নানান বরণ মানুষ রে ভাই ২২ তম পর্ব

0
245

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
২২ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

শিমুলের ডায়েরি

আমার নাকি মানসিক চিকিৎসার দরকার।অনেকদিন ধরেই অনেকের মুখে এই পরামর্শ শুনে এসেছি। কান দিইনি। হাসান সাহেব যাঁকে আমি মামা ভাবতাম, তিনিতো এক সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেলেছিলেন আমার চিকিৎসার জন্য। অথচ ভদ্রলোক নিজে কতোটা পারভারটেড! ছোট্ট বাচ্চা মৌরীকে তিনি তাঁর খেলার পুতুল বানিয়েছিলেন। নিজের অসুস্থ মানসিকতার জন্য তিনি কিন্তু মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানোর প্রয়োজন মনে করেন নি।

তবে এখন আমার নিজেরই মনে হচ্ছে অবশ্যই আমার সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার। না হলে একের পর এক ভয়ংকর কান্ড ঘটতেই থাকবে। আমার কিছু করার থাকবে না।নিজের উপরে আমার নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল হয়ে যাচ্ছে। আমি পিশাচী হয়ে যাচ্ছি।

প্রথম ঘটনার পরে ভেবেছিলাম খুব শান্তি পাবো। নাহ্, পাইনি। বরং আরও অস্হিরতা। এখন মনে হচ্ছে টার্গেট ফুলফিলড হলেও আমার মন শান্ত হবে না। এভাবে মন শান্ত করা যায় না আসলে। আবার টার্গেট থেকে সরে আসবো,এটাও মেনে নিতে পারছি না।

মা ঘুমাচ্ছে। মায়ের সাথে মৌরী। মা যে কবে থেকে এতো শুকিয়ে গেলো, মায়ের চাপা গায়ের রং কবে থেকে যে এতো সাদা হয়ে গেলো, আমি জানি না। ডাক্তার যখন বললেন,”রোগীর এতো খারাপ অবস্থা, শরীরে এক ছটাক ও রক্ত নেই, প্রচন্ড অ্যানিমিক, নিউট্রিশনাল ডেফিসিয়েন্সি এতো বেশি, আর আপনারা বাড়ির এতোগুলো মানুষ টেরই পেলেন না? এমনতো একদিনে হয়নি ” _ তখন আমার হুঁশ হলো,মা আমার সত্যি ই বড় রোগা হয়ে গেছে, বড্ড ক্লান্ত।

মৌরী দুদিনেই বাড়ির গিন্নী হয়ে গেছে। মায়ের সেবা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। একটু পরপর খাবার নিয়ে জোরাজোরি করছে। রান্নার বই পড়ে পড়ে মায়ের জন্য নানারকম পুষ্টিকর রান্না করছে।আমার ছয় ভাইবোনের সেবার ঠেলায় মায়ের আরও করুণ অবস্থা। কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কেউ পা টিপছে। আমি শিমুল কিছুই করছি না।কারণ আমার কিছু করতে ইচ্ছা করে না। জোর করে একটা জিনিসই করি,লেখাপড়া। একদিন আমি এতো বড় হবো,এতো উঁচুতে উঠবো, সবাই আমার ভয়ে কাঁপবে, আমি যেমন করে কেঁপেছি।

মা আমার মনের কথা বুঝতে পারলে বলতেন,শুধুমাত্র লেখাপড়া করে উঁচু মাপের মানুষ হওয়া যায়না। লেখাপড়া থেকে অর্জিত বিদ্যা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ না করলে সেই লেখাপড়ার দাম নেই। সততা,সত্যবাদিতা, মানবতা না থাকলে সেই লেখাপড়া মূল্যহীন। সত্যিকারের লেখাপড়া মানুষকে বিনয় শেখায়, নিরহংকার ও সহিষ্ণু হতে শেখায়। মায়ের কথাগুলো ঠিক না ভুল, তা আমি কোনোদিন যাচাই করিনি, যাচাই করতে চাইও না। আমি উঁচুতে উঠতে চাই ছড়ি ঘুরানোর জন্য।

একসময় আমার জীবনের লক্ষ্য ছিলো মা ও পলাশকে সুখী করা। আর কোনো লক্ষ্য ছিলো না। এখনও আমি অবশ্যই মা ও পলাশকে সুখী দেখতে চাই, কিন্তু নিজেকে পরিবর্তন না করে। আমি আমার সিদ্ধান্ত বা চিন্তা থেকে এক চুল নড়বো না,এতে মা সুখী হোক আর না হোক।

মা’কে আমি এতো ভালোবাসি,কিন্তু কতোদিন হলো একটু ভালো করে মায়ের সাথে কথা বলিনা। পলাশকে বুকে জড়িয়ে ধরিনা। বেচারা মাঝেমধ্যে আহ্লাদ করতে আসলে আমি কাঠ হয়ে বসে থাকতাম। তাই এখন আর কাছে আসে না।দূর থেকে তাকিয়ে থাকে। তখন খুব মায়া হয়, তাও ডাকিনা।আমি কি খুব বিষন্নতায় ভুগছি?

আমার মধ্যে বিষন্নতা নেই। যা আছে, তা হলো প্রচন্ড রাগ। সারা দুনিয়ার উপরে রাগ।ভাগ্যের উপরে রাগ। মানুষের শৈশব -কৈশোরের একটাতো অন্ততঃ সুখস্মৃতি থাকে। পৃথিবীতে আমিই একমাত্র মানুষ যার জীবনে কোনো সুখস্মৃতি নেই, হবেও না। শৈশব -কৈশোর এবং তারুণ্যের শুরুর দিকটা আমার সব আনন্দের অনুভূতি সারাজীবনের জন্য কেড়ে নিয়েছে।আমি হাসতে পারিনা,ভালবাসতে পারি না, কাঁদতেও পারি না, কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না।আমার রাগ অন্যদের কষ্টতো দিচ্ছে বটেই, আমি নিজেও কম কষ্ট পাইনা।

মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করি যেন মা এক ভয়ংকর অপরাধী। মা-ই যেন আমাদের জীবনটাকে একদম নষ্ট করে দিয়েছে। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়।
আমাকে আর পলাশকে বাঁচাতে মা অমানুষিক কষ্ট করেছে। এখনো করছে। খান বাড়ির আফরোজা বেগম, ওমর খান,রিয়া,রিয়ার মায়ের অত্যাচার থেকে আমাদের বাঁচানোর কোনো চেষ্টা মা বাদ রাখেনি। আমাদের রক্ষা করতে যেয়ে মা মার খেতো। মা’কে নিজের চোখে আমি ওমর খানের লাথি খেতে দেখেছি। আগে ভাবতাম মা কেন আমাদের দুই ভাই বোনকে নিয়ে ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো না? এখন বুঝি মা সাহস পেতো না।আমাদের জন্য ই,আমাদের রক্ষা করার জন্য ই মা সাহস পেতো না। মায়ের ভাইরা যে পদের, সেখানে যেয়ে আমরা যে নিরাপদ বা সুখী থাকবো না,মা সেটা বুঝতে পেরেছিল। আমার আগে মনে হতো,মা তো বস্তিতে আমাদের নিয়ে থাকতে পারতো, অন্যের বাড়িতে ঝি এর কাজ করে আমাদের বড় করতে পারতো।এখন বুঝি,কি হাস্যকর ভাবনা ছিল আমার। ছোট ছোট দুটি বাচ্চা,তারমধ্যে একজন আবার শারীরিক -মানসিক প্রতিবন্ধী , তাদের নিয়ে কোথাও যাওয়ার উপায় আমার মায়ের ছিলো না। আগে আমি মনে করতাম, মা কেন ওই অমানুষগুলোর অত্যাচারের প্রতিবাদ করতো না? এখন বুঝি, প্রতিবাদ করলে মা ও আমাদের কপালে আরও বেশি অত্যাচার জুটতো।ফল ভালো হতো না।

তবে যে কাজ মায়ের করা উচিৎ ছিলো, সেটা হলো বুড়িটাকে বাড়িতে না রেখে ওল্ড হোমে রাখা। অবশ্যই মায়ের এটাই করা উচিৎ ছিল। বুড়ি ভূতের মতো আমাদের ঘাড়ে চড়ে বসলো। কই মাছের প্রাণ! মরার কথা সেই কবে,কিন্তু মরার নামটি নেই। মায়ের ভুলের কারণে ডাইনিটার চেহারা দেখতে, ডাইনিটার গলার আওয়াজ শুনতে বাধ্য হতাম। এতো শিক্ষা পাওয়ার পরেও বুড়ির আদতে চেন্জ হয়নি। তার নোংরা মনটা নোংরা ই থেকে গিয়েছিল। অসহ্য লাগতো আমার,দমবন্ধ হয়ে আসতো বাড়িতে। ঐ বুড়ির জন্য মা-ভাইকে ছাড়া সপ্তাহে পাঁচ দিন আমাকে গ্রামের বাড়িতে থাকতে হতো এসএসসির জন্য। মায়ের উচিৎ ছিল,কপাল ফেরার পর মানসিক ও শারীরিক ভাবে ক্ষতবিক্ষত আমাকে আর পলাশকে সারাক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখা। তা না, যাদের জন্য আমরা এতো কষ্ট পেয়েছি, মা তাদের নিয়েই ব্যতিব্যস্ত হয়ে রইলো। মা কেন বুঝতে পারলো না ঐ সময়ে মা’কে আমার অনেক দরকার ছিল, অনেক। উফ্,আবার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।

মৌরী-মিতুলদের বিষয়টা অবশ্য আলাদা। মিতুলকে যখন মা নিয়ে এলেন মানুষ করতে,ভীষণ রাগ হয়েছিল। কিন্তু এখন মিতুল আমার জান্। মা মৌরীদের মানুষ করেছেন, এজন্য মায়ের প্রতি আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। মায়ের এই বদান্যতার জন্য আমরা দুই ভাই বোন থেকে সাত ভাই বোন হয়েছি। আমার কষ্টভরা জীবনে মা ও পলাশের মতো ওরাও শান্তির পরশ বুলায় কিছুটা।

দেখো মা, তোমার শিমুলের অবস্থা। তার অপছন্দের মানুষকে তুমি দেখাশোনা করেছো, তাতে তার প্রচন্ড রাগ তোমার উপরে। তার ভালোবাসার পাঁচজনকে তুমি লালন পালন করেছো মায়ের যত্নে।যে তোমার স্বামীকে দখল করে, তোমাকে দাসী বানিয়ে,তোমারই পালংকে তোমার স্বামীর সাথে ফূর্তি করে এই পাঁচ জনকে জন্ম দিয়েছে,তার সন্তানদের কতো যত্নে-আদরে তুমি মানুষ করেছো তাতে আবার তোমার মেয়ে খুব খুশি। সুয়োরাণীর পাঁচ সন্তানকে বড় করতে যেয়ে এতো বছর ধরে তোমার কতো শারীরিক কষ্ট হয়েছে, রাত জাগতে হয়েছে, সেটা তোমার মেয়ে চিন্তা করে দেখেনি। সে চিন্তা করেনি সতীনের পুত্র -কন্যাকে লালন-পালন করতে স্নেহের অমৃত ধারার পাশাপাশি তোমার বুকে নীরব রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিনা।
আমরা সবাই যার যার সুবিধা মতো তোমাকে ব্যবহার করেছি মা।তোমার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, চাওয়া-পাওয়া, তোমার স্বপ্ন সবকিছু চাপা পড়ে গেছে অন্য মানুষদের নিষ্ঠুরতায়।সেই দলে আমিও আছি।

সবই বুঝি মা। কিন্তু দুঃসহ যন্ত্রণা, রাগ,প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা আমাকে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে দেয় না। আমার অতি গোপন কিন্তু ভয়ংকর কিছু কষ্টের গল্প আছে যা তোমাকেও কখনো বলা হয়নি ।মনে হয়,বলা হবেও না। গুপ্ত কথা গুপ্ত থাকুক, তবে আমি যা করার তা করবো। কিন্তু প্রতিশোধের এই খেলাতো আমার যন্ত্রণা এতোটুকু কমাতে পারছে না।কি করলে আমি শান্তি পাবো?কি করলে আমার জন্য তুমি শান্তি পাবে মা?

আমার খুব ভয় হচ্ছে। কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার বিচ্ছেদ আসন্ন। কি করে তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকবো আমার লক্ষী মা,সোনা মা? যদিও বাঁচার কোনো মোহ আমার নেই, কিন্তু কাজগুলো শেষ না করে তো মরতেও ইচ্ছা করেনা।

লিখতে লিখতে আমি কাঁদছি, তোমার জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, অসহনীয় কষ্ট, কিন্তু চোখ থেকে একফোঁটা পানি বের হচ্ছে না। তোমাকে জড়িয়ে ধরে যদি একটানা অনেকদিন চিৎকার করে কাঁদতে পারতাম,তাহলে বোধ হয় মনটা শান্ত হতো।

ভালোবাসি মা তোমাকে, খুব খুউব ভালোবাসি। আমি মুখে এটা বলতে পারবো না, তুমি কোনোভাবে বুঝে নিও।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here