নানান বরণ মানুষ রে ভাই ৭ম পর্ব বড় গল্প নাহিদ ফারজানা সোমা

0
281

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
৭ম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

ছুটির দিনে ছোটমামার বাসায় চলে গেলাম। নানী এই বাসাতেই থাকেন।মানে এটাই নানা-নানীর বাসা। নানী এখন শুকিয়ে হাড় জিরজিরা। বিছানায় লেপ্টে থাকেন।একজন নার্স চব্বিশ ঘণ্টা তাঁর সাথে থাকেন।বেশ কয়েক বছর ধরে এই অবস্থা। ছোট মামা-মামীও নানীর যথেষ্ট দেখভাল করেন।

নানী আমার হাত জড়িয়ে ধরলেন।তাঁর দু-চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। প্রতিবারই এক দৃশ্য।

আম্মু চাকুরিজীবী, দাদীকে ব্যবহার করতেন,কিন্তু নিজের মা-বোনদের সাহায্য নিতেন না।নানীর বাসায় আমাদের খুব বেশি বেড়াতেও যেতে দিতেন না। অবশ্য মামা-খালা-চাচা-ফুপি সবার বাসায় আমাদের যাওয়া খুব সীমিত ছিলো। অনেক গেট টুগেদারও মিস করতাম আমরা।আম্মু বলতেন,”অনুষ্ঠান লেগেই থাকবে, এতো ঘন ঘন লেখাপড়া বন্ধ রাখলে চলবে না।”

নানাভাই মারা যান আমি যখন ক্লাস ফাইভে। সব নাতি নাতনিদের মধ্যে নানাভাই আমাদের তিন বোনকে বেশি আদর করতেন। শেষের তিন বছর নানাভাই প্যারালাইজড ছিলেন। আম্মু প্রতিদিন অফিস ফেরত নানাকে দেখতে যেতেন, অনেকক্ষণ থাকতেন, আমরা বাসায় দাদীর হাওলাতে থাকতাম। ফিরে এসে আম্মু আমাদের তিন বোনের সব হোম ওয়ার্ক চেক করতেন। শুধু স্কুলের হোমওয়ার্ক না, আম্মু নিজেও একগাদা হোমওয়ার্ক দিয়ে রাখতেন। একটু ভুল করলে,হাতের লেখা সামান্য এদিক ওদিক হলে রক্ষা ছিলো না। আমি ভাবতাম আম্মু বুঝি নিজের বাবার খুব যত্ন আত্তি করেন। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ নানার বাড়িতে যেয়ে দেখেছি অদ্ভুত দৃশ্য। নানা বিছানাতে পড়ে থাকতেন, ফ্যালফ্যাল করা চেহারা, সামনে একটা চেয়ারে আম্মু চুপ করে বসে থাকতেন,সোজা হয়ে, স্হির চোখে নানার দিকে তাকিয়ে। ঘন্টার পর ঘন্টা। নানী বা মামা-খালারা কোনো প্রশ্ন করলে আম্মু খুবই সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতেন। নানী কতো কিছু খেতে সাধতেন, মা খেতেন না। সেই চুপ করেই বসে থাকতেন। আমরা গেলে নানী,খালা,মামীরা যত্ন করে কতো খাবার খাওয়াতেন, আবার বাক্সেও ভরে দিতেন। কিন্তু আমাদের ভীষণ হতাশ করে কখনোই আম্মু কোনো খাবারের বক্স নিতেন না। নানী বলতেন,”তুই না খাস,বাচ্চাগুলো খাবে,জামাই আর ওর মা খাবেন।নিয়ে যা।” আম্মু ঠান্ডা গলায় বলতেন,”বাসায় রান্না করা আছে।” মামা বা কোনো খালাকে দিয়ে নানী যদি খাবার পাঠাতেন, আম্মু সেই খাবার ফেরত পাঠিয়ে দিতেন। দাদী আর আমরা আম্মুর এহেন কর্মকাণ্ডে খুব অবাক হয়ে যেতাম। দাদী নিচু গলায় বলতেন,”বাপের বাড়ির চাল বাঁচায়। “একবার কি যে বিশ্রী ঘটনা ঘটেছিল। আম্মু অফিসে ছিলেন। আমাদের স্কুল বন্ধ ছিল। মেজ ফুপি আর ফুপা দাদীকে দেখতে এসেছিলেন। দাদীর পছন্দের নানারকম খাবার নিয়ে। দুপুর বারোটার দিকে ছোট মামা হাজির। নানী একগাদা খাবার পাঠিয়েছিলেন। পোলাও,কাবাব, রোস্ট, খাসীর রেজালা,ইলিশ ভাজা, আরও কি কি যেনো। একটা বাক্স আলাদা করে দাদীর হাতে দিয়ে মামা বলেছিলেন, ” মাঐমা,এটাতে আপনার বৌমার খুব পছন্দের খাবার, ইলিশ পাতুরি। মা এটা শুধু আপার জন্য দিয়েছেন। ” আম্মু সেদিনকেও নানাকে দেখতে গিয়েছিলেন, নানী খেতে সেধেছিলেন, যথারীতি আম্মু খান নি। বাসায় এসে ফুপি-ফুপাকে দেখে আম্মু কাষ্ঠ হাসি হেসে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসেছিলেন। টেবিল ভরা নানীর দেওয়া খাবার।
আম্মু ভেবেছিলেন ফুপা-ফুপি এসেছেন দেখে দাদী রান্না করেছেন। খাওয়ার শুরুতেই দাদি একটা বাটি আম্মুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “ইলিশ পাতুরি তোমার মা স্পেশালি তোমার জন্য পাঠিয়েছেন। এটাই আগে খাও।”
কথাটা শুনে আম্মু কি ভয়ংকর চমকে উঠেছিলেন, আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তারপর চিল চিৎকার, “এগুলো ও বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার?কে নিয়ে এসেছিলো? কেন রাখলেন আপনারা?আমি নিষেধ করিনি ঐ বাসা থেকে খাবার বা কোনো জিনিসপত্র পাঠালে নিবেন না? কেন নিলেন? নিলেন,বাড়িসুদ্ধ সবাইকে খাওয়ালেন, কেন, মেয়ে-জামাইকে নিজে পোলাও রেঁধে খাওয়ানোর মুরোদ আপনার নেই? আর এই রাক্ষসের বাচ্চা তিনটা, নোলা খুব বেড়েছে তোদের। পোলাও-কোর্মা ছাড়া মুখে আর কিছু রুচে না,রাক্ষসগুলো?হাজারবার নিষেধ করিনি,কেউ কোনো খাবার দিলে রাখবি না? হাড় হাভাতের দল।” আম্মু ধাক্কা দিয়ে সব বাটিগুলো ফেলে দিলেন।রাগে তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপছিলো। মুখ দিয়ে প্রায় ফেনা ওঠার যোগাড়। স্ত্রী ভক্ত আব্বু যথারীতি আম্মুকে সামলাতে লাগলেন। তাই দেখে দাদী ঘেন্নায় মুখ বাঁকালেন। ফুপা-ফুপি লজ্জায় আর অপমানে লাল হয়ে গিয়েছিলেন। আর কোনোদিন আমাদের বাসায় আসেন নি। আমাদের তিন বোনেরও সেদিন খুব খারাপ লেগেছিল। দাদী গজগজ করছিলেন,”তার বাপের বাড়ির খাবার তার পারমিশন ছাড়া আমি খেয়েছি, মেয়ে জামাইকে খাইয়েছি দেখে এতো রাগ! ছিঃ! কি নিচু মন।”

পরদিন নানার বাড়িতে যেয়ে কি বলেছিলেন আম্মু, কে জানে! ও বাড়ি থেকে চিরতরে খাবার আসা বন্ধ হয়ে গেল।

নানার চিকিৎসার সব খরচ আম্মু দিতেন। প্রচুর বাজার করে নিয়ে যেতেন ঐ বাসায়। থাকতেন অনেকক্ষণ। গম্ভীর, চুপচাপ! নানার দিকে স্হির তাকিয়ে থাকতেন। খুব দরকার না পড়লে কারোর সাথে কোনো কথা বলতেন না।

খালা-মামারা আমাদের এতো আদর করতেন,মন চাইতো প্রতিদিন যেতে। কিন্তু উপায় ছিলো না।মামা-খালারাও আমাদের বাসায় বেশি আসতে পারতেন না আম্মুর অসম্ভব নিস্পৃহ আচরণের জন্য। হয়তো বলে বসলেন, “তোরা বসলে বস্,কি খাবি বুয়াকে বলিস, আমি বিশ্রাম নিই।রীতু,নীতু, বুবলি,আড্ডা মারলে তো চলবে না। এ বাড়িতে তো সারাক্ষণ ই আড্ডা চলে।আসো,পড়তে আসো। তিনজনই আমার রুমে বইখাতা নিয়ে চলে আসো।”

আম্মু নানার বাড়ির কারো সাথে তেমন মেশেন না, দেবর-ননদদের সাথে হৃদ্যতা নেই, আম্মুর কোনো বন্ধু নেই, কলিগদের সাথেও জাস্ট কাজের সম্পর্ক, আমাদের সাথেও লেখাপড়া বিনা গীত নেই, আম্মু এমন কেন? খুব স্বার্থপর, রাগী মানুষ। দাদী বিড়বিড় করে বলতেন,” নিজেকে মহারানী মনে করে। এদিকে না আছে রূপ,না গুণ। নিজের বাচ্চাদেরই দেখতে পারেনা, অন্যদের ভালোবাসবে কি ভাবে? মেয়ে তিনটার জন্য ই এ বাড়িতে থাকি, নইলে এখানে থুথু ফেলতেও আসতাম না।”

আম্মু নানাভাই এর জন্য অনেক খরচ করেছেন। চব্বিশ ঘন্টার জন্য নার্স রাখা, নার্সের বেতন, খাওয়া-পরা, নানার ওষুধ -পথ্য, বড় বড় হাসপাতালে কয়েকদিন পরপরই ভর্তি করা,সেগুলোর সব খরচাপাতি, এমন কি একবার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরেও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের হাতে নানার এতোটুকু সেবা আম্মু করেন নি।

নানার ব্যাবসা নাকি ভারি জমজমাট ছিলো। একসময় নানা লস খেতে থাকেন। বড় আপা তখন আম্মুর পেটে। আম্মু নিজের টাকা আর গয়না দিয়ে, নিজের নামে রাখা সম্পত্তি বেচে নানাকে ফতুর অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন। বড় মামা,মেজ খালা-খালুর যথেষ্ট সামর্থ্য থাকলেও নানা-নানীর উপকারে তাঁরা তেমন ভূমিকা রাখেন নি। ছোট মামাকে ইন্জিনিয়ারিং পড়ানোর পুরো খরচ দিয়েছেন আব্বু-আম্মু। সেজ খালার আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। পালিয়ে বেকার ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন খালা। বাড়ির কেউ খালা-খালুকে মেনে নেয়নি, আম্মু খালা-খালুকে ব্যবসার জন্য টাকা দেন। এখন তাঁরা ভালো অবস্থায় আছেন। নিজের বাবা,মা,ভাই,বোনদের জন্য আম্মু অনেক খরচ করেছেন, তাঁদের দিকে বহুত খেয়াল রেখেছেন, তাঁদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখা সত্বেও। নিজের বাপের বাড়ির খেয়াল ঠিকই রেখেছেন, বঞ্চিত করেছেন আমার দাদা দাদীকে। এজন্য ক্ষমা করা যায় না আব্বু-আম্মুকে।

আমার মামা-খালাদের মধ্যে আম্মু সবার বড়। আম্মুর ছয় বছরের ছোট মেজ খালা। তারপরে বড় মামা।এরপরে যথাক্রমে সেজ খালা,ছোট মামা,ছোট খালা।

ভার্সিটি থেকে নানীর কাছে আমি প্রায় চলে আসি। নানী হাত ধরে থাকেন,কাঁদেন। কি কি যেন বলেন,ভালো করে বোঝা যায় না। তবে আমাকে “বুবু” ডাকেন,এটা বুঝতে পারি। মাঝে মাঝে জড়ানো উচ্চারণে পলাশ বলে কাউকে ডাকেন,এটাও বুঝতে পারি।আমাদের ফ্যামিলির মধ্যে পলাশ বলে কেউ নেই। আম্মুর নাম ধরে ডাকেন, এটাও বুঝি। আম্মু সম্পর্কে কি যেন বলতে চান। কিন্তু আমার শোনার আগ্রহ নেই বলে কথা এগুতে দিই না।
মেজ আপার কাছে শুনেছি আম্মু এখানেও দুই একদিন পরপর আসেন, চেয়ার নিয়ে নানীর সামনে চুপচাপ বসে থাকেন। শান্ত,গম্ভীর। দৃষ্টি শীতল,স্হির। নার্স ঠিকমতো খাওয়ান কিনা,বেড সোর হলো কিনা, ডায়াপার সময়মতো পাল্টানো হয় কিনা, পাল্টানোর সময় নানীকে ঠিক মতো পরিস্কার করা হয় কিনা, এগুলোর তত্ত্ব তালাশ করেন, ঘন্টা দুয়েক থেকে চলে যান। যথারীতি এক গ্লাস পানিও খান না।

আগে গভীর ভাবে ভাবিনি, ভেবেছি আম্মু রাগী, উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চ পদে আসীন বলে অহংকারী, স্বার্থপর, নিষ্ঠুর। কিন্তু ইদানিং মনে প্রশ্ন আসে,আম্মুর কি আসলে দুইটা সত্ত্বা?

নানীর কাছে আসার আগে মামীকে ফোন করে নিই,আম্মু এসেছে কিনা,আসবে কিনা।সেক্ষেত্রে আমি যাবো না। মামী গ্রীন সিগনাল দিলে আসি।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here