শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর লেখক- এ রহমান পর্ব ১১

0
777

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১১

ঘড়ির কাটা ১২ টা ছুঁইছুঁই। নিস্তব্ধতায় ঘেরা রাতটার সময় যেন কিছুতেই এগুচ্ছে না। ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল ইভান। নিশব্দে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই এগিয়ে গেলো বেসিনের দিকে। নিকষ অন্ধকারের মাঝে ড্রইং রুমের জানালার পাশে দাঁড়ানো ল্যাম্পপোস্টটার সাদা আলোটা কাচ ভেদ করেই ঢুকে পড়েছে। তার বদৌলতেই অন্ধকার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে পিছনে ঘুরতেই চমকে গেলো। তার মা ঠিক পিছনেই দাড়িয়ে আছে। শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান একটু হকচকিয়ে গেলেও আবার নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–এখনও ঘুমাওনি তুমি?

ইভানের মা ছেলের কথার উত্তর না দিয়ে উলটা প্রশ্ন করে বসলো।
–তুই এতক্ষন কোথায় ছিলি?

ইভান নরম গলায় বলল
–আসিফের সাথে দেখা হয়েছিলো। কথা বলছিলাম। তাই দেরি হয়ে গেলো।

ইভানের মা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–এতো রাত পর্যন্ত তুই তো বাইরে থাকিস না। আজ কেন?

ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–বললাম তো। বিশ্বাস হল না কেন তোমার?

ইভানের মা একটু নরম হল। হালকা গলায় বলল
–বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয় বাবু। তুই খুব জরুরি কাজ ছাড়া এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকিস না। আর থাকলেও বলেই যাস। আজ না বলেই এতো রাত পর্যন্ত বাইরে ছিলি। আমি তো মা। চিন্তা হয় নাকি?

ইভান মায়ের হাত ধরল। অপরাধির সরে বলল
–বাড়ির নিচেই ছিলাম। একটু কথা বলতেই দেরি হয়েছে। আর হবে না।

ইভানের মা হালকা হেসে বলল
–খাবি চল। খাবার দেই।

ইভানের মা পা বাড়াতেই ইভান বলল
–ক্ষুধা পায়নি মা। তুমি ঘুমাও। পরে আমি নিজে নিয়ে খাবো।

ইভানের মা কথা বললেন না। ইভান দাঁড়ালো না। ভেজা মুখের পানি চুয়ে চুয়ে পড়ে টি শার্টটা ভিজে যাচ্ছে। সে ঘরের আলো জালিয়ে তোয়ালেটা নিয়ে মুখ মুছে ফেলল। ফোনটা বের করে একবার দেখে নিলো। ইভানের মা পিছন থেকে মৃদু আওয়াজে বলল
–দুধটা খেয়ে নে।

ইভান পিছনে ঘুরে ভ্রু কুচকে বলল
–আমি দুধ খাই?

ইভানের মা বিছানায় বসে পড়লেন। ছেলের দিকে না তাকিয়েই বললেন
–জানি খাস না। কিন্তু মাঝে মাঝে খেতে হয়। তুই যে পরে আর কিছু খাবিনা সেটা আমি জানি। তাই খালি পেটে ঘুমালে আমার যে শান্তিতে ঘুম হবে না। এই দুধ টুকু নিজে চোখে খেতে দেখলে তাও একটু শান্তি পাব।

মায়ের কথার বিপরিতে ইভান কিছু বলতে পারল না। আর কথা বাড়ান মানেই মাকে কষ্ট দেয়া। মুচকি হেসে বিছানায় মায়ের পাশে বসে দুধের গ্লাসটা হাতে নিলো। এক নিশ্বাসে সবটা শেষ করে মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
–এখন শান্তি?

ইভানের মা মৃদু হাসলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
–কি হয়েছে? কিছু নিয়ে কি খুব বেশী চিন্তা করছিস?

ইভান মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের ভালবাসা এমনি হয়। না বলতেই বুঝে যায় সব কিছু। ইভানের মা আবারো জিজ্ঞেস করলো
–ঈশার জন্য চিন্তা হচ্ছে?

ইভান চোখ নামিয়ে নিলো। কোন কথা বলল না। তার মা ছেলের মনের কথা বুঝতে পেরে আবারো বলল
–চিন্তা করিস না। মেয়েটা ঠিক হয়ে যাবে। ছোট মানুষ উলটা পাল্টা কিছু খেয়েছে হয়তো। তাই ফুড পয়জনিং হয়েছে। সকালেই দেখবি ঠিক হয়ে যাবে।

ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–তোমার কথাই যেন ঠিক হয়।

ইভানের মা আর কিছু বলল না। গ্লাসটা হাতে নিয়ে উঠে চলে গেলো। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার দাড়িয়ে বলল
–সারা রাত এখন মেয়েটার চিন্তায় আবার জেগে বসে থাকিস না। মেয়েটা নিজেও ঘুমাচ্ছে। তুইও শুয়ে পড়। বেশী চিন্তা হলে ঘুম থেকে উঠে একবার দেখে আসিস।

মায়ের এমন খোলামেলা কথা শুনে ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। একটু দুষ্টুমি করে বলল
–এতই যখন ছেলের ঘুম নিয়ে চিন্তা হচ্ছে তাহলে সেই চিন্তার কারণটাকেই এনে দাও। আমিও শান্তিতে ঘুমাই আর তুমিও ঘুমাও।

ইভানের মা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
–আমি তোর মা। সেটা কি ভুলে যাচ্ছিস?

ইভান ঠোট চেপে হেসে বলল
–ভুলে যাইনি তো। তুমি মা বলেই তো তোমার টেনশনটা কমাতে চেষ্টা করছি। আমি ছেলে হিসেবে কর্তব্য আছে না?

ইভানের মা কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন। গম্ভির গলায় বললেন
–তুই দিন দিন লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছিস।

ইভান একটু হেসে বলল
–এখন তো সব আমার দোষ। তোমার টেনশন কমাতেই তো ভালো উপায় বলে দিলাম। সেটাও তোমার পছন্দ হলনা। এখন আর কি করার। তোমার বা আমার কারো যদি ঘুম না হয় তাহলে সে জন্য কিন্তু আমি কোনভাবেই দায়ি থাকব না।

ইভানের মা হালকা হেসে বের হয়ে গেলেন। ইভান দরজা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বিছানায় বসে কিছুক্ষন ভাবল। এক রাশ চিন্তারা এলোমেলো ভাবে বিচরন করছে তার মস্তিষ্কে। আজ রাতে আর কোন ভাবেই ঘুম আসবে না। তার মা ছেলের মন ঠিকই বুঝেছেন। ইভানের কেন জানি মনে হচ্ছে ঈশা তার কাছ থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছে। ঈশার আচরন আজ বেশ অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। তার চোখের সেই অসহায় দৃষ্টি দেখেই ইভান বুঝতে পেরেছে ঈশা এমন কিছু লুকাচ্ছে যা সে কাউকেই জানতে দিতে চায় না। কিন্তু কেন? কি এমন গোপন বিষয় থাকতে পারে? কিছু জিজ্ঞেস করেও তো লাভ নেই। কোন ভাবেই বলবে না। নিজেকেই খুজে নিতে হবে। কিন্তু কিভাবে? বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে ভাবতে লাগল সে। কেন ঈশা তার উপরে ভরসা করতে পারেনা। সে নিজেও জানে ইভান তাকে কতটা ভালবাসে। কিন্তু সেই ভালবাসার মুল্য ঈশা কখনই দেয়না। ঈশা তার প্রতি অনেক অন্যায় করে। সেটা ভাবতেই ইভানের মনে অভিমান বাসা বাধল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঘুম না আসলেও চেষ্টা তো করতে পারে।

—————
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা গুলো সাধারণত জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সুচনা করে। কখনও সেটা ভালো হয় আবার কখনও খারাপ। জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা গুলোকে কেউ আঁকড়ে ধরে বেচে থাকার অবলম্বন হিসেবে নেয়। আর কেউ সেগুলোর চাপে পিষ্ট হয়ে জীবন থেমে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

অনেকটা দিন কেটে গেছে। বর্ষার মাঝামাঝি সময়। কবি সাহিত্যিকের ভাষায় বর্ষাকাল নাকি প্রেমের ঋতু। বৃষ্টি নাকি মানব মনে প্রেমের জন্ম দেয়। কিন্তু এই প্রেমের ঋতুতেই ঈশার জিবনে ঘটে গেলো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। শুন্য মস্তিষ্কে কালো মেঘে ঢেকে যাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নিকষ কালো অন্ধকারে ঠিক কালো মেঘটা দেখা না গেলেও দূর আকাশের বিদ্যুতের ঝলকানি দেখে আন্দাজ করা সম্ভব। মাঝে মাঝেই আবার বেশ শব্দে কেপে উঠছে চারপাশ। কিন্তু ঈশার সেসবের কিছুই মনে ধরছে না। অনুভুতি শুন্য হয়ে পড়ে আছে মন। এলোমেলো ভাবনা। সব কিছুতেই বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে সে। আর সহ্য করতে পারছে না। এলোমেলো ভাবনার মাঝেই আচমকা কান ফাটানো আওয়াজে নামলো বৃষ্টির ধারা। কিন্তু সেই বৃষ্টি মনে আনন্দ দেয়ার বদলে জমে থাকা সমস্ত কষ্ট যেন বাধ ভেঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে সাহায্য করছে। এক রাশ অভিমান। কিন্তু কার প্রতি এই অভিমান? ভাগ্যের? সে কি ভাগ্যের চরম নির্মমতার স্বীকার? বাধ ভাঙ্গা কান্না থামাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এক দৌড়ে চলে গেলো ওয়াশ রুমে। প্রকৃতির কান্না সে পৃথিবীর বুকে বিলিয়ে দিয়ে নিজেকে হালকা করতে পারে কিন্তু ঈশা তার কান্না কাউকে দেখাতে পারেনা। এই কষ্ট তার একান্ত। ঝর্নার নিচে বসে হাঁটু দুই হাতে ধরে অসহায়ের মতো কেদে চলেছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই কান্নার বেগ বেড়ে যাচ্ছে। সাথে আর্তনাদও। সেটাকে আটকাতেই মুখে হাত চেপে ধরছে। মাঝ রাত হওয়ায় রুমে এখন কেউ আসবে না। তাই কোন চিন্তাও নেই। নিশ্চিন্তে ঝর্নার নিচে বসে কাদছে সে।

অনেকটা সময় পর বের হয়ে এলো ওয়াশ রুম থেকে। ঠিক কতটা সেটা হিসাব করে বলতে পারবে না সে। এতটা সময় ভেজার ফলে চোখ নাক লাল হয়ে গেছে। মাথাটাও ভারি হয়ে আসছে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। ভেজা কাপড় পরেই সারা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শুকনা কাপড় বের করে নিলো আলমারি থেকে। চেঞ্জ করার জন্য ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়াতেই টেবিলের উপরে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। এতো রাতে কেউ ফোন দিবে ভেবে একটু অবাক হয়েই সেদিকে তাকাল। ইভানের নামটা দেখে চোখ ছলছল করে উঠল তার। পাতা জোড়া বন্ধ করতেই গাল বেয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। ফোনটা হাতে নিলো ঠিকই। কিন্তু রিসিভ করতে নয়। কেটে বন্ধ করে দিতে। কিছুদিন ধরেই ঈশা ইভান কে ইগনোর করছে। ইভান বিষয়টা বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলছে না। আবার হার মানতেও নারাজ সে। নিজের মতো করেই ঈশার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। কিন্তু ঈশা চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছে। ঈশা ফোনটা কেটে বন্ধ করতে চাইলেও সেটা সম্ভব হল না। কারন ঐ যে কিছু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তেমনি কিছু ঘটে গেলো। প্রচণ্ড রকমের শ্বাস কষ্ট শুরু হতেই হাত পা কাপতে লাগল তার। কথায় আছে বিপদের সময় মানুষ নাকি তাকেই মনে করে যাকে সব থেকে আপন মনে হয়। ঈশার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। প্রবল বাচার আকুতি নিয়ে মনের সাথে যুদ্ধ করে ফোনটা ধরে অস্পষ্ট সরে বলল
–আমার খারাপ লাগছে। খুব খারাপ লাগছে।

কথাটা ইভানের কান পর্যন্ত পৌছালো কিনা সেটা বোঝার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেলো ফোনটা। ওপাশের মানুষটা আদৌ কিছু শুনতে পেয়েছে কিনা বা বিপদটা ঠিক ঠাক আন্দাজ করতে পেরেছে কিনা সেটা বোঝা সম্ভব হল না।

চলবে………

(একটু সাসপেন্স না থাকলে ভালো লাগেনা। দুষ্টু মিষ্টি প্রেমের মাঝে হালকা সাসপেন্স থাকলে কি খারাপ হয়? )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here