#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১০
পূর্ণিমার চাঁদটার আশে পাশে শুভ্র মেঘের বিচরন। চাঁদের আলোয় মেঘ গুলো বেশ লাগছে দেখতে। ঠিক যেন শিল্পীর রঙ তুলিতে আঁকা কোন পূর্ণিমার ছবি। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোতে কিছু পোকা ঘুরে ঘুরে উড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে নিজের মতো খেলায় ব্যস্ত তারা। ছাদের এক পাশে দাড়িয়ে ইলু সায়ানের সাথে ফোনে কথা বলছে। কথা বলার মাঝেই নিচে এক পলক তাকাতেই ইভানকে দেখতে পেয়ে ডাকল।
–ইভান ভাইয়া।
ইভান বাইরে বেরিয়েছিল একটু হাঁটাহাঁটি করতে। পূর্ণিমা রাতে রাস্তায় অজানা উদ্দেশ্যে হাটতে বেশ লাগে। মাথা তুলে ইলুর দিকে তাকিয়ে গলা তুলে বলল
–কি হয়েছে?
ইলু কান থেকে ফোনটা হালকা সরিয়ে বলল
–কোথায় যাচ্ছ?
–কোথাও না। হাঁটছি। কিছু বলবি?
ইলু হাত উঠিয়ে বলল
–একটু দাড়াও। আমি আসছি।
ইভান বেশ বিরক্ত হল। সে একা একা হাটতে বেরিয়েছিল। এই সময় ইলুকে নিয়ে হাটতে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই তার। ঈশা হলে তাও একটা কথা ছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদটা দেখেই মন ভরে গেলো। এর মাঝেই ইলু হাপাতে হাপাতে এলো। ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল তার দিকে। কয়েকটা বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলল
–ঈশাদের বাসায় যাব চল।
ইভান সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–আমি এখন ঐদিকে যাব না। সামনে যাব।
ইলু ইভানের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–ঈশা অসুস্থ তুমি জাননা?
ইভানের ভ্রু কুচকে এলো। বিচলিত কণ্ঠে বলল
–অসুস্থ মানে? বিকেলেই না ছাদে দেখলাম।
–আরে বাবা বিকেলে ছাদে উঠলে যে এখন অসুস্থ হওয়া যাবে না তা তো না। সন্ধ্যা থেকে পেট ব্যাথা। কয়েকবার বমিও করেছে। সবাই ওখানেই আছে। আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম তাই এখনও যাইনি।
ইভান আর কথা বাড়াল না। ইলুর সাথে ঈশাদের বাড়ির দিকে হাটা দিলো। ইলু কিছুদুর যেতেই প্রশ্ন করলো
–তুমি কেন জাননা? তুমিও কি বাসায় ছিলে না?
ইভান চিন্তিত কণ্ঠে বলল
–হুম। আমি সন্ধ্যার আগেই বাইরে গিয়েছিলাম। একটু আগেই আসলাম। তাই আম্মুকে বাসায় দেখলাম না। জানলে তো এতক্ষন চলেই জেতাম।
ইলু সামনে তাকিয়েই বলল
–খুব চিন্তা হচ্ছে?
ইভান কঠিন দৃষ্টিতে ইলুর দিকে তাকাল। কিন্তু বেশ সাভাবিক ভাবেই মৃদু আওয়াজে বলল
–চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক নয় কি? নাকি আমাকে তোর মানুষ মনে হয়না?
ইলু মুচকি হাসল। সামনে তাকিয়ে আবারো বলল
–ইভান ভাইয়া তুমিও জানো ঈশা তোমাকে পছন্দ করে। তাহলে কেন এই লুকোচুরি? বলে দিলে কি হয়?
ইভান হতাশ হয়ে বলল
–পছন্দ করা আর ভালবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। আমি ঈশাকে শুধু পছন্দ করিনা ভালবাসি। প্রচণ্ড ভালবাসি। আমার সব কিছু জুড়ে শুধুই ঈশা।
–এতো ভালবাস অথচ কিছুই বল না। কেন? তোমার ভয় করেনা। এই চুপ করে থাকার কারনে যদি ঈশা কোন ভাবে অন্য কোথাও ইনভল্ভ হয়ে যায়।
ইভান মুচকি হেসে বলল
–আজ পর্যন্ত ঈশার ধারের কাছেও কোন ছেলে ঘেষতে পারেনি। আমি দেইনি। একদম ছোটবেলা থেকে ওর চারিদিকে আমি আমার অনুভুতি বিছিয়ে রেখেছি। যাতে সেগুলো ছাড়া আর কিছুই তার চোখে না পড়ে। ওর সব কিছুর খবর আমার কাছে থাকে। এতো সহজ না। আমার ভাবনার মাঝে যেমন শুধু ঈশার বিচরন তেমনি ওর ভাবনার মাঝেও আমি আমার জায়গা করে রেখেছি।
ইলু কৌতূহলী হয়ে বলল
–সবই বুঝলাম। কিন্তু তুমি ওকে কিছু বল না কেন? আর বিয়ে কবে করবে? এভাবে আর কতদিন?
ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ইলুর দিকে। গম্ভির আওয়াজে বলল
–শুধু কি বিয়ে করলেই হয়ে যায়? বিয়ে মানে অনেক বড় দায়িত্ব। আমি নিজেই এখনও সেই দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত না। আর ঈশার তো প্রশ্নই আসেনা। ওর মাঝে এখনও ছেলে মানুষী আছে। আর একটু সময় যাক তারপর ভাবা যাবে। তাছাড়াও আমি এখন নিজের ক্যারিয়ার গোছাতেই ব্যস্ত। এই সময় কি আর বিয়ে নিয়ে ভাবা যায়।
ইলু ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–এতো কিছু কিভাবে ভাব তুমি? ভালবাস অথচ তাকে কাছে পাওয়ার কোন আকুলতা নাই তোমার মধ্যে। তাকে পাওয়ার চেয়েও তার জীবন নিয়ে ভাবনাটাই তোমার বেশী। কি অদ্ভুত তুমি আর তোমার ভালবাসা। এভাবেও কি ভালবাসা সম্ভব?
ইভান মুচকি হেসে বলল
–আমি কখনও ঈশাকে খারাপ রাখার কথা কল্পনাতেও আনিনি। আমি সব সময় চাই ঈশা আমার কাছে দুনিয়ায় সব থেকে ভালো থাকুক। কোন কিছুর অভাব না থাকুক। ঈশার জিবনে কোন আফসোস থাকলে আমি নিজেকে কখনও মাফ করতে পারব না। আমি ওকে জীবনের সব সুখ দিতে চাই।
ইলু অবাক হয়ে ইভানের কথা শুনছে। সেও সায়ান কে ভালোবাসে। কিন্তু ইভানের এই গভির ভালবাসার সাথে তাদের ভালবাসার কোন তুলনা হয়না। তারা হয়তো এভাবে ভাবতেও পারবে না কখনও। এভাবে কথা বলতে বলতেই তারা ঈশাদের বাড়িতে পৌঁছে গেলো। বাড়ির দরজা খোলা। সবাই ভিতরে বসে গল্প করছে। ইভান কে দেখে তার মা বলল
–আরে তুই কখন এলি?
ইভান ছোট্ট করে বলল
–একটু আগেই। ঈশা এখন কেমন আছে? কি হয়েছিলো?
ঈশার বাবা চিন্তিত সরে বলল
–হুট করেই পেট ব্যথা আর বমি শুরু হয়। আমি পরিচিত ডক্টরকে ফোন করি। এসে কিছু ঔষধ আর ইনজেকশন দিয়ে যায়। এখন রেস্ট নিচ্ছে।
ইভান সোফায় বসতে বসতে বলল
–এরকম হওয়ার কারন কি হতে পারে মেজ বাবা?
ঈশার বাবা গম্ভির আওয়াজে বললেন
–ডক্টরের ধারনা ফুড পয়জনিং। আপাতত মেডিসিন নিলেই কমে যাবে। যদি না কমে তাহলে টেস্ট করতে হবে।
একটু থেমে আবার বলল
–হয়ত সেরকম কিছুই। অন্য কিছু হলে তো এতক্ষন কমতো না।
ইভান একটা ছোট্ট শ্বাস ছাড়তেই তিনি ইভানের পিঠে হাত রেখে বললেন
–ঘরে যা। একবার দেখে আয়।
ইভান ম্লান হেসে উঠে গেলো। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই দেখল ঈশা চাদর মুড়ি দিয়ে গুটি সুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে। ইভান গিয়ে বিছানার উপরে বসে পড়ল। ঈশার দিকে ভালো করে দেখে নিলো। ভাবল হয়ত তার ঠাণ্ডা লাগছে। চাদরটা গলা পর্যন্ত ভালো করে টেনে দিতেই ঈশা চমকে উঠল। ইভান মাথায় হাত দিয়ে বলল
–ভয় পাস না। আমি তো।
ইভানের গলার আওয়াজ শুনে ঈশা সস্তি পেল। উঠে বসতে চাইলে ইভান আবার জোর করে শুয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে
–এখন কেমন লাগছে?
ঈশা ক্লান্ত সরে বলে
–ভালো।
ইভান একটু কঠিন সরে জিজ্ঞেস করে
–কি খেয়েছিলি? এরকম হওয়ার কারন কি?
ঈশা কোন কথা বলল না। অসহায় চোখে তাকাল একবার। ঈশার অসহায় দৃষ্টি ইভানের চোখে পড়ল ঠিকই কিন্তু তার মানে বুঝতে পারল না সে। ঈশা মুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইভান মাথায় হাত বুলিয়ে আশস্তের সরে বলল
–টেনশনের কিছু নেই। ঠিক হয়ে যাবে। রেস্ট নে।
বলে উঠে দাড়াতেই ঈশা আবারো ‘আহ’ শব্দ উচ্চারন করলো। ইভান ঘুরে তাকাল। ঈশা পেট চেপে ধরে কোঁকড়া হয়ে শুয়ে আছে। চোখ খিচে বন্ধ করে রেখছে। ইভান বসে পড়ল। বিচলিত কণ্ঠে বলল
–কি হয়েছে জান? কষ্ট হচ্ছে? কেমন লাগছে আমাকে বল?
ঈশা এক হাতে ইভানের হাত চেপে ধরল শক্ত করে। ইভান ঈশার মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু সরে বলল
–কি হয়েছে?
ঈশা কোন কথা বলতে পারছে না। ইভান কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল
–হসপিটালে যেতে হবে। এভাবে হবে না।
ঈশা একবারেই উঠে বসলো। ইভানের হাত টেনে ধরে বলল
–আমি যাবনা। আমার কিছু হয়নি।
ইভান দাতে দাত চেপে বলল
–আমার সাথে জেদ করবি না একদম।
ঈশা এবার কাদতে শুরু করলো জোরে জোরে। তার কান্নার আওয়াজ শুনে সবাই ঘরে চলে এলো। ইভান একটু দূরে সরে বসলো। ঈশার মা ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–কি হয়েছে? কাদছিস কেন?
ঈশা ফিকরে ফিকরে কাদতে কাদতে তার বাবাকে বলল
–বাবা দেখনা ইভান ভাইয়া আমাকে জোর করে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে। আমি যাবনা।
ঈশার বাবা মেয়ের পাশে বসল। ইভান অসহায়ের মতো বসে আছে। ঈশার দিকেই তার দৃষ্টি স্থির। ঈশার বাবা বলল
–যদি সেরকম কিছু বলে থাকে তাহলে অবশ্যই সেরকম কিছু হয়েছে। কারন ইভান অকাজে কোন কিছু ভাবার মতো ছেলে না।
ইভান অভিমানের সুরে বলল
–তোমার মেয়ের ধারনা আমার মাথায় তো অকাজের ভাবনা ছাড়া আর কিছুই আসেনা। আমি সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবতেই পারিনা।
ঈশা মাথা নামিয়ে অসহায় বলল
–আমি যাবনা হসপিটালে।
ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা বেশ সাহস করে মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের সরে বলল
–প্লিজ ইভান ভাইয়া। আমি যাবনা প্লিজ। হসপিটাল ডক্টর এসবে আমার ভয়ংকর রকমের ফোবিয়া আছে। তুমি বুঝতে চেষ্টা কর প্লিজ।
ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঈশার এভাবে কথা বলা তার এই মুহূর্তে মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। কারন এভাবে বললে সে কোন ভাবেই তার কথা ফেলতে পারবে না। একটা শ্বাস ছেড়ে ধমকের সুরে বলল
–একটা লাইনে এতো বার প্লিজ বলার কি আছে?
সবাই ঠোট চেপে হাসতে লাগল। ঈশা অসহায়ের মতো বসে থাকল। ঈশার বাবা বললেন
–টেস্ট করিয়ে আনলে বোধ হয় ভালই হতো।
ইভান নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–থাক মেজ বাবা। খুব বেশী প্রব্লেম হলে তো দেখাই যেত। মেডিসিন কাজ করতে একটু তো সময় নিবেই। রাতটা দেখ। তারপর ভাবা যাবে।
ঈশার বাবাও সম্মতি দিলো। ঈশা সস্তির নিশ্বাস ফেলল। সেটা দেখেই ইভান মুচকি হাসল। ঈশার বাবা ঈশাকে রেস্ট নিতে বলে বের হয়ে গেলেন। তার পিছনে পিছনে সবাই বের হয়ে গেলো। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। ঈশা একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। নিচু কণ্ঠে বলল
–আমি একটু ঘুমাব। তাহলেই ঠিক হয়ে যাব।
ইভান শান্ত ভাবে বলল
–আমাকে কি তোর বলদ মনে হয়? আমি কিছু বুঝি না তাই না?
ইভানের এমন কথা শুনে ঈশা শুকনো ঢোক গিলে ফেলল। কারন তার যে এখনও পেট ব্যথা আছে সেটা ইভান ভালো করেই বুঝতে পারছে। অসহায় হয়ে বলল
–আমি সকালের মধ্যে ঠিক হয়ে যাব। সত্যি। তবুও হসপিটালে যাব না।
ইভান গম্ভির আওয়াজে বলল
–মনে থাকে যেন। নাহলে সকাল বেলা কিন্তু হসপিটালে রেখে আসব।
বলেই উঠে দরজার কাছে গিয়ে লাইট অফ করে দিয়ে বলল
–ব্যথা খুব বেশী মনে হলে আমাকে ফোন দিবি। ঠিক আছে?
ঈশা মাথা নাড়ল। ইভান দরজা বন্ধ করে চলে গেলো। ঈশা চোখ বন্ধ করে মাথা বিছানায় ঠেকিয়ে দিলো। চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। বাস্তবতা অনেক কঠিন। ঈশা কি পারবে সেটা সামলে নিতে? নাকি কঠিন কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে?
চলবে……।
(রিচেক করার সময় হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)