#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৪
১০.
ডিভানে বসে আছে মৌন। লোকটা পেয়েছে কি! মৌন মানে প্রিয় মানুষের অকাল মৃত্যুতে খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। মৌনরও অদ্ভুতভাবে খারাপ লাগছে। লোকটাকে সময় দেওয়া প্রয়োজন। মৌনর এরূপ ব্যবহার ঠিক হয়নি।
বাথরুম থেকে এলোমেলো ভিজা চুলগুলো মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো নিভৃত। মেয়েটাকে দেখে আবার তেড়ে গেলো তার দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় মৌন পাথরের ন্যায় বসে রইলো।
‘এই মেয়ে তুমি তো অতিরিক্ত বেহায়া। বলেছিনা এই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে।’
হঠাৎ করেই থমকে গেলো নিভৃত। হাত বাড়িয়ে মৌনর চিবুকের লাল তিলটায় আঙুল ছুঁয়ালো। শীতল স্পর্শে কেঁপে উঠলো মৌন। নিভৃত হাতের তালু দিয়ে ঘষতে লাগলো ঐ লাল তিলটি। শক্ত হাতের ঘষায় লাল হয়ে গেছে মৌনর চিবুক। হলদে সাদা মুখটা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। নিভৃতের ভিজা চুলের ছিটেফোঁটা পানি ছিটকে ভিজিয়ে দিচ্ছে মৌনর মুখ। মৌন নিভৃতের হাতটা জোর করে সরিয়ে বললো,
‘কি করছেন আপনি?’
‘এই মেয়ে তোমার চিবুকে লাল তিল কেন?’
মৌন হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত তো! ওঁর চিবুকে লাল তিল আছে কেন এর উত্তর ও কি দিবে?
‘আমি কি জানি।’
‘এই তুমি এটা নকল বানিয়েছো। তাই না? নয়তো আমার রুহানির মতো তিল তোমার মুখে কেন? দেখো যতই তুমি রুহানি সাজার চেষ্টা করো না কেন। জীবনেও ওঁর মতো হতে পারবেনা।’
‘আজব তো! কিসব আবোল তাবোল কথা বলছেন? এটা আমার বাস্তব তিল। রুহানি আপুর যে তিল ছিল তাই তো জানতাম না।’
‘তুমি মিথ্যা বলছো।’
মৌন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই লোকটা তো আস্ত পাগল।
‘আমার মিথ্যা বলার কোনো প্রয়োজন আছে কি? নিজেই তো এতক্ষণ আমার চিবুক ঘষে লাল বানিয়ে দিলেন। তাও আপনার স্বাদ মিটেনি। নিন আরো পরীক্ষা করে দেখুন। নিন।’
নিভৃতের সামনে এগিয়ে গেলো মৌন। নিভৃত বিরক্তির সুর তুলে বললো,
‘এই মেয়ে বের হও তো তুমি। কোথা থেকে এসব আপদ আসে!’
‘প্রথমে তো আমার নাম এই মেয়ে না। আমার নাম মৌনতা সুবহা মৌন।’
নিভৃত লাল চোখ করে এক ধমক দিলো। মৌন বেচারি পায়ের ব্যথা নিয়ে ছুটে পালিয়েছে। এই সাইকোর সাথে কিভাবে সারাজীবন কাটাবে! অদ্ভুত লোক!
১১.
বিকালের আকাশটা বড়ই অপূর্ব। সাদা, নীলের কি সুন্দর কারুকার্য! নীল রঙা সমুদ্রে যেন সাদা মেঘের দল বৈঠা বিহীন ভেলা ভাসিয়েছে। কালো কালো কিছু পাখির দল ছুটে যাচ্ছে নিজেদের নীড়ে। মৌন একমনে আকাশ দেখছিলো। তার স্তম্ভিত ফিরে মিতুর ডাকে। দোলনায় পাশেই বসে মিতু।
‘কোথায় হারালে?’
‘আকাশে।’
‘তুমি কিন্তু বড্ড মিষ্টি।’
‘আপু আর কতবার বলবে?’
‘মিষ্টি কে মিষ্টি না বললে হয় নাকি। এবার বলো কি খাবে তোমার ভাইয়া আসার সময় নিয়ে আসবে।’
‘না, আপু। কিছু খাবোনা।’
‘তা বললে তো হয়না। আমরা তো পরশুই সিঙ্গাপুর চলে যাবো। এই আপুটাকে আবার দেখতে পাবে একবছর পর। তোমাকে বাইরে নিয়ে ঘুরিয়ে আনতাম। তবে তোমার পা…
মন খারাপ হয়ে গেলো মিতুর। বাবা-মায়ের উপর রাগ হলো প্রচুর। এই ছোট মেয়েটার ভবিষ্যত নষ্ট করেছে তারা। মিতু নিজের ভাইকে চিনে। রুহানি তার ঠিক কতোটা জুড়ে ছিলো তাও জানে। তার ভাই কোনোদিন হয়তো এই মেয়েটাকে মেনে নিবেনা। কিংবা মেনে নিলেও তা কি মন থেকে হবে! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।
রাতুল হাতে একটা প্লেট নিয়ে ছাদে হাজির হয়। রাতুল মিতুর বর। সাথে শরিফা। শরিফার হাতে একটা প্লেট। শরিফা এ বাড়িতে কাজ করে। বয়স চল্লিশ হবে। চিকন গড়নের শ্যামলা গাঁয়ের রং। পান খেয়ে মুখ লাল করে রাখে সবসময়। মৌনর অনেক ভালোলাগে দেখতে। তার মাও পান খেয়ে মুখ রঙিন করে রাখতো।
‘কি পিচ্চি বোন নাকি ভাবি বলবো!’
‘আপনার যা ইচ্ছে ডাকেন ভাইয়া।’
‘ঠিক আছে তাহলে তোমাকে আমি পিচ্চি বোন বলেই ডাকি।’
দুইটা প্লেটে কিমা পুরি, মোগলাই আর খাসির চপ। শরিফা চলে গিয়েছেন। তবে তিনি যাওয়ার আগে মিতু জোর করে তার হাতে দুইটা চপ দিয়ে দিয়েছে। মৌনর খুবই লাগলো। উচ্চবিত্ত হয়েও ওদের ব্যবহার অনেক অমায়িক। হাসি, ঠাট্টায় কেটে গেলো বিকেল। মৌনর একটুও খারাপ লাগেনি। সব ভুলে প্রাণ খুলে হেসেছে সে।
১২.
ডাইনিং টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। নিভৃতও সেখানে বসে খাচ্ছে। আড়চোখে মায়ের আহ্লাদীপনা দেখছে। অসভ্য মেয়েটাকে ভাত খাইয়ে দিতে দেখে তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। তবে বাবার জন্য কিছু বলছেনা। অর্ধেক খাবার খেয়েই উঠে হাত ধুঁয়ে নিজের ঘরে চলে এলো সে। আসার সময় একটা কাঁচের গ্লাস ভেঙে এসেছে। বাবা-মাকে তার নির্দয় লাগছে। এতো সহজে রুহানিকে তারা ভুলে গেলেন।
রুহানির ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো নিভৃত।
মৃত্যু! কি অদ্ভুত একটা শব্দ! আজ থেকে একবছর আগেও এই বাড়িটা মাতিয়ে রাখতো রুহানি। কত খুনসুটি! হাসি ঠাট্টা। আর আজ তার মৃত্যুর ছয়মাসও হয়নি অন্য একটা মেয়ে এসে দখল করতে চাইছে সবকিছু। আর তার বাবা-মাও মেয়েটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এতো সহজে সব ভুলে গেলেন তারা। দুই দিনের মেয়ের জন্য এতোগুলো বছরের সম্পর্ক ভুলে গেলেন। আলমারি থেকে অ্যাবসিনতের বোতলটা বের করলো নিভৃত। নিজের কষ্টটাকে কমাতে, বুকের জ্বালাটাকে কমাতে একটা ঝাঁঝালো কিছুর প্রয়োজন। কড়া কিছু। অন্যগুলোতে নেশা ধরেনা।
একচুমুকে অ্যাবসিনতের বোতলটা অর্ধেক করে দিলো সে। গলা জ্বলছে। মাথা ভনভন করছে। বিছনায় হেলান দিয়ে চোখ বুজলো নিভৃত।
ভয়ে ভয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে মৌন। আজোও যদি নিভৃত গাঁয়ে হাত তুলে! শরিফার কাছ থেকে একটা মাদুর, কাঁথা আর বালিশ চেয়ে এনেছে। মৌন জানে নিভৃত তাকে জীবনেও বিছানায় জায়গা দিবেনা। মৌন ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলো। নিভৃত নিশ্চুপ। এমন শান্ত নিভৃতকে দেখে ভরকে গেলো মৌন। এটা কি ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা! মৌন যতগুলো সূরা জানে বিড়বিড় করে সব পড়ছে। না, লোকটার কোনো হেলদুল নেই। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফ্লোরে মাদুর পেতে সেখানে শুয়ে পড়লো মৌন।
গভীর রাতে হঠাৎ কারো স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায় মৌনর। অন্ধকার ঘরে বারান্দা থেকে হালকা আলো আসছে। নিভৃত তো আসবেনা। এটা কি কোনো ভৌতিক কর্মকাণ্ড! ভয়ে ভয়ে যেই চিৎকার দিতে নিবে এমনি একটা শক্ত হাত মুখ চেপে ধরলো তার। বিস্মিত হয়ে হাতের মালিকের দিকে তাকিয়ে আছে মৌন। কারণ এটা নিভৃত!
মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ করার চেষ্টা করছে মৌন। তবে তা সফল হচ্ছেনা। নাকে ঠেকছে বিশ্রি, ঝাঁঝালো গন্ধ। গন্ধে বমি আসার উপক্রম মৌনর। নিভৃত অস্ফুট সুরে বললো,
‘রুহানি।’
তারপর একটা কামড় বসিয়ে দিলো মৌনর লাল তিলটায়। সে অনবরত বিড়বিড় করেই যাচ্ছে,
‘এটা তোমার শাস্তি রুহানি। তোমায় আর কোথাও যেতে দিবোনা। আমার সাথে বেঁধে রাখবো।’
অতঃপর কোলে তুলে নিলো মৌনকে। খাটে নিয়ে শুইয়ে ঝাপটে ধরে তার বুকে মাথা রাখলো। মৌন চিৎকার করে বলছে,
‘আমি আপনার রুহানি না। আমি মৌন। এই যে শুনছেন আপনি। ছাড়ুন আমায়। আমি রুহানি না।’
তবে এসব কথা আদোও নিভৃতের কানে ঢুকছে কিনা সন্দেহ। সে শান্তির ঘুম দিয়েছে। মৌন অসহায় মুখে হালকা আলোয় নিভৃতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সকালে উঠে তাকেই যে কথা শুনতে হবে! মৌন নিশ্চিত।
(চলবে)……