নানান বরণ মানুষ রে ভাই চতুর্দশ পর্ব (১৪ তম পর্ব) বড় গল্প

0
263

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
চতুর্দশ পর্ব (১৪ তম পর্ব)
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষ এতো চিন্তা করে, এটা বুঝেও বোঝে না ভাগ্যের চাকা বদলাতে এক মুহূর্ত লাগে। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ওমর খান পথের ফকির। কানাকড়ি সম্বলও নেই। রিয়ার কলেজের যে বেতন,সেটাও স্হায়ী ভাবে বন্ধ হয়ে গেলো। কারণ স্বামী -স্ত্রী দুজনেই জেলে। এক বৃদ্ধাকে মেরে ফেলার হীন চক্রান্ত, জোর করে অন্যায় ভাবে সম্পত্তি আদায়ের চেষ্টা, প্রথম স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে দ্বিতীয় বিবাহ। আফরোজা বেগম এই শরীরেও থানায় যেয়ে ছেলে আার তার বৌএর নামে মামলা করেছেন। তাঁর উপরে দীর্ঘ দিন চলা অত্যাচারের বর্ণনা ও চিহ্ন দেখে পুলিশ সহ সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। আফরোজার ইচ্ছা অনুযায়ী সব সম্পত্তি রেখার নামে ট্রান্সফার করা হয়েছে। রেখার অবর্তমানে মালিক হবে শিমুল আর পলাশ।

রিয়ার পরিবার থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া গেলোনা। রিয়ার বাবা-মা অসুস্থ ও বয়স্ক। এরমধ্যে রিয়ার আব্বার ফুসফুসে ক্যান্সার, আর তাঁর স্ত্রী স্ট্রোক করে প্যারালাইজড। ছেলে-ছেলের বৌরা ঠিকমতো দেখেনা। এমপি ভাইয়ের বদৌলতে হাসানের দারুণ প্রভাব। তাছাড়া তিনি নিজেও যেমন সফল,ধনবান ব্যবসায়ী, তেমনই প্রবল জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। মানুষের উপকার করা তাঁর নেশা। এমপি ভাই-এর কিছু লোকজন সাথে নিয়ে তিনি রিয়ার ভাইদের পাকড়াও করলেন। নানারকম আইনি ঝামেলা সামলে তিনি খান বাড়ির সম্পত্তি খান বাড়িকে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হলেন।রেখার তীব্র আপত্তি স্বত্ত্বেও সেটা তাঁর নামে করা হলো।

শিমুলের হয়েছে জ্বালা। সে পাঁচ দিন গ্রামে হাসান মামার বোন রাবেয়া খালার কাছে থাকে, স্কুল করে,বৃহস্পতিবারে আবার খান বাড়িতে ফিরে আসে।শনিবার সকালে পুণরায় গ্রামে যাত্রা। রেখার একই কথা,”পড়্,পড়্ মা, পড়া ভিন্ন গতি নেই। মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো খুব দরকার। হাসান ভাই না থাকলে তোদের দুজনকে নিয়ে আমি কি করতাম, আল্লাহ জানেন।
লেখাপড়ায় গলতি যেন না থাকে।” এতো উপদেশের দরকার ছিল না,লেখাপড়া করতে শিমুলের এমনিতেই খুব ভালো লাগতো। রেখার এই বাড়িতে থাকার এতোটুকু ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু অসুস্থ শাশুড়ি আর ওমর-রিয়ার চার সন্তানের জন্য থেকে যেতে হয়েছে। বাচ্চাগুলো যদিও বাপ-মায়ের মারধোর খেতো, বকা খেতো,বাপ-মা’র মারামারি কাইজা দেখে ভয়ে অস্হির হয়ে যেতো, তবু বাপ-মা বলে কথা। দুজনেই জেলে যাওয়ায়
বাচ্চা চারটার শোকের সীমা ছিলো না। রেখার আদরে,মমতায়,যত্নে আস্তে আস্তে তারা স্বাভাবিক হয়েছে। শিমুলও ওদের খুব ভালোবাসে। পলাশের মতো অতটা না হলেও ভাইবোনগুলোকে শিমুল খুবই ভালোবাসে। ওদেরতো কোনো দোষ নেই। এতো নিষ্পাপ,টুলটুলে একেকটা বাচ্চা। ওরাও আপা অন্ত প্রাণ। পলাশকে তারা মাথায় তুলে রাখে। ভাইয়া,ভাইয়া করে অস্হির করে দেয়। মৌরি পলাশকে খাইয়ে দিতে খুব ভালোবাসে। সব ভাই বোন বাড়ির সামনের ও পিছনের বাগানে খেলা করে। ওরা জেনেছে,রেখা ওদের আরেকজন মা। শিমুল -পলাশের দেখাদেখি তারাও রেখাকে মা বলে ডাকে।মা তাদের ভীষণ ভালোবাসেন,মজার মজার রান্না করে খাওয়ান, গল্প বলেন, এতোটুকু বকা দেন না। মুমু রাতে মায়ের বুকেই ঘুমায়।

রেখা নিজে শাশুড়ির দেখাশোনা করেন। এখন মন্জু,মতির মা, সখিনা সবার হাবভাব পাল্টে গেছে। রেখা-শিমুল-পলাশের সামনে বিনয়ে বিগলিত। মন্জু সেদিন শিমুলকে খুশি করার জন্য মিথুনকে কি একটা কারণে বকা দিল,”পাজী মাইয়া। ভীষণ দুষ্ট। হইবো না কেন?যেমন বাপ,মা, তেমন ছা। লেখাপড়ায় বলদ। শিমুল আপারে দেইখা শেখ্। ”

শিমুল মিথুনকে জড়িয়ে ধরলো। কপালে চুমু খেয়ে বললো,”আমার মিথুন আপুটার মতো লক্ষী মেয়ে আমি আর একটাও দেখিনি। যাও তো সোনা, তুমি একটা নৌকার ছবি এঁকে নিয়ে এসো। পালতোলা নৌকা।ঠিক আছে?”
বোনকে খুশি করার জন্য মিথুন দৌড় লাগালো।শিমুল মন্জুকে বললো,”বুড়ি হতে চললে,স্বভাব পাল্টালো না। ছোট ছিলাম,কিন্তু তোমার ব্যবহারের কথা কিচ্ছু ভুলিনি। তোমাকে আমি আর দাদী ছাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম, তোমার চৌদ্দ গুষ্ঠিতে কেউ নেই, এখন তোমাকে কেউ কাজে নিবে না,এসব কথা বলে মা আমাদের চুপ করিয়ে দিলো।কিন্তু তুমি যদি আর একদিনও এই পরিবারের কোন সদস্যের সাথে এতোটুকু খারাপ ব্যবহার করো, তোমাকে আমি সেই দিনই ছাড়িয়ে দিবো।”

আফরোজা বেগম এখন অনেকটা সুস্থ। রেখার স্বভাব সম্পর্কে তিনি আগের থেকেই জানতেন, কিন্তু রেখার সহনশীলতা, নম্রতা,দায়িত্ববোধ,সবার দিকে খেয়াল রাখার,সবাইকে ভালোবাসার ক্ষমতা
আফরোজাকে নতুন করে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। নিজেকো খুব ক্ষুদ্র মনে হয়। জীবনটা একেবারে ব্যর্থ। ছেলের এতোটা অধঃপতন হয়েছে তাঁর আশকারায়। আজ নিজের পেটের ছেলেকে তাঁর ঘেন্না লাগে।এর থেকে কষ্টের কিছু আছে? নিজেও তো পাপ কম কিছু করেন নি।

রিয়া গর্ভবতী। বেশ অসুস্থ। চার সন্তানের চিন্তায় উন্মাদপ্রায়। হাই প্রেশার। তাঁকে পুলিশ প্রহরায় হাসপাতালে রাখা হয়েছে। সেখানেই তাঁর একটি পুত্র হলো।

সবাইকে আনন্দের সমুদ্রে ভাসিয়ে শিমুল এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় ও মেয়েদের মধ্যে প্রথম হলো। পাড়া গাঁয়ের একটা সাধারণ, নাম না জানা স্কুল হতে এমন রেজাল্ট করায় সাংবাদিকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। জেলে বসে ওমর খান শুনলেন।
মেয়ে তাঁর মেধা পেয়েছে। রেখা-শিমুল-পলাশের জন্য অনেকদিন ধরেই তাঁর মনে কোমল অনুভূতি তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে শিমুলের জন্য। তাঁর প্রথম সন্তান। কেমন ভাবে মানুষ হওয়ার কথা ছিল সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে, হেসে খেলে,আদরে যত্নে, আর বাস্তবে কতো কষ্ট সহ্য করেই না বড় হলো।জেলে বসে ভাবনার অনেক সময় পাওয়া যায়। তিনি নিজের জীবন নষ্ট করেছেন। কিন্তু কেন তাঁর এতো অধঃপতন হলো? মা সবসময় অতি আহ্লাদ দিয়েছেন, আশকারা দিয়েছেন, এটা সত্য। তা এরকমটা তো অনেক মা ই করে। বাবার মতো নীতিবান লোক তিনি কম দেখেছেন। তাঁর সন্তান হয়ে এতোটা অধঃপতন হওয়াটা একটু অস্বাভাবিক। বাবা যথেষ্ট যত্ন করে, সময় দিয়ে, নীতিশিক্ষা দিয়ে ছেলেকে মানুষ করেছিলেন। ভালো স্কুল , ভালো কলেজ,ইন্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি। তিনি প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়েছেন। এমন নয় যে বাবার মৃত্যুর পরে এতো টাকা দেখে তাঁর মাথা ঘুরে গেছে। তাহলে কোন ফাঁকে কেমন করে তিনি মদ্যপ, নারীলোভী, অলস,অপদার্থ হয়ে গেলেন? কোন অপরাধে তিনি রেখার সাথে সারাটা জীবন এতো অন্যায় করলেন? কিসের নেশায় পড়ে তিনি নিজের ঔরসজাত সন্তান শিমুল-পলাশকে জীবন থেকেই মুছে ফেলেছিলেন? কতোটা দানব হলে নিজের মা’কে না খাইয়ে রাখা যায়?এ কি করলেন সারাজীবন ওমর খান? নিজেকে অনবরত প্রশ্ন করেন তিনি, উত্তর মেলে না।লোক মারফত শুনেছেন, তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তানেরা বিমাতার কাছে পরম আদর ও যত্নে আছে। তাদের খাওয়া-দাওয়া,লেখাপড়া কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে না। তারা এখন মহাসুখে আছে।নিজেদের মা বা বাবার জন্য তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। মানবিক কারণে শিশুসহ রিয়াকে পুলিশ হাসপাতালে রাখা হয়েছে। কিন্তু কতো দিন?একসময়ে তো রিয়াকে আবার জেলে ঢুকতে হবে,তখন বাচ্চাটার কি গতি হবে?

শিমুলকে তার দাদী এক সেট গয়না বানিয়ে দিয়েছেন ভালো রেজাল্টের জন্য। মহিলা সত্যি ই এখন শিমুল -পলাশকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। কিন্তু শিমুল মায়ের মতো গলে যেতে পারে না। যতোটা সম্ভব দাদীকে সে এড়িয়ে চলে। শিমুলের শুধু নিজেদের বাড়িটার কথা মনে হয়। ওখানে চলে যেতে ইচ্ছে করে। মা,পলাশ,মৌরি, মুকুল,মিথুন, মুমু আর সে।মা’কে সে তার মনের কথা জানিয়েছে। রেখা মেয়ের কথা নাকচ করে দিলেন। “তোর দাদীকে এই অবস্থায় ফেলে যাওয়া যায়?সেটা কি মানুষের কাজ? আর এখানে কতো ভালো ভালো কলেজ, এগুলো ফেলে তুই ওখানের কলেজে ভর্তি হবি? ”

“মা,এই বাড়িতে থাকতে ভালো লাগে তোমার?”

“ভালো লাগা-মন্দ লাগার কথা ভাবি না শিমুল। আমার কাছে কর্তব্য আগে।তোমার দাদীর চিকিৎসা গ্রামে হবেনা।উনাকে এই অবস্থায় ফেলে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না। বাচ্চারা আমার কাছে আমানত।ওদের বাপ-মার অনুমতি ছাড়া ওদের আমি গ্রামে নিয়ে যেতে পারিনা। তুমি খুবই মেধাবী, সেই সাথে লেখা পড়া করেছো অনেক মন দিয়ে, তাই ঐ স্কুল হতে তুমি এমন রেজাল্ট করলে। কিন্তু এরা সেটা পারবে না। এদেরকে এখানকার ভালো স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আমি তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারি না। এদের বাপ-মা ফেরত এলে বাড়ি-বাচ্চা বুঝিয়ে দিয়ে আমি গ্রামে ফিরে যাবো।”

“বাড়ি বুঝিয়ে দিবে মানে?বাড়িতো তোমার নামে। শোনো মা,জীবনে অনেক কষ্ট করেছি,অনেক বঞ্চনা সহ্য করেছি।আর কষ্ট করতে আমি রাজি না। এই বাড়ি,বাগান সব মিলে বহু টাকার প্রপার্টি। এবং এই প্রপার্টি আমাদের। বাড়ির দলিল আমি দাদীর কাছ থেকে নিয়ে রাখবো।তোমাকে বিশ্বাস নেই। তোমার মহত্বের জন্য আমি আর পলাশ সাফার করতে পারবোনা। ”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here