# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
প্রথম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
বিবাহিত বড় বোন বাসায় আসলে কার না ভালো লাগে?আমার ভালো লাগেনা। আসে,কয়েক ঘন্টা থেকে চলে যায়।এই কয়েক ঘন্টা বোধহয় আমাদের ঘরে ফেরেশতারা ঢুকেন না। শুধু গীবত আর গীবত। আম্মু আর আপা মিলে। আর এতো নেগেটিভ কথাবার্তা, আচরণ, কি আর বলবো।
প্রথম প্রথম ওদের কাছে বসে থাকতাম মা-বোনের গায়ের গন্ধ পাওয়ার জন্য, এখন শতহস্ত দূরে থাকি।
আপা,আম্মু আর আব্বু সবসময়ই একটু সমালোচক ধাঁচের। তাঁদের চোখে পৃথিবীর সবারই অল্প বেশি খুঁত আছে, বড় চাচী উপরে ভালো কিন্তু ভিতরে ভিতরে নাকি দারুণ কুটনি, বড় চাচা নাকি দাদা-দাদীর বেশি বেশি দেখাশোনা করেছেন বেশি সম্পত্তি আদায় করার জন্য, পাশের বাড়ির আংকেল নাকি চরম ঘুষখোর, তিথি মামীর নাকি চরিত্র ভালো না। এসব শুনতে শুনতেই ছোট থেকে বড় হয়েছি। আগে আমিও তাল মিলিয়ে বদনাম করতাম,যেমন শবনমকে বিনা কারণে টিচার বেশি নম্বর দেন। আম্মু সাথে সাথে বলতেন,”দেবে না? বাপ-মা দুহাতে কামাই করে, সব টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়ে, লোক ঠকানো টাকা, এই স্যারকে শার্ট দেয়, ম্যাডামদের দামী দামী শাড়ি দেয়,শবনম ফার্স্ট হবে না তো কে হবে?”
সবাই মাথা ঝাঁকাতো,আমিতো আরও বেশি, কিন্তু আমিও যে সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়ি, আম্মুও যে প্রায় স্যার-ম্যাডামকে এটা সেটা গিফট দেন,তা যেন ঐ সময়ে আমরা বেমালুম ভুলে যাই।
এসএসসির পরে হলিক্রস কলেজে পড়ার সময় আমার পরিবর্তন ঘটা শুরু
হলো। একেতো মিস্ রা পড়াতেন দারুণ, তার ওপরে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে কি সুন্দর সুন্দর উপদেশ দিতেন। কি মিষ্টি করে কতো কথা বলতেন। তার উপরে কয়েকজন বন্ধু জুটলো। ওদের ধ্যান ধারণা, কথাবার্তা, কাজ কর্ম আমার থেকে অনেক আলাদা। স্কুলে আমি আর আমার ফ্রেন্ড সার্কেল মিলে খুব কুটনামি করতাম এর ওর নামে, এমনকি নিজেদের মধ্যে ও। কোন ম্যাডাম মোটা, কে কড়া লিপস্টিক দিয়ে আসে, কোন্ ম্যাডামের স্বামী বাড়িতে তাঁকে বেধড়ক পেটায় তাই ম্যাডাম ক্লাসে এসে সেই রাগ আমাদের উপরে ঝাড়েন, কোন স্যার দারুণ সুপুরুষ, কোন স্যার লুচ্চা,কোন ছাত্রীর মা আসলে একজন প্রস্টিটিউট, কোন্ মেয়ে কোন্ ছেলের সাথে প্রেম করে,এগুলোই ছিল আমাদের আলাপ-আলোচনার মুখ্য বিষয়। এ পর্যন্ত কয়টা ছেলে আমার জন্য ফিদা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে রীতিমতো সুপ্ত প্রতিযোগিতা হতো বান্ধবীদের মধ্যে। অবসর কাটতো মোবাইল টিপে আর গাল গপ্পো করে,সে বাসাতেই হোক আর স্কুলেই হোক। তবে আম্মুর ভয়ে পড়ালেখা ঠিক করে করতাম তিন বোনই, ফার্স্ট না হলে পিঠে চামড়া অবশিষ্ট থাকতো না।
কলেজে এসে, নতুন বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে, মিসদের সুন্দর সুন্দর কথা শুনে ধীরে ধীরে আমি পাল্টাতে লাগলাম। নিজেকে বড় নীচ মনে হলো। মানুষ কতো মহৎ চিন্তা ও কাজ করে, অপরের দোষ না খুঁজে নিজের দোষটা উপলব্ধি করে, অনুতপ্ত হয়, নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করে, বন্ধুরা ভুল করলে তাদের আড়ালে বংশোদ্ধার না করে বরং সামনাসামনি কি সুন্দর করে ভুলটা ধরিয়ে দেয় যেন অপরাধীর বুকে আঘাত না লাগে, সমাজ নিয়ে দেশ নিয়ে এখনই কারোর কারোর কি বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা।
আমি গভীর অন্ধকার হতে আলোর জগতে এসে পড়লাম। এখন মিথ্যা বলিনা, মনের আনন্দে পরচর্চা করতে বসিনা, কার বাসায় কয়টা হাঁড়ি তা নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করিনা।বাসায় যখন গীবতের আসর বসে আমি উঠে যাই।কয়েকদিন চেষ্টা করেছিলাম ওদের বুঝাতে যে পরের নিন্দা করা ঠিক নয়,যা বলার সামনে বলো, ওরা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। আমার নাম দিয়েছে ভণ্ড ফেরেশতা। আমাদের বাসায় গৃহকর্মীরা বেশ কষ্টে থাকে। এটার প্রতিবাদ করতে যেয়ে চরম নাজেহাল হয়েছি। এখন আমি আমার মতো থাকি। বাসার সবাই যে সবসময় খারাপ গল্পগুজব করে,তা তো না। সাধারণ গল্পের আসরে যোগ দিই।
একদম প্রথমে যে কথা বলছিলাম। বড় আপা ডাক্তার। ইন্টার্নশিপের সময় তার বিয়ে হয়। দুলাভাই আর আংকেল -আন্টি খুবই ভালো।আপার দেবর-ননদরাও ভালো। আপার বড় জা তিথি ভাবীতো খুবই ভালো। কিন্তু ক’দিন পর থেকে আপার নালিশ শুরু হোলো। শ্বশুরবাড়িতে নাকি প্রাইভেসি থাকছে না। আমি তো শুনে হাঁ। অতো বড় বাড়িতে প্রাইভেসির অভাব? আপার নিত্যদিন ঘ্যানঘ্যানানি শুনে আম্মু বললো,”তোর রুমে গুষ্টি এসে আড্ডা মারে নাকি?”
“মারে মাঝেমধ্যে। ”
“ড্রইং রুম নাই? তোর রুম কি সরাইখানা নাকি যখন যার খুশি আসবে আর আড্ডা মারবে? জামাই বলে না কিছু? ”
“সে তো একটা রাম গাধা। মিনমিনে। অকর্মার ঢেঁকি। ”
আমার খুব খারাপ লাগলো।দুলাভাই আমার অতি প্রিয় মানুষ। একদম সাদামাটা। দুলাভাইকে প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব আপা ই দিয়েছে। আব্বু-আম্মুর তীব্র আপত্তি ছিলো, বিয়ে নিয়ে আলোচনার সময় ঠারে ঠুরে দুলাভাই এর বাবা-মাকে অনেক কথাও শোনালো,যেন জমিদার বাড়ির কন্যা তাদের কোনো প্রজার বাড়িতে বৌ হতে যাচ্ছে, প্রজা আর তার বাপ-মায়ের ষড়যন্ত্রে। ব্যাপারটা তা না, দুলাভাইও আপার পেছনে হত্যে দিয়ে পড়েনি, দুলাভাই এর ফ্যামিলিও আপাকে বৌ হিসাবে পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পায়নি। ছেলের আপত্তি নেই,তাই বাপ-মায়েরও আপত্তি নেই। দুলাভাই এর বাবা-মায়ের উচিৎ ছিল আমার বাপ-মায়ের খুবই লজ্জাজনক, হাবিজাবি কথাবার্তার কড়া জবাব দেওয়া।
এই যে আপা দুলাভাইকে রামগাধা,মিনমিনে,অকর্মার ঢেঁকি বললো, লেখাপড়া তাহলে কি কাজে লাগলো তার জীবনে। আমার আম্মুও চাকুরিজীবী,পদস্হ কর্মকর্তা, জীবনে তাহলে উনি কি শিখেছেন আর সন্তানদেরই বা কি শিক্ষা দিয়েছেন?
আর ভেতরের কিছুটা খবর আমি জানি। আপার ঘরে হয়তো চার-পাঁচদিন
আত্মীয় স্বজনেরা একটু আড্ডাবাজি,হৈ হুল্লোড় করেছে, তা সে নিজেদের মনের আনন্দে আর নতুন বৌকে সম্মানের সাথে সাহচর্য দিতে, তারপরে যখন বৌয়ের মনোভাব টের পেয়েছে, তখন থেকে আর আপার ঘরে সহজে কেউ যায় না।তিথি ভাবীর ঘর অবারিত।
আম্মু বললেন,”স্পষ্ট বলে দিবি,আমার ইন্টার্নশিপ চলছে,আমাকে অনেক কাজ করতে হয়, তাছাড়া আমার পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য লেখাপড়া করা দরকার, আমার রুমে দয়া করে ভীড় জমাবেন না।”
“একটু রেষ্ট ও নিতে পারি না।”
কিছুদিন পরে আপা তার বইপত্র, ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে আমাদের বাসায় চলে এলো। হাসপাতালে প্রায় আপা ফাঁকি দেয়,নিজের কাজ কলিগকে গছিয়ে দেয়।এসব খবর আমি পাই আমার বন্ধু রেহনুমার থেকে।রেহনুমা পায় তার বোনের থেকে যিনি আপার ইয়ারমেট। পোস্ট গ্রাজুয়েশনের পড়ার কথা বলে আপা অল্প স্বল্প পড়েও,কিন্তু বেশির ভাগ সময় মোবাইল টিপে আর ফেসবুক চালিয়ে তার সময় কাটে। দুলাভাই মাঝেমধ্যে আসেন, আপাকে নেওয়ার কথা বললেই আব্বু,আম্মু,আপা একযোগে সুর তোলেন,দুলাভাইদের বাসায় প্রাইভেসি নেই, পড়ার পরিবেশ নেই, দুলাভাই এর বোনেরা ঘন ঘন বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসেন,ভাগ্নে-ভাগ্নীর চিৎকারে বেঁচে থাকা দায়। আম্মু বলেন,” ও তো খুব ব্রিলিয়ান্ট, ইন্টার্নশিপ পিরিওড খুবই ইম্পরট্যান্ট, ভালো করে ট্রেনিং করা দরকার, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য লেখাপড়ার ভালো পরিবেশ দরকার।ও এখানেই থাকুক।তুমিও চলে আসলে ভালো হয়।”
“জ্বী না,আমি চলে আসবো না। তবে আমাদের বাড়িতে পড়ার পরিবেশ নেই, কথাটা ঠিক না। রীতুকে সংসারের কোনো দিক দেখতে হয়না,ওকে কেউ কোনো উৎপাতও করেনা। তার রুমেও কেউ ঢুকে না।”
“ও যখন ওর মায়ের বাসায় বেশি কমফোর্ট ফিল করে,তাহলে এখানেই থাকুক না। লেখাপড়ায় কনসেনট্রেট করতে পারবে। তুমি যেমন তোমার মাকে ছাড়া শ্বশুর বাড়ি থাকবে না,একই কথা আমার মেয়ের ক্ষেত্রেও তো খাটে,তাইনা? ”
দুলাভাই হতাশ হয়ে চলে যান, মা বিজয়ী মুখে টিভি দেখেন, আপা পড়ার নামে ফেসবুক চালায়। মাসে একবার-দুবার শ্বশুর বাড়ি যায়। মেহমানের মতো কয়েক ঘন্টা থেকে চলে আসে। খানিকক্ষণ শ্বশুর বাড়ির বদনাম করে। তারপরে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
মেজো আপা আমাকে একদিন ফিসফিস করে বললো,”খুব জঘন্য একটা ঘটনা ঘটেছে রে। আপা আরেকজন ফিঁয়াসে পাকড়াও করেছে। খুবই দহরম মহরম চলছে। রাগে আর ঘেন্নায় আমার গা কাঁপছে। ”
মেজ আপাও ডাক্তারি পড়ে,ফোর্থ ইয়ারে। আপার কথা শুনে আমি হতভম্ব। বিয়ের এক বছর হয়েছে কি হয়নি, এর মধ্যে ই রুচি পরিবর্তন? মেজ আপা আর আমি মিলে সব প্রমাণ যোগাড় করে আব্বু-আম্মু আর খোদ আসামীর সামনে পেশ করলাম। বড় আপা এটাকে চরম মিথ্যাচার, নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিতে যেয়েও পার পেলো না। অনেক প্রমাণ আমাদের হাতে।মেজ আপা কিভাবে যেন যোগাড় করেছে।
আপার অস্বীকার করার উপায় থাকলো না। আম্মু ঠাস করে এক চড় কষালেন। আপার নৈতিক পতনের জন্য না, আপা কেন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের প্রস্তুতি না নিয়ে বেলেল্লাপনায় সময় কাটাচ্ছে তার জন্য। আম্মু হিসহিস করে বললেন,”এইবারে তুমি পাশ করতে পারো নি,আমার গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করছিলো, পরের বার যদি পাশ না করো,দা দিয়ে দুই টুকরো করে ফেলবো।”
বড় আপা পাশ করার প্রতিশ্রুতি দিলো আর নয়া প্রেমের কারণ হিসেবে দুলাভাই এর নিস্পৃহতা, রোমান্টিকতার চরম অভাব, শ্বশুর বাড়ির মানসিক অত্যাচার, শাশুড়ির ট্যারাব্যাকা কথাকে দায়ী করলো। আমি বললাম,”তুমি সবটাই মিথ্যা বলছো আপা।” আম্মু আমাকে ধমক দিয়ে বললেন,”বাইরে থেকে লোককে দেখে জাজ করা অতো সহজ না। যে ঘর করে সে জানে।”
মেজ আপা ফোঁড়ন কাটলো,”আপা ঘর করলো কই?”
কেলেংকারী বেশি দূর গড়ায়নি। আম্মু মধুর করে দুলাভাইকে ডেকে পাঠালেন। বললেন,”ভেবে দেখলাম একসাথে স্বামী-স্ত্রীর থাকাটা খুব দরকার, নইলে বন্ডিং ঠিকমতো হয় না,মানুষও দশ রকম কথা ছড়ায়,কাজ না থাকলে যা হয় আরকি। তুমি রীতুকে নিয়ে যাও বাবা। তোমার কথা ভেবে ওরও মনটা খারাপ থাকে,বুঝি।”
আপা চলে গেলো। আম্মু হিসহিসিয়ে বললেন,”এবারে কোনো মতে ম্যানেজ করেছি। ভবিষ্যতে এমন কোনো কথা যেন না শুনি। সমস্ত ফোকাস থাকবে লেখাপড়ার দিকে। ওনলি লেখাপড়ার দিকে। বুঝলে?”
এতো কিছুর পরেও আম্মু দুলাভাইকে বললেন,” ওর তোমাদের বাড়ি যেতে ইচ্ছে হচ্ছে, যাচ্ছে। তবে বাবা, আমি কিন্তু মেয়ের ক্যারিয়ারের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। প্লিজ,তোমরা ওকে পড়ালেখার সুযোগ দিও, সারাদিন যেন লাইব্রেরিতে পড়তে পারে, আমার বেয়ান যদি নিজের মেয়ের মতো আমার মেয়েটাকেও দেখতেন,খুব ভালো হতো।”
“কি করেছেন আমার মা?”
“তিনি পুরানো ধ্যান ধারণার মানুষ। আশা করেন বৌ রান্নাবাড়া করবে, শ্বশুর -শাশুড়ির টুকটাক সেবাযত্ন করবে,বাড়ির দেখভাল করবে।এসব আশা উনি করতেই পারেন। কিন্তু ডাক্তার বৌ এগুলো করবে কি করে?তাকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হতে হবে, ডাক্তারি করতে হবে, ওর তো রান্নাঘরে হাঁড়ি ঠেললে হবে না বাবা।”
“আমি যতদূর জানি,রীতুকে রান্নাঘরে ঢোকা লাগে নি।আমাদের লোকজন আছে কাজ করার জন্য। মা,ভাবী সুপারভাইজ করেন। রীতুকে কিছুই করতে হয় না। কেউ ওর কাছ থেকে কিছু আশাও করে না। যাহোক,আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না, রীতুকে কিছুই করতে হবে না।”
ওরা চলে গেলে আমি বললাম,”আম্মু, আংকেল -আন্টি-ভাবীকে জড়িয়ে তোমার কথা বলা ঠিক হয়নি। উনারা অসম্ভব ভালো মানুষ। আর বিয়ের পরে হাসব্যান্ড -ওয়াইফকে এতো কন্ট্রোল করা উচিৎ না, কোনো পক্ষেরই।”
আম্মু খুব রেগে গেলেন। এতো বকা খেলাম আমি, বলার নয়।
আপা পোস্ট গ্রাজুয়েশনের প্রথম ধাপ পাশ করলো। সেই সাথে আমি আর মেজো আপা খালা হওয়ার সংবাদ পেলাম। কি আনন্দ! মেজ আপা বললো,”আমাকে বাবু ডাকবে মামনি।” আমি চেঁচিয়ে বললাম,”আমাকে কি বলে ডাকবে?”
“তুই নিজেই ঠিক করে নে। আম্মা,মাম্মা,আম্মু,আম্মি কতো কিছু ডাকার আছে।”
এদিকে বাসার পরিস্থিতি বড়ই থমথমে। আম্মু রেগে আগুন।
“শেষ পর্যন্ত বাচ্চার বুয়াগিরি করবে বলে ডাক্তারি পড়িয়েছিলাম?পোস্ট গ্রাজুয়েশন পর্যন্ত তর সইলো না?”
“আমি বুঝতে পারিনি আম্মু।আমিও এখন কোনো ঝামেলা চাইনা।”
আবার দুলাভাই এর ডাক পড়লো। দুলাভাই এর সাথে তার বাবা-মা-ভাই-ভাবীও এলেন।
দুলাভাইদের পরিবার কঠিন আপত্তি করলেন। সেই আপত্তিকে উপেক্ষা করে আম্মু আর আপা অ্যাবরশনের ডেট ও ডাক্তারও ঠিক করে ফেললেন।
আম্মুর যুক্তি হলো বাচ্চা অনেকবার নেওয়া যাবে কিন্তু পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের এই সুবর্ণ সময় আর ফিরে আসবে না।
খালাম্মা মৃদুস্বরে বললেন, “এই কথাতো আগেই বুঝা উচিৎ ছিল। এখন আল্লাহ একটা প্রাণ দিয়েছেন,সেটাকে মেরে ফেলার প্রশ্নই উঠে না।বাচ্চার সব দেখাশোনা আমরা করবো। রীতু তার লেখাপড়া চালিয়ে যাবে।”
“এতো সহজ না বেয়ান। বাচ্চা কি নয় মাস আপনি পেটে ধরে রাখবেন? জন্মানোর পর রাত জাগা,বুকের দুধ খাওয়ানো – এগুলো কি আপনি করতে পারবেন?এতো মেরিটোরিয়াস মেয়ে, একবার গ্যাপ হলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন হোক,তারপরে বাচ্চা নেওয়া যাবে।”
দুলাভাই বললেন,”মাফ করবেন, রীতু কখন মা হবে না হবে, সেটা আপনি ঠিক করে দিবেন?”
“অবশ্য ই। আমি ওর মা।আমি ওকে মেডিকেলে পড়িয়েছি।ওর সবচেয়ে ভালো আমিই চাই।”
দুলাভাই এবারে বেশ শক্ত ভূমিকা পালন করলেন। বাচ্চা নষ্ট করলে তিনি আপার সাথে সম্পর্ক রাখবেন না। আমার মুখরা মাও ভয়ংকর রূপ ধারণ করলেন। দুলাভাইএর আব্বা-মা ছেলের ডিভোর্স ঠেকাতে সমঝোতা করলেন, খুবই বেদনার সঙ্গে।
কয়েকদিনের মধ্যে আপার ঝামেলা চুকে গেলো। আমার বুকের ভিতর ফাঁকা হয়ে গেলো। মেজো আপা সারারাত নীরবে কাঁদলো, আমি টের পেলাম।
কি একটা বিদিকিরিচ্ছি অবস্থা। একই শহরে দুলাভাই এক জায়গায়,আপা এক জায়গায়। আপা মাঝেমধ্যে যায়, দুই তিনদিন থাকে, ফিরে এসে শ্বশুর বাড়ির বিশৃঙ্খল অবস্থার গল্প শোনায়। বাসায় সবসময় মেহমান আসা যাওয়া করে, ননদিনীরাতো আছেই, একটাতো রোজ বাচ্চাকে মায়ের কাছে রেখে অফিসে যায়,বাচ্চাটা অসম্ভব শয়তান। তার চিল্লাচিল্লিতে আপার পড়ার অসুবিধা হয়। শাশুড়ি নিজের মেয়েদের এক চোখে দেখে, আপাকে আরেক চোখে দেখে। মেয়েদেরকে তুলে তুলে যত্ন করে খাওয়ায়। আদিবও বোন-আর ভাগ্নে-ভাগ্নিকে নিয়ে বেশি আদিখ্যেতা করে। আপার অসহ্য লাগে দুলাভাই এর আদিখ্যেতা দেখলে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,”তিথি ভাবীর সাথে খালাম্মার রিলেশন তো খুবই ভালো বোধ হয়।”
“ঐ মহিলা চালাকের চালাক। মুখে মধুর শেষ নেই। সবাইকে তেল দিয়ে বেড়ানোই তার কাজ। তেল দিয়ে দিয়ে সবাইকে হাত করে রাখে।”
দিন গড়াতে থাকে। মেজ আপা ডাক্তার হয়ে যায়।বড় আপার পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষের দিকে। আপা আবার কনসিভ করে।আম্মু আবার রাগে নিজের হাত কামড়ায়।কিন্তু এবারে আগের মতো কিছু করার সাহস পায়না।
আপা পাশ করে। আপা ভালো একটা করপোরেট হাসপাতালে জয়েন করে।সকাল থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত ডিউটি। কিন্তু আপা সাধারণত রাত দশটার আগে বাসায় আসে না। আজ বন্ধুদের গেট টুগেদার, কাল কোনো কলিগের বিয়ে,পরশু অমুকের ছেলের জন্মদিন, আল্লাহর ওয়াস্তে প্রায় প্রতিদিন প্রোগ্রাম লেগে থাকে। দুলাভাই আর তাঁর বাবা-মা মাঝে মাঝে মন খারাপ করেন। সব প্রোগ্রামে অ্যাটেন্ড করার কি দরকার? কিছু প্রোগ্রাম অ্যাভয়েড করা যায় না। কলিগের বোনের গায়ে হলুদ,বিয়ে সবকিছুতেই অ্যাটেন্ড করতে হবে? বাসার লোকেদের সাথে একটু সময় কাটানো যায় না?
আপা রাগ করে চলে আসলো আমাদের বাসায়। আপার স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে, সে কোথায় যাবে না যাবে,সেটা কি ওরা নির্ধারণ করে দিবে?আপার ব্যক্তিগত ইচ্ছা -অনিচ্ছা নাই?
আম্মু আপার শাশুড়িকে ফোন করে বললেন,” হাইলি কোয়ালিফাইড মেয়ে আমার। পার্টি, এটা সেটাতো থাকবেই। ওকে তো ওর লেভেলের সাথে সামাজিকতা মেইনটেইন করতেই হবে বেয়ান।এতে যদি আপনারা রাগ করেন,জামাই ঝগড়া করে,তাহলেতো খুব দুঃখের কথা। জামাই ওর সাথে সব প্রোগ্রামে গেলেইতো পারে।বাসায় সন্ধ্যার পরপরই ফিরতে হবে কেন?আপনি কি আপনার ডাক্তার বৌমাকে রান্নাঘরে হাঁড়ি ঠেলতে দেখতে চান?”মেজ আপা আর আমি এক ঘরে ঘুমাই যদিও তিন বোনের আলাদা আলাদা ঘর। ঘুমাতে এসে মেজ আপা বললো,”আব্বু-আম্মু-আপা কি কারোর ভালোটা দেখতে পায় না?দুনিয়ার সবাই খারাপ, শুধু আমরা ভালো। কি আজব আর বিচ্ছিরি চিন্তা ভাবনা। আমার ভাবতে অবাক লাগে যে আব্বু -আম্মু এতো বড় চাকরি করে,এতো পড়াশোনা জানা।”
আমাদের পরিবারে মেজ আপা গোড়া থেকেই ব্যাতিক্রম। আমি যেমন একটা সময়ে মিথ্যাবাদী, কুটনি বুড়ি ছিলাম,ঝগড়াটে ছিলাম,মেজ আপা কখনোই তেমন ছিলো না। সে থাকতো আপন মনে,কারোর সাতেও না,পাঁচেও না।
আম্মু এখন মেজ আপাকে ধরেছে। “খবরদার,কোনো লাইন ঘাট যেন না হয়। ক্যারিয়ার কমপ্লিট করে তারপর বিয়ে-শাদি। এক চান্সেই যেন পাশ হয়। পড়লে পাশ হবে না একথা পাগলও বিশ্বাস করবে না।”
চলবে