ময়ূখ #লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি #পর্ব-২০

0
631

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২০

৫৮.
ব্রিজের উপর দিয়ে চলছে গাড়ি। ব্রিজের নিচে স্বচ্ছ জলধারা। এটা মূলত সিলেট-জাফলং রোড। পাশে ঐতো দূরে পাহাড় আর পাহাড়। এগুলো ভারতের পাহাড়। শুধু চূড়া নয় সম্পূর্ণ, স্ব বিস্তীর্ণ গিরিরাজের দল। আকাশের নীলচে রঙে অভাবনীয়, মোহনীয় সৌন্দর্য। মৌন গাড়ির জানালা দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মন খুলে, সুর মেলে ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে সুরের ধারা ছড়িয়ে দিলো মৌন। বাইরে তাকিয়ে আপন মনে গাইছে সে,

চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন,
আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট
আহা উত্তাপ কত সুন্দর,
তুই থার্মোমিটারে মাপলে
হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল,
মিঠে কুয়াশায় ভেজা আস্তিন
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম,
আর তুই কাকে ভালোবাসতিস
চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন।

প্রিয় বন্ধুর পাড়া নিঝুম,
চেনা চাঁদ চলে যায় রিকশায়
মুখে যা খুশি বলুক রাত্তির,
শুধু চোখ থেকে চোখে দিক সায়
পায়ে ঘুম যায় একা ফুটপাথ,
ওড়ে জোছনায় মোড়া প্লাস্টিক
পায়ে ঘুম যায় একা ফুটপাথ,
ওড়ে জোছনায় মোড়া প্লাস্টিক
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম,
আর তুই কাকে ভালোবাসতিস।
চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন।

পোষা বালিশের নিচে পথঘাট,
যারা সস্তায় ঘুম কিনতো
তারা কবে ছেড়ে গেছে বন্দর,
আমি পাল্টে নিয়েছি রিংটোন
তবু বারবার তোকে ডাক দিই,
একি উপহার নাকি শাস্তি
তবু বারবার তোকে ডাক দিই,
একি উপহার নাকি শাস্তি
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম,
আর তুই কাকে ভালোবাসতিস

চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন,
আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট
আহা উত্তাপ কত সুন্দর,
তুই থারমোমিটারে মাপলে
হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল,
মিঠে কুয়াশায় ভেজা আস্তিন
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম,
আর তুই কাকে ভালোবাসতিস
চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন।

নিভৃত সারাটা সময় মন দিয়ে গানটা শুনছিলো। তার মনে হচ্ছে প্রত্যেকটা শব্দ তার জন্য গাওয়া। কি অদ্ভুত ভাবনা!
‘তুমি তো খুব ভালো গান করো।’
‘বাহবা, আজ আমার প্রশংসা করলেন যে?’
‘তোমার না তোমার গানের স্টুপিড!’
‘হুহ্। প্রশংসাও করবে আবার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে।’
‘বুঝতে পারলে জিজ্ঞেস করো কেন?’
‘আমার ইচ্ছে।’
‘একেবারে পিয়াইন নদীর অতলে চুবিয়ে আনবো। তখন দেখবো থাকে কিনা তোমার ইচ্ছে।’

মৌন বিরক্তিতে অন্যদিকে তাকালো। এই লোকের সাথে কথা মানেই ঝগড়া। দুইপাশে ধানক্ষেত দেখা যাচ্ছে। শো শো বাতাসে ধানক্ষেতের গাছগুলো এপাশ ওপাশ হচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর ঝর্ণার দেখা মিললো। কি অভূতপূর্ব পাহাড়ের গাঁ হতে নীর প্লাবিত হওয়ার দৃশ্য! গাড়ি থামলো তামাবিল জিরো পয়েন্টের কাছে। জাফলং হতে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে তামাবিল জিরো পয়েন্ট। এটি মূলত সিলেট ও ভারতের শিলংয়ের রাস্তার মধ্যকার চৌকি। গাড়ি থেকে নেমে জায়গাটা ঘুরে দেখলো দুজনে। আশেপাশে অনেক মানুষ। মৌন উচ্ছ্বাসের সাথে দেখছে। মাঝে ফোনে কথা হলো বাড়ির মানুষদের সাথে। মিটির সাথে।

৫৯.
জাফলং। সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই লীলাভূমি। পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন। এর অপর পাশে ভারতের ডাওকি অঞ্চল। ডাওকি অঞ্চলের পাহাড় থেকে ডাওকি নদী এই জাফলং দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মূলত পিয়াইন নদীর অববাহিকায় জাফলং অবস্থিত। সিলেট জেলার জাফলং-তামাবিল-লালখান অঞ্চলে রয়েছে পাহাড়ী উত্তলভঙ্গ।

গাড়ি থেকে নেমে পাশের বিস্তর মাঠে দাঁড়িয়ে অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছে দুজনে। বালিময় আস্তরণ পেরিয়ে নদী। অপরপাশে ভারতের পাহাড়! পাথর আর স্বচ্ছ পানির অভূতপূর্ব নয়নাভিরাম।

মৌনকে এতো জোর করেও পানিতে নামাতে পারলোনা নিভৃত। বেচারির মনে ভয় যদি নিভৃত তাকে সত্যিই পানিতে চুবায়। এই লোকের মাথার তাঁর ছিঁড়া। কোনো বিশ্বাস নাই এর।
নিভৃত বিরক্তি নিয়ে বললো,
‘এই মেয়ে আসো। পানিতে পা ভিজিয়ে চলে যেও।’
‘না।’
‘আশ্চর্য! তোমাকে কি আমি সত্যিই পানিতে চুবাবো নাকি?’
‘আমি কি জানি। আপনি ভালো জানেন।’
‘তুমি তো বড্ড বিরক্ত করছো আমায়! চলো বলছি।’
‘না, না। আমি যাবোনা।’
‘তো থাকো। যত্তসব।’

নিভৃত নিজেই পানিতে পা ভেজালো। মৌন আড়চোখে সাদা শার্ট, ডেনিম প্যান্ট পরিহিত লোকটাকে অবলোকন করছে। প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে পানিতে পা ভেজাচ্ছে নিভৃত। প্রিয়জন পাশে আছে বলেই পূর্ণভাবে জাফলং উপভোগ করতে পারছে মৌন। আরো কতমানুষ! সবাই সবার প্রিয়জনের সাথে এসেছে। হাতে হাত রেখে পানিতে ভিজছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত আনন্দ! কত উচ্ছ্বাস চারপাশে!

‘আপু এই পাথরটা কিনবেন?’

একটা ছোটছেলের কথায় পিছনে ফিরে মৌন। ছেলেটা মায়াবী হেসে একটা রঙিন পাথর এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘নিবেন, আপু?’

মৌনর মায়া হয়। তবে তার ব্যাগ সাথে আনেনি। ছেলেটা মৌনকে চুপ থাকতে দেখে চলে যেতে নেয়। কারণ চুপ থাকার অর্থ সে ধরে নেয় মৌন পাথর কিনবেনা।
‘এই দাঁড়াও।’

ছেলেটা উচ্ছ্বসিত হয়ে পিছনে ফিরে বলে,
‘নিবেন আপু একটা পাথর? দশটাকা।’

মৌন নিভৃতকে ডাক দেয়। মৌনর ডাকে এগিয়ে আসে নিভৃত,
‘কি হয়েছে?’
‘আমাকে একশটাকা দিতে পারবেন? আমি ব্যাগ নিয়ে আসিনি। গাড়িতে উঠলে দিয়ে দিবো।’
‘আমি কি বলেছি আমাকে টাকা ফেরত দিতে হবে? স্টুপিড।’
‘না, মানে..
‘কেন চাই?’

ছোট ছেলেটিকে দেখিয়ে বললো,
‘ওকে দিবো।’

ছেলেটির দিকে তাকালো নিভৃত। ফুটফুটে প্রাণবন্ত একটা ছেলে। দুহাত ভর্তি পাথর।
‘ভাইয়া একটা পাথর কিনবেন?’

নিভৃত নরম কন্ঠে বললো,
‘নাম কি তোমার?’
‘অতুল।’
‘অতুল তুমি কি জানো এভাবে জাফলংয়ের পাথর বিক্রি একটা অপরাধ। এতে তোমার সাজাও হতে পারে।’

ছেলেটি ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
‘কেন ভাইয়া?’
‘জাফলং আমাদের রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক সম্পদ। এই যে তুমি নদী থেকে পাথর কুড়িয়ে বিক্রি করো একবার ভেবে দেখোতো একসময় সব পাথর ফুরিয়ে গেলে কি হবে?’
‘কি হবে ভাইয়া?’
‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হবে। তখন দেখা যাবে বাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে জাফলংয়ের পাথর তবে জাফলংয়েই পাথর নেই। আমি কি বলছি বুঝতে পারছো অতুল?’
‘জ্বি, ভাইয়া। আসলে পারিবারিক অবস্থার কারণে আমি এই কাজে নেমেছি।’
‘তোমার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি তবে তোমার কারণে প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা তুমি চাও?’
‘না, ভাইয়া। আমি আর পাথর বিক্রি করবোনা।’

মাথা নিচু করে বলে অতুল। নিভৃত হেসে বলে,
‘তুমি তো খুব সুন্দর বাংলা বলো। সাধারণত তোমার বয়সী জাফলংয়ের ছেলেদের এতো সুন্দর বাংলা বলতে আগে দেখিনি।’

মৌন পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। এ কোন নিভৃত?

‘আমরা আগে ঢাকা থাকতাম ভাইয়া। আমার আব্বু হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। মা খরচ সামলাতে না পেরে সিলেট দাদুবাড়ি চলে আসে। এখানেও সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা। মা কাপড় সেলাই করে সংসার চালান।’

মৌনর খুবই খারাপ লাগছে। এত ছোট একটা ছেলে অথচ কত কষ্ট তার।

৬০.
‘পড়াশোনা করো তুমি?’
‘না, ভাইয়া। ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলাম পরে আর পড়া হয়নি।’

নিভৃত একহাজার টাকার নোট বের করে দিতে চাইলো অতুলকে।
‘আমি এটা নিতে পারবোনা ভাইয়া। মা আমাকে বকবে।’
‘বড় ভাই দিচ্ছে। নেও।’

নিভৃত জোর করে অতুলের হাতে টাকাটা গুঁজে দিলো। মুচকি হেসে বললো,
‘তোমার মায়ের ফোন নাম্বারটা দাওতো অতুল।’
‘কেন ভাইয়া?’
‘পড়তে চাও তুমি?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার এই ভাইয়া যদি তোমার পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়? পড়বে তো?’
‘কিন্তু!’
‘কোনো কিন্তু নয় অতুল।’

অতুলের থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে তার মায়ের সাথে কথা বলে নিভৃত। যদিও তিনি প্রথমে মানা করছিলেন তবে ছেলের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়েছেন। অতুলের থেকে বিদায় নিয়ে তারা রওনা দেয় জৈন্তাপুর রিসোর্টে। অতুল একধ্যানে গাড়িটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। এই জাফলংয়ে কত মানুষ এসেছে। কত মানুষ তার সাথে খারাপ আচরণ করেছে। তবে আজকের মতো এমন দেবদূতের মতো কেউ আসেনি। কেউনা। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। অতুল মন ভরে দোয়া করে।

__________________

মৌন অবাক চোখে সে কখন থেকে নিভৃতকে দেখছে। নিভৃত বিরক্ত হয়ে গাড়ি থামিয়ে একদম মৌনের মুখের কাছে চলে এলো। ঘটনার আকস্মিকতায় মৌন হতভম্ব।
‘দেখো ভালো করে দেখো। আরো দেখতে চাও।’
‘আপনি এমন করেছেন কেন! দূরে যান।’

নিভৃত দূরে সরে বলে,
‘আমি সুন্দর আমি জানি। এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে নজর লাগাতে হবেনা।’
‘আমি আপনাকে ভালো ভেবেছিলাম। তবে না আমার ধারণা ভুল। আপনি একটা বদলোক।’
‘তাই। তুমি আজ জানতে পারলে। খুবই ভারাক্রান্ত হলাম শুনে। আমার কি কান্না করা উচিত?’
‘আপনি আসলেই ফালতু।’

নিভৃত মিটিমিটি হেসে গাড়ি চালনায় মন দিলো। মৌন বাইরে তাকিয়ে রাগে গজগজ করছে। একটু আগেও নিভৃতকে সে ভালো ভেবেছিলো! কতটা ভুল ছিল সে! এই লোক ভালো হবার নয়।

(চলবে)…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here