#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১২
ইভানের কথাটা শুনে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু ঈশা গম্ভির হয়ে গেলো। তার চোখে মুখে হতাশার ছাপ। সে ইভানের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে। ঈশার বাবা সস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল
–আমি তো না করিনি বাবা। আমি তোর হাতে তুলে দিলেই নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো। সময় হলেই আমি তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।
ইভান চোখ তুলে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা ইভানের দৃষ্টি দেখে আঁতকে উঠল। ইভানের চোখ ছলছল করছে। হারানোর ভয়। সাথে ধরে রাখার আকুলতা। ঈশা করুন দৃষ্টিতে তাকাল। ইভান ছলছল চোখে ঈশার দিকে তাকিয়েই বলল
–আমি এখনি এই মুহূর্তে ঈশাকে বিয়ে করতে চাই।
পুরো ঘর নিরবতায় ভরে গেলো। ঈশার বাবা অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন
–এখনি?
ইভান ঈশার বাবার দিকে তাকাল। করুন সরে বলল
–তোমার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিয়ে যদি তুমি নিশ্চিন্তেই থাক তাহলে আজ হলে সমস্যা কোথায়? মানুষটা তো আমিই বাবা। তোমার সেই ভরসার মানুষ। আমি আজ এখন থেকেই ঈশার দায়িত্ব নিতে চাই। প্লিজ তুমি রাজি হয়ে জাও বাবা।
ঈশার বাবা কি বলবে বুঝতে পারছে না। একদিকে মেয়ের অসুস্থতা। অন্যদিকে ইভানের যুক্তি। তিনি একটু ভেবে বললেন
–ঈশা সুস্থ হওয়া পর্যন্ত না হয়……।
ইভান থামিয়ে দিলো। কাপা কাপা গলায় বলল
–আমি তো তোমার মেয়েকে এখান থেকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছি না। শুধু রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করবে। এটাই কি খুব বেশী চাওয়া? তোমার আর তোমার মেয়ের কাছে আমি এই মুহূর্তে এটাই চাই। আমি কোনদিন কিছুই চাইনি বাবা। আমাকে নিরাশ করোনা। আপাতত শুধু ঈশার সাইনটাই দরকার। বাকিটা নাহয় সুস্থ হলে দেখা যাবে।
ঈশার বাবা মাথা নিচু করে ভাবলেন কিছুক্ষন। চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাতেই দেখল সে ঈশার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তিনি ঈশার দিকে তাকালেন। ঈশা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। চোখের পানি গড়ে পড়ছে। ঈশার বাবা তার কাছে গিয়ে মাথায় হাত দিতেই ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষন পর মুখ ঘুরিয়ে বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। চোখ দিয়ে ইশারা করে বুঝিয়ে দিলো সে এই বিয়ে করতে চায় না। তার বাবা মেয়ের কথা বুঝলেও এটা বুঝতে পারলেন না যে এখনি বিয়ে করতে তার আপত্তি নাকি ইভান কে বিয়ে করতে আপত্তি। তিনি আরও কিছু বলার আগেই ইভান গম্ভির গলায় বলল
–আমি ঈশার সাথে কথা বলতে চাই। একা।
সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ইভান টুলে বসে পড়ল। সাদা পর্দায় মোড়ানো নিস্তব্ধ ঘরটার নিরবতা ভয়ংকর লাগছে ঈশার কাছে। এক হাতে স্যালাইন ঝুলছে। আর এক হাতে নিজের গায়ে জড়ান শুভ্র চাদরটা খামচে ধরে আছে। শ্বাস অনবরত চলছে। চোখে মুখে ভয়ের আভাষ। সামনের টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা হাত নিলো ইভান। ফাকা গ্লাস। পানি নেই। হাত ধরে ঈশার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নরম গলায় বলল
–তুই কি ভাবছিস আমি সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছি। আর কি বলতে চাইছিস সেটাও জানি। তুই কথা না বললেও তোকে বুঝতে আমার কষ্ট হয়না জান।
কথাটা ঈশার বুকের ভিতরে তোলপাড় শুরু করে দিলো। অবাক চোখে কিছুক্ষন ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকল। ইভান মৃদু হেসে বলল
–খুব অধিকার বোধ নিজের উপরে তাই না?
ঈশা চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইভান হাতের গ্লাসটা চাপ দিয়ে ভেঙ্গে দিলো। এতে কাচের টুকরো গুলো তার হাতে ঢুকে গেলো। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ঈশা সেদিকে তাকাল। ইভানের হাতে রক্ত দেখে তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। এক হাত উঠিয়ে ইভানের দিকে বাড়াতেই সে হাত সরিয়ে নিলো। হালকা হেসে বলল
–এতো সহজ? আমার কষ্টের কোন দাম নেই না? এখন থেকে থাকবে। তুই এবার থেকে আমার সব কষ্টের দাম দিবি। আমি সব হিসাব তোর কাছ থেকে নিব।
দাতে দাত চেপে বলল
–তোর সব অধিকার আমি কেড়ে নিব। তোর উপরে এখন থেকে শুধু আমার অধিকার থাকবে। আমার এই অধিকার এতটাই কষ্টের হবে তোর জন্য যা তুই ভাবতেও পারবি না। আমি আর কোন ভাবেই কষ্ট পেতে রাজি না। কোন ভাবেই না।
রেজিস্ট্রি পেপারটা ঈশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
–সাইন কর। আমি হেল্প করছি। দেরি করিস না।
ঈশা কি করবে বুঝতে পারছে না। ইভানের দিকে তাকিয়ে অনবরত চোখের পানি ফেলেই যাচ্ছে। ইভান এক হাতে ঈশার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
–তুই যত দেরি করবি আমার শরির থেকে ততই রক্ত ঝরবে। তাই তাড়াতাড়ি কর। হাতে বেশী সময় নেই।
ঈশা করুন চোখে তাকাল। ইভান তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বলল
–আমি তোর উপরে জোর করতে চাইনা। আমাকে এসব করতে বাধ্য করিস না। এই মুহূর্তে নাহলে আমি যে কোন কিছু করতে দুই বার ভাবব না। আমাকে তো তুই চিনিস জান।
কথা শেষ করেই ইভান তার হাত থেকে কাচের টুকরো টান দিয়ে বের করলো। হাত থেকে গল গল করে রক্ত পড়তে লাগল। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এতো ভাবার সময় নাই তো। তোর কাছে কোন অপশন নাই।
ঈশা বুঝতে পারল ইভানের কথা শোনা ছাড়া তার কাছে কোন উপায় নাই। ইভান আর কিছুতেই কোন কথা শুনবেনা। তাই কিছু না ভেবেই কাপা কাপা হাতে সাইন করে দিলো। ইভান সস্তির নিশ্বাস ফেলে কাগজটা ঈশার হাত থেকে নিয়ে নিলো। ঈশার গালে আলতো করে হাত রেখে বলল
–সরি জান। তোর জন্য কোন অপশন রাখিনি। বাধ্য করার জন্য সরি। পারলে মাফ করে দিস।
ঈশার কপালে একটা চুমু দিয়ে বের হয়ে গেলো। ঈশা নিজের চোখের পানি আটকাতে পারল না। সে বুঝতে পারছে না তার জীবনের কাঙ্খিত প্রাপ্তিটাকে সে গ্রহন করবে নাকি বাস্তবতার কাছে হার মেনে দূরে ঠেলে দিবে। কিন্তু সে তো ইভান কে ভালবাসে। তাহলে কেন এতো বাধা।
ইভান কাগজ হাতে বাইরে বেরিয়ে এলো। ঈশার বাবার হাতে কাগজটা দিয়ে বলল
–ঈশা সাইন করে দিয়েছে মেজ বাবা। সব ঠিক আছে।
ঈশার বাবার চোখ থেকে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। এটা তার খুশির কান্না। সবাই এগিয়ে এলেন। তখনি ইফতি চিৎকার করে বলল
–ভাইয়া তোমার হাত কাটল কিভাবে?
ইভান স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–কাচ লেগে। তেমন কিছু না।
ইলহাম কাছে এসে ইভান কে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। তার রুমে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়ে কাচ গুলো সাবধানে বের করতে করতে বলল
–ইচ্ছা করে করেছিস তাই না? ঈশা সাইন করতে রাজি হচ্ছিল না? কিন্তু কেন?
ইভান হাতের দিকে তাকিয়েই বলল
–ঈশার অসুস্থ হয়ে যাওয়াটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার না সেটা তুমি জানো। যা করেছে সবটা ইচ্ছাকৃত। ওর মধ্যে বাচার কোন ইচ্ছাই নাই। কিন্তু আমি যে ঈশাকে ছাড়া বাচব না। আমার জন্য হলেও ওকে বাচতে হবে।
ইলহাম একটু চিন্তিত হয়ে বলল
–কিন্তু ঈশার এরকম আচরন করার মানে কি? কেন এমন করছে?
ইভান মৃদু হেসে বলল
–বাস্তবতা! বাস্তবতার কাছে হার মেনে ঈশা এরকমটা করছে। কিন্তু লাভ নেই। ও হয়তো ভুলে গেছে যে ওর জীবনে এমন কিছু নেই যা এই ইভান জানেনা। আমি এতো সহজে ঈশাকে হেরে যেতে দিবনা। কোনভাবেই না। আমি এই নাটকটা না করলে ঈশা কোনদিনও সাইন করত না। আপাতত ঈশাকে বেচে রাখতে এটাই যথেষ্ট। বাকিটা সুস্থ হলেই নাহয় ভাবা যাবে।
ইলহাম ইভানের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলল
–তুই অনেক ভালো বুঝিস ইভান। আমি আশা করব তোদের মধ্যে সব ঠিক থাকবে।
ইভান হেসে বলল
–ভেবনা ভাইয়া। ঈশাকে আমি সামলাতে পারি। এখন শুধু ওর সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা।
কথা শেষ করে ইভান বের হয়ে এলো। সবাই একসাথে দাড়িয়ে তাদের বিয়ে নিয়েই জল্পনা কল্পনা করছে। ভিতরে কি হয়েছে কেউ জানে না। কিন্তু বাইরে সবাই বেশ খুশি। ইভান কে এগিয়ে আসতে দেখে তার মা হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো
–কিভাবে কাটল?
ভিতরে কি হয়েছে। কিভাবে ঈশার কাছ থেকে সাইন নিয়েছে এসব কিছুই সে কাউকে জানতে দিতে চায়না। কারন সেসব নিয়ে কথা বলতে গেলে যে অনেক কিছুই সামনে আসবে। আর ইভান কোন ভাবেই সেসব নিয়ে কথা বলতে চায়না। তাই ইভান চায় তাদের সম্পর্ক দুনিয়ার সামনে স্বাভাবিক থাকবে। তাদের মাঝে কি হচ্ছে সেটা কেউ জানবে না। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–অসাবধানতায় গ্লাস ভেঙ্গে হাতে লেগে গেছে। তেমন কিছু না মা। সব ঠিক আছে।
ইভানের মা একটু হেসে বলল
–সব ঠিক থাকবে এখন।
ইভান একটু হেসে চোখ নামিয়ে নিলো। ঈশার মা এগিয়ে এসে ইভানের সামনে দাঁড়ালো। ইভান চোখ তুলে তার দিকে তাকালেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আজ ইভান না থাকলে তার মেয়ের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত। ইভান তাকে জড়িয়ে ধরে বলল
–এভাবে কান্না কাটি করার কি আছে? তোমার মেয়ে একদম ঠিক আছে। পুরপুরি সুস্থ হতে একটু তো সময় লাগবেই। সেই সময়টাও কি দিতে চাওনা?
ঈশার মা নিজের চোখ মুছে ফেললেন। ইভানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
–সারাদিন কোথায় ছিলি? ফোন কেন বন্ধ তোর?
ইভান নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল
–একটু কাজ ছিল। আর ফোনে চার্জ নেই তাই বন্ধ হয়ে গেছে।
ইলুর বাবা এগিয়ে এসে বললেন
–তুই কিভাবে ঈশার অসুস্থতার কথা জানলি?
–ঈশার ঘরে লাইট জালানো ছিল। আর এতো রাতে ঘরে লাইট জালিয়ে রাখা একটু অস্বাভাবিক। কারন ঈশা আলোর মধ্যে একদম ঘুমাতে পারেনা। তাই ভেবেই নিয়েছিলাম যে সে জেগে আছে। আমি ফোন দিয়েছিলাম জিজ্ঞেস করতে কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। কিন্তু আমার সাথে কোন কথা হয়নি। ফোনটা রিসিভ করার কিছুক্ষন পরেই আমি কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পাই। তারপর কিছুক্ষন পর ঈশার রেসপন্স না পেয়ে মেজ বাবাকে ফোন করি। মেজ বাবাই ঈশার রুমে দেখে আমাকে ফোন করে সবটা জানায়।
ইভানের কথা শুনে সবাই সস্তির নিশ্বাস ফেলল। ইভানের কারনে হয়তো আজ খারাপ কিছু হওয়া থেকে বেচে গেলো।
চলবে………
(ব্যস্ততার মধ্যেই আজকের পর্বটা লিখলাম। একটু খাপছাড়া হয়েছে। রিচেক করার সময় পাইনি। ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)