#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২২
কোন এক তামিল সিনেমার মারামারির দৃশ্য চলছে টেলিভিশনে। সেদিকে না তাকিয়েও শব্দ শুনে বিষয়টা বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঈশা ইভানের দুই হাতের মাঝে আটকে আছে। নিচের দিকে তাকিয়ে তার চোখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়া ইভানের উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করছে। এই উষ্ণতা সামলাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই উষ্ণতার তেজ তার ভিতরে পর্যন্ত পৌঁছে সবকিছু জালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। ইভান মাথার কাছ থেকে এক হাত সরিয়ে কোমরের কাছাকাছি আনতেই ঈশা চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলল। ইভান আলতো করে দরজার লকটা টিপে দিলো। ঈশা শব্দ শুনে চোখ খুলে সেদিকে তাকাল। আবার হাত উঠাতেই ঈশা আবারো চোখ বন্ধ করে ফেলল। এবার ইভান পাশের দেয়ালের সুইচ বোর্ডে হাত দিয়ে লাইটের সুইচটা অফ করে দিলো। ঈশা আবারো চোখ খুলে ফেলল। ইভান আর একটু কাছে আসতেই ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–আ…আমার ঘুম পাচ্ছে।
ইভান ভ্রু কুচকে ফেলল। গম্ভির সরে বলল
–পাইলেও কিছু করার নাই। ঘুমানো তো যাবে না।
ঈশা এদিক সেদিক অস্থির দৃষ্টি ফেলে অসহায় কণ্ঠে বলল
–কেন যাবেনা?
ইভান একটু সরে দাঁড়ালো। কিন্তু হাত সরাল না। স্বাভাবিক ভাবে বলল
–বাসর রাতে কেউ ঘুমায় না। তাই ঘুমানো যাবে না।
–মানে?
ঈশার সরল প্রশ্নের উত্তরে ইভান সোজা সাপটা বলল
–তুমি আমাকে যতটা ভদ্র ছেলে ভাব আমি আসলেই ততোটা ভদ্র না। এতদিন ভদ্রতা দেখাতে চেয়েছি তাই দেখেছ। কিন্তু এখন আর ভদ্রতা দেখায়ে কি হবে বল। নিজেরি ক্ষতি।
ঈশা ভয় পেয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। ইভান হাত উঠিয়ে ঈশার সামনের চুলগুলো কানের পিছনের গুজে দিয়ে বলল
–ভয় পাচ্ছ?
ঈশা হ্যা বলবে কি না সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। কি একটু ভেবে অনুনয়ের সুরে বলল
–আমি কি একটু বিছানায় বসতে পারি? আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।
ইভান নিশব্দে হাসল। ঈশার অবস্থা সে বুঝতে পারছে। কিন্তু ঈশা তার হাসি দেখতে পেলো না। সে ঈশাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো বিছানায়। বসিয়ে দিয়ে পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। ঈশা সেটা হাতে নিয়ে সব পানি এক নিশ্বাসেই শেষ করে ফেলল। ইভান পাশে বসে আবার হেলানি দিলো বিছানায়। গম্ভির গলায় বলল
–শুয়ে পড়।
ঈশা সস্তির নিশ্বাস ফেলল। আর দেরি না করে শুয়ে পড়ল। ঈশা ভালভাবে শুয়ে পড়তেই ইভান টিভির দিকে তাকিয়ে গম্ভির ভাবে বলল
–বলেছিলাম যে সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে সময় প্রয়োজন। আমার কথা তখন মাথায় না ঢুকলেও এখন মাথায় ঢুকেছে নিশ্চয়?
ঈশা পাশ ফিরে শুয়ে ছিল। ইভানের কথা শুনে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাতে গিয়েও তাকাল না। কেমন অসস্তি হচ্ছে। মনের আবেগটা তীব্র হলেও জড়তাটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আর উঠবেই বা কিভাবে সেরকম সুযোগ হয়নি তো। ইভান দেয় নি বা পায়নি সে যাই হোক। তাদের সম্পর্ক কোন কালেই স্বাভাবিক কোন প্রেমিক প্রেমিকার মতো ছিল না। তারা কখনই একে অপরের সাথে আলাদা ভাবে সময় কাটায় নি। নিজেদের মধ্যে অনুভুতির আদান প্রদান করেনি। সেরকম কোন কথা তাদের মধ্যে হয়ে উঠেনি। ঈশা মনে মনে ভাবল ‘ইভান ঠিকই বলেছিল। যখন বুঝতে পারবে তখন মনে হবে সত্যিই সময় প্রয়োজন ছিল।’ ইভান আবারো বলল
–কি ম্যাডাম? আমি কিছু বললাম। আমার কথা কি মাথায় ঢুকেছে?
ঈশা পাশ না ফিরেই কাপা কাপা গলায় বলল
–বি…বিয়ের পরেও তো সময় দেয়া যায়।
ইভান হেসে ফেলল। সে ঈশার কাছ থেকে এরকমি কিছু আশা করেছিলো। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা যে এমন কথা বলবে সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিল। এতো কিছু তো ছিল শুধু ঈশাকে বিষয়টা বোঝাতে। ইভান মৃদু হেসে বলল
–যায় তো।
ঈশা কোন কথা বলল না। বেশ কিছুক্ষন ধরেই ঈশা নড়াচড়া করছে। তার ঘুম আসছে না। নতুন বিছানা। তার উপরে আবার পাশে ইভান শুয়ে আছে। সারা শরীর অসস্তিতে কাটা দিয়ে উঠছে। ঈশা ঘুমায়নি বুঝতে পেরে ইভান বলল
–অসুবিধা হচ্ছে? টিভি অফ করে দিবো?
ঈশা মৃদু সরে ‘না’ বলল। ইভান খানিকবাদেই টিভি অফ করে নিজেও ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু এভাবে কি আর ঘুমানো সম্ভব? ঈশার শরীরের ঘ্রান ইভানের সব কিছু কেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে। কাঙ্খিত মানুষটার পাশে শুয়ে এভাবে ঘুমানো একেবারেই অসম্ভব। সুপ্ত অনুভুতি গুলো ধারালো হয়ে যাচ্ছে। তার মাঝেও অসস্তি কাজ করছে। কিছুক্ষন এপাশ অপাশ করে উঠে বসলো। একবার ঘাড় ফিরে দেখল। ঈশা ঘুমাচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। উঠে সোফায় গিয়ে বসলো। সেখান থেকেই খোলা জানালা দিয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় ঈশাকে দেখল কিছুক্ষন। ঈশা উলটা দিকে ঘুরে শুয়ে আছে। সেই দৃশ্য দেখেই ইভানের চোখ জুরিয়ে গেল। মনটা হালকা হয়ে গেলো। এতো বছরের সেই অপেক্ষার অবশান হল। ঠোটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ঈশার দিকে তাকিয়েই সোফায় শুয়ে পড়ল। ঈশাকেই নিস্পলক দেখে যাচ্ছে সে। কি অদ্ভুত এক প্রশান্তি মনে। মুহূর্তেই কত কিছু বদলে গেলো। এভাবে নিজের প্রিয়তমাকে দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল বুঝতে পারলো না।
———–
খোলা জানালার পর্দাটা সরানো। বেশ আলো ঢুকছে ঘরে। খুব একটা বেলা গড়ায় নি। তবুও যেন মনে হচ্ছে অনেক বেলা হয়েছে। আলোর দাপটে সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখ নিয়ে উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে কোথায় আছে সেটা বুঝতেই কিছুটা সময় পার হয়ে গেলো ঈশার। ঘাড়টা ব্যথা করছে। সারা রাত একদিকে শুয়ে ছিল তাই। হাই তুলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে পাশ ফিরতেই দেখল ইভান নাই। এতো সকালে তো ইভানের উঠার কথা ছিল না। কই গেলো? একটু ভেবে নিচে নামলো। কুচকান শাড়ীটা টেনে ঠিক করে নিলো। আধ খোলা চুল গুলো ভালো করে বেধে নিলো। উপরের দিকে চোখ পড়তেই দেখল ইভান সোফায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ঈশা ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর সত্যি সত্যি বিষয়টা মাথায় ঢুকতেই একটু এগিয়ে গেলো সোফার দিকে। একটু ঝুকে ভালো করে ইভান কে দেখে নিলো। গভির ঘুমে আছে। কিন্তু ইভান তো বিছানায় শুয়েছিল রাতে। আর সেটা ভেবেই ঈশা একদম নড়াচড়া করেনি। ঈশার ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করার অভ্যেস আছে। চুপচাপ সে কিছুতেই ঘুমাতে পারেনা। কিন্তু একি বিছানায় শুয়ে এভাবে নড়াচড়া করলে ইভানের ঘুমের ডিস্টার্ব হবে ভেবেই সে নড়ার সাহস পায়নি। কিন্তু ইভান সোফায় আসলো কিভাবে? ঘুমের মধ্যে আবার হাটার অভ্যেস নাই তো? ঈশা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বেশ বিরক্ত নিয়ে বিড়বিড় করে বলল
–সোফাতেই যদি ঘুমায় তাহলে আগেই ঘুমাত। আমিও একটু শান্তিতে নড়েচড়ে ঘুমাতে পারতাম। এক পাশে শুয়ে ব্যাথা হয়ে গেছে।
বিরক্ত নিয়ে আলমারির সামনে দাঁড়ালো। ইরিনা আর ইলু মিলে কাল অল্প কিছু কাপড় এনে আলমারি গুছিয়ে দিয়েছে। চারিদিকে দেখল। কিন্তু কোনটা পরবে বুঝতে পারছে না। অনেক সময় নিয়ে ভেবে বের করলো সে এখন থেকে শুধু শাড়ি পরবে। বাড়ির বড় বউ বলে কথা। তার কাছে তেমন শাড়ি নেই। মায়ের সব শাড়ি নিয়ে আসবে। কিন্তু অন্য কিছু পরবে না। অল্প কয়টা শাড়ির মধ্যে থেকে একটা সবুজ সুতির শাড়ি খুজে বের করলো। সেটা নিয়েই ওয়াশ রুমে গেলো। বেশ লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল মুছছে। খুটখাট আওয়াজে ইভানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। প্রচণ্ড রকমের বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে ফেলল। খুব একটা গাড় ঘুম হয়নি তার। কাল রাতের সব কথাই মনে আছে। তাই এই শব্দের পিছনে যে ঈশাই দায়ী সেটা মাথায় রেখেই ভয়ংকর এক ধমক দিতে প্রস্তুত হল। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই তার দুনিয়া অন্ধকার হওয়ার বদলে সবুজে ছেয়ে গেলো। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা জড়ানো চোখ গুলোও বড় বড় হয়ে গেলো। ঈশার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। ভেজা চুল গুলো ইচ্ছা মতো আছড়ে জাচ্ছে সে। সবুজে জড়ানো মায়াবতীকে কি স্নিগ্ধটাই না লাগছে। চোখ ফেরান দায় হয়ে গেছে। একটু ছুয়ে দিতে মন চাইছে। কিন্তু কিছু একটা ভেবে নিজেকে সংযত করে নিলো। চুল ঠিক করে ঈশা পুরো ঘরে এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে কি যেন কাজ করছে। ইভানের এবার ঈশার উপরে প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ লাগছে। অযথাই রাগটা ক্ষণে ক্ষণে চাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু এমন কোন কারন নাই। তবুও ইভান নিজেকে কিছুতেই রাগ করা থেকে আটকাতে পারছে না। এর মাঝেই দরজায় জোরে জোরে ধাক্কানর আওয়াজে ঈশা পিছন ঘুরে একবার ইভানের দিকে তাকাল। ইভান কে চোখ খুলে থাকতে দেখে নিরভয়ে দরজা খুলে দিলো। ইরা দৌড়ে এসে ঈশার পায়ের কাছে ধরে বলল
–আপু তুমি এখানে কেন ছিলে? বাসায় যাবে না।
সকাল সকাল ইরার এমন কথা শুনে ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকাল। ইভান উঠে বসে পড়ল। ইফতি ঘরে ঢুকে বলল
–রাতে তোমাকে বাসায় দেখতে না পেয়ে প্রচণ্ড কান্না কাটি করেছে। সকাল থেকে জেদ আপুর কাছে যাবে। তাই নিয়ে এলাম সকাল সকাল।
ইভান মৃদু সরে বলল
–ভালো করেছিস।
ইরা আবারো ঈশার শাড়ি টেনে বলল
–ও আপু। বাসায় কখন যাবে?
ঈশা মৃদু হেসে বসে পড়ল। ইরার গাল টেনে বলল
–আমি এখন থেকে এখানেই থাকব ইরু মনি।
–কেন থাকবে? তোমার কি বাড়ি নেই?
ইরা ভ্রু কুকে বলতেই ঈশা হাসল। ইরা ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে ইভানের কাছে গিয়ে বলল
–ও ভাইয়া আপু কেন তোমার ঘরে থাকবে?
ইভান ইরার কথার কি উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না। চুপচাপ বোকার মতো তাকিয়ে থাকলো। ইরা আবারো বলল
–আপু থাকলে কিন্তু আমিও তোমার ঘরে থাকব।
ঈশা ইরার কথা শুনে তার দিকে তাকাল। ইভান শান্ত ভাবে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল
–একদম। আমি তো ভাবছি তোর বাপের বাড়িতে যত মেয়ে হবে আমি সবাইকে নিয়ে এসে আমার ঘরে রাখবো। আর আমি আমার ঘর বিছানা সব ছেড়ে বারান্দায় থাকব।
ঈশা বড় বড় চোখে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ইরার দিকে আছে। ঈশা একটু এগিয়ে গিয়ে বলল
–তুমি সোফায় শুয়েছিলে কেন?
ইভান শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু আবারো রাগটা চেড়ে উঠলো। কোন রকমে সেটাকে গিলে উঠে দাড়িয়ে বলল
–তোর মাথায় কখন কি চলে কে জানে। ঘুমানোর আগে মনে হয়েছে সময় দরকার আবার ঘুমানোর পরে যদি মনে হয় আর সময় দরকার নেই। যদি কোনভাবে আমার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিস। তাই নিজেকে সেফ রাখতেই দূরত্ব বজায় রেখেছি।
চলবে……।