ময়ূখ #পর্ব-২৪ #লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

0
637

#ময়ূখ
#পর্ব-২৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৭০.
হঠাৎ করেই মাথা ঘুরে মাটিতে ঢলে পড়ে মৌন। পাশের ইটে বাড়ি লেগে কপালের পাশটা কেটে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। লুবনা, ঝিনিয়া হকচকিয়ে মৌনকে ধরলো। নাম ধরে ডেকেও কোনো সাড়া নেই। বোতল থেকে হালকা পানি ছিটিয়ে দিতেই আবছা চোখ মেললো মৌন। তাড়াতাড়ি কিছু মানুষের সহায়তায় মৌনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে গেলো তারা। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে দুজনের। মাথা বেশি কাটেনি। সামান্য একটু কেটেছে কেবল। রক্ত পরিষ্কার করে ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলেন ডাক্তার। ডাক্তার মিতালি মৌনের হাতের নার্ভস পরীক্ষা করলেন। মৌন ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রাখা বেডে শুয়ে আছে। জ্ঞান থাকলেও আশপাশের পরিবেশ তার কাছে আবছা। মিতালি লুবনার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘পেশেন্টের নাম কি?’
‘মৌন।’

ডাক্তার মিতালি আস্তে আস্তে ডাকলেন,
‘মৌন, আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?’
‘জ্বি।’
‘আপনার শারীরিক গঠন এবং আপনার বান্ধবীদের কাছ থেকে শুনে যা বুঝলাম এগুলো গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ। আপনি কি বুঝতে পারছেন মৌন?’
‘জ্বি।’
‘আপনার কিছু পরীক্ষা করা প্রয়োজন। পরীক্ষা গুলো করিয়ে আমাকে রিপোর্ট দেখিয়ে যাবেন।’

কিছুটা সুস্থবোধ করছে মৌন। লুবনাকে ধরে ধরে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে পরীক্ষা করে নিয়েছে। তবে রিপোর্ট আগামীকাল দিবে।

‘একা যেতে পারবি মৌন?’

লুবনার চিন্তিত কন্ঠস্বর। লুবনা, ঝিনিয়া দুজনেই রোকেয়া হলে থাকে। মৌনর সাথে সম্পর্কটা অনেক ভালো। মৌনকে রিকশায় তুলে দিয়েছে। তবুও তাদের চিন্তা থামেনা। মৌন মলিন হেসে বলে,
‘চিন্তা করিস না। আমি তো সুস্থ এখন। যেতে পারবো।’
‘আচ্ছা, সাবধানে যাস।’

__________________

‘মৌন, কপালে ব্যান্ডেজ কেন মা?’

মিরা উদ্বিগ্নচিত্তে প্রশ্ন করে এগিয়ে আসেন। মৌনকে সোফায় বসিয়ে বলেন,
‘কি হলো বল?’
‘এই একটু মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম।’
‘এইজন্যই বলি শরীরের যত্ন নিতে। একদম নিস না। আচ্ছা, একটা কথা বলতো কোনো সুসংবাদ আছে?’

মিরার প্রশ্নে মৌন লজ্জা পেয়েছে খুব। হলদে গালগুলো লাল রাঙা হয়ে আছে।
‘তেমন কিছুনা মা।’

মৌন আসলে নিশ্চিত না হয়ে ব্যাপারটা কাউকে জানাতে চাচ্ছেনা। আচ্ছা, ও যদি সত্যিই প্রেগন্যান্ট হয় তাহলে নিভৃতের প্রতিক্রিয়াটা কি হবে? খুব খুশি হবে কি? মুচকি হাসে মৌন। রাগ তো সব তাকে ঘিরে। বাবুর কথা শুনলে নিভৃত রাগ দেখাতেই পারবেনা। আবার লাজে রাঙা হয় মৌনর মুখ। মিরা আর বিষয়টা ঘাঁটলেন না। মেয়েটাকে লজ্জা দিতে চান না তিনি।

রাতে নিভৃতের সাথে কথা বলেনি মৌন। একটা চাপা অভিমান ছিলো তার। নিভৃত একবার জিজ্ঞেসও করেনি মাথায় ব্যান্ডেজ কেন। অভিমানটা গাঢ় হয় যেন। তবে এই অভিমান কি আদো কেউ বুঝে? মরুভূমির খা খা বালুগুলো যখন তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সূর্যের সাথে অভিমান করে সূর্য কি আদোও সে অভিমান বুঝে? উল্টো নিজের তেজ বাড়ায় শতগুণ!

৭১.
পেরিয়ে গিয়েছে দুইটা দিন। বিভিন্ন ঝামেলায় রিপোর্ট আনতে যেতে পারেনি মৌন। বাড়িতে রুহানির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এতিম খাওয়ানো হবে। বিভিন্ন ব্যস্ততায় কাটছে মৌনর দিনরাত। অহনা প্রতিদিন ভোরে ফজরের নামাজের পর অনেকটা সময় রুহানির কবরের পাশে বসে কাঁদেন। একদিন মৌন কথা বলতে চেয়েছিলো তবে তিনি এড়িয়ে গেছেন। এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা দোষ কেবল মৌনর। সবাই তাকেই ভুল বুঝে। তার দোষ থাকুক কিংবা না থাকুক। শতকষ্টের মাঝেও গতকাল বিকালের কথা মনে করে মনটা ভালো হয়ে যায় মৌনর।

_________________

‘আপা আপা আপা।’
‘আরে পাগলি কি শুরু করলি ফোনে। কি হয়েছে?’
‘আপা রিপু ভাই কাল রাতে।’

লাজুক কন্ঠ রথির। মৌন মুচকি হাসে। হেসে ঠাট্টা করে বলে,
‘হুম। রিপু ভাই রাতে কি?’
‘তুমিও না আপা। খালি লজ্জা দাও।’
‘আমি আবার কি বললাম?’
‘উফফ, আপা তুমিও না।’

মৌন খুশি হয়। তার বোন সুখে আছে, রিপু ভাই ভালো আছে।

আজ রুহানির মৃত্যুবার্ষিকী। নিভৃত স্তব্ধ হয়ে বসে আছে রুহানির কবরের পাশে। বাড়ির সামনে প্যান্ডেল করা হয়েছে। ভিতরে কোরআন তেলওয়াত হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সবাইকে খাওয়ানো হবে। নিভৃত এতো কাজের মাঝেও বসে আছে নিশ্চল হয়ে। অনুভূতিশূন্য সে। নিজেকে অপরাধী লাগে তার। গতকাল রাতে অহনা ডেকে নিয়ে তাকে বেশ কথা শুনিয়েছেন। আচ্ছা, নিভৃত কি সত্যিই স্বার্থপর! বিশ্বাসঘাতক! ভালোবাসার মান দিতে জানেনা!

হাসপাতাল থেকে ফোন আসায় মিরাকে জরুরি কাজের কথা বলে বেরিয়ে যায় মৌন। একটা উত্তেজনা কাজ করছে তার মাঝে। সত্যিই কি তার মাঝে বেড়ে উঠছে আরেকজন! উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে মৌনর। যদিও বাসায় এসে টেস্ট করেছিলো সময় পজিটিভ এসেছিলো রেজাল্ট। তবুও বিশ্বাস হয়না তার!

ডাক্তার মিতালি অভিজ্ঞচোখে রিপোর্ট দেখে বললেন,
‘আপনি গর্ভবতী মিসেস মৌন। সাত সপ্তাহ চলছে।’

মৌনর চোখ দুটো চিকচিক করে উঠে। এত স্নিগ্ধ কেনো এই অনুভূতি!

‘মিসেস মৌন আপনার বয়সটা কম। তাই নিজের খেয়াল রাখবেন। বেশি টেনশন করবেন না আর খাওয়া দাওয়াটা ঠিক মতো করবেন। আপনার স্বামী কোথায়? আপনার সাথে আসেনি?’
‘আসলে উনি একটু ব্যস্ত।’

মিতালি অবাক হলেন। সচরাচর এমন পেশেন্টের সাথে স্বামীরা থাকে কিংবা তাদের কোনো প্রিয়জন। তবে মেয়েটা একেবারেই একা।

‘নিয়মিত চেক-আপ করে যাবেন।’
‘জ্বি, চেষ্টা করবো।’

রিপোর্টটা নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে বেরিয়ে আসে মৌন। সাদাকালো রিপোর্টটায় বলের মতো ছোট একটা অংশ। মিতালি দেখিয়ে বলেছিলেন এটা নাকি বাবুর বর্তমান অবস্থা। মৌনর চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মাতৃত্বের অসীম সুখের সন্ধান পেয়েছে মেয়েটা।

৭২.

বিগত দু’দিন যাবত কথাটা বলবে বলবে করেও বলতে পারছেনা মৌন। কেমন একটা লজ্জা! আড়ষ্টতা! অহনা,রিজভী চলে গিয়েছেন। নিভৃত একেবারেই চুপ। কথা বলেনা, ঝগড়া করেনা। একেবারে নিশ্চল, স্তব্ধ। যেনো স্তব্ধতায় তার রাজত্ব। মৌন নিজের ধ্যানে আছে। সকল অভিমান ভুলে গিয়েছে তার অবুঝ মন। আজ মিরা বাড়িতে নেই। দিলারা, নাজমুল আছেন কেবল। মিরা ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছেন।

রাত বাড়ছে ক্রমশ। বাইরে শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠেছে। বারান্দা ভেদ করে চাঁদের মিঠা আলো প্রবেশ করছে ঘরে। নিভৃত খাটে আধ শোয়া হয়ে ল্যাপটপে বসে কাজ করছে। পাশে মৌন বসে। নিভৃত একমনে কাজ করে যাচ্ছে। মৌনর হঠাৎ হঠাৎ কি হচ্ছে ও বুঝতে পারেছেনা। তবে অদ্ভুত অনুভূতি।
‘এই যে শুনুন?’

নিভৃত মৌনের কথায় কপাল কুঁচকে তাকায়। আজ প্রচন্ড বিরক্ত সে। অফিসে প্রচুর রাগ দেখিয়েছে। অহনার দগদগে কথাগুলো আরো মাথা নষ্ট করে দিচ্ছে তার। আরেকদিকে রুহানির স্মৃতি, অপরাধবোধ।
‘কি?’
‘আপনার বেবি কেমন লাগে। ছোট ছোট বেবিগুলো।’

মৌনর অহেতুক ফালতু কথায় নিভৃত বিরক্ত হয়। জরুরি কাজ ফেলে তাকে এসব শুনতে ডেকেছে মেয়েটা?

‘আমি কাজ করছি। বিরক্ত করোনা।’

মৌন থামেনা। বলে যায়,
‘আমাদের একটা বেবি হলে কেমন হয় নিভৃত?’

নিভৃত বিরক্ত কন্ঠে বলে,
‘আমি কি তোমাকে বলেছি আমার বাচ্চা লাগবে? আমাদের সম্পর্কটা কেমন তুমি জানোনা?’
‘আমার যে চাই নিভৃত। আমার যে একটা বেবি চাই।’

মৌন একা একাই বকবক করছে। নিভৃত ল্যাপটপটা পাশে ঠাস করে ফেলে গাল চেপে ধরে মৌনর। শক্ত কন্ঠে বলে,
‘বুঝিস না তুই। আমি বলছি আমার বাচ্চা লাগবে? তোর আর আমার বাচ্চা! এই আমাদের সম্পর্ক কেমন তুই জানিস না? বাচ্চার কথা ভাবলি কেমনে তুই?’

মৌনর গাল ছেড়ে অন্যদিকে ফিরে নিভৃত। মৌন থমকে যায়। তার সকল আশা, ভরসা শেষ হয়ে গিয়েছে একমুহূর্তে। রাগে গলা উঁচিয়ে সে বলে,
‘কেন? চাহিদা পূরণ করার সময় মনে থাকেনা বাচ্চা লাগবেনা?’

নিভৃত গর্জে উঠে। গলা উঁচিয়ে বলে,
‘চুপ। আর একটা কথা না।’

মৌনর কি হলো সে জানেনা। অনেক মুড সুইং হচ্ছে তার। সেও গলা উঁচিয়ে বলে,
‘রুহানি, রুহানি, রুহানি। একটা মৃত মানুষের জন্য এতো ভালোবাসা! অথচ একটা জীবিত মানুষকে যে মৃত বানিয়ে দিচ্ছেন। কেন সব ভালোবাসা রুহানি কে ঘিরে? আমার দোষটা কোথায়? মৃত ব্যাক্তিকে এত ভালোবাসেন। আমাকে একটু ভালোবাসা যায় না? মরার প্রতি এতো দরদ..

আর কথা বাড়াতে পারলোনা মৌন। একটা থাপ্পড় পড়লো তার গালে।
‘তুই এই কথাটা বলার সাহস পেলি কই। এই তোর বুক কাঁপলো না। তোরে যদি এখন আমি খুন করি।’

মৌন চিৎকার করে। চিৎকার করে বলে,
‘তো করুন খুন। কেন বাঁচিয়ে রেখেছেন আপনারা আমায়। আমি আর পারছিনা। আর সাহসের কথা বলছেন আপনি? আমি একশবার বলবো। কি করবেন আপনি। মৃতের প্রতি সব ভালোবাসা।’

আরেকটা থাপ্পড় পড়ে তার গালে। নিভৃতের চোখ লাল হয়ে আছে। ক্ষিপ্র বাঘের মতো হিংস্র লাগছে তাকে। মৌন এবার ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায়। নিজেকে খাটের এককোণে গুটিয়ে নেয় সে। নিভৃত পাশ থেকে উঠে মৌনর একটা হাত ধরে টেনে দাঁড় করায় তাকে। আকস্মিক আক্রমণে পেটে একটু টান পড়ে তার। নিভৃত টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে দরজার দিকে। মৌনর বামহাতটা চলে যায় তার পেটে। বাবুটার কি কষ্ট হচ্ছে! তার পঁচা বাবার কারণে কি কষ্ট পাচ্ছে বাবুটা! বুক ফেটে যাচ্ছে মৌনর। একটা টান দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় সে।
‘আমাকে এভাবে বের করে দিতে হবেনা। আমি নিজেই বেরিয়ে যাচ্ছি। আপনি থাকুন আপনার জগত নিয়ে।’

বলেই বেরিয়ে যায় মৌন। নিভৃত থমকে যায়। ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে সে। মাথাটা চেপে ধরে রাখে। কি ছিল সেই কন্ঠে! এতটা বলিষ্ঠ কন্ঠ নিভৃত আগে তো শুনেনি! এতটা শক্ত কন্ঠ!

(চলবে)……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here