কেও না…
রোদেলার মা যে নিঃস্ব প্রায় তিনিও তার ছেলে থাকলে এভাবেই ভাবতেন। এভাবে ভাবা দোষের কিছু না। দোষ ওদের ভাগ্যের। কেও ওদেরকে ওদের পরিচয়ে দেখে না, ওদের দোষ গুনে বিচার করে না। দেখে পরিবারক মর্যাদা, সামাজিক অবস্থান, আর্থিক প্রতিপত্তি সামগ্রিক ভাবে।
হাপুস নয়নে কাঁদছে রোদেলা, এর শেষ কবে, কোথায়…?
চোখের সামনে ওর পুরো জীবণটা যেন স্লাইড সো তে ভেসে যাচ্ছে। একটা মানুষের কত ধৈর্য থাকে। আর কত ধৈর্য ধরতে হবে ওকে….
আর কত….?
এমনি সময় ফোন আসে রোদেলার ফোনে।
একবার…
দুইবার…
তৃতীয় বারে অনিচ্ছাকৃতভাবে ফোনটা তুলতে বিছানার কাছে যায়। নাতাশার ফোন…
সাইলেন্ট করে রাখতেই কলটা হাতের চাপে রিসিভ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে কানে ফোনটা ধরে রোদেলা।
: হ্যালো আপা..
: হু বল
: কি যে মিস করলি না এসে, ছবি দেখলে বুঝবি,
: এ কথা বলতে ফোন করেছিস,
: আপা তুই এভাবে কেন কথা বলছিস, তোর কি শরীর খারাপ লাগছে…? কথা কেমন যেন শুনাচ্ছে…?
: না, মাথা ব্যাথা করছে…
: হও্ , আচ্ছা রাখি আপা, তুই রেস্ট নে
: ওকে..
ফোনটাকে বিছানায় ছুড়ে আবার দাঁড়ায় আয়নার সামনে…
চোখ মুখ মুছে চোয়াল শক্ত করে তাকায় নিজের দিকে। মনে মনে বলে- ভেঙে গেলে চলবে না রোদোলা, জীবণের পথ অনেক দূর্গম।
এ কারনেই রোদেলা বিয়ে নিয়ে ভাবে না। আগে সব ঠিক করবে ও। সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক প্রতিপত্তি। এতে যদি জীবণের অর্ধেকও পার হয়ে যায় হোক…
বাথরুমে গিয়ে চোখমুখে ঠান্ডা পানি ছিটায় রোদেলা। শান্ত ভাবে বসে কি যেন ভাবে কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়ায় ও। কাপড় বদলে তৈরী হয় ও। ময়েশ্চারাইজার দেয় মুখে, ভ্রু-জোড়া এঁকে চোখে কাজল পরে। হালকা রঙের লিপস্টিক দেয় ঠোঁটে। একটু দুরে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে ও। জামাটার গলাবন্ধ। সবগুলো বোতাম আটকে নিলো ও। গলায় ওড়নাটা ঝুলিয়ে নিলো।
সাজ দেখে বোঝা যাচ্ছে না কি করতে যাচ্ছে ও…
কি ভেবে যেন হঠাৎজামার দুইটা বোতাম খুলে ফেললো ও।
আমরা যতটুকু জানি রোদেলা না ভেবে কিছু করে না কখনো। কিন্তু বোতাম দুইটা খুলবার কারন আপাততঃ বোঝা যাচ্ছে না।
রুম লক করে বাইরে বের হয় ও.. করিডোর ধরে একটু এগিয়েই একটা দড়জার সামনে দাঁড়ায়। একটু সময় নিয়ে নক করে দরজায়।
একবার…
দুইবার…
তৃতীয় বারের আগেই দড়জা নক করতেই দড়জা খোলে শোভন….
রোদেলাকে দেখে ভুত দেখার মতো হতবাক হয়ে যায় ও।
দড়জা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মুর্তির মতো। যেন চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
রোদেলা দরজায় টোকা দিয়ে শব্দ করে ওর সংবিৎ ফেরাতে। বলে-
: তুমি….
: হ্যা, কেন আমি আসতে পারি না….?
: না, তা নয়,
: ভেতরে আসতে পারি…
: শিউর…
বলে দড়জা ছেড়ে দাঁড়ায় ও। একটা স্যান্ডোগেঞ্জি গায়ে ছিলো ওর। দ্রুত একটা শার্ট পরলো শোভন।
রোদেলা ওর রুমের সোফাটাতে বসলো, এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে…
শোভন দাঁড়িয়ে রইলো খাটের কাছে। রোদেলা বললো-
বসুন…
: দাঁড়িয়ে আছেন কেন…
: সমস্যা নেই,
: আমি কিছু কথা বলতে এসেছি এখানে… আমি একটু সময় নিবো, আপনি প্লিজ বসুন।
শোভন বাধ্য ছেলের মতো বসলো। কেমন যেন চুপসানো একটা ভাব ফুটে উঠলো ওর চোখেমুখে।
একটু সময় নিলো রোদেলা, কথাগুলো গুছিয়ে নিতে। তারপর বললো-
আমাকে কি মনে হয় আপনার বলেন তো …?
: তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না…
: আমি স্পষ্ট বাংলায় কথা বলছি। না বোঝার কিছু নেই..
কি মনে হয় আপনার আমাকে…?
আমি ব্রোকেন ফ্যামলির কেও, যখন যা খুশি তাই করা যায় আমার সাথে কেও জবাবদিহি করবার নেই তাই কি…?
: নাহ্, মোটেও না।
: তাহলে পরপর তিন বার কোন সাহসে আপনি আমার সাথে এমন করেছেন…? কেন অপমান করেছেন আমাকে…?
: কোনটাকে তুমি অপমান বলছো…?
: মেয়ে মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই নাজুক, স্পর্শকাতর, আমি দূর্বল কথাটা এখানে ইচ্ছে করেই ব্যাবহার করলাম না। কারন মেয়েরা দূর্বল না, যার প্রমাণ আমি নিজে। আপনি একটু আগে যে আমাকে অপমান করেছেন তার দুইঘন্টাও পার হয় নি… তারপরও আমি এখানে…! যদি দূর্বল হতাম তাহলে এখান অব্দি আসতে পারতাম না। আশাকরি ব্যাপারটা বুঝেছেন।
শোভন তাকিয়ে আছে, কিছুই যেন বুঝতে পারছে না ও কি বলছে ও, আন্দাজও করতে পারছে না কি বলতে চাচ্ছে…
: আল্লাহ এই নাজুক বৈশিষ্ট্য দিয়েই মেয়েদের তৈরী করেছেন। আপনাদের দৈহিক কাঠামোগত দিক থেকে আপনারা সবল। তাই বলে কি তাদের নাজুকতায় বারংবার আঘাত করবেন সবল হয়ে….
: আমি সরি রোদেলা… আমি এভাবে ভাবি নি…
: এ পর্যন্ত এতবার এই শব্দটা ব্যাবহার করেছেন যে আপনার মুখের উচ্চারিত এই শব্দটা তার নিজের ওজন হারিয়ে ফেলেছে। এ শব্দটা আর বলবেন না দয়া করে। আমার কাছে আপনার ক্ষমা চাওয়ার কোন দরকার নেই। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
: ধন্যবাদ, আমি তোমাকে অপমান করতে এসব করি নি। ভালোবাসার দাবিতে….
কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রোদেলা বললো
: আমি কি একবারও বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি…
: নিশ্চুপ শোভন,
: বলুন…?
: আপনি আমাদের আত্নীয়, তাই খুব সুন্দর করে বোঝাতে চেয়েছি যে এ সম্পর্কটা সম্ভব না। আপনার জায়গায় অন্য কেও থাকলে এতবার অপমান করার সাহস আমি তাকে দিতাম না…
: বারবার অপমান শব্দটা বলছো কেন…
: ঠিক যতটা ক্ষত আমার ভিতরে হয়েছে, ঠিক ততটুকু ফেরত দিতে… আমি মোটেও সহজ কোন মেয়ে না, আমি আমার জীবণের চেয়েও জটিল। আপনার এত সুন্দর জীবণটা আমার সাথে জড়িয়ে নষ্ট করুন তা আমি চাই না, তাই আপনাকে বারবার আমি নিষেধ করেছি আমার সাথে নিজেকে জড়াতে…. আর এটাকে আপনি কি ভেবেছেন আপনিই জানেন…
: আমি তোমাকে নিজের করে পেতে চেয়েছি, এর বেশী কিছু আমি জানিনা…
: বাস্তবতা যখন ফেইস করবেন তখন সবই জানতে পারবেন। যখন মা, বোন, আত্নীয়, বন্ধুবান্ধবদের কথা শুনবেন তখন…
চুপ হয়ে যায় রোদেলা। কিছু সময় নিরব থাকে ও। কি বলবে তা ভাবছে হয়তো…
বিরতির পর রোদেলা বলে-
আমার প্রিয় কিছু মানুষ যখন মারা যায় আমি তাদের শেষবারের মতো দেখতে যাই না, কেন জানেন, আমি চাই তারা আমার স্মৃতিতে জীবন্তই থাকুক। মৃত লাশ হয়ে শুয়ে থাকার স্মৃতি আমি জমা করতে চাই না। এজন্য আমার মা অবশ্য আমাকে পাষাণ ভাবে।
আমি চাই না দুনিয়ার বাস্তবতা দেখে আপনি বদলে যান। এই প্রেমিক শোভনের স্মৃতিই থাকুক আমার কাছে। আজকে এই মুহুর্তে এই বিষয়ে কথা বলা এখানেই শেষ হলো। এরপর থেকে এসব বিষয়ে কোন কথা হোক তা আমি চাই না।
আমি অনুতপ্ত, আমার জন্য আপনি এক্সিডেন্টের মুখোমুখি পর্যন্ত হয়েছেন। আমার সাথে জড়ালে কি কি হবে তা ভাবতেও পারবেন না আপনি। জানেন তো আমার মা আমাকে অপয়া বলে… এর অর্থ আপনি জানেন নিশ্চয়ই।
আজ থেকে আমরা আত্নীয়ই শুধু। এর বাইরের কোন পরিচয় নিয়ে আপনি আমার সামনে আসবেন না। এটা অনুরোধ না ওয়ার্নিং। কোমল রোদেলাকে দেখেছেন আপনি, আমার একটা কঠোর রূপও আছে…
বলেই উঠে দাঁড়ায় ও। পা বাড়ায় দড়জার দিকে। খাটে বসেই শোভন বলে- তুমি সব শেষ বললেই তো শেষ হয়ে যাবে না রোদেলা, ব্যাপারটা যে এতোও সহজ না তা তুমিও জানো…
রোদেলা শুনেও না শোনার ভান করে, কোন প্রতিত্তোর না দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে….
চলবে….
(সবাই কমেন্ট করে জানাতে ভুলবে না কিন্তু, আর হ্যা খুব শীঘ্রই একটা গেইম শুরু করবো আমরা…)
previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1519216561872863/
next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1520762401718279/